স্বাধীনতা বলতে কি বুঝেন? সাম্য বলতে কি বুঝেন?

স্বাধীনতা ও সাম্যের ধারণা
স্বাধীনতা : সাধারণ ভাষায় স্বাধীনতা বলতে মানুষের ইচ্ছামত বা মুক্তভাবে কোন কিছু করা বা না
করার অবাধ অধিকারকে বুঝায়। এদিক থেকে অধীনতামুক্ত বা নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থাকে স্বাধীনতা বলা
যেতে পারে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এরূপ অধিকারের পরিস্থিতিকে স্বাধীনতা বলে গণ্য করা হয় না।
কেননা, এ ধরনের স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা কখনও এক হতে
পারে না।
প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা হল নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা। সমাজে একত্রে বসবাস করতে হলে সকল মানুষকে
আইনকানুন মেনে চলতে হয়। রাষ্ট্রীয় আইনকানুন স্বাধীনতার অন্তরায় তো নয়ই, বরং রক্ষাকবচ।
আইন বিবর্জিত অবাধ ও নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা কখনও সভ্য সমাজের কাম্য হতে পারে না। স্বাধীনতার
প্রকৃতিকে যথার্থভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে স্বাধীনতার নেতিবাচক ও ইতিবাচক - দু’টি দিক
পরিলক্ষিত হয়। নেতিবাচক দিক হতে, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অর্থাৎ অবাধে কাজ করার অধিকারকেই
স্বাধীনতা বলা হয়। অপরদিকে, ইতিবাচক দিক হতে, অপরের সমপরিমান অধিকার খর্ব না করে
আইন অনুযায়ী ব্যক্তির স্বার্থ ও সুবিধা অর্জনের জন্য কাজ করার পরিবেশকেই স্বাধীনতা বলা হয়।
লাস্কি বলেছেন, ‘স্বাধীনতা বলতে আমি সেই পরিবেশের সযতœ সংরক্ষণকে বুঝি, যেখানে ব্যক্তি তার
প্রকৃত সত্তাকে পরিপূর্ণভাবে উপলদ্ধি করতে পারে’।
এ আলোচনায় একথা স্পষ্ট যে, স্বাধীনতা বলতে এমন একটি পরিবেশকে বুঝায় যেখানে ব্যক্তিসত্তার
সর্বোচ্চ বিকাশ হয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত গুণাবলীর সর্বোচ্চ বিকাশের অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টিই হল
স্বাধীনতা।
সাম্য : গণতন্ত্রের বিকাশের ফলে ক্রমশ: এটি নীতিগতভাবে স্বীকৃত হয় যে, রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক
হিসেবে প্রত্যেক ব্যক্তিই আইনের চোখে সমান। কিন্তু বাস্তবে মানুষের মধ্যে দৈহিক গড়ন, মনোবল ও
সামর্থের দিক দিয়ে বহু পার্থক্য বিদ্যমান। এই পার্থক্য যতদিন টিকে থাকবে ততদিন সকলে সমাজের
নিকট থেকে সমান আচরণ আশা করতে পারে না। একজন প্রকৌশলী এবং একজন সাধারণ
শ্রমিককে সমান মূল্য দেয়া হয় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সাম্য কথাটির অর্থ সকলে সমান হবে- এটি নয়।
মূলত: সাম্য বলতে সুষম পরিবেশ গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকেই বুঝায়। এ পরিবেশে প্রত্যেক ব্যক্তি তার
যোগ্যতা অনুসারে অন্যান্যদের সঙ্গে নিজস্ব ব্যক্তিত্বের পূর্ণ বিকাশ সাধন করতে পারে। লাস্কির মতে
সাম্যের তিনটি অন্তর্নিহিত অর্থ আছে। যথা প্রথমত: সাম্যের অর্থ হল বিশেষ সুযোগ-সুবিধার
অপসারণ। দ্বিতীয়ত: সাম্যের অর্থ হল সকল নাগরিকের জন্যে যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করা। সাম্য
মানুষের ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি রেখে সকলকে তাদের প্রতিভার পূর্ণবিকাশের জন্যে
প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পর্যাপ্তভাবে প্রদান করবে। সাম্য মানেই ধন-সম্পদ ও মর্যাদার পার্থক্যের
সম্পূর্ণ দূরীকরণ বুঝায় না। তৃতীয়ত: যেগুলো ছাড়া মানুষের জীবন অর্থহীন, সেগুলোর শ্রেণী-নির্বিচারে
মেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সুতরাং সাম্যের অর্থ হল আইনগতভাবে সকল ব্যক্তিকে সমান বলে
