বাংলাদেশের সংবিধানের সংশোধন পদ্ধতি আলোচনা কর। (Describe the Amendments Procedure of Bangladesh Consititution.)

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের সংশোধনীসমূহ (১৯৭২-৭৫)
Amendments on Constitution of 1972 (1972-75)
১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর থেকে বলব ও কার্যকরি হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ সংবিধানে বেশকিছু সংশোধনী আনয়ন করা হয়েছে। মূলত, বিভিন্ন সময়ে, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রয়োজনী আনয়ন করা হয়েCW আমরা এখানে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বাংলাদেশ नान যেসব সংশোধনী আনীত হয়েছে সেগুলোই কেব বর্ণনা করব। প্রকাশ থাকে যে, এ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৪টি সংশোধনী আনয়ন করা হয়। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে সেগুলো আলোচনা করা হলো :
প্রথম সংশোধনী-১৫ জুলাই, ১৯৭৩ (Ist Amendment 15th July, 1973)
জাতীয় সংসদ (পার্লামেন্ট) ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আইন প্রণয়ন ও বিধিবদ্ধ করে। সংশোধনীর বলে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানের ৪৭নং অনুচ্ছেদের পরিবর্তন ও পরিবর্তন করে। ৪৭-ক নামে একটি নতুন অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করা হয়। এতে বলা হয় যে, কোনো প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনী অথবা কোনো সহায়ক হীর সদস্য, কোনো যুদ্ধবন্দী বা গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ কিংবা আন্তর্জাতিক আইনের বিধান মোতাবেক অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির আটক, ফৌজদারি বিচারে সোপর্দকরণ বা শাস্তিদানের বিধান করে এমন কোনো আইন সংবিধানে যেকোনো বিধান থাকা সত্ত্বেও বৈধ থাকবে। অর্থাৎ সংবিধানের কোনো বিধানের সাথে অসামঞ্জস্য হবার কারণে এরূপ আইন অবৈধ বলে গণ্য হবে না।
৪৭-ক ধারায় আরও বলা হয় যে, এ আইন যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে, তার বা তাদের বেলায় সংবিধানে উল্লিখিত মৌলিক অধিকার প্রযোজ্য হবে না। এমনকি কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ সংবিধানের অধীনে কোনো প্রতিকার লাভের আশায় সুপ্রিম কোর্টের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে না।
উল্লেখ্য যে, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ জুলাইয়ের এ সংশোধনীর ফলে বাংলাদেশের যুদ্ধপরাধী ও গণহত্যার অভিযোগে বন্দীদের বিচারের পথ সুগম হয়। এর ফলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে আর কোনো আইনগত বাধা রইল না।
দ্বিতীয় সংশোধনী-২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ (2nd Amendment - 20 September, 1973 )
জাতীয় সংসদ (পার্লামেন্ট) ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী আইন প্রণয়ন ও বিধিবদ্ধ করে। এ সংশোধনী বলে সংবিধানের ৩৩নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত জরুরি বিধানাবলির ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিবর্তন সাধন করে অনেকগুলো বিধান সংযোজন করা হয়।
এ সংশোধনীতে বলা হয় যে, যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ অথবা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা-এর যেকোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা (Proclamation of Emergency) করতে পারবেন। তবে এ ধরনের ঘোষণাকে বৈধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি স্বাক্ষরের প্রয়োজন হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা পরবর্তী কোনো ঘোষণার দ্বারা প্রত্যাহার করা যাবে বা জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত করা হবে নতুবা ১২০ দিন পার হয়ে যাবার পূর্বে সংসদের প্রস্তাব দ্বারা অনুমোদিত না হলে তা কার্যকর হবে না। জরুরি অবস্থা চলাকালে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights of the Citizens ) স্থগিত থাকবে।
এছাড়াও, এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ২৬নং অনুচ্ছেদের শেষে একটি নতুন দফা সংযোজন করা হয়, ৬৩নং অনুচ্ছেদের কিছু অংশ বাদ দেয়া হয় এবং ৭২নং অনুচ্ছেদের পরিবর্তন সাধন করা হয়।
তৃতীয় সংশোধনী—২৮ নভেম্বর, ১৯৭৪ (3rd Amendment - 28 November, 1974)
জাতীয় সংসদ (পার্লামেন্ট) ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৮ নভেম্বর সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী আইন প্রণয়ন ও বিধিবদ্ধ করে। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মে তারিখে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভূমি-সীমানা চিহ্নিতকরণ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তা কার্যকর করার জন্য সংবিধানে তৃতীয় সংশোধনী গৃহীত হয়।
