গ্রামসীর মতানুসারে জৈব বুদ্ধিজীবী ও প্রথাগত বুদ্ধিজীবীর মধ্যে পার্থক্য কি? সংক্ষেপে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা

বুদ্ধিজীবী কারা?
বুদ্ধিজীবী শব্দটি ইংরেজি শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু ব্রিটিশ
আমলে বুদ্ধিজীবী বলতে বাংলাদেশে আইনজীবীদের বুঝানো হতো। একারণে বিনয় ঘোষ
শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ করেছেন ‘বিদ্ব্যৎ সমাজ’। তবে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি
শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবেই ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
প্রথমেই প্রশ্ন উঠে, বুদ্ধিজীবীদের শ্রেণীগত অবস্থান কি? সমাজবিজ্ঞানী ম্যানহেইম মনে করেন
বুদ্ধিজীবীরা নিজেরা কোন শ্রেণী নয়, বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বুদ্ধিজীবীরা অবস্থান করেন। গোল্ডনারের
মত হল, বুদ্ধিজীবীরা নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র শ্রেণী। আবার মার্কসবাদীরা বুদ্ধিজীবীদের সমাজের
মধ্যস্তরের সাথে অধিক পরিমাণে সংযুক্ত বলে মনে করেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়ার পন্ডিতমহল কর্তৃক বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত হয়।
‘বুদ্ধিজীবী’ বা ' শব্দটি সর্বপ্রথম তারাই ব্যবহার করেন। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের
কতিপয় বিশেষ গুণ ও সামাজিক মর্যাদা বিবেচনা করে তাদের বিশেষ সামাজিক অবস্থান মেনে নেয়া
হয়। তখন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পাশাপাশি পাশ্চাত্য সং¯কৃতি অনুকরণ করার উপর অত্যধিক
গুরুত্ব আরোপ করতেন।
অধুনা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বলতে কায়িক শ্রমের সাথে যুক্ত নয় এমন ব্যক্তিদের বুঝানো হয়। কিন্তু এ
ধারণাকে অনেকেই যথেষ্ট সংকীর্ণ বলে মনে করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, যারা বুদ্ধিবৃত্তি
লালিত ও বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষ বিধানে ন্যস্ত তারাই বুদ্ধিজীবী হওয়ার দাবি রাখে। তাদের ধারণা
অনুসারে কবি, সাহিত্যিক, শিল্প ও দার্শনিকবৃন্দ সকলেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। বুদ্ধিজীবী
সম্প্রদায়ের সাধারণ চরিত্র নিয়ে আলোচনা করে র‌্যামন্ড অ্যারণ (জধুসড়হফ অৎড়হ) দেখিয়েছেন যে,
যেভাবেই হোক না কেন বুদ্ধিজীবীরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তিকে কাজে লাগায় এবং সামাজিক জীবনবোধের
মোটামুটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রদান করে। তার ভাষায়, ‘বুদ্ধিজীবীরা হল ধারণার সৃজনকারী ও
বিজ্ঞানের আবিষ্কারক’।
বৃদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের পরিচয় প্রদানে আরো অনেক ধারণা রয়েছে। মিশেল্স-এর মতে, ‘বুদ্ধিজীবী
তারাই যারা পেশাগতভাবে নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা ও মননের মাধ্যমে যে কোন ধরনের বিষয় সম্পর্কে
বিচার বিশে ষণ করতে সক্ষম’। এডওয়ার্ড শিলস্ লিখছেন, ‘বুদ্ধিজীবী তারাই যাদের উন্নত আধুনিক -
শিক্ষা রয়েছে এবং সেইসাথে রয়েছে বুদ্ধিজীবী চেতনা ও দক্ষতা। সমাজবিজ্ঞানী কার্ল ম্যানহেইমের
মতে, ‘প্রত্যেক সমাজে নানা গোষ্ঠীভ‚ক্ত এমন কিছু লোক থাকেন যাদের কাজ হলো সেই সমাজের
জীবন-দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গী রচনা করা ও ব্যাখ্যা করা। যারা সমাজের এই জীবন-দর্শন রচনা ও ব্যাখ্যা করেন, তারাই বিদ্ব্যৎ সমাজের অন্তর্ভূক্ত হবার যোগ্য−তারাই প্রকৃত বিদ্ব্যৎজন।’
যাদের উন্নত আধুনিক শিক্ষা রয়েছে এবং সেই সঙ্গে রয়েছে বুদ্দিবৃত্তিক দক্ষতা তারাই বুদ্ধিজীবী।
সমাজবিজ্ঞানীদের এসকল বক্তব্য পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, যিনি অবশ্যই বিদ্যা চর্চা করেন, যিনি
