, প্রাচীন যুগের পাল বংশের অন্যতম শাসক দেনপালের কৃতিত্ব পর্যালোচনা কর। উত্তরা

ভূমিকা ঃ বাংলার প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাজা শশাঙ্কের পতনের পর অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে গোপাল পাল বংশের সূচনা করেন। আর এ পাল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ধর্মপালের মৃত্যুর পর উপযুক্ত পিতার উপযুক্ত বিজয়ী দেবপাল পরমেশ্বর পরমটারক মহারাজাধিরাজ উপাধি ধারণ করে পিতৃ া আর কর। মির তাম্রলিপি অনুসারে ধর্মপালের স্ত্রী রাষ্ট্রকুটরাজ পরবর্গের কন্যা রীদেবীর জেষ্ঠপুত্র ছিল পাল ও কনিষ্ঠপুর সেট বা সেপাল নামে দুই পুত্রের মধ্যে আজীবন বিজয়ী দেবপাল রাজ্যভার গ্রহণ করেন। দেবপাল তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্বকালে (৮১০-৮৫০) পিতৃ সিংহাসন অক্ষুণ্ণ রাখার পরও বাহুবলে আর্যাবর্তে বিশাল সমাজ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, তথ্যের সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না। যা জানা যায় তা কেবল বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ ও পরোক্ষ তথ্যাদি থেকে।
দেবপালের কৃতিত্ব ঃ
পালবংশের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ধর্মপাল হলেও দেবপালের কৃতিত্ব ও প্রশসংনীয়। নিম্নে • দেবপালের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
বিজেতা হিসেবে ঃ পালবংশের শাসকদের মধ্যে দেবপাল একমাত্র ব্যক্তি যিনি আজীবন কোন যুদ্ধে তেমন পরাজয়বরণ করে নি । নিম্নে এর বিজেতাহিদের কৃতিত্বের বিবরণ দেওয়া হল ঃ ১. প্রাগজোতিষ জয় : ব্রহ্মপুত্র নদের উপত্যকার নাম প্রাগজোতিষ। ভাগলপুর তাম্রশাসনে বলা হয়েছে যে, প্রাগজোতিষের রাজা সম্ভবত প্রলম্ব অথবা তাঁর পুত্র হররাজ গৌড়ের সেনাপতি জয়পালের নাম শুনে যুদ্ধোদ্যম ত্যাগ করে পাল রাজাদের বশ্যতা স্বীকার করেন। এ থেকে মনে হয় যে, প্রাগজোতিষের রাজা বিনাযুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করে সামন্ত রাজার ন্যায় রাজত্ব করেন।
২. উড়িষ্যা জয় :
দেবপাল কর্তৃক উৎকল বা উড়িষ্যা জয়ের কথা বাদল শিলালিপি ও ভাগলপুর শিলালিপিতে উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক তারনাথও এর উল্লেখ করেছেন। সীমান্তবর্তী রাজ্যে বিজয়াভিযান প্রেরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক। ভঞ্জবংশীয় রাজা রণভঞ্জের রাজধানী পরিত্যাগের ফলে দেবপাল উড়িষ্যা অধিকার করেন। ভঞ্জ রাজ বংশের লিপিতে এ রাজধানী পরিত্যাগের উল্লেখ আছে। অন্যদিকে, ঐতিহাসিক তারনাথের বর্ণনা অনুসারে দেবপাল করবংশীয় রাজ্য শিবকরকে পরাজিত করে উড়িষ্যা অধিকার করেন। তবে দেবপাল উড়িষ্যা অধিকার করে তা পালরাজ্যভুক্ত করেন। . মজুমদারের মতে, দেবপাল সম্ভবত নবম শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাই এ বংশীয় রাজাকে দূর করে দেবপাল অন্তত উড়িষ্যা বা তাঁর অধিকাংশ অঞ্চল অধিকার করেন।
৩. রাজ্য ও কম্বোজ জয় :
দেবপাল যে হুনজাতির গর্ব খর্ব করেন তাদের রাজ্য কোথায় ছিল তা নিশ্চিত বলা যায় না। ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রারম্ভে হুনজাতি আর্যাবর্তের পশ্চিম ভাগে বিস্তৃত রাজ্য স্থাপন করেছিল। কিন্তু তারা ক্রমশ হীনবল হয়ে পড়েন এবং বিভিন্ন স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেন। হর্ণচরিত্র পাঠে জানা যায় যে, উত্তরাপথে হিমালয়ের কাছে শুনদের একটি রাজ্য ছিল। সম্ভবত দেবপাল এ রাজ্য জয় করে কম্বোজ পর্যন্ত অগ্রসর হন। পঞ্চনদের উত্তর পশ্চিমে ও গ্যাঙ্গারের ঠিক উত্তরে হুনরাজ্যের ন্যায় পাল সাম্রাজ্যের সীমান্ত অবস্থিত ছিল। সুতরাং, এ দুই রাজ্যের সাথে কোন মতবিরোধের ফলে অথবা স্বীয় শাসিত এলাকার নিরাপত্তা বিধানের জন্য হুন ও কম্বোজ জয় খুবই স্বাভাবিক ছিল।
৪. দ্রাবিড় রাজ্য জয় :
