নৈতিক প্রগতি কাকে বলে ? নৈতিক প্রগতির শর্তসমুহ কি ?

নৈতিক প্রগতি
ব্যক্তির আচরণের ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত বোধ সম্পর্কিত আলোচনা হচ্ছে
নীতিবিদ্যার আলোচ্য বিষয়। নৈতিক প্রগতি ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে ব্যক্তির জীবনে পুর্ণতা
এনে থাকে। ব্যক্তি মাত্রই একটা লক্ষ্য সামনে রেখে কর্মজীবন পরিচালনা করে থাকে। মানব জীবনের
চুড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়াকেই নৈতিক প্রগতি বলা হয়। এক্ষেত্রে নৈতিক প্রগতি
বলতে অনৈতিক স্তর থেকে নৈতিক স্তরে পৌছানো নয়, বরং নৈতিকতার নি¤œ স্তর থেকে উচ্চ স্তরের
দিকে ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হওয়াকে বুঝায়। নিরন্তর ও অব্যাহত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জীবনে যে বিভিন্ন
পরিবর্তন আসে সে পরিবর্তনগুলো হচ্ছে নৈতিক প্রগতির বিভিন্ন পর্যায়। নৈতিক প্রগতি সকল সময়
এক পর্যায়ে থেকে অন্য পর্যায়ে ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে থাকে। তাই নৈতিক প্রগতি হলো নৈতিক
জীবনের উচ্চতর অবস্থায় যাওয়া। নৈতিকতার পরিমন্ডলের মধ্যে এগিয়ে যাওয়া নৈতিক প্রগতির
মূলকথা।
পরম লক্ষ্যে না পৌছা পর্যন্ত এ নীতি অব্যাহত ধারায় চলতে থাকে। অবশ্য কখনও কখনও নৈতিক
প্রগতি বাধাপ্রাপ্তও হয়ে থাকে, যেমন-সমাজে দুর্নীতি, অনাচার ইত্যাদি অসদগুণের অনুপ্রবেশ ঘটলে
সমাজে নৈতিক প্রগতি অনেকাংশে ব্যাহত হয়। নৈতিক প্রগতির সীমা বলতে কিছু নেই। ব্যক্তি যত
আদর্শের দিকে অগ্রসর হয়, প্রগতি তত উচ্চ পর্যায়ের দিকে ধাবিত হবে।
নৈতিক প্রগতির শর্তসমুহ
নৈতিক প্রগতির শর্তগুলো হচ্ছে নৈতিক জগত, জগতের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা, অপুর্ণতা বোধ, নৈতিক
অর্ন্তদৃষ্টির গভীরতা, নতুন বাধ্যবাধকতা, নৈতিক পরিবর্তন ও পরিবেশের পরিবর্তন এবং আদর্শ জগত।
নৈতিক জগত : নৈতিক জগতই নৈতিক প্রগতির প্রধান শর্ত। প্রত্যেক ব্যক্তিই একটি নৈতিক জগতে
অবস্থার করে। এ নৈতিক জগত নৈতিক আদর্শ, নির্দিষ্ট সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং ক্রিয়ার অভ্যাসগত
রূপ ইত্যাদি উপাদান সমন্বয়ে গঠিত।
জগতের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা : সমাজে নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠান এবং অভ্যাসের মধ্যে বিরোধিতা
দেখা দিলে সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। এ সঙ্গতি প্রতিষ্ঠা করার ফলে নৈতিক আদর্শ,
সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও অভ্যাসের মধ্যে পরিবর্তন সাধিত হয় এবং নৈতিক উন্নতির পথ সুগম হয়। তাই
নৈতিক উন্নতির ক্ষেত্রে নৈতিক জগতের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের গুরুত্ব রয়েছে।
অপুর্ণতা বোধ: নৈতিক জগত ও এর অভ্যন্তরীণ বিরোধিতাই নৈতিক প্রগতির জন্যে যথেষ্ট শর্ত নয়,
অপূর্ণতা বোধও এক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। নৈতিকতার ধারণা সম্পর্কে যখন আমাদের
চেতনা অসম্পূর্ণ থাকে, তখন কোন নৈতিক সংস্কারের শিক্ষার ফলে আমরা সচেতন হই এবং নৈতিক
প্রগতি সাধিত হয়।
নৈতিক অন্তদৃষ্টির গভীরতা: দার্শনিক গ্রীণ সদগুণ সম্পর্কে গ্রীকদের ধারণা ও আধুনিক চিন্তাবিদদের
ধারণার তুলনামূলক আলোচনা করে দেখান যে, সদগুণের পরিসীমা আধুনিক কালে আরও বিস্তৃত
হয়েছে। কেবল সদগুণের পরিসীমারই বিস্তৃতি ঘটেনি, এমনকি সদগুণ যে সূত্রের উপর নির্ভর করে সে
