বাংলার পাল বংশের ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা কর। Pala rule in Bengal

ভূমিকা ঃ বাংলার প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম গৌড়াধিপতি শশাঙ্কের মৃত্যুর পর আন্তঃবিদ্রোহ ও পার্শ্ববর্তী রাজাদের উপর্যুপরি আক্রমণের ফলে বাংলায় এক অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয় এবং রাজতন্ত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। সমসাময়িক কালের পর্যটক হিউয়েন সাং, লামা তারনাথের বিবরণ, বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প, সন্ধ্যাকর নন্দির রামচরিত, কলহনের রাজতরঙ্গিনী, বৈদ্যদেবের কৌমলি তাম্রলিপি, বানগড় তাম্রলিপি, খালিমপুর তাম্রলিপি প্রভৃতির বিবরণে এ অস্থির অবস্থা ও খণ্ডবিখণ্ড গৌড়রাজ্যের চিত্র পাওয়া যায়। বাংলার এ অরাজক অবস্থাকে মাৎস্যন্যায় বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মাৎস্যন্যায়ের অবসানকল্পে গোপালের ক্ষমতা লাভ প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় ।
পাল বংশের উৎপত্তি ঃ
পাল বংশের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল কোন পৌরাণিক বীরের বংশধর বলে দাবি না করা। খালিমপুর তাম্রশাসন হতে জানা যায় যে, পাল বংশ দয়িতবিষ্ণু হতে উদ্ভূত। তাঁর পিতা ছিলেন পাট। খালিমপুর তাম্রশাসনে ধর্মপালকে 'ভদ্রাত্মজ' বলে বর্ণনা করায় কোন কোন পণ্ডিত মনে করেন যে, গোপালের স্ত্রী অর্থাৎ ধর্মপালের মাতা দদ্দদেবী পূর্ববঙ্গের ভদ্র বংশের কন্যা ছিলেন। এ পরিচিতি অত্যন্ত কষ্টকল্পিত বলে ঐতিহাসিকগণ এটা গ্রহণে উৎসাহী নয় । পাল বংশের উৎপত্তি সম্পর্কে পরবর্তী পাল রাজগণ নানা প্রকার অলীক দাবি উত্থাপন করেছিলেন তার প্রমাণ সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত ও সমসাময়িক রচনায় পাওয়া যায়। এসব দাবির মূল বক্তব্য হল পালগণ সূর্যবংশীয় বা সমুদ্রবংশীয় বলে প্রচার করা। [History of Ancient India P. 335 R.S. Tripathi] বলা বাহুল্য, এসব কাহিনী কিংবদন্তী ঐতিহাসিক তথ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে পাল রাজগণ ক্ষত্রিয় ছিলেন এর সমর্থন তিব্বতীয় পুরোহিত তারনাথ, সন্ধ্যাকর নন্দী প্রভৃতির রচনা পাওয়া যায়।
পাল বংশের ইতিহাস : বাংলার ইতিহাসে গোপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পালবংশ বংশ পরম্পরায় প্রায় চারশ বছর বাংলায় প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখেন। নিম্নে ধারাবাহিকভাবে পাল বংশের উল্লেখযোগ্য শাসকদের বিবরণ দেওয়া হল ঃ
১. গোপাল (৭৫০-৭৭০ খ্রিস্টাব্দ) :
গোপালের বংশ পরিচয় সম্পর্কে উপযুক্ত তথ্যের অভাবে জানা খুব দুরূহ ব্যাপার । একমাত্র খালি পুর তাম্রলিপিতে গোপালের পিতা বপ্যট (শত্রু ধ্বংসকারী বলে খ্যাত) এবং পিতামহ দয়িতবিষ্ণুর (সর্ববিদ্যার বিশুদ্ধকারী বলে খ্যাত) নাম উল্লেখ আছে। এ থেকে মনে হয়, গোপালের পিতা বপ্যট যুদ্ধে পারদর্শী ছিলেন এবং খুব সম্ভবত গোপালও পিতার ন্যায় সুনিপুণ যোদ্ধা ছিলেন। তাই গোপাল শশাঙ্কের পরবর্তীকালের বাংলার অরাজকতার অবসান করে স্বীয় ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করেন। ধর্মপালের ৩২ রাজ্যাংক বা খালিমপুর তাম্রলিপি, লামা তারনাথের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস নামক কাহিনীতে গোপালের ক্ষমতা লাভ সম্পর্কে জানা যায়। খালিমপুর তাম্রলিপির চতুর্থ শ্লোকে গোপাল সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায় :
