যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসন কার্যক্রম আলোচনা কর। ( Discuss the Rehabilitation Activities of War-ravaged Bangladesh.)

যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন Reconstruction of the War-Ravaged Country ভূমিকা Introduction
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস সময়ে বাংলাদেশে যেভাবে গণহত্যা, নারী নির্যাতন আর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় তা ইতিহাসে বিরল। বিশ্বের ইতিহাসে এমন বর্বরতা কোনো দেশে কোনো সময় দেখা যায়নি। এ বিধ্বস্ততার বিবরণ এখানে সংক্ষেপে উপস্থাপিত হলো। বঙ্গবন্ধুর শাসনভার গ্রহণের সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে ঘোষিত স্বাধীনতার সনদ। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম যে কাজটি করেন তাহলো- ১১.০১.৭২ তারিখে 'অস্থায়ী সংবিধান আদেশ' জারির মাধ্যমে দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন ।
বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন ছিল একটি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার। সেই লক্ষ্যে অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারির পর ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রধান বিচারপতির কাছে প্রথমে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং পদত্যাগ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শাসনামল বা ‘বঙ্গবন্ধুর শাসনামল’ এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হলে ঐ শাসনামলের অবসান ঘটে। সুতরাং, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামল মাত্র ৩ বছর ৭ মাস ৩ দিন স্থায়ী ছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ততা
War Ravaged Situation of Independent Bangladesh
ত্রিশ লাখ বাঙালির শহিদি বুকের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের কঠিন মূল্যে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বুকে নেমেই বঙ্গবন্ধু দেখলেন-এর যুদ্ধবিধ্বস্ততা, যেখানে তাকান সেখানেই ধ্বংস আর ধ্বংস। আর এ ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়েই নির্মাণ করতে হবে রাষ্ট্রীয় সমৃদ্ধির সিঁড়ি-উপসিঁড়ি। সরকারি পরিকল্পনা প্রণয়নে পর্যবেক্ষণকৃত স্বাধীন বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত রূপ নিচে তুলে ধরা হলো :
১. কৃষি ক্ষেত্রে (Agriculture Sector) : বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বৈরি পরিস্থিতির সময়ে খাদ্য শস্য উৎপাদন বিঘ্নিত হয়েছিল। কৃষি উপকরণ সংগ্রহ করে আবাদ করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা কৃষকের হাতে ছিল না। হাল চাষের জন্য গবাদি-পশুর সংকট দেখা দেয়। তাছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী সরকারি গুদামে মজুদকৃত খাদ্যশস্য, শস্যবীজ, সার, কীটনাশক ঔষধ এবং মাঠের গভীর ও অগভীর নলকূপ ধ্বংস করেছিল। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে কৃষিঋণ প্রদান, বীজ সংগ্রহ করা, গভীর ও অগভীর নলকূপ মেরামত বা পুনর্খনন করা, কয়েক লক্ষ গরু আমদানি করা ইত্যাদি বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। পাকিস্তান আমলে ভূমি উন্নয়ন ও সেচ কার্যক্রমের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করায় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ৭৪% আবাদি জমি ছিল এক ফসলি এবং মাত্র ২৬% জমি ছিল দো-ফসলি ও তিন ফসলি।
খাদ্য সংকট (Scarcity of Food) : স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারের শাসনভার গ্রহণের সময় দেশে খাদ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪০ লক্ষ টন। সরকার মাত্র ৪ লাখ টন খাদ্য শস্য মজুদ পান। এমনি সংকটময় পরিস্থিতিতেও সরকারকে প্রায় ৯০,০০০ পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দী, আটককৃত ৫০-৬০ হাজার রাজাকার ও দালাল এবং প্রায় সোয়া লক্ষ ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর জন্য খাদ্য সরবরাহের এক কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়।
ধ্বংসপ্রাপ্ত সরকারি-বেসরকারি ভবন ও শরণার্থী পুনর্বাসন (Rehabilitation of Refugee and Damaged Government- Non Government Building) : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকার-আলবদর ও তাদের সহযোগীরা সারা বাংলাদেশে প্রায় ৪৩ লক্ষ বসতবাড়ি, ৩,০০০