চতুর্থ সংশোধনী ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ ( 4th Amendment - 25 January, 1975)
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর শাসনামলের সবচেয়ে সমালোচিত বিষয়। সংশোধনীটি গৃহীত হয় ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি। এ সংশোধনীতে সংবিধানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ফলে মন্ত্রিপরিষদ ও জাতীয় সংসদ ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। মূল সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারসংক্রান্ত সমস্ত অধিকার রক্ষা ও অধিকারসমূহ প্রয়োগের জন্য একটি সুপ্রিম সাংবিধানিক আদালত গঠনের বিধান করা হয়। তাছাড়া চতুর্থ সংশোধনীতে হাইকোর্ট কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারির বিধানও প্রত্যাহার করা হয়। চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক একক জাতীয় দল গঠনের ঘোষণা দেয়া এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করার বিধান প্রণীত হয় ।
এক নজরে সংশোধনীসমূহ
রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা বিধান
অনুযায়ী বেরুবাড়ী
১ম সংশোধনী, ১৯৭৩ যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য গণবিরোধীদের বিচারের বিধান মনোরঞ্জন ধর ১৫/০৭/১৯৭৩ আইনমন্ত্রী
২য় সংশোধনী, ১৯৭৩

২০/০৯/১৯৭৩ চুক্তি চুক্তি ভারতের নিকট ৩য় সংশোধনী, ১৯৭৪ হস্তান্তরের বিধান
০৮/১১/১৯৭৪ ৪র্থ সংশোধনী, ১৯৭৫ * সংসদীয় পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত পদ্ধতির প্রবর্তন।
২৫/০১/১৯৭৫

* বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন
১৯৭২-৭৫ সময়কালে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান প্রণয়ন করা।
সংবিধান বিষয়ে মওদুদ আহমদের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে :
'মাত্র এক বছরের মধ্যে সংবিধান প্রণয়নের জন্য আওয়ামী লীগকে প্রশংসা না করে পারা যায় না। এটি ছিল একটি ব্যাপক, সুলিখিত দলিল এবং এ উপমহাদেশের অন্যান্য সংবিধানের তুলনায় উন্নতমানের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব এবং দুর্বলতা থাকলেও এ সংবিধান জনগণের তৎকালীন আশা-আকাঙ্ক্ষা বহুলভাবে প্রতিফলিত করেছিল। সুদীর্ঘকালীন সংগ্রামে আওয়ামী লীগ জাতির সামনে যে অসংখ্য প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেছিল, এ সংবিধানের মাধ্যমে সেগুলোর এক বিরাট অংশের বাস্তবায়ন ঘটানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।'
বাংলাদেশের আইন প্রণয়ন ও অধ্যাদেশ
Formation of Laws and Oridinance of Bangladesh
বঙ্গবন্ধু সরকার বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করার জন্য সরকার গঠনের প্রথম এক বছরেই বেশকিছু আইন প্রণয়ন করে। পাশাপাশি বেশকিছু অধ্যাদেশও জারি করেন। উদাহরণস্বরূপ একটি আইন ও একটি অধ্যাদেশ-এর বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলো :
ক. পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলীকরণ আইন (Possessioning Act of Abandoned Property)
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হবার পর অসংখ্য অবাঙালি মালিকগণ দেশ ত্যাগ করলে তাদের সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দখল সংক্রান্ত এ আইনটি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৩ জানুয়ারি প্রণীত হয়। এটি ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির ১নং আদেশ (APO-১) নামে পরিচিত। এ আইনের বিষয়বস্তু-

যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিচালকমণ্ডলী অথবা ব্যবস্থাপকবৃন্দ কিংবা তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশ পরিত্যাগ করেছেন কিংবা প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য উপস্থিত নেই, সরকার সে সকল প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন;
এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার ভার এবং এগুলোর হিসাবরক্ষণের দায়িত্ব সরকার মনোনীত ব্যবস্থাপকমণ্ডলী অথবা প্রশাসকদের হাতে কিংবা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত থাকবে;
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত রাষ্ট্রপতির ১৬ নং আদেশ (PO ১৬)-এর মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তি শুধু দখল নয়; তার বিক্রয়ের অধিকারও সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়;
পরিত্যক্ত সম্পত্তির কাছে কোনো প্রতিষ্ঠানের ঋণ পাওনা থাকলে সে বিষয়ে সরকারের হিসাব চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে; PO ১৬-এর মাধ্যমে সরকার ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চের পর সম্পাদিত সম্পত্তির যেকোনো ইজারা বা চুক্তি অযোগ্য বলে বিবেচিত করতে পারবেন;