দেবপাল যে দ্রাবিড়নাথের দর্পচূর্ণ করেন ঐতিহাসিকরা তাকে দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূটরাজ বলে শনাক্ত করেছেন। প্রতীহার রাজার ন্যায় রাষ্ট্রকূট রাজার সাথে পাল রাজাদের বংশানুক্রমিক শত্রুতা ছিল। সুতরাং, দেবপাল কোন এক রাষ্ট্রকূট রাজাকে পরাজিত করে থাকবেন এটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দ্রাবিড় বলতে সাধারণত দাক্ষিণাত্য বুঝায় না। এটা দক্ষিণ ভারত অর্থাৎ, কৃষ্ণ নদীর দক্ষিণাস্থিত ভূভাগের নাম। এ সুদূর দেশে যে দেবপাল যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন তার পক্ষে কোন প্রমাণ না থাকাতে পণ্ডিতগণ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দ্রাবিড়নাথ এবং রাষ্ট্রকূট রাজাকে অভিন্ন রাজা বলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, দেবপাল যে দ্রাবিড়নাথকে পরাজিত করেন তিনি হলেন পাণ্ড্যরাজা শ্রীমার শ্রীবল্পও। তাঁর মতে, দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি লিপি থেকে জানা যায় যে, মগধ, করিঙ্গ, ঢোলব পহলব ওঙ্গ প্রভৃতি রাজা মিলে পাণ্ড্যরাজার সাথে যুদ্ধ করতে পারেন এটা অসম্ভব নয়। মুঙ্গেরে প্রাপ্ত দেবপালের তাম্রশাসন হতে মজুমদারের এ মতের সমর্থন পাওয়া যায়।
৫. প্রতিহার রাজাকে পরাস্ত ।
দেবপাল যে প্রতিহার রাজার দর্প চূর্ণ করেন তিনি সম্ভবত নাগভট্টের পৌত্র প্রথম ভোজ। রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয় গোবিন্দের হাতে নিদারুণ পরাজয়ের পর প্রতিহার রাজ নাগভট্ট ও তাঁর পুত্র রামভদ্রের শক্তি অতিশয় ক্ষীণ হয়েছিল। রামভদ্রের রাজত্বকালে প্রতিহার রাজ্য শত্রু কর্তৃক বিধ্বস্ত হয়েছিল এরূপ ইঙ্গিত এ বংশের লিপিতে পাওয়া যায়। তৎপুত্র ভোজ প্রথমে কিছুটা সফলতা লাভ করেছিল। কারণ, তিনি ৮৩৬ সালে কৌনজ ও কালিঞ্জরে আধিপত্য লাভ করেন । কিন্তু তিনি ৮৬৭ অব্দের পূর্বে রাষ্ট্রকূট রাজ কর্তৃক পরাজিত হন এবং ৮৬৯ অব্দের পূর্বে স্বীয় রাজ্য থেকে বিতাড়িত হন। সম্ভবত ৮৪০-৮৬০ অব্দের মধ্যে দেবপাল তাকে পরাজিত করেন।
৬. শাসক হিসেবে দেবপাল :
আজীবন বিজয়ী দেবপাল শুধুমাত্র পিতৃসাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখেন নি, বরং এর সীমানা ও বৃদ্ধি করেন। দেবপালের মুঙ্গের তাম্রশাসনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজ্যজয় উপলক্ষ্যে তাঁর সৈন্যদল বিন্ধ্যা পর্বত ও কম্বোজ অঞ্চলে বিচরণ করেছিল এবং তিনি উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্যন্ত এবং পূর্বে ও পশ্চিমে সমগ্র ভাগ শত্রুমুক্ত করে শাসন করেন। কেবলমাত্র বাদল শিলালিপিতে দক্ষিণে রাজ্যসীমা সেতুবন্ধের পরিবর্তে বিন্ধ্যা পর্বত পর্যন্ত বলা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যই শেষ হিন্দু সাম্রাজ্য, কিন্তু পাল সাম্রাজ্য যে এটা অপেক্ষাও বিস্তৃত ও অধিককাল স্থায়ী ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বাহুবলে আর্যাবর্তে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাই দেবপালের রাজত্বের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। তাঁর সময়ে পাল সাম্রাজ্য গৌরবের উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল।
৭. বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন ঃ
দেবপাল জীবনের অধিকাংশ সময় যুদ্ধবিগ্রহে ব্যস্ত থাকলেও তিনি দূর দেশীয় রাজাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন। ভারত উপমহাদেশের বাইরেও দেবপালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল । যবদ্বীপ, সুমাত্রা মালয় উপদ্বীপের অধিপতি শৈলেন্দ্র বংশীয় মহারাজা বালপুত্রদেব তার কাছে দূত প্রেরণ করেন। শৈলেন্দ্র রাজ নালন্দায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন । ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষক ঃ দেবপাল বৌদ্ধধর্ম ও শিক্ষার উন্নয়নে উৎসাহ দান করেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধধর্মের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক। মগধের বৌদ্ধ মঠগুলোর তিনি সংস্কার করেন। তিনি নালন্দায় কয়েকটি মঠ এবং বুদ্ধ গয়ায় একটি বিরাট মন্দির নির্মাণ করেন। পাটলিপুত্রের চেয়ে দেবপালের মুঙ্গের শহরের প্রতি টান ছিল বেশি। তাই তিনি মুঙ্গেরে নতুন রাজধানী স্থানান্তর করেন । তিনি বিদ্বান ও বিদূষীদের প্রতি অতিশয় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ তাঁর রাজসভা অলংকৃত করেছিল। দেবপালের পৃষ্ঠপোষকতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বৌদ্ধধর্ম সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