সূত্রের ধারণার গভীরতাকেও সম্পৃক্ত করেছে।
নীতিবিদ সেথ নৈতিক জীবনের বিবর্তন প্রক্রিয়ার আলোচনায় তিনটি পর্যায়ের কথা বলেন:
ক. বাহ্যিক মত থেকে অভ্যন্তরীণ মতে গমন, খ. কঠোর সদগুণগুলোকে কোমল সদগুণের অধীনে
আনা; গ. সদগুণের পরিসরের ব্যাপকতা।
ক. বাহ্যিক মত থেকে অভ্যন্তরীণ মতে গমন : নৈতিকতার প্রথম পর্যায়ে ব্যক্তি রাষ্ট্রের বিধি-বিধানকে
নৈতিকতার বিচার-বিবেচনার মানদন্ড বলে মনে করে। কিন্তু নৈতিক প্রগতি সম্পর্কীয় সচেতনতার
মাধ্যমে বুঝতে পারে বহির্বিধি নৈতিক বিচার-বিবেচনার সঠিক মানদন্ড নয়। নৈতিকতা বাহ্যিক নিয়ন্ত্রণ
থেকে উদ্ভ‚ত নয়।
খ. কঠোর সদগুণগুলোকে কোমল সদগুণের অধীনে আনা: কঠোর সদগুণগুলোকে ক্রমাগত কোমল
সদগুণে রূপান্তর এবং অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার সদগুণগুলোকে কল্যাণ ও স্বাচ্ছান্দের সদগুণে রূপান্তর
করাই হচ্ছে নৈতিক প্রগতির দ্বিতীয় পর্যায়। ব্যক্তি তার নৈতিকতার প্রথম দিকে কঠোর সদগুণ, দৈহিক
শক্তি, সাহস ও সামর্থ্যরে উপর নির্ভর করে থাকে। কিন্তু যখন তার জীবনে প্রগতির দ্বিতীয় পর্যায়
আসে, তখন সে এই কঠোর সদগুণগুলোকে কোমল সদগুণে অর্থাৎ সহানুভুতি, বদান্যতা, দয়া, ক্ষমা,
সহনশীলতা, ধৈর্য্যশীলতা ইত্যাদির অধীনে নিয়ে আসে।
গ. সদগুণের পরিসরের ব্যাপকতা : ব্যক্তির মধ্যকার সদগুণগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর যতই ব্যাপকতর
হতে থাকে এবং নৈতিক আদর্শের কাছাকাছি যেতে থাকে, ততই তার আত্মকেন্দ্রিক সদগুণগুলো
পরকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপ নেয় এবং ফলে সে অপরাপর ব্যক্তির কল্যাণের কথা চিন্তা করতে থাকে।
ব্যক্তির নৈতিক প্রগতির শর্ত
ব্যক্তির নৈতিক প্রগতি বিকশিত হয়ে থাকে আত্মসংযম, অপরের প্রতি সহানুভুতি, ন্যায় নীতি ইত্যাদির
প্রতি আনুগত্যের মাধ্যমে। ব্যক্তির নৈতিক প্রগতির জন্যে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ শর্তের আলোচনা নি¤েœ
করা হলো।
ক. বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন : ব্যক্তির নৈতিক প্রগতির জন্যে বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন অপরিহার্য। বুদ্ধিবৃত্তির
সুষ্ঠু অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে ব্যক্তি অন্যান্য কর্মকে ন্যায় কর্ম থেকে পৃথক করতে পারে। ফলে সে
অন্যায়কে পরিহার এবং ন্যায়কে গ্রহণ করতে পারে। বুদ্ধির অনুশীলন ব্যতীত নৈতিক আদর্শ ও কর্তব্য
সম্পর্কে পরিস্কার ধারণা গঠন করা সম্ভব নয়। সক্রেটিস বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনের উপর গুরুত্ব আরোপ
করেছেন।
খ. সদগুণের অনুশীলন : সদগুণের অনুশীলন প্রয়োজন এবং এর মাধ্যমেই সৎ অভ্যাস গঠিত হয়।
সাহসিকতা, মিতাচার বা সংযম, দানশীলতা, উদারতা, মহানুভবতা, উচ্চাকাক্সক্ষা, নম্রতা, বন্ধুত্ব,
সত্যবাদিতা, হাস্যরস, শালীনতা ও ক্রোধপ্রবণতা রোধ প্রভৃতি সদগুণের অনুশীলন করা দরকার।
প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন দেশে সদাচার, বিচার, বিনয়, বিদ্যা ইত্যাদিকে সদগুণ হিসাবে ধরা হয়।
মহাভারতেও কতকগুলো সদগুণের উল্লেখ দেখা যায়, যেমন- আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা তীর্থস্থান
দেখা, নিষ্ঠা, বৃত্তি, স্তর, দান এবং এই নয়টিকে মহাভারতে কুল লক্ষণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কুরআন মজিদেও মুসলমানদেরকে মধ্যম পন্থা-ধৈর্য্য, দানশীলতা বিনয়, মিতব্যয়িতা, শালীনতা,
