রেনেসাঁ
সাধারণভাবে রেনেসাঁ বলতে নবজাগরণ বুঝায়। রেনেসাঁ অর্থ-জাগৃতি বা পূনর্জন্ম। ব্যক্তিত্বের বিকাশের
সংগ্রাম হচ্ছে রেনেসাঁ। বিশ্বের ইতিহাসে রেনেসাঁ এক স্মরণীয় ঘটনা। মধ্যযুগ হতে আধুনিককালে
যুগপরিবর্তনের সন্ধিক্ষণটি ইউরোপীয় ইতিহাসে রেনেসাঁ নামে পরিচিত। ১৪শ’ শতকে ইতালিতে যে
সংস্কৃতি ও চিন্তাবিপ্লব শুরু হয় এবং ১৬ শতকে যার চরম বিকাশ ঘটে। ক্লাসিক্যাল গ্রীক, ল্যাটিন,
সাহিত্য এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারের ফলে মধ্যযুগীয় যাজকতন্ত্র, চিন্তাধারা ও বিশ্বাসের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ ঘোষণার মাধ্যমেই রেনেসাঁ যুগের সূত্রপাত। ইউরোপীয় এ রেনেসাঁর মূলে আরবীয়
মুসলমানদের প্রচুর অবদান ছিল। ইউরোপের অন্ধকার যুগে মুসলমানগণই গ্রীক ও ল্যাটিন জ্ঞানবিজ্ঞানের সেরা গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করে তা রক্ষা ও পরিপুষ্টি সাধন করেন। ক্রুসেডের বা
ধর্মযুদ্ধে যুদ্ধে ইউরোপীয়রা মুসলমানদের সংস্পর্শে এসে এ সমস্ত গ্রীক-ল্যাটিন ক্ল্যাসিকাল সম্পদ ও
উন্নত মুসলিম সভ্যতার পরিচয় লাভ করে। এ পরিচয়ের ফলেই ইউরোপে নতুন চিন্তাধারা ও রেনেসাঁর
উন্মেষ ঘটে। রেনেসাঁর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটে ইতালিতে। সেখান থেকে ফ্রান্স, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও
ইউরোপের অন্যান্য অংশে প্রসার লাভ করে। লীওনারদো-দা-ভীনচি, ম্যকিয়াভেলী ইতালীয় রেনেসাঁর
শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। শিল্পকলা, স্থাপত্য ও আধুনিক চিন্তাধারার বিকাশে ইউরোপীয় রেনেসাঁর প্রভাব ছিল
সুদূরপ্রসারী।
নি¤েœ রেনেসাঁর কারণগুলো বর্নিত হল:
মুসলমানদের অবদান
মধ্যযুগে ইউরোপ যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত মুসলমানরা তখন শিক্ষা ও সভ্যতায় সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। সে
যুগে মুসলমানদের পরিচালিত কর্ডোভা ও বাগদাদ ছিল শিক্ষা-দীক্ষার প্রাণ কেন্দ্র। মুসলমানরা গ্রীক,
ল্যাটিন সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানের পরিপুষ্টি সাধন করেছিল। ইউরোপীয়রা এ সকল বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষা
কেন্দ্রে অধ্যয়ন করতে আসত। তারা উন্নত ও সুন্দর আদর্শের সান্নিধ্যে এসে নবজাগরণের কথা
ভাবতে শুরু করে। ইসলাম ধর্মের শাশ্বত ও সুন্দর আদর্শ বলে বলীয়ান মুসলমানরা এ ভাবে ইউরোপে
সভ্যতার আলো প্রজ্জ্বলিত করেছিল।
জাতীয় ভাষা ও সাহিত্যের প্রভাব
চতুর্দশ শতাব্দীর দিকে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে দেশী ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়। সংস্কৃতির
পুনরুত্থানের সঙ্গে জাতীয় ভাষা এবং প্রাচীণ শিক্ষা সাহিত্যের উন্মেষ ঘটে। সংস্কৃতি আন্দোলনের
পুরোভাগে ছিলেন পেত্রাক ও তাঁর শিষ্য বোকাসিও। এ সকল বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের মধ্যে মহাকবি দান্তের
‘ডিভাইন ‘কমেডী’ ম্যাকিয়াভেলীর ‘দি প্রিন্স’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মহাকবি দান্তে তাঁর গ্রন্থে
মধ্যযুগের ক্ষয়িষ্ণু চরিত্রকে অংকন করে নতুন যুগকে অভিনন্দিত করেন। ম্যাকিয়াভেলী তাঁর গ্রন্থে
শাসকশ্রেণীর প্রতি যে উপদেশাবলীর কথা উল্লেখ করেন তা সমগ্র ইউরোপের গণচেতনার সৃষ্টি করে।
এ সকল উপদেশাবলী প্রাচীন সমাজব্যবস্থা ভেঙ্গে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ার প্রেরণা যোগায়। মুদ্রণযন্ত্র
আবিষ্কারের ফলে তাদের লেখনী দ্রুত ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে এবং নবজাগরণকে তরান্বিত করে।