মাৎস্যন্যায় অপরিতুম প্রকৃতিভি লক্ষণ্যাকরং গ্রহিতঃ শ্রী গোপাল ইতি ক্ষিতিশ শিব সাং চূড়ামণি সতৎ সুতঃ ॥
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় এর বঙ্গানুবাদ করেছেন, “দুর্বলের প্রতি সবলের মাৎস্যন্যায় দূর করার অভিপ্রায়ে প্রকৃতিপুঞ্জ রাজাকে রাজলক্ষ্মীর কর গ্রহণ করাইয়া নরপাল, কুলচূড়ামণি গোপাল নামক সেই প্রসিদ্ধ রাজা হতে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন।” এ উক্তি থেকে বুঝা যায় যে, গোপালের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে প্রকৃতির ভূমিকা ছিল। তাঁর ক্ষমতা গ্রহণ সম্পর্কে বিতর্কের শেষ নেই। তবে ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি মাৎস্যন্যায়ের মত অরাজকতার অবসান কেবল নয়, বরং রাজ্যবিস্তার, রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে যোগ্যতার পরিচয় দেন। এছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি পান মাত্র গৌড় রাজ্য। এটাকে তিনি বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। তিব্বতীয় গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গোপাল নালন্দায় একটি বৌদ্ধ বিহার ও অনেক বৌদ্ধধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন।
৪. প্রথম বিগ্রহপাল :
আজীবন বিজেতা হিসেবে চার দেবপালের বাকপালের পুত্র) রাজা হন। বিগ্রহপাল ছিলেন যেন পারিনি শাসনকার্যে মনোযোগী না হয়ে ধর্মকর্মে আগ্রহ কেমন দেখা দেয়। এক পর্যায়ে বিশে পুত্র নারায়ণ পালের সপক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করে ধর্মকর্মে মনোনিবেশ করেন।
৫. নারায়ণ পাল ঃ
বিগ্রহপাল স্বইচ্ছায় সারাক্ষণ পদকে শাসকদের ধিকার নিযুক্ত করেন। নারায়ণ পাল পালবংশের ক্ষমতা গ্রহণ করে তেমন যোগ্যতার পরিচয় নিতে ব্যার্থ হন। তিনি পিতার নাম শান্তিপ্রিয় ও দুর্বলচেতা ছিলেন। তাঁর শাসনামলে পাল সাম্রাজ্যের কিছু অঞ্চল বিদ্রোহীদের দখলে চলে ৬. রাজ্যপাল, দ্বিতীয় গোপাল, দ্বিতীয় বিগ্রহপাল
। নারায়ণ পালের পরবর্তী পাল রাজগণ যথা: রাজ্যপাল (৯০৮-৯৪০), দ্বিতীয় গোপাল (৯৪৩-৯৬০), দ্বিতীয় বিগ্রহপাল (১৬০-১৮৮) প্রভৃতির রাজত্বকালের পাল সাম্রাজ্য আরও পতনোন্মুখ হয়ে পড়ে । তাদের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে দশম শতকের শেষভাগে কম্বোজ বা কাম্বোজ নামে এক পার্বত্য জাতি পাল সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। দিনাজপুর স্তম্ভলিপি থেকে কম্বোজ আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায় ।
৭. প্রথম মহীপাল (৯৮৮–১০৩৮) : দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পর তাঁর পুত্র প্রথম মহীপাল পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ এবং উত্তরবঙ্গ কম্বোজদের পদানত, পশ্চিমবঙ্গের একাংশ শূর বংশ, পূর্ববঙ্গে চন্দ্রবংশ প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করতেছিল। প্রথম মহীপাল নিজ রণকৌশল দ্বারা প্রথম সমগ্র মগধ জয় করেন । এরপর ক্রমান্বয়ে একের পর এক রাজ্য আক্রমণ করে পালবংশের হারানো ঐতিহ্য কিছুটা ফিরে আনতে সক্ষম হন ।