সরকারের হাতে কোনো পরিত্যক্ত সম্পত্তির দখলিযত্ব যাওয়ার পর আদালত এ ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারবে না;
সরকার ভুলক্রমে কোনো সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দখল করে থাকলে, ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের প্রতিকার বিধানের ব্যবস্থা PO ১৬ তে রাখা হয়।
PO ১৬-এর মাধ্যমে 'শুধুমাত্র পাকিস্তানিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির উপরই নয়, দেশের নাগরিকদের যেকোনো সম্পত্তি দখল করার ব্যাপারেও সরকারকে অনন্যসাধারণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়'।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের অব্যবহিত পূর্বে 'পাকিস্তানিরা ২৮৮.৬০ কোটি টাকা মূল্যের ৭২৫টি শিল্প ইউনিট পরিত্যক্ত রেখে পালিয়ে যান'। এগুলো বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পসমূহের মোট অংশের ৪৭% এবং বেসরকারি খাতের মোট শিল্পের ৭১%। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক, যেগুলো এ অঞ্চলের মোট ডিপোজিটের ৭০% নিয়ন্ত্রণ করতো'। আমলাতন্ত্রের দুর্বলতার সুযোগে কিছু সম্পত্তি লুটপাট হয়েছে, কিছু ক্ষেত্রে মালিক উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও কেবল অবাঙালি হওয়ার কারণে তার সম্পত্তি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সরকারি মালিকানায় বা ব্যক্তি নামে দখল করা হয়েছে। খ. বাংলাদেশ দালাল অধ্যাদেশ, ১৯৭২ (Bangladesh Dalal Ordinance, 1972) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুঃসহ নির্যাতন, গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটপাট, গৃহে অগ্নিসংযোগ এবং অন্যান্য দুষ্কর্মে সহযোগিতা করার জন্য রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে 'গণহত্যা তদন্ত কমিশন' গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতে বলা হয়, হাইকোর্টের কর্মরত কিংবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কিংবা সমপর্যায়ের মনোনীত কোনো ব্যক্তির নেতৃত্বে এ কমিশন গঠিত হবে, যার কাজ হবে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাদের সহযোগীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্তদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রণয়ন করা'। এভাবেই দালালদের বিচারের উদ্যোগের সূচনা ঘটে ।
বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরেই ঘোষণা করেছিলেন, 'বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে।' ১৮ জানুয়ারি (১৯৭২) প্রখ্যাত সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে (পরবর্তীতে স্যার) দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধপরাধী রাজাকার, আলবদরদের বিচার প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'আমি সবসময় ক্ষমা এবং ভুলে যাওয়ায় বিশ্বাস করি। এখন আমার পক্ষে অসম্ভব, কারণ এগুলো ঠাণ্ডা মাথায় এবং পরিকল্পিত ধরনের হত্যা, আমার মানুষের ওপর গণহত্যা। আপনি কি মনে করেন কোনো মানুষ এগুলো মেনে নিতে পারে? এ লোকগুলোকে শাস্তি দিতেই হবে । এ ব্যাপারে কোনো প্ৰশ্ন নেই।' তাই শাসনভার গ্রহণের ২ সপ্তাহের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৪.১.১৯৭২ তারিখে জারি করেন ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ, ১৯৭২।' এ আদেশ জারির প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে অধ্যাদেশের প্রস্তাবনায় উপস্থাপন করা হয়েছিল যে, কতিপয় ব্যক্তি অথবা কোনো সংগঠন বিশেষের সদস্যগণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর দালালরূপে গণহত্যা, নির্যাতন, নারী ও শিশু নিধন ও বাংলাদেশের জনগণের সম্পত্তি ও সম্মান হরণের জন্য পাক বাহিনীকে সাহায্য করেছেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা বাংলাদেশে একটি সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন এবং মানবতার বিরুদ্ধে তারা এমন জঘন্য অপরাধ করেছেন, যা বাংলাদেশের জনগণ এবং বিশ্ব বিবেকের কাছে জঘন্যতম । আইনে কোনো ব্যক্তিকে দালাল হিসেবে চিহ্নিত করার কারণগুলো যথাক্রমে নিম্নরূপ :
যারা বাংলাদেশে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীকে তাদের অবৈধ অবস্থানে সহায়তা, সমর্থন, সংরক্ষণ এবং জোরদার করণে সাহায্য করেছেন;
যারা তাদের প্রতিশ্রুতি, আকার-ইঙ্গিত বা আচরণের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে যেকোনোভাবে বৈষয়িক সহায়তা দিয়েছেন; যারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হয়েছেন অথবা যুদ্ধেরত হতে সহায়তা করেছেন:
যারা পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বাংলাদেশের জনগণের কোনো প্রচেষ্টা প্রতিহত কিংবা ধ্বংস করেছেন এবং যারা পাকহানাদার বাহিনীকে বাংলাদেশে তাদের অবৈধ অবস্থান সুদৃঢ়করণে সহায়তা করতে গিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছেন কিংবা দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে অপপ্রচার করেছেন কিংবা হানাদার বাহিনীর কোনো প্রতিনিধিদলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন বা বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পরিচালিত উপনির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
মূল আইনে অপরাধের সংখ্যা ৬০টি নির্ধারণ করা হয়েছিল। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসে প্রণীত সংশোধনীতে অপরাধের সঙ্গে জড়িত যেকোনো ব্যক্তিকে 'দালাল বলে যুক্তিসংগতভাবে সন্দেহ করা হলে যেকোনো পুলিশ অফিসার কিংবা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত যেকোনো ব্যক্তি তাকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতার করতে পারবেন।' এভাবে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ৬ মাস অন্তরীণ রাখা যেত। প্রথমে মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে বিচারের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পরে নির্দিষ্ট অপরাধের বিচার করার জন্য সেশন জজ বা অতিরিক্ত সেশন জজ, বা সহকারী সেশন জজ দ্বারা গঠিত এক সদস্যের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরবর্তীতে দালাল আইনের এক সংশোধনীবলে বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পলাতক দালালদের অনুপস্থিতিতেই বিচার পরিচালনার বিধান করা হয়। কোনো দালালের অপরাধ প্রমাণের জন্য আইনে সংশোধনী ১০ (ক) বিধান করা হয় : কোনো ময়নাতদন্ত রিপোর্ট, মেডিকেল রিপোর্ট কিংবা রাসায়নিক পরীক্ষার অন্য কোনো রিপোর্ট পাওয়া না গেলে, কিংবা পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ দায়ের করা না হলে, কিংবা তা বিলম্বে করা হলে, অথবা মৃতদেহের কোনো খোঁজ পাওয়া না গেলেও, কোনো অপরাধ প্রমাণের অযোগ্য বলে বিবেচিত করা হবে না। হানাদার বাহিনীকে সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত কোনো দলিল যথাযোগ্য প্রমাণ সহকারে আদালতে পেশ করা হলে এবং এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ উত্থাপন না করা হলে, সে সমস্ত দলিল গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত করা হয়। বিশেষ করে আলবদর, আলশামস বা রাজাকারবাহিনীর লোকদের বিচার করার সময়ে এ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করা হতো ।
দালাল আইনের আওতায় সারাদেশে ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাজা ছিল মৃত্যুদণ্ড থেকে শুরু করে কমপক্ষে ৩ বছরের কারাদণ্ড প্রদান । এ আইন সম্পর্কে মওদুদ আহমদের মূল্যায়ন-
*এ আইনের প্রতিটি বিধানই ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ এবং সে কারণে উচ্চতর আদালতগুলো অনেকগুলো ক্ষেত্রে দালাল আইনে গ্রেফতারকৃত ও অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিকে জামিন প্রদানে অস্বীকার করে। এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনের মতামত হলো, আইনের ১৪নং অনুচ্ছেদ বলে হাইকোর্ট দালাল আইনে অভিযুক্ত কাউকে জামিন প্রদান করতে পারে না। কারণ, আইনে বর্ণিত বিধানগুলো ছিল অত্যন্ত পরিষ্কার এবং অবিতর্কিত।'
মওদুদ আহমদ-এর হিসাবমতে দালাল আইনে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির আনুমানিক সংখ্যা ছিল ৫০ থেকে ৬০ হাজার এবং সমান সংখ্যক ব্যক্তি পলাতক ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। অন্য আরেক হিসেবে মতে ২৪.১.৭২ থেকে ৩০.১১.৭৩ পর্যন্ত ৩৭,৪৭১ জন দালালকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় ৭৫২ জন দালাল দণ্ডিত হয়।
দালালদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলে বঙ্গবন্ধু অভ্যন্তরীণ চাপের সম্মুখীন হন। অনেক মুক্তিযোদ্ধার আত্মীয় ছিল দালাল। যাদের মুক্তির জন্য প্রচণ্ড তদবির শুরু হয়। তাছাড়া পাকিস্তানে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ বাঙালি (১,৬০,০০০ সরকারি কর্মচারী, ৩৩,০০০ সেনাবাহিনীর সদস্য) আটকা পড়েছিল, তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রচণ্ড চাপ। এমনি পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ৩০.১১.৭৩ তারিখে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন যে, ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, অগ্নিসংযোগের দায়ে দণ্ডিত অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমা প্রযোজ্য হবে না। ক্ষমা ঘোষণার পর গ্রেফতারকৃত ৩৭,০০০ ব্যক্তির মধ্যে ২৬,০০০ মুক্তি পেলেও ১১,০০০ ব্যক্তি নির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]