প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার একটি বিবরণ দিন। প্রাচীন রোমান সভ্যতার একটি বিবরণ দিন।

সভ্যতার সংজ্ঞা
সৃষ্টির শুরু থেকে যাযাবর মানুষের সংগ্রামী জীবন যাত্রাকে গঠনমূলক রূপ দিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন
সভ্যতার উদ্ভব হয়েছিল। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অৎহড়ষফ ঞড়ুহনবব -এর মতে পৃথিবীর ইতিহাস,
বিভিন্ন কৃষ্টির ক্রম বিকাশ আর কৃষ্টির সমন্বয়ে সভ্যতার সৃষ্টি। মানব ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন
অঞ্চলে যে বিশেষ বিশেষ কৃষ্টির উদ্ভব হয়েছিল তাকেই সাধারণত প্রাচীন সভ্যতা বলা হয় কৃষ্টি
অপেক্ষা সভ্যতার অর্থ আরও ব্যাপক।
মানব ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের সে স্তরকেই সভ্যতা গণ্য করা হয়, যখন আবিষ্কৃত হয়েছে
লিখন পদ্ধতির, উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে শিল্প ও বিজ্ঞানের, উন্নতি সাধিত হয়েছে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক,
অর্থনৈতিক, ও ধর্মীয় অবস্থার। প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবসানের মাধ্যমেই সভ্য যুগের উদ্ভব ঘটে।
সভ্য যুগের দু’টি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল- (ক) মানুষের লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার। অর্থাৎ মানুষ তার
ধ্যান ধারণা, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভ‚তি লিখে প্রকাশ করে পাথরের গায়ে, তামার পাতে, কাদার
úেটে বা কাগজে। (খ) দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল-মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে পুরাতন গ্রাম্য সংস্কৃতির
অবসান ঘটিয়ে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলে নগর সংস্কুতি। সে দিনের নগর সংস্কৃতির উপর
ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে আজকের নতুন প্রজম্মের নতুন নগর সংস্কৃতি।
খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকে বিশ্ব সভ্যতার যাত্রা শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। পৃথিবীর প্রাচীনতম
সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদী, মিশরের নীল নদ, ভারতের
সিন্ধু নদ, চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংহো ও ইয়াং সিকিয়াং নদীর অববাহিকায়। এ সকল নদীবিধৌত
অঞ্চলে নিয়মিত পানি সরবরাহ, উর্বর ভ‚মি, যানবাহনের সুযোগ, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ ইত্যাদি
কারণে সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল। প্রাচীন সভ্যতায় যথাক্রমে- শিরীয়, সুমেরীয়, হিব্রু, পারসিক,
গ্রীক ও রোমান সভ্যতার আর্বিভাব ঘটে ও পরবর্তীতে বিলুপ্ত হয়।
প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা
প্রাচীন গ্রীসের অধিবাসীদের গ্রীক জাতি বলা হয়। এ জাতির পূর্ব পুরুষ ছিল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায়
কথা বলা এক মেষপালক আর্য গোষ্ঠী। খিস্ট্রপূর্ব ৩০০০ অব্দে জনসংখ্যা তুলনামুলকভাবে বেশি বৃদ্ধি
পাওয়ায় আর্য জাতির এ বংশধরেরা তাদের আদি নিবাস দানিয়ূব নদীর তীরে অবস্থিত তৃণভ‚মি অঞ্চল
থেকে ইজিয়ান অঞ্চল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তারা কালক্রমে ডোরীয়, আওনীয়, ইওনীয় এবং এচিত্ত