সুদক্ষ ও সৃজনশীল, মানসিক সংগ্রামে রত থাকেন, আদর্শগত সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন
এবং সর্বোপরি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তা প্রয়োগ করেন তিনিই বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য হবেন।
বুদ্ধিজীবীদের বিভাজন
ইতালীয় দার্শনিক এন্থনী গ্রামসী বুদ্ধিজীবীদের প্রধানত: দুইভাগে বিভক্ত করেছেন: জৈব বুদ্ধিজীবী ও
প্রথাগত বুদ্ধিজীবী। গ্রামসীর মতে, নতুন সমাজ বিকাশের সাথে সাথেই জৈব বুদ্ধিজীবীদের বিকাশ
ঘটে। যেমন, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা তথা আন্তারপ্রেনিয়ার (বিনিয়োগকারী) শ্রেণীর
বিকাশের সাথে সাথেই জন্ম নেয় শিল্প প্রযুক্তিবিদ, অর্থনীতি-বিশেষজ্ঞ, বাজার-ব্যবস্থাপক, সাং¯কৃতিক
সংগঠক ও আইনবিদ। এই বুদ্ধিজীবীরা নতুন সমাজে নিজেদের পরিচয় ও ভ‚মিকা স্পষ্ঠ করে তোলে
এবং নিজ সমাজের পক্ষে অনুক‚ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। অপরদিকে, প্রথাগত বুদ্ধিজীবীরা কোন বিশেষ
শ্রেণীর বিকাশ অবলম্বন করে আবিভর্‚ত হয়নি। এরা মূলত, প্রাচীন সমাজ ও ঐতিহাসিক পরষ্পরার
প্রতিভ‚। পুরোহিত শ্রেণী প্রথাগত বুদ্ধিজীবীর পর্যায়ভ‚ক্ত। এরা ধর্মীয় মতাদর্শ, প্রাচীন যুগের দর্শন ও
বিজ্ঞান এবং তার সাথে শিক্ষা, নীতিজ্ঞান, বিচার ব্যবস্থা, দয়াধর্ম, সদাচার−এসবের চর্চা ও বিকাশ
ঘটিয়েছেন।
গ্রামসীর জৈব ও প্রথাগত বুদ্ধিজীবীর এই বিভাজন ছাড়াও বুদ্ধিজীবীদের গ্রামীণ ও নাগরিক এবং
প্রতিষ্ঠানিক ও অপ্রতিষ্ঠানিক−এইভাবেও বিভাজিত করা যায়। সাধারণত: ধর্মীয় নেতা, শিক্ষক, গ্রাম্য
ডাক্তারএদেরকে গ্রামীণ বুদ্ধিজীবী এবং প্রযুক্তিবিদ, ব্যবস্থাপক, আইনবিদ, সাংবাদিকএদেরকে নাগরিক
বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য করা হয়।
এছাড়া, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মে নিয়োজিত থাকে তাদেরকে বলা হয়
প্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী। আর যারা প্রতিষ্ঠানিক কর্তৃত্বের আওতার বাইরে থেকে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে
নিয়োজিত থাকে তাদেরকে বলা হয় অপ্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী। অèান দত্ত এদেরকে ’চিন্তক’ নামে
অভিহিত করেছেন। সাধারণত- অধ্যাপক, আইনবিদ, সাংবাদিক, গবেষক−এরা প্রাতিষ্ঠানিক
বুদ্ধিজীবীর পর্যায়ভুক্ত এবং কবি, সাহিত্যিক, শিল্প, দার্শনিক-এরা অপ্রাতিষ্ঠানিক বুদ্ধিজীবী হিসেবে
স্বীকৃত।
উন্নয়নশীল দেশসমূহে বুদ্ধিজীবীদের পেশাগত অবস্থান
উন্নয়নশীল দেশসমূহে ( এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা) বুদ্ধিজীবীরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত
থাকেন। এসকল পেশার মধ্যে রয়েছে সিভিল সার্ভিস, আইন ব্যবসা, শিক্ষকতা, চিকিৎসা,
সাংবাদিকতা, প্রকৌশল, স্থাপত্য কলা প্রভৃতি। এসকল পেশাতেই প্রধানত: বুদ্ধিজীবীদের থাকতে
দেখা যায় এবং এই প্রতিটি পেশার জন্যই বুদ্ধিবাদী দক্ষতা প্রয়োজন হয়। এ ছাড়াও উন্নয়নশীল
দেশগুলোতে প্রযুক্তিবিদ, শিল্প রসায়নবিদ, পরিসংখ্যানবিদ, হিসাবরক্ষক, পদার্থবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী,
প্রজননতত্ত¡বিদ, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণী ক্ষুদ্র হলেও তাদেরকে এ শ্রেণী থেকে
কিছুতেই বাদ দেয়া যায় না। এরা সকলেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। এই শেষোক্ত পেশাগুলোতে
নিয়োজিত বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা উপনিবেশিক যুগে যেমন স্বল্প ছিল, বর্তমানেও অনেকটা সেই
অবস্থায়ই রয়েছে। তবে সময়ের বিবর্তনে এদের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।