৮. দ্বিতীয় মহীপাল ঃ
দ্বিতীয় মহীপাল তৃতীয় বিগ্রহপালের প্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন । তিনি স্বীয় যোগ্যতার গুণে অপরাপর ভ্রাতা শূরপাল ও রামপালকে সিংহাসনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে নিজ ক্ষমতার ভিত্তিতে মজবুত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কৌশল নির্ধারণে ভুল করার জন্য তিনি বেশি দিন টিকে থাকতে পারেন নি। তাঁর শাসনামলে দেশের সর্বত্র বিদ্রোহাত্মক কার্যকলাপ দেখা দেয় । এক পর্যায়ে বরেন্দ্রের সামন্ত নায়ক কৈবর্ত প্রধান দিব্য বা দিব্বোক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন । এ বিদ্রোহে দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হন ।
৯. রামপাল : কৈবর্ত বিদ্রোহে দ্বিতীয় মহীপাল নিহত হওয়ার পর ভ্রাতা রামপাল সিংহাসনে আহেণ করেন। এ ধারণা রামচরিত থেকে পাওয়া যায়। তবে রামপাল যে দ্বিতীয় মহীপালের পরবর্তী রাজা হিসেবে বরেন্দ্রের বিদ্রোহের অবসান করে পাল বংশের হারানো ঐতিহ্য কিছুটা ফিরে এনেছিলেন তা নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হয়। রামচরিত গ্রন্থ থেকে রামপালের রাজত্বকালের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় । তিনি দীর্ঘ ৪২ বছর রাজত্ব করে খণ্ড বিখণ্ড বিক্ষিপ্ত বাংলাদেশকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করে যান ।
১০. পরবর্তী পাল রাজাগণ :
রামপালের পর তাঁর পুত্র কুমারপাল (১১২০-১১২৮) সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর রাজত্বকালে দক্ষিণবঙ্গে বিদ্রোহ দেখা দেয়। কুমারপালের পর রাজা তৃতীয় গোপাল পাল বংশের রাজা হন। তৃতীয় গোপালের পর মদনপাল পালবংশের রাজা হন। এ মদনপালকে উত্তরবঙ্গ থেকে বিজয় সেন অধিকারচ্যুত করেন। এরপর গোবিন্দপাল নামে জনৈক রাজার নাম পাওয়া যায়। এরপর আর পালবংশের চিহ্ন পাওয়া যায় না ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনা পরিশেষে বলা যায় যে, পরিবর্তন হল ইতিহাসের ধর্ম। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় শশাঙ্কের পরবর্তী বাংলার অরাজকতার অবসান করে গোপাল পালবংশের সূচনা করেন। এ পালবংশ প্রায় চারশ বছর টিকে থাকার পর আবার প্রকৃতির নিয়মে পতনের দিকে ধাবিত হয়। তবে ইতিহাসের আলোচনায় প্রাচীন যুগে পালবংশের সুদীর্ঘকালব্যাপী শাসনামল তুলনামূলক প্রশংসনীয় ছিল। তবে এ পালবংশের চারশ বছরের ইতিহাসে সতের পুরুষ এর মধ্যে ধর্মপাল ছিলেন শ্রেষ্ঠ রাজা । আর দেবপাল ছিলেন বিজেতা হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার । তবে দেবপালের বিজেতা হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচয় দিলে অভ্যন্তরীণ শাসনকার্যে তেমন দক্ষতার প্রমাণ দিতে না পারায় তাকে পালবংশের পতনের জন্য দায়ী করা হয় । তবে এটা গ্রহণযোগ্য নয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]