নামে পরিচিত হয় এবং ইজিয়ান অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়ে তোলে।
মানব সভ্যতায় গ্রীকদের অবদান : প্রায় ১০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রীক জাতি সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের
জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিল। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রতœতাত্তি¡ক খনন কার্যের ফলে গ্রীক জাতির ইতিহাস
উম্মোচিত হয়। প্রাচীন গ্রীক কবি হোমার রচিত ইলিয়াদ এবং ওডিসি দুই মহাকাব্যে বর্ণিত ঘটনাবলী
অনুমান করে খনন কার্য পরিচালিত হয়। তাতে করে মহাকাব্যে বর্ণিত অনেক তথ্য যথার্থ বলে জানা
যায়। নি¤েœ বিশ্ব সভ্যতায় গ্রীকদের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. দর্শন : বিশ্ব সভ্যতায় গ্রীকদের অন্যতম অবদান ছিল দর্শনে । পৃথিবীর সৃষ্টি, এর পরিভ্রমণ,
সূর্যগ্রহণ ইত্যাদির কারণ খুঁজতে গিয়ে গ্রীসে দর্শন চর্চার সূত্রপাত ঘটে। প্রাচীন গ্রীসে কয়েকজন
বিখ্যাত যুক্তিবাদী দার্শনিক ছিলেন। যুক্তিবাদী দার্শনিকদেরকে বলা হত সফিষ্ট। সুশাসক পেরিক্লিস
সফিষ্টদের অনুসারী ছিলেন। সক্রেটিস ছিলেন অন্যতম শ্রেষ্ট দার্শনিক। অন্যায় শাসনের প্রতিবাদ,
আদর্শ রাষ্ট্র, সৎ নাগরিক সন্বন্ধে তাঁর বক্তৃতা তরুণদের আকর্ষণ করে। এতে শাসক শ্রেণী ভীত হয়ে
তাঁর বিরুদ্ধে তরুণদের বিপথে পরিচালনার অভিযোগ আনে। অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে বিচারে
তাকে হেমলক বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়।
সক্রেটিসের ছাত্র প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের স্বাপ্নিক ছিলেন। তাঁর রচিত রিপাবলিক গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের ধ্যান
ধারণা পাওয়া যায়। তিনি তাঁর শিক্ষক সক্রেটিসের বক্তৃতামালা নিয়ে ডায়ালগস অব সক্রেটিস নামে
অপর এক গ্রন্থ রচনা করেন।
২. ইতিহাস ও সাহিত্য : গ্রীকরা স্মরণীয় অবদান রেখে গেছে ইতিহাস রচনায়। প্রাচীন গ্রীক
ঐতিহাসিক হেরোডোটাস-কে ইতিহাসের জনক বলা হয়। থুগিডাইডস প্রাচীন গ্রীসের একজন
খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ছিলেন। সাহিত্য ক্ষেত্রেও গ্রীকদের অসামান্য অবদান রয়েছে। অন্ধ কবি
হোমারের ইলিয়াড ওডিসি মহাকাব্য বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। গ্রীক জাতির ঐতিহ্য এবং বীরদের
দু:সাহসিক অভিযানের অপূব বর্ণনা দেখা যায় এ দুই মহাকাব্যে। কবি গেসিয়াড, সাম্পো, পিন্ডার গ্রীক
যুগের বাস্তববাদী সাহিত্যিক কবি ছিলেন। প্রাচীন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গ্রীকদের অন্যতম অবদান ছিল
রঙ্গমঞ্চ তৈরি ও নাটক করা।
খোলা আকাশের নিচে বৃত্তাকার রঙ্গমঞ্চ প্রথম তেরি হয়েছিল গ্রীস দেশে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত
উৎসবের সময়ে মঞ্চে অভিনয় হত। গ্রীসের বিখ্যাত ও জনপ্রিয় নাট্যকার ছিলেন এসকাইলাস বা
এক্রিলাস। তাঁর অন্যতম রচনা ট্রাজেডি নাটক বন্দী প্রমিথিউস মহান গ্রীক নাট্যকার সফোক্লিসের
আন্তিগোনে একটি উল্লেখযোগ্য ট্রাজিক নাটক ছিল। তিনি প্রায় একশতেরও বেশি নাটক রচনা করেন।
৩. অলিম্পিক খেলা : প্রাচীন বিশ্ব সভ্যতার সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গ্রীকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান
অলিম্পিক খেলা প্রর্বতন। যা এখনও পৃথিবীতে প্রচলিত আছে। প্রাচীন গ্রীসে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের মধ্যে
সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি এবং ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা হিসেবে অলিম্পিক খেলা ৭৭৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে শুরু করা
হয়। প্রতি চার বছর অন্তর গ্রীসের অলিম্পিয়া শহরে এ খেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গ্রীসের বিভিন্ন
নগররাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া কুশলীরা দৌড়, ঝাপ, মল যুদ্ধ, চাকতি নিক্ষেপ, বর্শা ছোঁড়া ও মুষ্টিযুদ্ধে -
অংশগ্রহণ করত। অলিম্পিক খেলার মাসকে পবিত্র বলে মনে করা হত। এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ
ছিল।
৪. বিজ্ঞান : বিজ্ঞান সাধনার ক্ষেত্রে গ্রীকরা উলে খযোগ্য অবদান রেখে গেছে। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও -
পৃথিবীর জম্ম রহস্যের উদ্ঘাটনে তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। এথেনীয় মহাবিজ্ঞানী
ডেমোক্রিতাস প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে প্রচুর গবেষণা করেছেন। আমাদের এ বিশ্ব যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু দ্বারা
গঠিত এ ধারণা তিনিই প্রথম দিয়ে গিয়েছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের গ্রীক প›িডত এরিস্টটল
সর্ব বিষয়ে অসাধারণ পা›িডত্যের পরিচয় দিয়ে গেছেন। গ্রীক গণিতবিদ পীথাগোরাস খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ট
শতকে জম্ম গ্রহণ করেছিলেন।
৫. ভাস্কর্য, স্থাপত্য ও শিল্পকলা : স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে গ্রীকরা অপূর্ব শিল্প নৈপূণ্য ও দক্ষতার চিহ্ন রেখে
গেছেন। মন্দির ও প্রস্তর মূর্তি নির্মাণে, পুস্পাধারে অ্িঙ্কত চিত্র কলায় গ্রীকদের অসাধারণ প্রতিভার
বিকাশ লাভ ঘটে। অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত স্তম্ভের ওপর তারা প্রাসাদ নির্মাণ করত। এথেন্সের পার্থেনয়
মন্দির তাদের স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
দেব-দেবী, বীর ও সমকালীন লোকজনের মূর্তি গ্রীক ভাস্করগণ এমনভাবে তৈরি করতেন যে তাতে
অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটে উঠত। ফিদিয়াস, মাইরন, প্রাকসিটেলেস খ্যাতিমান ভাস্কর ছিলেন।
৬. শিক্ষা ও সঙ্গীত : হোমারীয় যুগের শেষভাগে ফিনিসীয়দের লিপির সাথে গ্রীকদের পরিচয় ঘটে।
ব্যঞ্জন বর্ণের সাথে স্বরবর্ণ যুক্ত করে গ্রীকরা মোট ২৪টি অক্ষরের বর্ণমালা উদ্ভাবন করে। গ্রীকরা
পাপিরাসের ওপর এবং মাটির প্লেটে লিখত। গ্রীকের অধিবাসীগণ বই পড়া খুব ভালবাসত। গ্রীক
বাসীর সন্তানেরা সাত বছর বয়স থেকে পাঠশালায় যাওয়া আসা করত। কৃষক ও কারিগরের সন্তানেরা
প্রাথমিক শিক্ষা পেত। দাসদের ছেলেদের জন্যে বিদ্যালয়ের দ্বার বন্ধ ছিল।
ছবি আঁকা, নাচ গান এবং লিরা বাদ্য যন্ত্র বাজান শেখান হত তরুণদের। ধর্মীয় উৎসবে গান গাওয়ার
প্রয়োজনে গ্রীকদের সঙ্গীতের বিকাশ ঘটে এবং বাদ্যযন্ত্র নির্মাণে তারা দক্ষ হয়ে উঠে।
মানব সভ্যতার ক্রম-বিকাশে গ্রীক সভ্যতা দর্শন, ইতিহাস ও সাহিত্য, বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, ভাস্কর্য
