জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান সমস্যাবলী আলোচনা করুন।

জাতীয় সংহতি কি?
আধুনিকীকরণ ও রাজনৈতিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জাতীয় সংহতি একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
অধ্যাপক এলমন্ড রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতকগুলো সংকটের কথা উল্লেখ করেছেন, জাতীয়
সংহতির সমস্যা তার মধ্যে অন্যতম। তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ আর্থ-সামাজিক ও
রাজনৈতিক সংকটের সম্মুখীন। তাদের মূল সমস্যা হচ্ছে জাতীয় সংহতির সমস্যা। এর ফলে উন্নয়নের
গতি ব্যাহত হচ্ছে। সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত অনেক দেশই উপলব্ধি করেছে যে, স্বাধীনতা লাভ করার চেয়ে
জাতি গঠন আরও কঠিন কাজ। একটি সংজ্ঞা দ্বারা জাতীয় সংহতি বর্ণনা করা যায় না। জাতীয় সংহতি
কথাটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়।
জাতীয় সংহতি বা ঐক্যসাধন হচ্ছে এমন এক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে
পৃথক কতকগুলো গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে একটি ভ‚খন্ডগত আওতাধীনে নিয়ে এসে জাতীয় একাত্মতা
প্রতিষ্ঠা করা হয়। সংহতি হল সরকারের সেই ক্ষমতা যার মাধ্যমে সেই রাষ্ট্রের ভেতর সমস্ত সংগঠনের
উপর নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্ব খাটাতে পারে। এবং এই ক্ষমতাবলে জনগণের আঞ্চলিক ও সংকীর্ণ দৃষ্টি ভঙ্গি
দূর করে জাতীয় চেতনার সৃষ্টি করে। প্রফেসর রওনক জাহান অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, জাতীয়
সংহতি হল সেই প্রক্রিয়া যার দ্বারা এমন একটি জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা সৃষ্টি করা হয় যা সকল
আঞ্চলিক ব্যবস্থাকে অধীন বা অঙ্গীভ‚ত করে ফেলে। একটি রাজনৈতিক
ব্যবস্থায় সম্পর্কযুক্ত জনগোষ্ঠী যখন স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় তখন আমরা তাকে
জাতীয় সংহতি বলে চিহ্নিত করতে পারি।
কোন ব্যবস্থাকে একতাবদ্ধ রাখার সাধারণ সমস্যা বুঝাতে সংহতি কথাটি ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে
বিশেষণ যোগ করে বলা হয় জাতীয় সংহতি, ভৌগোলিক সংহতি, আচরণগত, মূল্যবোধগত সংহতি,
রাজনৈতিক সংহতি ইত্যাদি। আমাদের আলোচ্য বিষয় হচ্ছে জাতীয় সংহতি।
উপরি উক্ত আলোচনা ও বিশ্লেষণ থেকে সংহতি বলতে যা বুঝায় তা হলো:
১. সংহতি বলতে জাতীয় একাত্মতা প্রতিষ্ঠাকরণকে বুঝায়।
২. এটা অধীনস্ত রাজনৈতিক ইউনিট বা অঞ্চলগুলোর উপর জাতীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রতি ইঙ্গিত বহন
করে।
৩. সংহতি বলতে শাসক শাসিতের যোগসূত্র স্থাপন করার সমস্যার কথা বুঝানো হয়।
৪. কখনও এটা ম‚ল্যবোধগত ন্যূনতম মতৈক্যকে বুঝানো হয় যা সামাজিক শৃঙ্খলা ও গতিশীলতার
জন্যে প্রয়োজন।
৫. সংহতি কথাটি মানবিক সম্পর্ক ও মনোভাবের বিরাট ক্ষেত্রকে অন্তর্ভুক্ত করে।
উন্নয়নশীল জাতিগুলো সম্পর্কে একটি কথা গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়ে থাকে যে তাদের মূল সমস্যা হচ্ছে
জাতীয় সংহতি অর্জন করা যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। এডওয়ার্ড শীলস ও এল বাইন্ডার উল্লেখ
করেন যে, রাজনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় সংহতি হচ্ছে যুগপৎ সংযুক্ত বিষয়। জাতীয় সংহতির দিকে
যে কোন পদক্ষেপ রাজনৈতিক উন্নয়নের সূচক। স্বাধীনতা লাভ করার চেয়েও জাতি গঠন আরও কঠিন কাজ
জাতীয় সংহতি হচ্ছে এলিট ও জনগণের মধ্যকার ভৌগোলিক মূল্যবোধগত সংহতিমূলক আচরণ।
জাতীয় সংহতি মূলত ভ‚খন্ডগত ও জাতীয়তাবোধ সৃষ্টি সমস্যার প্রতি ইংগিত প্রদান করে; যা সংকীর্ণ
আনুগত্যকে দূরীভ‚ত করবে অথবা অধীনস্ত করে নেবে। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নানা উপজাতি
গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় থাকতে পারে। তাদের মধ্যে সংকীর্ণ আদর্শ দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য এবং দ্ব›দ্ব-সংঘাত
থাকা স্বাভাবিক। একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা এবং পূর্ণ কার্যকারিতার জন্য এ সমস্ত
দ্ব›েদ্বর অবসান হওয়া অবশ্য কাম্য। এ সকল উপজাতি গোষ্ঠীকে একটি জাতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত
করার প্রক্রিয়ার নামই হচ্ছে জাতীয় সংহতি।
নব্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশগুলোতে জনসাধারণ রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ
লাভ না করায় সেখানে জাতীয় সংহতির প্রয়োজনীয়তা উচ্চতর মাত্রায় দেখা দিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের
দেশগুলো নানা ধরনের সংহতিগত সমস্যার সম্মুখীন। সরকারের ব্যাপক কার্যক্রম সামাজিক ও
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষা-সংহতিগত সমস্যার সৃষ্টি করে। রাষ্ট্র যখন সম্পদ কাজে
লাগানো এবং বন্টন করার ব্যাপারে সক্রিয় হয় তখন সাধারণ মানুষ ও এলিটের মধ্যে নতুন ধরনের
সংহতির প্রয়োজন দেখা দেয়।
জাতীয় সংহতি সাধনের ক্ষেত্রে রয়েছে বহুবিধ সমস্যা । আমরা এখানে গোষ্ঠীগত ও সম্প্রদায়গত
পার্থক্য, শিক্ষার অভাব ও নেতৃত্বের সংকট ও এই চারটি সমস্যা নিয়ে আলোচনা করব।
গোষ্ঠীগত ও সম্প্রদায়গত পার্থক্য
নতুন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও ঐতিহ্যের দিক থেকে পার্থক্য দেখা যায়। ঔপনিবেশিক
শাসনের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীনতা লাভ করলেও গোষ্ঠীগত পার্থক্য বিভিন্ন ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়।
ফলে জাতীয় ঐক্য মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। আঞ্চলিক ও সম্প্রদায়িকতার বিষবাস্প জাতীয় সংহতির
প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। একাত্মতার সংকটের ফলে সরকারকে নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন
হতে হয়।
শিক্ষার অভাব
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে শিক্ষার হার খুবই কম। এ সকল দেশের সমাজব্যবস্থা বিভিন্ন কুসংস্কারে
জর্জরিত। শিক্ষার অভাবে তারা তাদের নাগরিকতাবোধ ও জাতীয় চেতনাবোধ সম্বন্ধে যথেষ্ঠ জ্ঞান লাভ
করতে পারে না। অশিক্ষার কারণেই পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থায় সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, ক্ষমতার মোহ, অর্থের
লোভ, ব্যক্তিস্বার্থ, উগ্র ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনা বিরাজ করে। উদার চেতনাবোধের অভাবে বিভিন্ন ধর্মীয়
সম্প্রদায়ের মধ্যে সহঅবস্থান অনেক সময়েই সম্ভবপর হয়ে উঠে না। অশিক্ষা নাগরিকদের মধ্যে
সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্র মানসিকতার জন্ম দেয়। এর ফলে জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ চিন্তা-চেতনা
প্রায়শই ধারণ করতে পারে না। তাই নি:সন্দেহে একথা বলা যায় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষার
অভাব সংহতির পথে একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে।
নেতৃত্বের অভাব
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো যে সমস্ত গুণাবলীর মাধ্যমে সংহতি লাভ করতে পারে নেতৃত্ব তার মধ্যে
অন্যতম। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির জন্যে প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্বের। জাতি গঠনে নেতৃত্বের ভ‚মিকা
অপরিসীম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের দায়িত্বহীন আচরণের কারণে জাতীয়
সংহতি সাধন বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। নেতৃবৃন্দের ব্যক্তিত্ব ও আদর্শের মধ্যে সৃজনশীলতার অভাব
