বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করুন

বাঙালি জাতি রক্তক্ষয়ী সশস্ত্রসংগ্রাম ও বহু তাজা প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে। মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর
নিকট পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, এ দেশবাসী তাদের বিজয় নিশ্চিত
করে। বাংলাদেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ এ যুদ্ধে একাত্বতা ঘোষণা করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গঠিত মুজিবনগর
সরকার স্বাধীনতার পর ঢাকা স্থানান্তরিত হয়। ঢাকায় এসে এ সরকার প্রকৃত শাসনভার গ্রহণ করে। প্রবাসী সরকারের
রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন হয়ে ঢাকায়
আসেন। তার পরের দিন অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি ‘‘বাংলাদেশ অস্থায়ী সংবিধান অধ্যাদেশ” জারি করা হয়। এ আদেশ জারিই
হল বাংলাদেশ সংবিধানের প্রথম পদক্ষেপ। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশে একটি নতুন ও সময়োপযোগী সংবিধান
প্রণীত হয়। গণ-পরিষদ গঠন
সংবিধান হল রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক বিধি-বিধানের সমষ্টি। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয়। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নেও এমন একটি গণপরিষদ গঠন করা হয়। এই পরিষদের সার্থক
প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে সংবিধান রচনা করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি
গণরিষদ গঠনের আদেশ জারি করেন। এ আদেশ সমগ্র বাংলাদেশের জন্য সমভাবে প্রযোজ্য ছিল। এ আদেশ ১৯৭১
সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে ধরে নেয়া হয়। এ আদেশ বলে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১
মার্চ পর্যন্তজাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়।
আইনের দৃষ্টিতে অযোগ্য বলে বিবেচিত এমন ব্যক্তিকে গণপরিষদের সদস্য হতে পারতেন না। রাজনৈতিক দল থেকে
বহিঃস্কৃত ব্যক্তি গণপরিষদ থেকে বহিঃস্কৃত হতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ও স্থায়ী সংবিধান রচনার
পবিত্র দায়িত্ব এ পরিষদের উপর ন্যস্তছিল।
গণপরিষদের অধিবেশন
১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। দেশ শত্রæমুক্ত হওয়ার মাত্র ১১৬ দিন পর গণপরিষদের এ প্রথম অধিবেশন বসে। এ দিনটি জাতীয় জীবনে একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন বলে চিহ্নিত। এ অধিবেশনে
গণপরিষদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হয়। শাহ আব্দুল হামিদ গণপরিষদের প্রথম স্পীকার নির্বাচিত হন।
তাঁর মৃত্যুর পর নির্বাচিত হন জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ। এ অধিবেশনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কমিটি গঠন করা হয়। এটি হল
‘‘সংবিধান কমিটি”। এ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন তৎকালীন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। এ
কমিটির মোট সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৪ জন।
গণপরিষদে সংবিধান পেশ
সংবিধান কমিটিতে ড. কামাল হোসেন ছাড়া আরও চার জন মন্ত্রী ছিলেন। তারা হলেন যথাক্রমে - (১) সৈয়দ নজরুল
ইসলাম; (২) তাজউদ্দিন আহমদ; (৩) খন্দকার মুশতাক আহমেদ; (৪) এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান। এ ছাড়া ৭ জন
মহিলা সদস্যের মধ্যে একজন ছিলেন সংসদ সদস্য। এ কমিটির প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল। কমিটি
বিভিন্ন মহল থেকে সংবিধান সম্পর্কে প্রস্তাব গ্রহণ করতে থাকে। ইতোমধ্যে কমিটি ৯৮টি প্রস্তাব গ্রহণ করে। সংবিধান
কমিটি ১৯৭২ সালের ১৮ এপ্রিল সংবিধানের মুখবন্ধ (চৎবধসনষব) রচনা সমাপ্ত করেন। ১৯৭২ সালের ১১ জুন কমিটির
সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। তাঁরা সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করেন। উক্ত সালের
১১ অক্টোবর সংবিধান কমিটির শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে সংবিধান সম্পর্কে চূড়ান্তমতামত পেশ করা
হয়। পরের দিন অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন বসে। ঐ অধিবেশনে সংবিধান
কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন সংবিধান বিল আকারে গণপরিষদে পেশ করেন। ১৩ অক্টোবর গণপরিষদ কিছু
কিছু সংশোধনীসহ এ খসড়া সংবিধানের বিধিমালা গৃহীত হয়।
সংবিধান সম্পর্কে বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর মতামত
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী খসড়া সংবিধান কমিটির পক্ষ থেকে গণপরিষদে
পেশ করেন। এ সংবিধান সম্পর্কে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, জনগণ ও রাজনৈতিক দল তাদের মতামত দেন।
এগুলো নি¤েœআলোচনা করা হল -
(১) ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বলেন, ‘‘এ সংবিধানে
জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা প্রতিফলিত হয় নি।”
(২) তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতা আ.স.ম.আব্দুর রব বলেন, ‘‘এ সংবিধান অগ্রহণযোগ্য, তবে সংবিধানের
অনুপস্থিতিতে একটি মন্দ সংবিধানও গ্রহণযোগ্য।’’
(৩) তৎকালীন জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা সংসদ অধিবেশনে সংবিধানের ৬টি অনুচ্ছেদ সম্পর্কে ভিন্নমত
ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘‘খসড়া সংবিধান উৎপাদনের সকল উপাদান জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু
জনগণের মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর কোন ব্যবস্থা এতে নেই।” তিনি আরো বলেন, ”জনগণ এ সংবিধান
প্রত্যাখান করবে।”
(৪) ন্যাপ (মোজাফফর) নেতৃবৃন্দের মতে, ‘‘সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলোর কিছু কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করার
ফলে সেগুলো ক্ষুন্ন হয়েছে।”
(৫) বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘‘সংবিধানে কতকগুলো অগণতান্ত্রিক ধারা থাকলেও উক্ত সংবিধনে
সাধারণভাবে গণতান্ত্রিক ছিল, তবে এ সংবিধান সমাজতান্ত্রিক নয়।”
(৬) তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘‘বাংলাদেশ গণপরিষদ যে সংবিধান রচনা করেছে তা
বাংলাদেশের জনগণের তাজা রক্তে লেখা হয়েছে।”
(৭) তৎকালীন আইন মন্ত্রী বলেন, ‘‘স্বপ্ন আজ বাস্তাবায়িত হয়েছে, এ সংবিধান বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসের এক বিরাট
দিক দর্শন।”
খসড়া সংবিধান চূড়ান্তভাবে অনুমোদন
বাংলাদেশের তৎকালীন আইন মন্ত্রী ও সংবিধান কমিটির চেয়ারম্যান ড. কামাল হোসেন ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর
গণপরিষদে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেন। ১৮ অক্টোবর গণপরিষদে সংবিধান বিল সম্পর্কে সাধারণ আলোচনা শুরু
হয়। এ আলোচনা ৩০শে অক্টোবর পর্যন্তস্থায়ী হয়। আবার ৩১শে অক্টোবর উক্ত পরিষদে খসড়া সংবিধানের ধারাওয়ারী
আলোচনা শুরু হয়। প্রথম দিনে ক্ষমতাসীন দল কর্তৃক কিছু সংশোধনীসহ সংবিধানের ১৬টি অনুচ্ছেদ গৃহীত হয়।
শাসন বিভাগ সম্পর্কিত সম্পূর্ণ অধ্যায়টি নভেম্বরের ২ তারিখ গৃহীত হয়। বহু বিতর্কিত ৭০ নং অনুচ্ছেদ অর্থাৎ দল ত্যাগ
বা দল থেকে বহিস্কার হওয়ার কারণে সংসদ আসন শূন্য হওয়ার বিধানটি স্থগিত করা হয়। সংবিধানের কতিপয়
সংশোধনীসহ খসড়া সংবিধানের সকল অনুচ্ছেদ ও তফসিল ৩রা নভেম্বর গৃহীত হয়। বিরোধী দলীয় সদস্য সুরঞ্জিত
সেনগুপ্ত উক্ত সংবিধানের লিপিগুলোতে স্বাক্ষর দানে বিরত থাকেন। ১৯৭২ সালের ১৪ ডিসেম্বর হস্তলিখিত সংবিধানে
স্বাক্ষরদানের লক্ষ্যে গণপরিষদের সদস্যগণ পুনরায় একত্রিত হন। অবশেষে বিধিবদ্ধ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান
১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকরী হয়। মাত্র ১ বছরের মধ্যে দেশবাসী একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে
সক্ষম হয়েছে। এ সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি আসলে বিরল। সংশোধনী সাপেক্ষে আজও এ সংবিধান ক্রিয়াশীল।
সারকথা
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আবিভর্‚ত হয় একটি স্বাধীন দেশ রূপে। স্বাধীনতার পর পরই বাঙালি জাতি
সংবিধান প্রণয়নে মনোনিবেশ করে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানুযায়ি পাকিস্তানী
কারাগার থেকে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন। পরের দিনই সংবিধান রচনার নির্দেশ দেন। এ আদেশ বাংলাদেশে সংবিধান
রচনার প্রথম পদক্ষেপ। ২৩ মার্চ সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে একটি ৪৩০ সদস্যবিশিষ্ট গণপরিষদ গঠন করা হয়। ১৯৭২
সালের ১০ অক্টোবর ঢাকায় গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি
সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তৎকালীন আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ড. কামাল
হোসেন। ড. কামাল হোসেন ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদে খসড়া বিধান পেশ করেন। পরিশেষে ১৯৭২
সালের ১৬ ডিসেম্বর উক্ত সংবিধান বলবৎ করা হয়। ঐ দিন থেকে গণপরিষদ বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়।
সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দিন
১। কোন তারিখে সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে গণপরিষদ গঠিত হয় ?
(ক) ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর (খ) ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ
(গ) ১৯৭২ সালের ৫ জুন (ঘ) ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি
২। কোন তারিখে সংবিধান কমিটি গঠিত হয় ?
(ক) ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল (খ) ১৯৭২ সালের ৫ই জুন
(গ) ১৯২ সালের ১০ এপ্রিল (ঘ) কোনটিই নয়
৩। সংবিধান কমিটির সভাপতি কে ছিলেন ?
(ক) ডঃ কামাল হোসেন (খ) শেখ মুজিবর রহমান
(গ) মোহাম্মদ উল্লাহ (ঘ) শাহ আব্দুল হামিদ
৪। কোন তারিখ থেকে সংবিধান কার্যকরী হয় ?
(ক) ১৯৭২ সালের ২ ডিসেম্বর (খ) ১৯৭২ সালের ২রা জুন
(গ) ১৯৭২ সালের ২৫ ডিসেম্বর (ঘ) ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর।
৫। কোন তারিখ গণপরিষদ বাতিল করা হয় ?
(ক) ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে (খ) ৫ জুন ১৯৭২ সাল
(গ) ১০ ডিসেম্বর ১৯৭২ সাল (ঘ) কোনটিই নয়।
উত্তরমালাঃ ১। খ ২। গ ৩। ক ৪। ঘ ৫। ক
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন
১। বাংলাদেশের গণপরিষদের গঠন প্রকৃতি ব্যাখ্যা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করুন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]