স্থাপত্য ও শিল্পকলা এবং শিক্ষা সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে।
প্রাচীন রোমান সভ্যতা
প্রাচীন রোমান সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল প্রাচীন রোম নগরীকে কেন্দ্র করে। বর্তমান ইতালির পশ্চিমে
দক্ষিণ ভ‚মধ্যাসাগরের উপকুলে রোম নগরী অবস্থিত। রোম নগরী সাতটি পার্বত্য টিলার উপর ছিল।
নগরের চারিদিকে ছিল উর্বর সমতল ভ‚মি। এ সমতল ভ‚মিতে বাস করত ল্যাটিন উপজাতি। ল্যাটিন
রাজা রোমিট্রলাস পত্তন করেন এক নগরী। তাঁর নামেই নগরীর নামকরণ করা হয় রোম। রোমবাসীরা
কথা বলত ল্যাটিন ভাষায়।
রোমান সভ্যতার অবদান : রোমানরা গ্রীসের ভাষা, বিজ্ঞান ও শিল্পকলার সাথে ধীরে ধীরে পরিচিত
হয়েছিল। তাদের এ পরিচিতি আরও বৃদ্ধি পায়-যখন রোমবাসীরা গ্রীস দখল করে। অবশ্য রোমের
সংস্কৃতি গ্রীসের শুধু অনুকরণ ছিল না-গ্রীকদের কাছে শিখে তারা নতুন অনেক কিছু সুষ্টি করেছিল।
নিচে রোমান অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হলো :
১. বর্ণমালা সৃষ্টি : রোমানরা গ্রীক বর্ণমালার ভিত্তিতে লাতিন বর্ণমালা সৃষ্টি করে।
২. সাহিত্য : সাহিত্য রচনায় রোমান সভ্যতা অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতাকে ছাড়িয়ে গেছে। বিজ্ঞানী ও
কবি লুক্রেৎ সিউস বস্তু প্রকৃতি নামে একটি কাব্য রচনা করেছেন। এ কাব্যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে
প্রকৃতি ও মানুষের ইতিহাস সম্বন্ধে লেখা হয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বহু প্রতিভাবান কবি রোমে
বাস করতেন। এদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত কবি ছিলেন ভেগিলিউস। তাঁর মহাকাব্য ইনিস
(অবহবরং) বহু ভাষায় অনুদিত রয়েছে। ওভিদ ও লিভি রোমীয় যুগের খ্যাতিমান দুই কবি ছিলেন।
৩. দর্শন ও ইতিহাস : রোমের জনপ্রিয় দার্শনিক মতবাদের নাম ছিল ষ্টোয়িকবাদ। এ মতবাদ অনুসারে
সুখ লাভের জন্যে প্রয়োজন শৃঙ্খলা, শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সত্যবাদী হওয়া।
৪. স্থাপত্য শিল্প : রোমের বিশাল ও জাঁকজমকপূর্ণ ইমারতগুলো রোমীয় সাম্রাজ্যের শক্তি ও প্রাচুর্য্যরে
বহি:প্রকাশরূপে উপস্থিত। রোমে আবিস্কৃত কংক্রীট স্থাপত্য শিল্পে তাদের নতুন অবদান। কংক্রীট
শক্তভাবে পাথর জোড়া লাগাত। ফলে সে সময়ে খিলান ও নির্মাণ সম্ভব হয়েছিল। রোমীয় স্থাপত্যের
অপূর্ব নিদর্শন ধর্ম মন্দির প্যান্থিত্তন।
৫. ভাস্কর্য শিল্প : রোমীয় ভাস্কর্যের অপূর্ব সাফল্য হল অবিকলভাবে মানুষের পূর্ণাবয়ব ও আবক্ষ মূর্তি
নির্মাণ। এ মূর্তি নির্মাণে মানুষের মনোজগত মুখায়বে জীবন্তভাবে চিত্রিত করা। রোম সম্রাট, কর্মকর্তা
ও দেবতাদের বহু মূর্তি পাওয়া গেছে যা রোমীয় ভাস্কর্যের নিদর্শন বলে মনে করা হয়।
৬. ধর্ম : রোমীয় ধর্মে গ্রীকদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রোমে বহু ধর্ম মন্দির নির্মিত হয়েছিল।
রোমবাসীদের প্রধান দেবতার নাম জুপিটার। নেপচুন, ভেনাস, মিনার্ভা তাদের অন্যতম দেব-দেবী
ছিল। অগাষ্টাস সিজারের সময়কাল থেকে সম্রাটদের ঈশ্বর বলে পূজা করা হত। শেষের দিকে রোমে
খ্রিস্ট ধর্ম প্রসার লাভ করে। খ্রিস্টধর্ম সম্রাট পূজা সমর্থন করে না। ফলে প্রথম দিকে রোমান শাসকেরা
খ্রিস্ট ধর্মের বিরোধী ছিল। দরিদ্র কৃষক, কারিগর ও দাসগণ খ্রিস্টধর্মকে জীবন ধারণের এক অবলম্বন