বিবেচনা করা অর্থাৎ রাষ্ট্রের উচিত নাগরিকগণের অধিকারসমূহ সমানভাবে বন্টন করা।
স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক
এককালে স্বাধীনতা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের এবং সাম্য সমাজতন্ত্রের মূলমন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হত। এ
কারণেই দ্য টকভিল, এ্যাকটন প্রমুখ চিন্তাবিদ যারা স্বাধীনতার সমর্থক ছিলেন তারা সাম্যকে সমর্থন
করেন নি। তাদের মতে, সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী। এ্যাকটন বলেন যে, ‘সাম্যের জন্যে
ভাবাবেগ স্বাধীনতার আশাকে ব্যর্থতায় পর্যবসতি করে।’ স্বাধীনতার মাধ্যমে যদি ধন ও ক্ষমতা
অর্জনের অবাধ অধিকার পাওয়া যায় তাহলে একদল মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়বে, আরেক দল হবে
দরিদ্র ও নি:স্ব। এ পরিস্থিতিতে প্রতীয়মান হয় যে, স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর বিরোধী।
বাস্তবে স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে এরূপ কোন বিরোধ নেই, বরং উভয়েই পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে
সম্পর্কযুক্ত। প্রকৃতিগতভাবে স্বাধীনতা সীমিত, সকলকে সমান আইনগত অধিকার ও মর্যাদা প্রদানের
মাধ্যমে সাম্য স্বাধীনতাকে সমৃদ্ধতর করে তোলে। স্বাধীনতাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে সাম্যনীতির
প্রয়োগ অপরিহার্য। আইনের চোখে সমানাধিকার এবং শাসন-ব্যবস্থায় সমানভাবে অংশ গ্রহণের
সুযোগ-ভোগের মাধ্যমেই জনগণ সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে উপভোগ করতে
পারে। আর, এইচ, টনি বলেন, “ বহুল পরিমাণ সাম্য স্বাধীনতার বিরোধী হওয়া তো দূরের কথা বরং
তা স্বাধীনতার পক্ষে অপরিহার্য।’’
স্বাধীনতা ও সাম্যকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করার যুক্তিযুক্ত কোন কারণ নেই। কেননা, তাদের
উভয়েরই সাধারণ লক্ষ্য আাছে এবং তা হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিত্ব ও সামর্থের স্বত:স্ফ‚র্ত ও পরিপূর্ণ
বিকাশ সাধন। লাস্কি বলেন স্বাধীনতা “বলতে আমি এমন পরিবেশের সযতœ সংরক্ষণকেই বুঝি,
যেখানে মানুষ তাদের আত্মার সর্বোত্তম বিকাশ সাধন করতে পারে’’। সাম্য নীতির বাস্তবায়নই এরূপ
পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। দেশের সংবিধানে লিখিত মৌলিক অধিকার সকলেই সমানভাবে ভোগ
করবে, নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বিচার বিভাগ সকল নাগরিকেরই এ সকল অধিকারকে পূর্ণভাবে রক্ষা
করবে। যদি স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ মানবাতœার নিরবচ্ছিন্ন উন্নতিসাধন হয় তাহলে সাম্যের ভিত্তিতে
প্রতিষ্ঠিত সমাজে তা সম্ভব।। শিক্ষিত-অশিক্ষিতের মধ্যে বৈষম্য দূর করা না হলে সেখানে আমরা
সর্বদাই প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক দেখতে পাব। যেকোন বৈষম্যপূর্ণ সামাজে ধনী-গরীবের উপর অবাধ
শোষণ ও উৎপীড়ন চালিয়ে যাবে এবং সেখানে অধিকাংশ জনগণই কোন সমাজিক ও রাজনৈতিক
স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে না। লা¯িকর মতে“ধন-সম্পদের বিরাট বৈষম্য স্বাধীনতা অর্জন
অস¤ভব করে তোলে’’। সে জন্যে লা¯িকর রুশোও মত বলেন যে ‘সাম্য ছাড়া স্বাধীনতার অর্থ
নিরর্থক’। সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতায় রূপায়িত হয়, আর স্বাধীনতা ছাড়া কোন সমাজের
সাম্য আনতে হলে সেখানে একরূপতারই সৃষ্টি হয়।
এখানে বলা-বাহুল্য যে, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে অতি নিবিড় সম্পর্ক থাকা সত্তে¡ও স্বাধীনতাকে
সাম্যের ঊর্ধ্বে স্থান দেয়া উচিত। কারণ ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্যে প্রথমে স্বাধীনতারই প্রয়োজন,