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ (১০৯৫-১২৯১ খ্রীস্টাব্ধ) ইউরোপের নবজাগরণ ও অগ্রগতিতে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের
গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। একাদশ শতাব্দীর শেষভাগ হতে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলমানদের নিকট
থেকে যীশু খ্রীস্টের জন্মভ‚মি জেরুজালেম উদ্ধার করার জন্য ইউরোপের খ্রীস্টানগণ প্রাচ্যের
মুসলমানদের সঙ্গে যে ভয়াবহ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল ইতিহাসে তাই ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ নামে পরিচিত।
প্রকৃতপক্ষে এ যুদ্ধ ছিল আফ্রো-এশিয়ার মুসলিম ও ইউরোপের খ্রীস্টানদের মধ্যে বিদ্যমান দীর্ঘকালের
ইউরোপের নবজাগরণ ও
অগ্রগতিতে ক্রুসেড বা
ধর্মযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ
অবদান ছিল।
ঘৃণা-বিদ্ধেষ ও দ্ব›দ্ব কলহের বহি:প্রকাশ মাত্র। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি নানাবিধ
স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে এ নৃশংস ক্রুসেড সংঘঠিত হয়েছিল। মধ্যযুগের ইতিহাসে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের
মধ্যে অনুষ্ঠিত যে কোন যুদ্ধ অপেক্ষা এটা ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। ইউরোপের নবজাগরণ ও
অগ্রগতিতে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল।
প্রায় দু’শতাব্দী ধরে মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মযুদ্ধের ফলে তাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান
হয়েছিল। এই ধর্মযুদ্ধ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিল। শিক্ষা,
সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রেও ক্রুসেডের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। ঐতিহাসিক টয়েনবি
যথার্থই বলেছেন,
ধর্মযুদ্ধের ফলেই আধুনিক ইউরোপ জন্মলাভ করেছে।
ধর্মযুদ্ধের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রভ‚ত উন্নতি সাধিত হয়েছিল। নতুন নতুন
জলপথ আবিষ্কৃত হয় এবং নৌপথে বাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। খ্রিস্টান-মুসলমানদের শিক্ষা উন্নত কৃষিপদ্ধতি
এবং শিল্পজীবনের সঙ্গে পরিচয় লাভ করে। তারা মুসলমানদের মার্জিত রুচিজ্ঞান, উন্নততর ভাবধারা ও
উদার সহানুভুতি নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে। মানুষের চিন্তাধারা প্রশস্ত হলে সমাজে সামন্ত রাজা,
খ্রীস্টান ধর্মযাজক ও পোপের ক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পায়। এর ফলে ইউরোপে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব
ঘটে। এভাবেই রেনেসাঁ এবং পরে নব্য ইউরোপের জন্ম হয়েছিল।
কনস্টান্টিনেপেলের পতন: ১৪৫৩ খ্রিস্টাব্ধে তুর্কীদের হাতে কনস্টান্টিনোপলের পতন ইউরোপের
নবজাগরণের পথ উন্মুক্ত করে দেয়। গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষার বহুপন্ডিত ও বুদ্ধিজীবী ইতালির বিভিন্ন
নগর রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেখানে তারা গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষা
প্রসারকল্পে আত্মনিয়োগ করেন। তাদের সান্নিধ্যে এসে ইউরোপীয়গণ নতুন নতুন ভাবধারায়
অনুপ্রাণিত হন। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার মধ্যদিয়ে এ সকল চিন্তাবিদগণ মানব মুক্তির পথ
নির্দেশ প্রদান করেন এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সূচনা করেন। এর ফলে ইতালীতে সর্বাগ্রে রেনেসাঁর
উন্মেষ ঘটে।
রেনেসাঁর ফলাফল:
ইউরোপের ইতিহাসে রেনেসাঁর ফল ছিল সুদূর প্রসারী। রেনেসাঁ মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক
অবিস্মরণীয় ঘটনা। রেনেসাঁ ইউরোপে বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধন করে। সামাজিক, রাজনৈতিক,
অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে রেনেসাঁ এক নতুন ভাবধারায় অনুপ্রাণিত করেছিল। চিন্তার জগতে রেনেসাঁ
আমূল পরিবর্তন সাধিত করে। এই চিন্তাধারা একদিকে যেমন প্রাচীন কৃষ্টি ও সভ্যতার উদ্ধার সাধন
করে অন্যদিকে নতুন নতুন আবিষ্কার ও বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। জ্ঞানবিজ্ঞানের পুনরুজ্জীবনে তাদেরকে নতুন নতুন দেশ, জলপথ ও স্থল পথ আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ করে।
মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির ভুমিকা ছিল গৌণ। রেনেসাঁর পরবর্তী সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তি প্রধান
ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়। এ আন্দোলনের ফলে মানুষ যুক্তিবাদের দিকে ঝুকে পড়ে। ফলে
ব্যক্তিস্বাত্যন্ত্রবাদের জন্ম নেয়। ব্যক্তির ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা সামাজিক চিন্তা-চেতনার অবিচ্ছেদ্য
অংশ হিসেবে পরিগণিত হল। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে ধর্মযাজকদের কর্তৃত্বের অবসান
হয়।
ঊাস্তবিক পক্ষে রেনেসাঁ সমাজ জীবনে এক সম্ভাবনাময় নবদিগন্তের সূচনা করে। শিক্ষার গুরুত্ব বহুগুণে
বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন বিদ্যাপীঠ গড়ে ওঠে। রেনেসাঁর ফলে মানুষের মনে ধর্মনিরপেক্ষ সুন্দর
জীবন ও নতুন সমাজ কাঠামো গড়ে তোলার ইচ্ছা জাগ্রত হয়। মানবতাবাদীগণ গোড়া খ্রিস্টানদের
বিরুদ্ধে প্রগতিশীল মতবাদ দ্বারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে যাজকদের প্রভাবমুক্ত করে। সবার উপরে
মানুষ সত্য এ নীতিতে তারা বিশ্বাসী ছিল। মানুষ হারানো সত্যকে ফিরে পেল। ধর্মীয় বন্ধন অতিক্রম
করে স্বাধীন চিন্তাধারায় শিল্প-সাহিত্য ও চিত্র অংকন শুরু হয়। সাহিত্য ও ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব বেড়ে
যায়। রেনেসাঁ ইউরোপীয় ছিন্ন ঐক্য পুনরুদ্ধার করে এবং জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটাতে থাকে।
সারকথা:
রেনেসাঁ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক অবি স্মরণীয় ঘটনা। মধ্যযুগ থেকে আধুনিককালে যুগ
পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণটি ইউরোপীয় ইতিহাসে রেনেসাঁ নামে পরিচিত। এই রেনেসাঁর মূলে আরবীয়
মুসলমানদের প্রচুর অবদান ছিল। রেনেসাঁ ইউরোপের সামাজিক, রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও ধর্মীয়
ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক রূপান্তর সাধন করে। রেনেসাঁর ফলে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে।
রেনের্সা ইউরোপে
বৈপ্লবিক রূপান্তর
সাধন করে
সঠিক উত্তরটি লিখুন।
১. ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূলে প্রচুর অবদান ছিল
ক. হিন্দুদের
খ. মুসলমানদের
গ. ইহুদীদের
ঘ. খ্রিস্টানদের।
২. রেনেসাঁর শ্রেষ্ঠ বিকাশ ঘটে
ক. ইতালিতে
খ. গ্রীসে
গ. ফ্রান্সে
ঘ. ব্রিটেনে।
৩. ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘঠিত হয়েছিল
ক. দু’শতাব্দী ধরে
খ. তিন শতাব্দী
গ. পাঁচ শতাব্দী
ঘ. এক শতাব্দী ধরে।
৪. কনস্টান্টিনেপলের পতন হয়েছিল
ক. ফরাসিদের হাতে
খ. ব্রিটিশদের হতে
গ. আরববাসীদের হাতে
ঘ. তুর্কীদের হাতে।
সংক্ষিপ্ত উত্তর মূলক প্রশ্ন
১. রেনেসাঁ কি ব্যাখ্যা করুন।
২. ক্রুসেড বা ধর্মযুক্ত কি ?
রচনামূলক প্রশ্ন
১. রেনেসাঁর কারণসমূহ আলোচনা করুন।
২. রেনেসাঁ কিভাবে ইউরোপে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে?
উত্তরমালা: ১ খ, ২ ক, ৩ ক ৪ ঘ ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত