ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে ধর্মপালের কৃতিত্ব আলোচনা কর । তিনি কি সমগ্র উত্তর ভারত জয় করেছিলেন?

ভূমিকা : গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ধর্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। পাল বংশের আঞ্চলিক রাজ্যকে এক সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করেন তিনি। প্রাচীন যুগে যেসব রাজার নাম পাওয়া যায়, তাঁদের মধ্যে ধর্মপালই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। গুজরাট কবি সোডঢলের মতে, ধর্মপাল ছিলেন উত্তরাপথস্বামীন। যদিও উত্তর ভারতের প্রতিহার বংশ ও দক্ষিণ ভারতের রাষ্ট্রকূট রাজ্য শক্তির সাথে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়েছিল, ইতিহাসে যা ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ নামে সুপরিচিত। যা হোক, বর্তমানে শুধুমাত্র কয়েকটি তাম্রশাসন, শিলালিপি ও তিব্বতি গ্রন্থ থেকে ধর্মপালের কীর্তি কথা জানা যায় ।
ধর্মপালের ক্ষমতা গ্রহণ ও পাল বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ধর্মপালের পিতা গোপাল। পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল হলেও পরবর্তীতে তাঁরা দুইজন উত্তরাধিকারী পাল সাম্রাজ্যকে বর্ধিষ্ণু করে তুলেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ধর্মপাল অন্যতম। পিতার মৃত্যুর পর ধর্মপাল সিংহাসনে বসেন। এ সম্পর্কে R. C. Majumdar বলেছেন, “প্রতিষ্ঠাতা শাসক গোপালের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য উত্তরাধিকারী পুত্র ধর্মপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন ৭৭০ সালে; যিনি পাল শাসকদের সুনাথ, গৌরব ও শক্তিমত্তাকে উত্তঙ্গের স্বর্ণশিখরে পৌঁছে দেওয়ার জন্যই সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।”
সাম্রাজ্য বিস্তার :
ধর্মপালের বিশেষ কৃতিত্ব এখানে যে, তিনি পাল বংশের আম সাম্রাজ্যে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল তাঁর মা স্থাপনের উপর রেখে গিয়েছিলেন, আর তদীয় পুত্র ধর্মপাল সে দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়ি সক্ষম হয়েছিলেন। ধর্মপালের বলিষ্ঠ নেতৃত্বেই এ সাম্রাজ্য বিস্তৃতির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল এখন আর রাজ্য নয়, বরং তা পাল সাম্রাজ্য নামে পরিচিতি পায়। गानরিক দিক থেকে বলেই উত্তর ভারতের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে এবং সেক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক প্রাচীন বাংলায় যেসব রাজার নাম পাওয়া যায় তাঁদের মধ্যে ধর্মপাল শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করা ধর্মপালকে 'উত্তরাপথস্বামীন' অভিধায় অভিহিত করেছেন।
ধর্মপাল ও ত্রিশক্তি সংঘর্ষ : ধর্মপালের गিान বসার সময় উত্তর ভারত ত্রিশক্তি দ্বন্ধ আরম্ভ হয়। এ ত্রিশক্তির মধ্যে বাংলার পাল শক্তি ছিল অন্য। পূর্বদিকে রাজ্যবিস্তার করে কৌনজ অধিকার করার চেষ্টা করেন। পূর্ব ভারত ान দমিয়ে কৌনজ নিজ অধিকারে রাখার চেষ্টা করেন। এদিকে দক্ষিণ ভারত থেকে রাষ্ট্রকূট পরাস্ত করে কৌনজ আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করে। এভাবে পাল, প্রতিহার, রাষ্ট্রকূট এ তিন প্রাচীন ইতিহাসে যা ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষ নামে সুপরিচিত।
এ ত্রিশক্তি দ্বন্ধের বৈশিষ্ট্য তিনটি শক্তিই ছিল প্রান্তিক বা প্রান্তসীমার। তিনটি শক্তির প্রদেশ বিশেষত কৌনজ অধিকার করা। কারণ অষ্টম ও নবম খ্রিস্টাব্দে সম্রাট হর্ষবর্ধনের প্রধান শাসনকেন্দ্র মনে করা হতো। পশ্চিম এশিয়ার যোদ্ধা জাতিগুলোর নিকট যেমন 1 বর্বরদের নিকট, প্রাচীন রোম শহর যেমন ছিল আকর্ষণের বস্তু, সেরূপ অষ্টম ও নবম শ কৌনজ এর উপর অধিকার স্থাপন ছিল মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক ।
পাল প্রতিহার শক্তি যদিও উত্তর ভারতে অবস্থিত ছিল, রাষ্ট্রকূট ছিল দক্ষিণ ভারতে আধিপত্য নিয়ে পূর্বাঞ্চলের পাল ও পশ্চিম অঞ্চলের প্রতিহার পক্ষে প্রতিদ্বন্ধিতা স্বাভাবিক হলে তাতে যোগ দিয়ে এ দ্বন্দ্বকে ত্রিকোণ দ্বন্দ্বে পরিণত করে। সম্ভবত রাষ্ট্রকূট শক্তি মনে করা প্রতিহার যে কোন একক শক্তির প্রাধান্য স্থাপিত হলে তাঁরা পরবর্তী পাল বা প্রতিহার যে ে ভেবে রাষ্ট্রকূটরা Preemptive attcick বা প্রতিরোধমূলক আক্রমণ চালায়।
ধর্মপাল-বৎসরাজ-ধ্রুব ত্রিশক্তির দ্বন্দ্ব ও ধর্মপাল মগধ জয় করে দোয়াবের গঙ্গার উপকূল ধরে অধিকার বিস্তার করলে, বৎসরাজ প্রতিহার তাঁকে বাধা দিতে দোয়াবে এি ধর্মপাল পরাস্ত হন। কিন্তু বৎসরাজ তাঁর বিজয় স্থায়ী করার আগেই দক্ষিণের রাষ্ট্র ধ্রুব বৎসরার মরু অঞ্চলে বিতাড়িত করেন। ধ্রুব এরপর ধর্মপালকে পরাস্ত করার জন্যে এগিয়ে এলে ধর্মপ বল্লমধারী পদাতিক ধর্মপালকে পরাস্ত করলেও এ জয় স্থায়ী হয় নি। ধ্রুব দক্ষিণে নিজ রাজ্য পেরে দক্ষিণে ফিরে যান। এ শক্তি শূন্যতার সুযোগে ধর্মপাল তাঁর হৃতশক্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন
খালিমপুরের তাম্রলিপিতে ধর্মপালের রাজ্যবিস্তার ও কৌনজের দরব মুঙ্গের লিপি থেকে জানা যায় যে, রাষ্ট্রকূট ও প্রতিহার উভয় শক্তির সামরিক দুর্বলতার সুযোগ স্থান অধিকার করেন। নারায়ণ পালের ভাগলপুর তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, ধর্মপাল ইন্দ্রায়ুধকে বিতাড়িত করে চক্রায়ুধকে নিজের হাতের পুতুল হিসেবে বসান। ধর্মপালের সামস্ত করতে থাকেন। ধর্মপাল উত্তর ভারতের দূরবর্তী অঞ্চলে অধীনস্থ সামস্তদের দ্বারা শাসনের উত্তর ভারতের নানা অঞ্চল জয় করে কৌনজে যে দরবারের অনুষ্ঠান
করেন, ভাতে উত্তর ভা উপস্থিত হয়ে বশ্যতা জানান বলে খালিমপুর লিপিতে বলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মমিন চৌধুরীর মতে, খালিমপুর লিপিতে সামন্ত রাজাদের উপর সম্পর্কে অতিশয়োক্তি আছে। ধর্মপালের এত বড় রাজ্য তার করা সম্ভব ছিল না বলে তিনি বে গুজরাটি কবি সোডঢলের 'উদয় সুন্দরী' কথা কাব্যে খালিমপুর লিপির বিবরণ সমাহিত হচ্ছে।
ড. মজুমদারের মতে, ধর্মপাল সমগ্র সাম্রাজ্য প্রত্যক্ষভাবে শাসন করতেন না। বাংলা ও বিহার ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনে। বাংলা ও বিহার ছিল তাঁর সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড। কৌনজ তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনে না হলেও তাঁর বিশেষ এক্তিয়ার ছিল। তাঁর বাইরে পাঞ্জাব পর্যন্ত ও মালব রাজপুতানা পর্যন্ত তাঁর সামন্ত রাজ্য ছিল। এ সামন্ত রাজারা তাঁর প্রতি আনুগত্য জানাতেন। ড. মজুমদারের মতে, খালিমপুর লিপি একটি সমকালীন উপাদান। এ লিপির সাক্ষ্যকে অবিশ্বাস করার কারণ নেই। ২য় ত্রিমুখী সংঘর্ষ (ধর্মপাল-নাগভট্ট-গোবিন্দ) : ধর্মপালের রাজত্বের শেষদিকে তাঁকে পুনরায় ত্রিশক্তি দ্বন্দ্বে ভাগ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। বৎসরাজের পুত্র নাগভট, প্রতিহার সিন্ধু, বিদর্ভ, অন্ধ প্রভৃতি রাজ্যের সাথে মিত্রতা স্থাপন করে ধর্মপালকে মিত্রহীন করে তোলেন। তারপর তিনি কৌনজ আক্রমণ করে ধর্মপালের সামন্ত ও প্রতিনিধি চক্রায়ুধকে বিতাড়িত করেন। এ অবস্থায় সম্ভবত ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় গোবিন্দের সাহায্য চান। কিন্তু রাষ্ট্রকূট হস্ত ক্ষেগের আগেই কৌনজ পুনরুদ্ধারের জন্য এগিয়ে যান। প্রতিহার রাজাদের গোয়ালিয়র লিপি থেকে জানা যায়, এ যুদ্ধে ধর্মপাল পরাস্ত হন। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রকূট দক্ষিণ হতে আক্রমণ চালায়। রাষ্ট্রকূট শক্তি প্রতিহারদের হাত থেকে বিজয়লক্ষ্মীকে ছিনিয়ে নেন। রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় গোবিন্দ, নাগভট্ট প্রতিহারকে পরাস্ত করেন। বাঁশ গাছ যেমন ঝড়ের সময় নুয়ে পড়ে পরে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দের কাছে সেরূপ 'বেতসীবৃত্তি' দেখান। তিনি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দের কাছে বশ্যতা জানান ।
ধর্মপালের কৃতিত্ব : ড. মজুমদারের মতে, রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দ দক্ষিণে ফিরে গেলে উত্তরে যে শক্তিশূন্যতা দেখা দেয় তার সুযোগে ধর্মপাল তাঁর লুপ্ত ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁকে আর কোন বিপদের সম্মুখীন হতে হয় নি। এভাবে ধর্মপাল বাংলার একটি প্রাদেশিক রাজ্যকে এক উত্তর ভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। ড. মজুমদারের মতে, ধর্মপালের রাজত্বকে বাঙালি জীবনের 'সুপ্রভাত' বলা চলে। তাঁর কূটনৈতিক ও সাময়িক কৃতিত্বের কথা সুবিদিত। শশাঙ্ক কৌনজ জয় করলেও তা অধিকারে রাখতে পারে নি। ধর্মপাল কৌনজ জয় করে তাঁর সামন্ত চক্রায়ুধকে কৌনজে বসিয়ে দেন। সোডঢলের মতে, ধর্মপাল ছিলেন 'উত্তরাপথস্বামীন'। খালিমপুর ও মুঙ্গের সাক্ষ্য লিপি থেকে মনে হয় যে, ধর্মপাল, তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য নিজ বাহুবলেই বিস্তার করেন। তৃতীয় গোবিন্দ উত্তর ভারত থেকে চলে গেলে ধর্মপাল তাঁর হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করেন। তবে অনেকে মনে করেন যে, নাগভট্ট প্রতিহারের কাছে পরাজয় ও রাষ্ট্রকূট তৃতীয় গোবিন্দের প্রতি বশ্যতা জ্ঞাপন ধর্মপালের সার্বভৌমত্বের হানি করে। যেসব রাজা আগে তার প্রতি বশ্যতা জানান তাঁরা আর তাকে অধিরাজ হিসেবে মান্য করতেন কি না সন্দেহ। ড. মজুমদার অবশ্য ধর্মপালের পুত্র দেবপালের সাফল্যের কথা মনে রেখেই বলেছেন যে, ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট শক্তির অপসারণের পর নষ্ট ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কৃতিত্ব : ধর্মপালের রাজত্বকালে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিশেষ উন্নতি হয়। ধর্মপাল মগধে নিজ স্থানে বিক্রমশীলা বিহার স্থাপন করেন। ধর্মপালের অন্য নাম ছিল বিক্রমশীলদের। তিনি সম্ভবত ওদন্তপুরী বিহার স্থাপন করেন। তিনি সোমপুর বিহার আংশিক স্থাপন করেন। এসব বিহারে বিদ্যাচর্চা, অধ্যাপনা ও ধর্মচর্চা হতো। পাল রাজারা ছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী। ধর্মপালদেব বৌদ্ধধর্মের প্রতি তাঁর অনুরক্তির জন্য পরম সৌগত বলে কোন কোন লিপিতে আখ্যাত হয়েছে। তাঁর লিপিতে ধর্মচক্রের চিহ্ন খোদিত দেখা যায়। বৌদ্ধ পণ্ডিত হরিভদ্র ছিলেন তাঁর গুরু । তবে ধর্মপাল ভারতীয় সংস্কৃতির রীতি অনুসারে ধর্মসহিষ্ণুতা নীতি অনুসরণ করেন। ধর্মপালদেবের আমলে বাংলার আর্থিক উন্নতি বিশেষভাবে ঘটেছিল। উন্নত কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, বাংলাকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কেন্দ্রে পরিণত করে। পাল যুগে বাংলা সাহিত্য, চর্যাপদ, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যের বিপদ ঘটে।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, পিতার মৃত্যুর পর ধর্মপাল প্রায় চল্লিশ বছর রাজত্ব করেন। ধর্মপালের গড়া বিশাল অঞ্চল তখন আর রাজ্য নয়, বরঞ্চ তা পাল সাম্রাজ্য নামে পরিচিতি পায়। খালিমপুর তাম্রশাসনে পাটলিপুত্রের মহিমা ও ধর্মপালের প্রবল পরাক্রম সম্পর্কে উচ্ছ্বাসিত বর্ণনা রয়েছে এবং সেখানে বর্ণিত আছে যে, বাংলার সর্বত্র জীবনের সর্বস্তরে ধর্মপালের গুণ কীর্তিত হতো। ভারতবর্ষের ইতিহাসে বাংলাদেশের এ বীর সন্তান যে সমুচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত থাকবে, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]