ঔপনিবেশিক শাসনামলে কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্ব ও বিকাশ ঘটেছিল তা আলোচনা কর। (How did the Communal Tendency Originate and Evolute in the Colonial Rule?)

'স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথার মানে এক এক মহারথী এক এক করে থাকেন। ভারবর্ষের এক পরমাণু বিদেশিদের অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষার শাসনভার সমস্ত থাকবে ভারতের হাতে
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলের ইতিহাস আলোচনা অত্যাবশ্যকীয়। ব্রিটিশের 'ভাগ কর, শাসন কর' নীতি ভারতবর্ষে তাদের অবস্থানকে একদিকে যেমন দীর্ঘায়িত করে অন্যদিকে তেমনি ভারত বিভক্তিতে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হলেও বাংলার বিভক্তি রোধ এবং বাঙালির স্বতন্ত্র রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা টিকিয়ে রাখার জন্য 'স্বাধীন অথন্ত বাংলা রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার শেষ মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে 'স্বাধীন অখণ্ড বাংলা রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন । কাজী নজরুল ইসলাম
(সূত্র : ধূমকেতু পত্রিকার ১৩শ সংখ্যা, ১৪ অক্টোবর, ১৯
ঐতিহাসিকভাবেই একথা সত্যি যেকোনো সমাজে বসবাসরত মানবগোষ্ঠীর মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি সৃষ্টির যতগুলো উপাদান থাকলে পারে তার মধ্যে ভাষার কার্যকারিতা সবচেয়ে বেশি এবং দ্বিতীয় স্যানে অনুশীলিত হয় ধর্মীয় বিশ্বাস। তাই ব্রিটিশ বা ব্রিটিশপূর সময় থেকেই বাংলা ভাষাভাষী এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান ছিল একটা সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধন। আর এ কারণেই ব্রিটিশরা এদেশের স্বাধীনতা প্রদানকালে কৌশলে এ উভয় বাংলার মিলিত অখণ্ড বাংলা গঠনের পরিপন্থী পরিবেশ তৈরি করেছিল। বাংলায় দুটি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে বসবাস করেছে। প্রাচীন বা মধ্যযুগে যে রাজা শাসন করেছেন শাসনক্ষেত্রে তার ধর্ম স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পেয়েছে তবে অন্য সম্প্রদায়কে এমন উৎপীড়ন করা হয় নি, যা প্রবল সাম্প্রদায়িকতার সৃষ্টি করতে পারে। ভারতবর্ষ বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, ভাষায় বিভক্ত হলেও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন পর্বের আগে ধর্ম নিয়ে প্রবল বিরোধ বা প্রবল সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেয় নি। উনিশ শতকে মুসলমানরা ইংরেজি ভাষা না শিখে ভুল করেছিল। ফলে তারা অনুন্নত একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছিল। হিন্দুরা ইংরেজি শিখে সম্প্রদায়গতভাবে এগিয়ে গিয়েছিল। কারণ সেই সময় ইংরেজি শিক্ষা ছিল বিত্ত ও মর্যাদার চাবিকাঠি। এ অসম উন্নয়ন দু' সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করেছিল। ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রয়োজনমতো একেক সম্প্রদায়কে গুরুত্ব দিতেন এবং বিভক্তির সৃষ্টি করতেন যাতে দীর্ঘকাল শাসন পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সুবিধা হয়। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লীগের উত্থান ও বিকাশ অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নবাব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের উর্ধ্ব ঘটে ঢাকায়, কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এর কর্তৃত্ব চলে যায় উত্তর ভারতীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দের হাতে। তারা নিজেদেরকে শৌর্যে-বীর্যে অতুলনীয় মনে করতেন। তারা মুসলমানদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে, আজকে মুসলমানদের যে দুরবস্থা তার জন্য ব্রিটিশ সরকার ও হিন্দুরা দায়ী। তাদের এ অবস্থা থাকবে না যদি মুসলমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ প্রচারণা মুসলমান তরুণদের মাঝে সাড়া জাগায় এবং পাকিস্তান মানসিকতার সৃষ্টি করে।
ব্রিটিশরা যখন এদেশের শাসন ক্ষমতা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় তখন এদেশের কিছু তাঁবেদার গোষ্ঠীর প্ররোচনায় তৎকালীন সময়ে চলমান অখন্ড বাংলা গঠনের প্রয়াসকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে কমিশন গঠনের মাধ্যমে প্রতিরোধের চেষ্টা চালায়। ফলে বাংলা ভাষাভাষী সচেতন বাঙালি সমাজের নেতৃত্বে অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রয়াসকে সফল হতে দেয় না। এর পাশাপাশি তারা ব্রিটিশদের প্ররোচিত করে যেকোনো কৌশলে পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে এবং পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের আওতায় রেখে সেই অখণ্ড বিভক্তির বাংলা সৃষ্টি করে।
প্রথম পরিচ্ছেদ
ঔপনিবেশিক শাসনামলে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিস্তার
Rise of Communalism Under the Colonial Rule and Development
ভূমিকা
Introduction
ইংরেজি 'Communalism' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। সম্প্রদায়ের সাথে যা কিছু সংশ্লিষ্ট বা যা কিছু সম্প্রদায় সম্পর্কীয় তার সবই সাম্প্রদায়িক (সম্প্রদায় + ফিক)। কাজেই ব্যুৎপত্তিগত অর্থে 'সাম্প্রদায়িক' শব্দটি মোটেই নিন্দার্থক নয় । যা দল, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়গত এবং সম্প্রদায়ের ভেদবুদ্ধি সম্পর্কিত তাই সাম্প্রদায়িকতা।
সাধারণভাবে সাম্প্রদায়িকতা বলতে ধর্মের নামে ধর্মাতিরঞ্জিত লক্ষ্য সিদ্ধির জন্য কাজ করাকে বোঝায়। এরূপ সাম্প্রদায়িকতাসম্পন্ন কোনো সম্পদ্রায় ধর্মকে ধর্মান্ধতায় রূপান্তর করে এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগ করে। তাই সাম্প্রদায়িকতা কথাটিকে বিভিন্ন অর্থে বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করা হয়। সাম্প্রদায়িক মনোভাবসম্পন্ন লোকেরা মনে করেন যে, তাদের ধর্মের অনুরাগীদের সকল স্বার্থ অভিন্ন এবং তা সমাজ ও রাজনীতির ভিত্তি বলে মনে করে থাকেন। তাছাড়া সাম্প্রদায়িকেরা সাম্প্রদায়িক মতে বিশ্বাস করে বিধায় তারা ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে দেশের জনগণের ঐক্য স্থাপনকে সমর্থন করে না। জিঘাংসা চরিতার্থ করতে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্ম বা গোত্রের প্রতি সহিংস হয়ে উঠে। শুরু হয় রক্তের হোলিখেলা। ঝড়ে পড়ে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের জীবন।
বদরুদ্দীন ওমরের মতে, “কোনো ব্যক্তির মনোভাবকে তখনই সাম্প্রদায়িক আখ্যা দেওয়া হয় যখন সে এক বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ভুক্তির ভিত্তিতে অন্য এক ধর্ম সম্প্রদায় এবং তার অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধাচরণ এবং ক্ষতিসাধন করতে প্রস্তুত থাকে।” মূলত ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য যে 'ভাগ কর ও শাসন কর' নীতি গ্রহণ করা হয় তারই অনিবার্য পরিণতি হলো উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িকতা। যার ফলে উপমহাদেশের প্রধান দুই সম্প্রদায় তথা হিন্দু ও মুসলিম পরস্পর বিরোধী দুটি দ্বন্দ্বাত্মক শ্রেণিতে পরিণত হয়।