পরিলক্ষিত হয়। আর এ কারণেই এলিট ও জনগণের মধ্যে সুষ্ঠু যোগাযোগ ও সমঝোতা গড়ে ওঠেনি।
সংহতির জন্যে প্রয়োজন ভারসাম্য পূর্ণ আঞ্চলিক উন্নয়ন। সুযোগ্য নেতৃত্ব ব্যতীত একটি দেশের আর্থ-
সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন অসম্ভব ব্যাপার। উন্নয়নশীল দেশের নেতৃবৃন্দ বিচক্ষণতার সাথে দেশ
পরিচালনা করতে সক্ষম হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় সংহিত অর্জন সহজ হবে। অশিক্ষা নাগরিকদের মধ্যে সংকীর্ণতা ও ক্ষুদ্র মানসিকতার জন্ম দেয়
সামাজিক ন্যায় বিচার, সাম্য, আইনের শাসন নৈতিকতা প্রভৃতি মূলবোধ ও আদর্শ জাতীয় সংহতির
জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।উন্নয়নশীল দেশের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে এ সকল আদর্শ
প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। এ ব্যর্থতা ও বিপর্যয় জাতীয় সংহতির পক্ষে বাঁধা স্বরূপ। জাতীয় সংহতির
জন্যে প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু বিকাশ। লক্ষ্যণীয় যে, ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তানে
এবং ১৯৭৫ সাল থেকে বাংলাদেশে বেশ কয়েকবার সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে এসকল দেশে
রাজনৈতিক সংগঠন ও জাতীয় সংহতির পথ সুগম হয়ে ওঠতে পারেনি।
সামরিক বাহিনী:
এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং ক্ষমতা দখলের
প্রবণতা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের
ফলে বহুদলীয় শাসনব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে এবং একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্ষমতা দখলের ফলে
গণতন্ত্র ও ব্যক্তি স্বাধীনতা বিনষ্ট হয়। সামরিক হস্তক্ষেপের কারণে বাকস্বাধীনতা, রাজনৈতিক
স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং অবধারিতভাবে পতন ঘটে
গণতন্ত্রের। দেখা দেয় সাংবিধানিক সংকট এবং বৃদ্ধি পায় প্রশাসনিক জটিলতা। সামরিক শাসন বিনষ্ট
করে অর্থনৈতিক ভারসাম্য। এর ফলে ক্ষুণœ হয় নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সামরিক বাহিনীর
হস্তক্ষেপ এভাবে উন্নয়নশীল দেশে জাতীয় সংহতির অন্তরায় সৃষ্টি করে।
সারকথা:
বিশ্বের উন্নয়নশীল জাতিগুলো জাতীয় সংহতির সমস্যায় নিমজ্জিত। জাতীয় সংহতি সরকারের সেই
ক্ষমতাকে বুঝায় যার সাহায্যে রাষ্ট্রের যাবতীয় সংগঠনের উপর কর্তৃত্ব চালাতে পারে। সংহতি সমস্ত
আঞ্চলিক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী দূরীভ‚ত করে জাতীয় চেতনার বিকাশ সাধন করে। সকল উপজাতী
গোষ্ঠীকে একটি জাতীয় সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করার নাম জাতীয় সংহতি। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক
কৃষ্টির সুষ্ঠু বিকাশ এবং বিচক্ষণ নেতৃত্ব জাতীয় সংহতি লাভের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারে। জাতীয় সংহতির জন্যে প্রয়োজন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু বিকাশ
সঠিক উত্তরটি লিখুন।
১. রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জাতীয় সংহতির কথা কে বলেছেন?
ক. এডওয়ার্ড শীলস
খ. বাইন্ডার
গ. এলমন্ড
ঘ. কোলম্যান।
২. স্বাধীনতার লাভ করার চেয়ে কঠিন কাজ কোনটি ?
ক. দেশের উন্নয়ন
খ. জাতি গঠন
গ. ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ
ঘ. প্রশাসনিক উন্নয়ন।
৩. জাতীয় সংহতির জন্য কি প্রয়োজন?
ক. রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সুষ্ঠু বিকাশ
খ. রাজনৈতিক দল গঠন
গ. অর্থনৈতিক উন্নয়ন
ঘ. সুষম বন্টন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন:
১. জাতীয় সংহতি বলতে কি বুঝায়?
রচনামূলক প্রশ্ন:
১. জাতীয় সংহতির ক্ষেত্রে প্রধান প্রধান সমস্যাবলী আলোচনা করুন।
উত্তরমালা: ১. গ, ২. খ, ৩. ক।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]