বিশ্বে উন্নত দেশসমূহে ছাত্র সম্প্রদায়কে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর পর্যায়ভুক্ত করা
হয় না। কিন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছাত্র সম্প্রদায়কে এই পর্যায়ে ফেলা হয়। বিশেষ করে
স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে ছাত্রদেরকে বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর অংশ বলে বিবেচনা করা হতো। কেননা, স্বাধীনতাআন্দোলনে তারা সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হতো। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সং®কৃতির সংস্পর্শে
এসে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটতো এবং বুদ্ধিবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতো। ছাত্র সম্প্রদায় মূলত দু’টো কারণে জনগণের আনুক‚ল্যও লাভ করতো। বুদ্ধিজীবীদের গ্রামীণ ও নাগরিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিক্ষানিক এইভাবে বিভক্ত করা যায়।
প্রথমত: , তারা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতো।
দ্বিতীয়ত:, তারা বিদেশী শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চালিয়ে যাবার মন্ত্রে দীক্ষিত হতো।
বুদ্ধিজীবিদের ভ‚মিকা
সামাজিক অগ্রগতি এবং আধুনিকায়নে বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে বুদ্ধিজীবীদের
সামাজিক পরিবর্তন ও আধুনিকায়নের বাহন হিসেবে অভিহিত করা হয়। মূলত: বুদ্ধিজীবীরা সমাজের
এমন একটি অগ্রসর অংশ, যারা অন্যদেরকে পথ দেখায় এবং পরিবর্তনের রূপরেখা প্রণয়ন করে।
একারণে বুদ্ধিজীবীদের সমাজ প্রগতির পথিকৃত বলা হয়।
এখন আমরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা তুলে ধরবো:
বিজ্ঞান ও প্রযুিক্ত গবেষণার মাধ্যমে বুদ্ধিজীবীরা উৎপাদনের নতুন ও আধুনিক উপকরণ সৃষ্টি করে।
এর ফলে পুরনো বা সনাতন উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে গিয়ে নতুন উৎপাদন ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। নতুন
উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে জন্ম নেয় নতুন নতুন শ্রেণী। ফলে জীবন ব্যবস্থায় সূচিত হয় পরিবর্তন।
বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন-যাপনে মানুষ অভ্যন্ত হয়ে উঠে। অর্থাৎ বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডের ফলেই
উৎপাদন ক্ষেত্রে পরিমাণগত ও গুণগত পরিবর্তন ঘটে। একারণে বস্তুগত সুবিধা সম্প্রসারিত হয়,
উন্নত হয় সমাজ ও ব্যক্তি-জীবন।
বুদ্ধিজীবীরা শুধু উৎপাদন ক্ষেত্রেই পরিবর্তন ঘটায় না, দৃষ্টিভঙ্গীতেও পরিবর্তন আনে। বুদ্ধিবৃত্তিক
আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পুরনো মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে ওঠে।
ইউরোপের রেঁনেসা আন্দোলন বুদ্ধিজীবীদের দ্বারাই সংগঠিত হয়েছিল। এর ফলে বিজ্ঞান মন¯কতা ও
ইহজাগতিক দৃষ্টিভঙ্গী প্রসারিত হয়েছিল। বেঁকন, কোপার্নিকাস, লিউনার্ডো দ্য ভিঞ্চি প্রমুখ বুদ্ধিজীবী
তাদের আবি¯কার ও উদ্ভাবন এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। সামাজিক
জাগরণ তথা আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছিল সে সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের ফলেই।
রাজনৈতিক আদর্শ গড়ে তোলা ও প্রগতিশীল আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা
সবচেয়ে বেশি। জাতীয়তাবাদ, উদারতাবাদ, গণতন্ত্র এসকল ধারণা বুদ্ধিজীবীদেরই চিন্তার ফসল।
মাৎজিনি, স্টুয়ার্ট মিল, লিংকন প্রমুখ চিন্তাশীল ব্যক্তিরাই এসকল রাজনৈতিক দর্শনের রূপকার। শুধু
রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রেই নয়, ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব−ইতিহাসের এসকল মহান পরিবর্তনও