সাম্প্রদায়িকতা ভারত উপমহাদেশ তথা বাংলার হিন্দু-মুসলমানদের বিরোধের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ব্রিটিশ রাজ্যের নাগপাশ থেকে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এ বিষয়টি এমন সব ঘটনাবলির ফল, যেগুলো অনেক সময়ই স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে স্ববিরোধী বলে মনে হয়। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী হয়ে উঠার সাথে সাথে সাম্প্রদায়িকতা আত্মপ্রকাশ করে। এর ফলে উপমহাদেশ ধর্মভিত্তিক দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়। আর ভারতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসনের প্রভাব ছিল সুগভীর। এ সময়ে উভয়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিস্তৃতি ঘটে। এর ফলেই ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দুদের পৃথক রাষ্ট্র ভারত এবং মুসলমানদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। কিন্তু পরবর্তীতে শুধুমাত্র ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ পাকিস্তানের ঐক্য আর বহাল থাকেনি। নানা ষড়যন্ত্র, ঘটনাপ্রবাহ, পাহাড়সম বৈষম্য ও অপশাসনের ফলে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব
Rise of Communalism
হিন্দু ও মুসলমান ভারতীয় উপমহাদেশের দুটি প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়। ব্রিটিশ শাসনামলে এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসম বিকাশ ঘটে। এজন্য দখলদার ব্রিটিশরাই যে কেবল দায়ী ছিল তা নয় বরং এর পিছনে সাম্প্রদায়িকতা অনন্য ভারতের বাইরের বিভিন্ন দেশ ইন্ডিয়া কোম্পানির এদেশে জমিদারি কিনে জমিদার বলে যায়। । এটা তাদের জন্য একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারও ছিল। তাই করছিল। পঞ্চাত, হিন্দু সম্প্রদারে জন্য দশিক মূলত শাসনের পরিবর্তন।
পাটনা দিন ব্রিটিশদের চেনে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সিপাহি বিদ্রোহ বা ভারতের প্রধান স্বাধীনতা সুদের পারভার পর গিয়ে পড়ে। এসব কিছু পরিণতিতে, হিন্দু সম্প্রদায় ব্যবসায়-বাণিজ্য, তুমি, শিল্প, পাতিল, চাকরি, শাসনকর্ম, নেতৃত্ব ইত্যাদি সেরে একটি মজ ও অগ্রবর্তী অবস্থান গড়ে তুলতে সক্ষম হয়।
মূলত, ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের হিন্দু ও মুসলর ও বিস্তার ঘটে। এর পূর্বে উত্তর ধর্মীয় সম্প্রদায়ভুক্ত কজন নিয়ে পড়ে সমাজ। সেখানে ধ-বम নির্বিশেষে মানুষ করে পরপর পাশাপাশি ও অভিযুক্ত হয়ে বসবাস করছে। ব্রিটিশ শাসনের পূর্ব মুন শাসন। সে সময়ও এ সামাজিক
সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ ছিল । সুলতানি আমলে মুসলমান শাসকরা বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায় বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা মুর্শিদকুলী খান, নবাব আলীবর্দী খান ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসনামলে অনেক হিন্দু ক্ষমতার উচ্চপদে আসীন ছিল ।
প্রদান করে ৷ নবাব
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে হিন্দু-মুসলিম দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমাগত দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনার সৃষ্টি হতে থাকে এবং ঔপনিবেশিক সরকারের প্রশ্রয়ই তার জন্য প্রধানত দায়ী। সময়ের সঠিক ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধারণ করার যতগুলো মাধ্যম তার মধ্যে আত্মজৈবনিক রচনাই প্রধান। তাই সমৃদ্ধ ব্যক্তিত্বগণের দ্বারা বিশ শতকে লেখা বিভিন্ন আত্মজীবনীতেও এসব বিষয়াদির নানাভাবে উল্লেখ আছে। কমিউনিস্ট নেত্রী মনিকুলা সেন লিখেছিলেন, 'এক গরিব মুসলমান, এক সম্ভ্রান্ত হিন্দুর বাড়ির উঠানে চলে এলে বাড়ির কর্তা জাত গেল বলে তাকে জুতা পেটা করে।'
উনিশ শতকের শেষভাগে বাঙালি চাষি সমাজের দুর্দশার কথা প্রায় সকলেরই জানা, যা দেখা যায় তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপটে রচিত কবিতা-নাটক-উপন্যাসে কিংবা কারও কারও আত্মজৈবনিক গ্রন্থে । কখনো কখনো সেসব সমাজচিত্র নিয়ে ভাবতে গেলে চোখে জল আসে এবং এরই পরিণতিতে রচিত হয় বিশ শতকের গোড়ার দিকের আন্দোলন-সংগ্রাম।
২.১.৩. সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার
Development of Communalism
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় হিন্দু-মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে। সে দ্বন্দ্ব যতটা ছিল হিন্দু-মুসলিম এলিটদের মধ্যে ততটা গরিব বাঙালির মধ্যে ছিল না। যে বিষয়টি গত একশ বছরে কলকাতাকেন্দ্রিক ও ঔপনিবেশিক সরকারের প্রচারের কারণে ওঠে আসে নি তাহলো এ অঞ্চলের বাঙালিগণ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা জোরালোভাবে করে—নি। এ অঞ্চলের অধিকাংশ মুসলমান ছিলেন চাষি আর হিন্দু চাষিদের ৯০% ছিলেন নমশূদ্র বাখেরগঞ্জে নমশূদ্রদের এক সভায় ঘোষণা করা হয়েছিল, ব্রাহ্মণদের ঘৃণা ও অপছন্দ এবং কায়স্থ ও বৈদ্যদের কারণে বিরাট এ নমশূদ্র সম্প্রদায় পশ্চাৎপদ । ব্রাহ্ম গিরিশ চন্দ্র সেন লিখেছিলেন, 'বঙ্গভঙ্গ তিনি সমর্থন করেন কারণ, এর ফলে পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের উন্নতি হবে । তবে সে উন্নতি কতটা হয়েছে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন।'
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে মাদ্রাজ কংগ্রেসে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস হলে নবাব আলী চৌধুরী এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'পুরনো প্রশাসনে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা অববাহিকা ছিল অবহেলিত। বর্তমানে নতুন প্রশাসন চালু হওয়ায় পূর্ববঙ্গ ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। যদি পূর্ববঙ্গে ১০০ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং সমসংখ্যক সাব-ডেপুটি মুনসেফ এবং সাব-রেজিস্টার নিযুক্ত হন, তাহলে তাঁরা হবেন এ দেশের মাটির হিন্দু-মুসলমান ছেলেমেয়েরা।' তিনি এক্ষেত্রে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে যে সমস্যা, পূর্ববঙ্গ কলকাতার সমস্যাটিকেও সেভাবে দেখেছেন এবং দেখাটা সমীচীন ছিল কিনা তা তলিয়ে দেখা আর হয়ে ওঠেনি । আমাদের দুর্ভাগ্য এই যে, আধিপত্যবাদী সমাজে নিরীহ গরিবের ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না ।
১৯০৬ থেকে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুসলিম লীগের উত্থান ও বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মুসলিম লীগের উদ্ভব ঢাকায় হলেও অচিরেই-এর কর্তৃত্ব চলে যায় উত্তর ভারতে। সেখানকার এলিটরা-এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করে এবং ১৯৪৭-এর আগে ভারতের মুসলমান নেতৃবৃন্দ সামাজিক সংগঠিত সমাবেশ ঘটানোর জন্য ইতিহাসের সূত্রগুলো তুলে ধরতে প্রয়াস পান। তারা জোর দিয়েছেন মুসলমান নৃপতিদের ওপর, যারা ছিলেন শৌর্যে বীর্যে অতুলনীয় এবং মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন ভারতীয় মুসলমানরা তাদেরই বংশধর। ইসলামি শাসনের যুগ স্বর্ণযুগ। ব্রিটিশ ও হিন্দুদের (কংগ্রেস) চক্রান্তে আজ তারা হীনবস্থায়। এ হীনবস্থা থাকবে না যদি মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমির ব্যবস্থা হয়। ইতিহাসের এ ব্যবস্থা মুসলমান তরুণদের সংগঠিতকরণে ভূমিকা রেখেছে এবং 'পাকিস্তান মানসিকতা' তৈরি করেছে। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে পাকিস্তান মানেই মুসলমান আর ভারত মানেই হিন্দু।
এই মানসিকতা গঠন খুবই তীব্র এবং শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্তের পক্ষে তা কাটিয়ে ওঠা দুরূহ। এটা ঠিক পূর্বাঞ্চলের মানুষদের বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদেরকেও এ প্রচার কিছুটা আচ্ছন্ন করেছিল। তবে পরবর্তীতে ১৯৭১-এর পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা কৃষিজীবী তাদের এ 'মিথ' ততটা প্রভাবিত করেনি যতটা করেছে অর্থনৈতিক বঞ্চনা ।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত সৃষ্টির পর ঐতিহাসিকরা এ তত্ত্বই প্রচার করেছিলেন যে, ভারত বিভাজনের জন্য মুসলমান বা মুসলিম লীগই দায়ী। আর রাজনৈতিক দল হিসেবে কংগ্রেস কংগ্রেসের আদর্শে বিশ্বাসীরা এ তত্ত্ব বেশি প্রচার করেছেন যাতে ভারত বিভাগের দায়িত্ব তাদের উপর না পড়ে। বাংলা বিভাগের ওপর গবেষণা করতে গিয়ে জয়া চ্যাটার্জী লিখেছিলেন, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি গবেষণা শুরু করেন, তখন একটা সাধারণ ও অনুকূল ধারণা প্রচলিত যে ভারত বাংলার বিভক্তি মুসলমানদের কাজ। হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির অখণ্ডতাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে কোনো কিছুই করেনি।'
আমাদের সমাজে বিশেষ করে বাঙালি লোকবিশ্বাস বা প্রচলিত ধারণার প্রভাব যথেষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণায় প্রকাশ পায় যে, স্বাভাবিক ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দুত্বের বৈশিষ্ট্য হলো সহনশীল এবং বহুত্ববাদী। তাই হিন্দুত্বে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার সুযোগ নেই। ঐ গবেষণায় প্রকাশ পায় যে, বাংলার হিন্দু ভদ্রলোকদের ( elites) - ক্ষয়িষ্ণু ক্ষমতা, ধনসম্পদ ও মর্যাদা হুমকির সম্মুখীন হওয়ায় তারা সামাজিক অবস্থান অক্ষুণ্ণ রাখার লক্ষ্যে কূটকৌশল অবলম্বন করে এবং নিজেদের কাজের যৌক্তিকতা হিসেবে বিভিন্ন ভাবাদর্শকে ব্যবহার করে। সত্যিকার অর্থে ঐ কূটকৌশলকে একমাত্র সাম্প্রদায়িক হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়।'
প্রশাসনিক-রাজনৈতিক-সামাজিক বিচারে দেখতে গেলে পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ থেকে যারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে পাড়ি জমিয়েছেন তাদের একটা বড় অংশ ছিলেন মধ্য বা নিম্নমধ্যবিত্ত। কৃষক বা নমশূদ্ররা সেভাবে দেশ ত্যাগ করেছেন কি-না সন্দেহ। এর পেছনে অর্থনৈতিক বঞ্চনাই ছিল প্রধান। তাই ১৯৪৭-এর পর দেখি, মুসলিম তরুণরা মুসলিম লীগ আরোপিত ইতিহাস ঝেড়ে ফেলছে এবং সেই অর্থনৈতিক বঞ্চনাই মূল প্রতিপাদ্য হয়ে উঠেছে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান বিভক্তির পেছনেও সেটিই মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতের ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় দ্বিজাতি তত্ত্ব এ পূর্ববঙ্গেই পরাজিত হয়। তাই এ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।
অন্যদিকে যারা বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা ছিলেন মুসলিম লীগের তরুণ তুর্কি। এ বিষয়ে হারুন-অর-রশিদ তাঁর “বাংলা বিভাগ ও অভিন্ন বাংলা প্রস্তাব' সম্পর্কে বিস্তৃত গবেষণার পর সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, 'বাঙালি মুসলিম লীগের কাছে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ ছিল ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থ, কৃষ্টি, ঐতিহ্যে বিভক্ত মুসলমানদেরকে তাদের সাধারণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস বা হিন্দুদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পরিচালনার একটি 'স্ট্রাটেজি' মাত্র। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, ভারতে দ্বিজাতি নয়, বহুজাতি সত্তা রয়েছে। বাংলার এ নেতৃত্বের নিকট ‘পাকিস্তান' ছিল লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিচালিত একটি আন্দোলনের নাম, একটি একক রাষ্ট্রের রূপরেখা নয় ।
প্রাক ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে এ ভূখণ্ডে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গড়ে ওঠা তার কাছে মনে হয়েছে দুরূহ ছিল এবং বাঙালির জাতি রাষ্ট্র গঠনের এ পর্বে এটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হিন্দু-আধিপত্যের ভীতি বাঙালি মুসলমানের মন থেকে কেটে গেলে বাঙালি-অবাঙালি দ্বন্দ্বটি প্রাধান্য লাভ করেতে থাকে। পূর্ববাংলার হিন্দুরা এবার এখানকার মুসলমানদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয় তাদের সাধারণ রাজনৈতিক শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসন, শোষণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে।'

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]