কে সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মপাল না দেবপাল ও দেবপাল ছিলেন পাল বংশের উল্লেখযোগ্য প্রথমসারির শাসক। ঐতিহাসিকগণ পাল রাজাদের মধ্যে ধর্মপালকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। একথা সত্য যে, গোপালদেব কর্তৃক সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাল রাজ্য ধর্মপালের রাজত্বকালে স্থায়িত্ব লাভ করেছিল। আর্যাবর্তের রাজনীতিতে, প্রাধান্য বিস্তারের জন্য গুজর প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট রাজার সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে ধর্মপাল স্বীয় রাজ্যের গৌরব ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হন। বৌদ্ধধর্ম ও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারেও ধর্মপালের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বাংলার ইতিহাসে পাল রাজাদের মধ্যে দেবপালের কৃতিত্ব কম নয়।
পিতা ধর্মপাল কর্তৃক সম্প্রসারিত সাম্রাজ্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যই দেবপালের পক্ষে রাজ্যবিস্তার করা সম্ভব হয়। সামরিক ক্ষেত্রে দেবপাল পিতা অপেক্ষা অধিক কৃতিত্বের দাবিদার। ত্রিপক্ষীয় সংঘর্ষে ধর্মপাল দু'বার পরাজিত হন যদিও পরিস্থিতি তাকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু দেবপাল সামরিক ক্ষেত্রে কোথাও বড় রকমের পরাজয় বরণ করেন নি । এরূপ জানা যায়, তার প্রচেষ্টায় বাংলাকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতে একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। পিতার ন্যায় তিনিও ছিলেন জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক । এছাড়াও বলা প্রয়োজন যে, পিতার বিশাল সাম্রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি করা অপেক্ষা যদি দেবপাল অভ্যন্তরীণ শাসন সংস্কারে মনোনিবেশ করতেন তাহলে হয়ত তার মৃত্যুর সাথে সাথে পাল সাম্রাজ্য ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হতো না। অবশ্য এর জন্য তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীরাও দায়ী ছিল। সবশেষে বলা যায়, ধর্মপাল ও দেবপালের প্রচেষ্টায় বাংলার শক্তি, সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পায় এবং আর্যাবর্তের রাজনীতিতে বাংলা একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছিল। এ অর্থে দেবপালকে বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও উল্লেখযোগ্য প্রথমসারির শাসক বলা হয় । উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, এক চরম অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে গোপাল যে পাল বংশের সূচনা করেন সে বংশের উত্তরসূরি ধর্মপালের পুত্র দেবপাল পিতৃরাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখার পরেও আসাম, উড়িষ্যা, হুন, গুজর, দ্রাবিড়, কম্বোজ জয় করে বিশাল সাম্রাজ্য সৃষ্টি করেন। এছাড়া আজীবন যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকলেও তিনি কোন যুদ্ধে বড় রকমের পরাজিত হন নি । এটা তাঁর বড় কৃতিত্ব। কারণ দেখা যায়, জয়পরাজয় মিলে হল রাজার শাসনকাল কিন্তু এদিকের বিচারে দেবপাল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী রাজা ছিলেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]