প্রতিজ্ঞা পালন, সৎ সাহস, ন্যায়পরায়নতা, উদারতা, সদ্ভাব, কৃতজ্ঞতা, পরোপকারিতা ইত্যাদি সদগুণ
অনুশীলনের জন্যে বলা হয়েছে।
গ. মহৎ ব্যক্তির জীবনী পাঠ: মনীষীদের জীবনী পাঠ ব্যক্তির নৈতিক প্রগতিতে প্রভ‚ত সাহায্য করে।
মনীষীদের জীবনী পাঠের জ্ঞান ব্যক্তির ক্রিয়া-কলাপের উপর শুভ প্রভাব ফেলে। এ প্রভাবের ফলেই
ব্যক্তির মন থেকে তুচ্ছতা, হীনতা, ক্ষুদ্রতা, স্বার্থপরতা দূরীভ‚ত হয়।
ঘ. সৎ সংসর্গ: ব্যক্তির নৈতিক প্রগতিতে সৎ সংসর্গের প্রভাব অনস্বীকার্য। ব্যক্তির একমাত্র কর্তব্য অসৎ
লোকের সাথে মেলামেশা পরিহার করা এবং সৎ লোকের সাথে চলাফেরা করা। আর এতে ব্যক্তির
নৈতিক প্রগতির পথ অনেকাংশে প্রশস্ত হয়।
ঙ. আত্মসংযম : আত্মসংযম ব্যক্তির নৈতিক প্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। কোন ব্যক্তি যদি
আত্মসংযমের মাধ্যমে ষড়রিপুকে দমন করতে না পারে, তাহলে তার নৈতিক প্রগতি ব্যাহত হয়। তাই
নৈতিক প্রগতির জন্যে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সংযমী হতে হবে।
চ. অনুতাপ : ব্যক্তিকে নৈতিক প্রগতি অর্জন করতে হলে অনুতাপের মাধ্যমে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতিকে
দমন করতে হবে। ভুলবশত: বা অনিচ্ছাসত্তে¡ও কেউ যদি কোন অন্যায় করে থাকে, তাহলে তার
অনুতপ্ত হওয়া উচিত। ব্যক্তির অনুশোচনা নৈতিক শাস্তি হিসাবে কাজ করে।
ছ. সামাজিক পরিবেশ : যে সামাজিক পরিবেশে ব্যক্তি তার জীবন চালিত করে সে পরিবেশও ব্যক্তির
নৈতিক প্রগতিতে প্রভাব বিস্তার করে থাকে। পরিবেশ নৈতিকতা অর্জনের ক্ষেত্রে বিরূপ হলে নৈতিক
প্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাই এরিষ্টটল রাষ্ট্রের সুশাসক ও সুনাগরিক তৈরী করার ক্ষেত্রে নীতিবিদ্যা
পাঠের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
সারকথা:
নৈতিক প্রগতি ব্যক্তির আচরণকে নিয়ন্ত্রিত করে ব্যক্তির জীবনে পূর্ণতা এনে দেয়। মানব জীবনের
চ‚ড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়াকেই নৈতিক প্রগতি বলা হয়। নিরন্তর ও অব্যাহত
প্রচেষ্টার মধ্যদিয়ে ব্যক্তির জীবনে যে বিভিন্ন পরিবর্তন আসে সেই পরিবর্তনগুলো হচ্ছে নৈতিক প্রগতির
বিভিন্ন পর্যায়। নৈতিক প্রগতিরশর্তগুলো হচ্ছে নৈতিক জগত, জগতের অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা,
অপূর্ণতার বোধ, নৈতিক অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা, নতুন বাধ্যবাধকতা, আদর্শ জগত ইত্যাদি।
সঠিক উত্তরটি লিখুন
১. নিচের কোন্টি সদগুণ ?
ক. কাম
খ. ক্রোধ
গ. ভয়
ঘ. ক্ষমা।
২. নিচের কোন্টি নৈতিক প্রগতির শর্ত নয় ?
ক. নৈতিক জগত
খ. সাম্প্রদায়িক পরিবেশ।
গ. নৈতিক অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা।
ঘ. অপূর্ণতা বোধ ।
৩. নিচের কোন্টি অসদ্গুণ?
ক. বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন
খ. আত্মসংযত
গ. দুর্নীতি
ঘ. উদারতা।
৪. আত্মসংসম ব্যক্তির কোন্ ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখে?
ক. নৈতিক ভাবাবেগে
খ. বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলনে
গ. নৈতিক অবদমনে
ঘ. নৈতিক প্রগতিতে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমুলক প্রশ্ন :
১. নৈতিক প্রগতি কাকে বলে ?
২. নৈতিক প্রগতির শর্তসমুহ কি ?
রচনামুলক প্রশ্র :
১. নৈতিক প্রগতির শর্তসমুহ আলোচনা করুন।
২. ব্যক্তির নৈতিক প্রগতির শর্তসমূহ ব্যাখ্যা করুন ।
উত্তর : ১. ঘ ২. খ, ৩. গ, ৪. ঘ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]