মনে করে এবং রোম সাম্রাজ্যে খ্রিস্টধর্মের প্রসার লাভ করে। সমাজে বিশৃঙ্খলা নিরসনের জন্যে
অবশেষে সম্রাট কনষ্টানটাইন খ্রিস্ট ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দান করেন।
৭. আইন : যেহেতু রোম শাসন ব্যবস্থার বিরাট বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশে পরিণত
হয়েছিল তাই রোমানদের শ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব প্রকাশ পায় তাদের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে। রোমান আইন
লিখিত এবং অলিখিত দু‘ই ছিল। অভিজাতদের (প্যাট্রেশিয়ান) সাথে সাধারণ নাগরিকের (প্লেবিয়ান)
সংঘাতের ফলে সাধারণ মানুষের কল্যাণে আইন প্রণীত হতে থাকে। ১২টি ব্রোঞ্জ পাতে এ আইন
লিখিত হয়। হেবিয়াস কোর্পাস নামে এ আইন পরিচিত ছিল। বেসামরিক আইন, জনগণের আইন
এবং আইনের নতুন বিন্যাস-এ তিনটি শাখায় রোমান আইন বিকাশ লাভ করে।
বেসামরিক আইন পালনে নাগরিকেরা বাধ্য ছিল। রোমান আ্ইনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হত। এ
আইন ছিল উদার ও মানবিক। এ আইনে বিধবা ও এতিমদের অধিকার সংরক্ষিত ছিল।
৮. রোমান সংস্কৃতির প্রভাব : রোমান সংস্কৃতির প্রভাব ইতালি ছাড়াও সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে
পড়েছিল। যেখানে তারা গিয়েছে সেখানে তারা খিলান, জল সরবরাহ ব্যবস্থা, ্এ্যামিক থিয়েটার ও পথ
নির্মাণ করত। দূর-দূরান্ত অঞ্চলে ল্যাটিন ভাষা ব্যবহৃত হত। প্রাচ্যের ও গ্রীসের বহু রচনা ল্যাটিন
ভাষায় অনুবাদ করা হয়। পশ্চিম ইউরোপের শিক্ষিত ব্যক্তিরা এ ভাষায় লিখত ও পড়ত। খনিজ দ্রব্য,
উদ্ভিদ ও পশু-পাখি ইত্যাদির নামকরণের সাধারণ ভাষা হল-ল্যাটিন।
পৃথিবীর সকল দেশের বিজ্ঞানীরা এ ভাষাতেই এগুলো চিনতে পারে। চিকিৎসকেরা এ ভাষাতেই
এখনও ঔষধের নাম লিখে থাকেন। আধুনিককালের বহু শব্দ ল্যাটিন ভাষা থেকে এসেছে। রোমে
তৈরি পঞ্জিকা পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যবহার করা হয়। ইংরেজি বার মাসের নাম ল্যাটিন ভাষা থেকে
উদ্ভ‚ত। লুক্রেৎসিউস, ভেগিলিউস এবং অন্যান্য রোমীয় লেখকদের রচনা ইউরোপীয় সাহিত্যকে
বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। রোমানদের লিখার ও গম্বুজ নির্মাণের কৌশল পৃথিবীতে স্থাপত্য শিল্পের
বিকাশে অমূল্য অবদান রেখেছে।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা
মিসরের নীল নদের অববাহিকায় পৃথিবীর প্রাচীন ও সমৃদ্ধ সভ্যতার উম্মেষ ঘটে। মিসরীয় সভ্যতার
মত আর কোন সভ্যতা মানব জাতির ক্রম বিবর্তন, উন্নতি ও উৎকর্ষতায় এতবড় অবদান রাখতে পারে
নেই। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০৯০ পর্যন্ত বিস্তৃত।
মিশরীয় সভ্যতার অবদান : মানব সভ্যতার ইতিহাসে মিসরীয় সভ্যতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্ময়কর।
মিশরীয় সভ্যতার অবদান মানব সভ্যতার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। নিচে মিসরীয় সভ্যতার (ক) রাষ্ট্র ও
সমাজ (খ) অর্থনীতি (গ) ধর্ম ও (ঘ) লিখন পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
(ক) রাষ্ট্র ও সমাজ : খ্রিস্ট্রপূর্ব ৩২০০ সাল থেকে মিসরের নীল নদের অববাহিকায় সংঘবদ্ধ জাতির
বসবাস শুরু হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ সালের পূর্বে মিসরকে প্রাক রাজবংশীয় যুগ বলা হয়। প্রাক্