১৮,০০০ প্রাইমারি স্কুল, ৬,০০০ হাই স্কুল ও মাদ্রাসা, ৯,০০ কলেজ ভবন ও ১৯,০০০ গ্রাম্য হাটবাজার পুড়িয়ে দেয়। এগুলো নতুন করে নির্মাণের জন্য প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণ অর্থের এবং নির্মাণসামগ্রীর। তাছাড়া ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী প্রায় ১ কোটি শরণার্থী ও দেশের অভ্যন্তরে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন করার এক কঠিন দায়িত্ব এসে যায়
সরকারের সামনে ।
৪. বিপর্যস্ত শিক্ষা কার্যক্রম (Reversed Educational Activities) : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের সময়
দেয়া শিক্ষাভবনগুলো পুননির্মাণ এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত আসবাবপত্র, বেঞ্চ, টেবিল, চেয়ার ইত্যাদি মেরামত বা নতুন নির্মাণ করে ক্লাস শুরু করা নতুন সরকারের জন্য ছিল এক বড় দায়িত্ব। তাছাড়া স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী পাঠ্যবই রচনা ও প্রকাশের এক গুরুদায়িত্বও সরকারকে পালন করতে হয়। শিক্ষকদের ৯ মাসের বেতন বন্ধ ছিল তা পরিশোধ করাও ছিল এক গুরুদায়িত্ব।
বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা (Ravaged Communication System) : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে ২৭৪টি ছোটবড় সড়ক সেতু ও ৩০০টি রেলসেতু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং ৪৫ মাইল রেল লাইনের সম্পূর্ণ অংশ ও ১০০ মাইল রেল লাইনের আংশিক ক্ষতি সাধিত হয়। ১৫০টি বগি ও বেশ কয়েকটি রেল ইঞ্জিন অকেজো হয়। রেল ইঞ্জিন ও বগি মেরামতের কারখানাগুলো সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়। সারা দেশে প্রায় ৩০০০ মালবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয়া হয়। দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ জলযান ধ্বংস হয়। দেশের বিমান বন্দরসমূহের রানওয়ের ক্ষতি সাধন করা হয়। ৬. বিধ্বস্ত টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা (Ravaged Tele - Communication System) : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মহান
মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকার সাথে বিভিন্ন জেলা শহরসহ বিদেশের টেলি-যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়। ১ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের পূর্বে পাকিস্তানি বাহিনী টেলিফোন এক্সচেঞ্জ-এর ট্রাঙ্কব্যবস্থা বিনষ্ট করে দেয়। টেলিফোন ব্যবস্থা সচল করার জন্য তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজন ছিল ঢাকা শহরের জন্য কমপক্ষে ৫০০ টেলিফোন সেট, ৩১টি ট্রাঙ্ক লাইন নতুন করে স্থাপন, এক্সচেঞ্জের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করা, ২০০০ কিমি দীর্ঘ টেলিফোন আমদানি করা, কমপক্ষে ১০০০ দক্ষ টেলিফোন কর্মী ইত্যাদি।
৭ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা (Electricity) : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সারা দেশে বিদ্যুৎ সাব-স্টেশনগুলো ধ্বংস্রাত হয়েছিল। অনেকগুলো বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন ও বিদ্যুৎ পোলগুলো বিনষ্ট হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার দায়িত্ব গ্রহণের সময় গোডাউনগুলোতে বিদ্যুৎ খুঁটি ও তার কিছুই মজুদ ছিল না।
৮. অর্থনৈতিক অবস্থা (Economic Condition) : বাংলাদেশের ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের শেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের পূর্বে ব্যাংকসমূহে গচ্ছিত কাগজের নোটগুলো পুড়িয়ে দেয় এবং গচ্ছিত সোনা লুট করে। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ অংশের ব্যাংকগুলোতে কর্মরত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ৬০% এবং নিম্নস্তরের কর্মচারীদের ২০% ছিল অবাঙালি। মুক্তিযুদ্ধের পর ব্যাংকগুলোতে দক্ষ জনবলের অভাব দেখা দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় শিল্প-কলকারখানাগুলো প্রায় বন্ধ ছিল। ফলে অনেক মিল-কারখানা অকেজো হয়ে পড়ে। এগুলো চালু করার মতো স্পেয়ারপার্টস ও কাঁচামাল কোনো গুদামেই মজুদ ছিল না। বিভিন্ন মিলে দক্ষ শ্রমিকের অভাব দেখা দেয় । কাঁচামাল আমদানির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয় ।
রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় সমস্যা
Political-Economic and State Problems
*একটি দেশের জন্ম প্রক্রিয়া তার পরবর্তী রাজনৈতিক গতিধারাকে বহুলাংশে প্রভাবিত করে।'—এস.এম. লিপসেট-এর এ উক্তিটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমরা জানি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও চূড়ান্ত পর্যায়ে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে এবং ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের দীর্ঘ ৯ মাসের মুক্তি সংগ্রামে