ঘটেছে বুদ্ধিজীবীদের কারণেই। রুশো, ভল্টেয়ার ফরাসি বিপ্লবের এবং পে খানভ রুশ বিপ্লবের -
দার্শনিক ভিত্তি সৃষ্টি করেছিলেন। কাজেই, রাজৈেনতিক আদর্শবাদ ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন বুদ্ধিজীবীদের
চিন্তা ও ভ‚মিকার কারণেই বাস্তব রূপ লাভ করে।
বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ও সৃজনশীল কর্মকান্ডের ফলে মানবিক অনুভ‚তি এবং নৈতিক বোধ গড়ে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়, জোলিও কুরি, বারট্রান্ড রাসেল, জ্যঁ-পল সার্ত্র, নোয়াম চম¯কী প্রমুখ চিন্তাশীল
বুদ্ধিজীবীর লেখনি মানুষের সামাজিক ও নৈতিক চেতনা বৃদ্ধি করেছে নি:সন্দেহে।
জাতীয় সং¯কৃতির পরিচয় গঠনের ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন। তাঁরা একটি নিজস্ব
জাতীয় সং¯কৃতির পরিচয় গঠন করেন। জাতীয় সুনাম গঠন করার জন্য তাঁরা ক্রমান্বয়ে নিজস্ব
সাং¯কৃতিক সম্পদসমূহ আবি¯কার করেন এবং একে জনমনের মধ্যে জাতীয় সচেতনতা বৃদ্ধির
মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।
জাতীয় আদর্শ চিহিৃত করতে না পারলে জাতীয় উন্নয়ন স¤ভব নয়। বুদ্ধিজীবীরা একটি আদর্শ
প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে পারেন।
দ্রুত সামাজিক রূপান্তরের প্রেক্ষিতে এ ধরণের জাতীয় আদর্শের প্রতিষ্ঠা একান্তভাবে কাম্য।
উপনিবেশগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করা তথা বিদেশী শাসকদের বিতারিত করার ক্ষেত্রে
বুদ্ধিজীবীরা অগ্রগামী ভ‚মিকা পালন করেছে। পাশ্চাত্য-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণীই এশিয়া ও আফ্রিকায়
জনগণকে সংগঠিত করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের নেতৃত্বের কারণেই দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে অনেকগুলো নতুন রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটে।
বুদ্ধিজীবীরা জাতি-গঠন ও রাষ্ট্র গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ও সৃষ্টির
প্রভাবে সংকীর্ণ গোষ্ঠীগত ও আঞ্চলিক চেতনা পরিবর্তিত হয়ে বৃহত্তর জাতীয় চেতনা গড়ে ওঠে। এর
ফলে রাষ্ট্রীয় সংহতি সুদৃঢ় হয়।
বুদ্ধিজীবীদের কর্মকান্ডের ফলে সামাজিক চেতনা বৃদ্ধি পায়। ফলে সামাজিক গতিশীলতা ও
রাজনৈতিক অংশগ্রহণের হারও বেড়ে যায়−যা রাজনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সহায়তা করে।
বুদ্ধিজীবীরা জাতীয় উন্নয়নের পথ-নির্দেশ করে এবং উন্নয়ন-প্রক্রিয়ার উপাদান হিসেবে পরিকল্পনা
প্রণয়ন ও সহায়ক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে। এছাড়া, বুদ্ধিজীবীদের প্রণোদনা, ট্রেনিং ইত্যাদির মাধ্যমে
জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়া গতি লাভ করতে পারে।
উন্নত ও উন্নয়নশীল−সকল ধরণের সমাজ ও রাষ্ট্রেই বুদ্ধিজীবীদের কর্মকান্ড যত বেশি সেই সমাজই
তত আধুনিক ও উন্নত। কেননা, বুদ্ধিজীবীদের মেধা ও মননই আধুনিকতা ও উন্নয়নের মূল শক্তি।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা
বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী শ্রেণী গড়ে উঠে ব্রিটিশ আমলে। তখন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে
বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ধর্ম সংস্কার ও শিক্ষা প্রসারে সে সময়ে
বুদ্ধিজীবীরা গুরত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। ব্রিটিশ শাসন বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছেন। এ কারণেই গোখলে বলেছিলেন ‘বাংলা
আজকে যা ভাবে, ভারত তার পরদিন তাই ভাবে।’ অর্থাৎ চেতনার দিক দিয়ে বাংলার বুদ্ধিজীবীরা ছিল
ভারত বর্ষের পথ-প্রদর্শক। রাজনৈতিক আন্দোলনেও বাংলার বুদ্ধিজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ লক্ষ্য