রাজবংশীয় যুগে মিসরীয় সভ্যতার সুচনা হয়। এ সময়ে মিসরে কতকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন নগররাষ্ট্র
ছিল-এতে রাষ্ট্রগুলো সংঘবদ্ধ ছিল না। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ সালে মেনেস নামের এক রাজা সমগ্র মিশরকে
একত্রিত করে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনিই প্রথম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। প্রথমে এ রাষ্ট্রের
রাজধানী উত্তরে থিরিসে ছিল। পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হয়ে দক্ষিণ মিসরে মেসফিসে আসে।
মিসরের শাসনকর্তাকে ফারাও (চযধৎধড়য) বা ফেরাউন বলা হত। তিনি ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে
রাজ্য শাসন করতেন। রাজা বড় রাজ প্রাসাদে বাস করতেন এবং প্রভ‚ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন
বলে তাকে ফারাও বলা হত। ফারাওগণ পরাক্রমাশালী ছিলেন, শান্তি ও শৃঙ্খলার সাথে রাজ্য শাসন
করতেন।
সামাজিক শ্রেণীবিভাগ : প্রাচীন মিসরীয় সমাজ পেশাভিত্তিক কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। এগুলো
হলো :
১। রাজ পরিবার ২। পূরোহিত শ্রেণী ৩। অভিজাত সম্প্রদায় ৪। ব্যবসায়ী শ্রেণী ৫। লিপিকার ৬।
শিল্পী এবং ৭। কৃষক ও ভ‚মিদাস।
রাজপরিবার ও শাসক সম্প্রদায় ছিল সমাজের সর্বোচ্চ স্তরে এবং শ্রমজীবী কৃষক ও ভ‚মিদাসের
অবস্থান ছিল সমাজের নিম্মস্তরে।
(খ) অর্থনীতি : প্রাচীন মিসরীয় অর্থনীতি ছিল কৃষি ভিত্তিক। কৃষক ও ভ‚মিদাস কৃষিকাজে নিয়োজিত
থাকত। প্রাক রাজকীয় যুগ থেকেই মিসরীয়রা চাষের জন্যে লাঙ্গলের ব্যবহার শুরু করে। কৃষি কাজের
জন্যে জল-সেচ, জলাশয়কে কৃষিক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার কৌশল তারা আবিস্কার করে। গম, যব,
তুলা, পেয়াজ অন্যতম কৃষিজ পণ্য ছিল।
কৃষিকাজ ছাড়াও প্রাচীন মিসরীয়রা বিভিন্ন ধরণের মাটির পাত্র নির্মাণ করত। তারা বিভিন্ন ধরণের
হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহারও জানত। পাথর শিল্প, নৌযান তৈরী, মাটির পাত্র রপ্তানি এবং সোনা,
রূপা, হাতির দাঁত, কাঠ ইত্যাদি আমদানি করত। ফিলিস্তিন, সিরিয়া, ফিনিশিয়া ও ক্রীট দ্বীপের সাথে
তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ছিল।
(গ) ধর্ম : প্রাচীন জাতি সমূহের মধ্যে মিসরীয়রা প্রথম ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রচলন করে। প্রাচীন
মিসরীয়দের জীবনে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল। মিসরীয়দের সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক
সাংস্কৃতিক জীবনের অর্থাৎ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতিফলন দেখা যায়।
মিসরীয়দের প্রধান দেবতার নাম ছিল আমনরে (অসসড়হ-জড়)। নীল নদী ভিত্তিক সভ্যতার অপর
এক দেবতার নাম ছিল ওসিরিস-(ঙংবৎরং) ওসিরিস নীলনদের দেবতা বলেও পরিচিত ছিল। এ
দু’দেবতাই প্রভাবশালী ছিল। অন্যান্য দেব-দেবী তেমন প্রভাবশালী ছিল না। মিসরীয়দের পূর্নজীবনের
প্রতি এবং দোযখ ও বেহেস্তের প্রতি তাদের পূর্ণবিশ্বাস ছিল।
(ঘ) লিখন পদ্ধতি : মিসরীয়দের লিখন পদ্ধতির নাম ছিল চিত্রলিখন রীতি এবং মিসরীয়রাই সর্বপ্রথম
লিখন পদ্ধতি আবিস্কার করে। গ্রীক ভাষায় এ নামের অর্থ হল পবিত্র লিপি। এ লিখন পদ্ধতির
চব্বিশটি চিহ্ন ছিল এবং প্রতিটি চিহ্ন একটি বিশেষ অর্থ নির্দেশ করত। প্রতিটি চিহ্ন পাশাপাশি খোদিত
করে শব্দ প্রকাশ করা হতো। ধর্ম লেখা এবং রাজার আদেশ প্রচারের জন্যে এ ধরনের লিপিকে
ব্যবহার করা হত। ধীরে ধীরে লিখন পদ্ধতির উন্নতি ঘটে। চিত্রভিত্তিক থেকে অক্ষরভিত্তিক এবং শেষে
বর্ণভিত্তিক লিপি ব্যবহৃত হয়। পাথর বা কাঠের গায়ে প্রথমে লিপি খোদাই করা হত। মিসরীয়রা প্রথমে
নলখাগড়া জাতীয় পাপিরাস গাছের মন্ড থেকে কাগজ তৈরী করে। এ কাগজের নাম ছিল পাপিরাস।
লিপিকারগণ পাপিরাসের গায়ে লিখে রাখত। বিশ্বসভ্যতায় মিসরীয়দের অবদান অনবদ্য। শুধু লিখন
পদ্ধতি, রাষ্ট্র ও সমাজ, অর্থনীতিতে তাদের অবদান সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং প্রাচীন সভ্যতার সর্ব ক্ষেত্রে
অবদান চিরস্মরণীয়।
সারকথা:
মানব ইতিহাসের ক্রমবিকাশ ও বিবর্তনের সে স্তরকেই সভ্যতা হিসেবে গণ্য করা হয় যখন আবিষ্কৃত
হয়েছে লিখন পদ্ধতির; উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে শিল্প ও বিজ্ঞানের, উন্নতি সাধিত হয়েছে রাষ্ট্রীয়,
সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থার। প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবসানের মাধ্যমেই সভ্য যুগের
উদ্ভব ঘটে। সভ্য যুগের দু’টি বৈশিষ্ট্য হলো মানুষের লিখন পদ্ধতির আবিষ্কার এবং পৃথিবীর বিভিন্ন
অঞ্চলে পুরাতন গ্রাম সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলা নগর সংস্কৃতি। পৃথিবীর
প্রাচীনতম সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ার ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদী, মিশরের নীল
নদ, ভারতের সিন্ধু নদী, চীনের হোয়াংহো ও ইয়াংসিকিয়াং নদীর অববাহিকায়। এসকল নদীবিধোত
অঞ্চলে নিয়মিত পানি সরবরাহ, উর্বর ভ‚মি, যানবাহনের সুযোগ, মৎস্য সম্পদ, বনজ সম্পদ ইত্যাদি কারণে সভ্যতার বিকাশ সম্ভব হয়েছিল।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন :
সঠিক উত্তরটি লিখুন
১. বিশ্ব সভ্যতার যাত্রা শুরু হয় কবে থেকে ?
ক. খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ অব্দ থেকে
খ. খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ থেকে
গ. খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে
ঘ. খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে।
২. মিশরীয় সভ্যতার সময়কাল কত ?
ক. খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০৯০ পর্যন্ত
খ. খ্রিস্টপূর্ব ৫০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০৯০ পর্যন্ত
গ. খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ২০৯০ পর্যন্ত
ঘ. খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১০৯০ পর্যন্ত।
৩. রোমানদের শ্রেষ্ট কৃতিত্ব প্রকাশ পায় কিসে?
ক. অনুবাদ কর্মে
খ. উদ্ভিদ ও পশু পাখির নামকরণে
গ. ভাস্কার্য তৈরিতে
ঘ. আইন প্রণয়নে।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন :
১. সভ্যতা কাকে বলে ?
২. প্রাচীন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোন সভ্যতার অবদান বেশি ?
রচনামূলক প্রশ্ন :
১. প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার একটি বিবরণ দিন।
২. প্রাচীন রোমান সভ্যতার একটি বিবরণ দিন।
উত্তর : ১. ক ২. খ, ৩. খ, ৪. ঘ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]