দেশের জনগণের কারো কারো বিতর্কিত ভূমিকা ও প্রত্যাশা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। সীমান্তরক্ষী বাংলাদেশ রাইফেলস ও পুলিশ বাহিনী তখন পর্যন্ত সুসংগঠিত হয় নি। আধা-সামরিক বাহিনীগুলোর প্রায় অস্তিত্বই ছিল না। তখন দেশের প্রায় সকল শ্রেণির মানুষের হাতে ছিল অসংখ্য বিভিন্ন ধরনের বহিয়াস্ত্র; এক কথায় মুক্তিবাহিনী, মুজিব বাহিনী, ষোড়শ বাহিনী, স্বাধীনতাবিরোধী দালাল শ্রেণি এবং পেশাদার দুর্বৃত্ত সকলেই অস্ত্রের জোরে দেশব্যাপী স্ব-স্ব এলাকায় ক্ষমতা ও প্রভাব খাটিয়ে এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিল।
জাতীয় একাত্মতায় সমস্যা (Problems of National Consensus) : সাধারণত আঞ্চলিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয়, ভাষাগত কিংবা জাতিগত বিভাজন কোনো দেশে জাতীয় একাত্মতার সমস্যা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, এদেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে আঞ্চলিক, ধর্মীয়, ভাষাগত বা জাতিগত প্রভেদ তেমন নেই। এ দেশের ৯৯% লোকের মাতৃভাষা বাংলা। প্রায় ৮৫% লোক একই (ইসলাম) ধর্মাবলম্বী। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো নিজেদেরকে পৃথক জাতিসত্তা হিসেবে দাবি করে না। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতীয়রা পৃথক জাতিসত্তা মনে করলেও তারা সংখ্যাগত ও সাংগঠনিকভাবে খুবই দুর্বল। এদেশে আঞ্চলিক বিভাজনও নেই। তা সত্ত্বেও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জাতীয় একাত্মতার সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়।
সর্বস্তরের জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও কয়েকটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী এর বিরোধিতা করে । এগুলোর মধ্যে ছিল মুসলিম লীগ, জামায়াত-ই-ইসলামিসহ কয়েকটি ডানপন্থি সাম্প্রদায়িক দল, যারা ইসলামি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতো। তাছাড়া কতিপয় চিনপন্থি বাম রাজনৈতিক গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কারণে আওয়ামী লীগ পরিচালিত স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন সরকারের প্রতিও আনুগত্য স্বীকার করে নি, বরং আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের জন্য সশস্ত্র লড়াই শুরু করে । সরকারও স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যার ফলে দেশে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয় ।
অংশগ্রহণের সমস্যা (Problems of Participation) : স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করে। তবে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনসমূহ আওয়ামী লীগের একক কর্তৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের দাবি ছিল স্বাধীনতার পক্ষের দলসমূহের সমন্বয়ে একটি জাতীয় দল গঠন করা এবং সংবিধান প্রণয়নে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া। অপরদিকে, আওয়ামী লীগ দাবি করে যে, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে একচেটিয়াভাবে জয়যুক্ত করে। অতএব সরকার পরিচালনা ও সংবিধান রচনার পূর্ণ নৈতিক ও আইনগত অধিকার তাদের রয়েছে। ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলসমূহের মধ্যে এ বিষয়ে বাকবিতণ্ডা অব্যাহত থাকে ।
সামরিক বাহিনীর মধ্যে বিভাজন (Dividation in Military Force) : ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের একটি অংশ, যারা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থান করছিল তারা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং স্বাধীনতার পর উচ্চতর সামরিক পদসমূহে অধিষ্ঠিত হয়। অপরদিকে, বাঙালি সেনাদের বৃহত্তর অংশ যারা পশ্চিম পাকিস্তানে আটকা পড়ে, স্বাধীনতার প্রায় দেড় বছর পর তারা বাংলাদেশে ফিরে আসে, পাকিস্তান ফেরত অমুক্তিযোদ্ধা বাঙালি কর্মকর্তারা মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনায় তাদের সিনিয়রিটি হারান এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নপদ লাভ করেন। ফলে অমুক্তিযোদ্ধা সেনারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের প্রতিও বৈরী মনোভাব পোষণ করেন। এভাবে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়, যা স্বাধীনতাত্তোর রাজনীতিতে অনৈক্য ও অস্থিরতার উপাদান হিসেবে কাজ করে। মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের একটি অংশ বিশেষভাবে বাম রাজনৈতিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে উৎপাদনমুখী গণবাহিনী হিসেবে পুনর্গঠিত করতে চান, যা ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে সংগতিহীন। সামরিক বাহিনীর এ রাজনৈতিকীকরণ (Politicization) স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এক সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করে এবং রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করে।