আর মানুষ যাতে সেই স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে সে জন্যে সাম্য স্বাধীনতা উপভোগের পরিস্থিতি
সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, স্বাধীনতার প্রয়োজন সাম্যই মেটাতে পারে। আবার সকলেই সাধারণভাবে স্বাধীনতা
ভোগ করতে চায় বলে স্বাধীনতার নামে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু যদি কোন সমাজে কেবল
সাম্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ঐক্যের চেয়ে সেখানে বিভেদের স¤ভাবনা দেখা দিতে পারে।
যাহোক, ব্যক্তির সত্তার পরিপূর্ণ ও স্বত:স্ফুর্ত বিকাশের জন্য স্বাধীনতার যেমন প্রয়োজন, সাম্যেরও
তেমন প্রয়োজন আছে। স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত, একে অপরকে
ছাড়া অর্থহীন।
বর্তমানে কোন রাষ্ট্রেই সাম্যবিহীন স্বাধীনতা অথবা স্বাধীনতাবিহীন সাম্যের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না।
সাম্য এবং স্বাধীনতা উভয়ই আইনগত ধারণা এবং রাষ্ট্রীয় আইন দ্বারা সংরক্ষিত। তবে সকল সমাজে
সাম্য ও স্বাধীনতার সমন্বয় সাধন স¤ভব হয় নি। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যাপক ধনবৈষম্য পরিলক্ষিত হয়।
ধনবৈষম্য অপরিহার্য- ভাবেই সামাজিক বৈষম্যের জন্ম দেয়। এ সমাজে সাম্য বলতে ধনিক শ্রেণীর
সুযোগের সমতাকে বুঝায়। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলেই একমাত্র সাম্য ও স্বাধীনতার মৈত্রী
বন্ধন সুদৃঢ় হতে পারে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোও এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তাই বলা
যায়, স্বাধীনতা ও সাম্যের সুমমন্বয় বাস্তবে স¤ভব নয় - এটা স¤ভব শুধু আদর্শ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্রে।
স্বাধীনতা ও সাম্য নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। সাম্য স্বাধীনতাকে সমৃদ্ধতর করে তোলে। অপরদিকে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার জন্যে সাম্য অপরিহার্য।
সারকথা:
স্বাধীনতা হল অন্যের অসুবিধা সৃষ্টি না করে ব্যক্তির স্বার্থ ও সুবিধা অর্জনের পরিবেশ। অপরদিকে
সাম্য হল রাষ্ট্রে নাগরিক হিসেবে অধিকারের ক্ষেত্রে সমতা। মূলত: স্বাধীনতা বলতে ব্যক্তিগত গুণাবলী
বিকাশের, আর সাম্য বলতে সুষম পরিবেশ গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকেই বুঝানো হয়। এ দৃষ্টিকোন
থেকে বলা যায়, স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে কোন বিরোধ নেই, বরং উভয়ই পরস্পর অঙ্গাঙ্গীভাবে
সম্পর্কযুক্ত। তবে একথাও ঠিক যে, স্বাধীনতা ও সাম্যের সুসমন্বয় বাস্তবে সম্ভব নয়-এটা সম্ভব শুধু আদর্শ রাষ্ট্র ও আদর্শ সমাজে।
সঠিক উত্তরটি লিখুন।
১। মানুষের কোন কিছু করা বা না করার অবাধ অধিকারকে কি বলে ?
ক) স্বাধীনতা
খ) স্বেচ্ছাচারিতা
গ) সাম্য
ঘ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য।
২। সুষম পরিবেশ গড়ে তোলার পরিবেশকে কি বলা হয়?
ক) উপযোগবাদ
খ) ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য
গ) উদারতাবাদ
ঘ) সাম্য।
৩। সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী -এ ধারণা কারা পোষণ করেন?
ক) দ্য টক্ভিল ও এ্যাকটন
খ) জন ও উইলিয়াম
গ) লাস্কি ও ম্যাকাইভার
ঘ) লিপসেট ও বল্ডউইন।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমুলক প্রশ্ন:
১। স্বাধীনতা বলতে কি বুঝেন?
২। সাম্য বলতে কি বুঝেন?

রচনামূলক প্রশ্ন :
১। স্বাধীনতা ও সাম্যের পারস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনা করুন।
উত্তারমালা: ১. খ. ২. গ, ৩. ক।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]