করা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশের আইনজীবীগণ, যেমন, সিআর.দাস, পি.আর.দাস, শেরে বাংলা
প্রমুখের রাজনৈতিক ভ‚মিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পাকিস্তান আন্দোলনেও বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় ভ‚মিকা লক্ষ্য করা যায়। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাসিম
প্রমুখ বুদ্ধিজীবী হিসেবেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। এ ছাড়া শিক্ষিত মুসলমানদের যে অংশে বুদ্ধি
বৃত্তিক পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, তারা পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজবিী সমাজ ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে
স্বাধীকার আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশের জনগণের অধিকার
প্রতিষ্ঠা, ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত প্রতিহত করা এবং জনগণকে সচেতন করে রাজনৈতিক
আন্দোলনে যুক্ত করার ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সে সময়ে সাহিত্য, চলচিত্র,
সাংবাদিকতা-প্রতিটি ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা ও সৃষ্টির প্রভাবে সাধারণ মানুষ উদ্বিপ্ত হয়েছে।
বুদ্ধিজীবীরা শুধু চিন্তা ও সৃষ্টির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, স্বাধীনতা সংগ্রামকে সংগঠিত করা এবং
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছেন। আন্তর্জাতিক জনমত গঠন
থেকে শুরু করে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ পর্যন্ত প্রসারিত ছিল বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা। বর্তমানেও
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা অন্যায়, অবিচার ও অপশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার।
সারকথা:
বুদ্ধিজীবী বলতে কায়িক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমন ব্যক্তিদের বুঝানো হয়। সাধারণত: কবি,
সাহিত্যিক, শিল্পি, দার্শনিক, সাংবাগিক, আইনজীবী, অধ্যাপক ইত্যাদি পরিচয়ে যারা মানসিক বা
বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মে নিযুক্ত থাকেন, তারাই মূলত: বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীরা সামাজিক পরিবর্তনে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেন। কেননা, সৃষ্টিশীল কর্ম ও অগ্রসর চিন্তার মাধ্যমে তারাই পরিবর্তনের
রূপরেখা প্রণয়ন করে থাকেন। একারণেই উন্নত ও অনুন্নত সকল সমাজেই বুদ্ধিজীবীদের সমাজ বিকাশের ইঞ্জিন হিসেবে গণ্য করা হয়।
নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন :
সঠিক উত্তরটি লিখুন।
১. কোন্ সমাজবিজ্ঞানীর মতে বুদ্ধিজীবীরা নিজেরাই একটি স্বতন্ত্র শ্রেণী?
ক. ম্যানহেইম
খ. র‌্যামন্ড অ্যারণ
গ. গোল্ডনার
ঘ. ম্যাক্স ওয়েবার।
২. মার্কসবাদীরা বুদ্ধিজীবীদের সমাজের কোন্ স্তরের সাথে অধিক পরিমাণে সংযুক্ত বলে মনে করেন?
ক. উচ্চ শ্রেণী
খ. মধ্য শ্রেণী
গ. নি¤œ শ্রেণী
ঘ. উপরের কোনটিই নয়।
৩. উনবিংশ শতাব্দীতে কোন দেশের পন্ডিত মহল বুদ্ধিজীবীদের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন?
ক. স্পেনের
খ. ফ্রান্সের
গ. জার্মানীর
ঘ. রাশিয়ার।
সংক্ষিপ্ত উত্তরমূলক প্রশ্ন :
১। বুদ্ধিজীবী বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়?
২। গ্রামসীর মতানুসারে জৈব বুদ্ধিজীবী ও প্রথাগত বুদ্ধিজীবীর মধ্যে পার্থক্য কি?
৩। সংক্ষেপে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা আলোচনা করুন।
রচনামূলক প্রশ্ন :
১. সামাজিক পরিবর্তন ও আধুনিকায়নে বুদ্ধিজীবীদের ভ‚মিকা মূল্যায়ন করুন।
উত্তরমালা: ১. গ, ২. খ, ৩. ঘ.

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]