৪. বেসামরিক আমলাবর্গের মধ্যে বিভাজন (Dividation in Civil Bureaucrats) : স্বাধীনতার প্রাক্কালে বাংলাদেশে বেসামরিক আমলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় চার লক্ষ। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী মুক্তিযুদ্ধের সময় 'মুজিবনগর' সরকারের অধীনে কাজ করেন। এ 'মুজিবনগর' কর্মচারিগণ নিজেদেরকে খাঁটি দেশপ্রেমিক বলে দাবি করেন এবং যারা বাংলাদেশে থেকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করেন তাদের পাকিস্তানের 'দালাল' বলে আখ্যায়িত করেন। আওয়ামী লীগ সরকার 'মুজিবনগর' কর্মচারীদের দ্রুত পদোন্নতি ও অতিরিক্ত বেতন বৃদ্ধি মঞ্জুর করেন। অপরদিকে, সরকার প্রায় ৬,০০০ কর্মচারীকে পাকিস্তানের সাথে যোগসাজশের অভিযোগে চাকরিচ্যুত করে। ফলে তারা সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। এভাবে সামরিক বাহিনীর মতো বেসামরিক আমলাতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক ঐক্য ও মনোবল ভেঙে পড়ে এবং রাজনৈতিক সরকার ও আমলাদের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক বিনষ্ট হয়।
৫. অর্থনৈতিক সমস্যা (Economic Problem) : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল না, এটা ছিল একাধারে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। উন্নততর জীবনের প্রত্যাশায় দেশের আপামর জনসাধারণ স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের সে আশা পূরণ হয় নি। ৯ মাসের স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশের অর্থনীতি দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। জতিসংঘের এক হিসাব মতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.২ লক্ষ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করা যে কোনো নতুন সরকারের পক্ষে এক পর্বত প্রমাণ কাজ। তাছাড়া ছিল যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ১ কোটি লোকসহ ৩ কোটি গৃহছাড়া লোকের পুনর্বাসন সমস্যা। স্বাধীনতা লগ্নে বাংলাদেশে না ছিল বৈদেশিক মুদ্রা, না ছিল খাদ্য মজুদ। এমতাবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ মানুষ চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পতিত হয়। ৭
আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা (Problems of Law and Order) : মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ডান ও বামপন্থি দলসমূহ সরকারকে উৎখাত করার পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করলেও অনেকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয় নি। এসব অস্ত্র সমাজবিরোধীদের হস্তগত হয়, যারা সশস্ত্র ডাকাতি, লুটতরাজ, ছিনতাই ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হয়। ফলে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। অপরদিকে, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় পুলিশ বাহিনীর প্রায় অর্ধাংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। অপরাধ দমনের জন্য পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনী ছিল না। সরকারকে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার ও সমাজবিরোধী কার্যকলাপ রোধকল্পে সামরিক বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করতে হয় বিধায় সামরিক বাহিনীর কাছে রাজনৈতিক সরকারের দুর্বলতা ধরা পড়ে।
রাজনৈতিক সংহতির সমস্যা (Problems of Political Consensus) : পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশ সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাপক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কতিপয় উগ্রপন্থি বাম সংগঠন ছাড়া সকল রাজনৈতিক দল সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষপাতী ছিল। তবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয় নি ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]