দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চন্দ্র বংশের ইতিহাস বর্ণনা কর।

উত্তর : ভূমিকা :
সাম্প্রতিককালে প্রাপ্ত ঐতিহাসিক উপাদানসমূহ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা করা সম্ভব। আগে ধারণা করা হতো দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা শুরু থেকে পাল সাম্রাজ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা যায়, এ অঞ্চলের পৃথক রাজনৈতিক সত্তা ছিল। পাল বংশের চারশ বছর ব্যাপী রাজত্বকালে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা খুব অল্প সময়ের জন্য উত্তর ও উত্তর পশ্চিম বাংলার সাথে জড়িত ছিল। অধুনা প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক বাংলায় ঐ সময়ের কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ বংশের রাজত্বকালের কথা জানা যায়। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল দেব বংশ, চন্দ্র বংশ ও বর্ম বংশ। ঐ রাজ বংশগুলোর মধ্যে চন্দ্র বংশ বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার ।
চন্দ্র বংশের ইতিহাস :
ময়নামতিতে প্রাপ্ত তিনখানি, ঢাকায় প্রাপ্ত একখানি, সিলেটের পশ্চিমভাগে প্রাপ্ত একখানি তাম্রশাসন হতে এ বংশের শাসন সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। চন্দ্র বংশের প্রথম দুজন রাজা পূর্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র সুবর্ণচন্দ্র রোহিতগিরিতে রাজত্ব করতেন। রোহিতগিরির সনাক্তকরণ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। কোন কোন পণ্ডিত রোহিতগিরিকে বিহার প্রদেশের শাহাবাদ জেলার অন্তর্গত রোটাসগড়ের প্রাচীন নাম বলে মনে করেন। তবে ডঃ নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে, কুমিল্লার কাছে লালমাই অথবা লালমাটি সংস্কৃত ভাষায় রোহিতগিরিতে পরিণত হয়েছে। লালমাই পাহাড়টি কুমিল্লার ৫ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। এখানে চন্দ্র বংশের কয়েকটি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে। চন্দ্র বংশের রাজধানী দেবপর্বত এর উপরে অবস্থিত ছিল। ডঃ আব্দুল মমিন চৌধুরী বলেন, লালমাই পাহাড়ে চন্দ্র রাজাগণের তিনটি তাম্রশাসন পাওয়া গেছে এবং এ বংশের প্রথম শক্তিশালী রাজা ত্রৈলক্য চন্দ্র হরিকেলের রাজার অধীনে ছিলেন বলে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং, লালমাই পাহাড়ের রোহিতগিরিতেই চন্দ্র বংশের রাজ্য ছিল বলে মনে করা সংগত। এ চন্দ্র বংশীয় রাজাদের সাথে আরাকানের চন্দ্র বংশের সম্ভবত নিকট সম্বন্ধ ছিল।
এ বাংলার রাজ বংশের প্রতিষ্ঠাতা পূর্ণচন্দ্র সম্বন্ধে উক্ত হয়েছে। তাঁর নাম বহু মূর্তির পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপিতে জয়স্তম্ভের গায়ে এবং তাম্রশাসনে খোদিত আছে। আর একটি তাম্রশাসনে বলা হয়েছে-- তাঁর নির্লজ্জশক্রগণ পরাজিত হয়ে তারই সৈন্যগণের পদোনিয়ত ধূলি নির্মিত ছত্রতলে আশ্রয় গ্রহণ করত। অসম্ভব নয় যে, পূর্ণচন্দ্র পাল রাজাগণের সামন্ত রূপেই এ সকল বিজয় যাত্রা করেছিলেন। তাঁর পুত্র সুবর্ণচন্দ্র সম্বন্ধে বলা হয়েছে, তিনি বৌদ্ধধর্ম অবলম্বন করেন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, পূর্ণচন্দ্র বৌদ্ধ ছিলেন না। কিন্তু পরবর্তী রাজাগণ সকলেই বৌদ্ধ ছিলেন। কারণ, তাদের তাম্রশাসনে প্রথমে বৌদ্ধের বন্দনা আছে। নিম্নে চন্দ্র বংশের রাজাদের রাজত্বকালের বিবরণ দেওয়া হল-
১. রাজা ত্রৈলক্যচন্দ্র :
কুমিল্লার লালমাই অঞ্চলেই চন্দ্রবংশীয় রাজারা প্রাথমিক ভূস্বামী ছিলেন। ত্রৈলক্যচন্দ্র তাঁর নিজ শক্তি ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা এ ক্ষুদ্র সাম্রাজ্যকে সুবিস্তৃত করতে সক্ষম হন। তাঁর পুত্রের তাম্রশাসন অনুযায়ী ত্রৈলক্যচন্দ্র চন্দ্রদ্বীপের অধিপতি ও হরিকেল রাজলক্ষ্মীর আধার ছিলেন। এতে অনুমান করা যায় তিনি হরিকেল রাজ্যেরও রাজা ছিলেন। পণ্ডিতদের ধারণা, কান্তিদেবের পরে তার রাজ্যে চন্দ্রবংশীয়দের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল । ত্রৈলক্যচন্দ্রের পৌত্রের তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তিনি বঙ্গের রাজা ছিলেন ।
ত্রৈলক্যচন্দ্র একজন স্বাধীন ও পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। কিন্তু দীনেশচন্দ্র সরকারের মতে, ত্রৈলক্যচন্দ্র একজন সামন্ত রাজা ছিলেন। কারণ, তাঁর পুত্র শ্রীচন্দের তাম্রশাসনে তাকে কেবলমাত্র মহারাজাধিরাজ বলা হয়েছে। অথচ শ্রীচন্দ্রকে পরমেশ্বর পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ বলা হয়েছে। ডঃ আব্দুল মমিন চৌধুরী প্রতিবাদ করে লেখেন, চন্দ্ররামদের তাম্রশাসনে কেবলমাত্র শাসনদাতাগণকেই এ শেষোক্ত উপাধি দেওয়া হয়েছে। অন্য সকল রাজাকে মহারাজাধিরাজ বলা হয়েছে। .
সিলেট জেলার অন্তর্গত পশ্চিম ভাগ গ্রামে প্রাপ্ত একটি তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, ত্রৈলক্যচন্দ্র বঙ্গ ও সমতট জয় করেন। কল্যাণচন্দ্রের ঢাকা তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, ত্রৈলক্যচন্দ্র গৌড় জয় করেন। পণ্ডিতদের অনুমান, তিনি ২৫/৩০ বছর রাজত্ব করেন। একটি তাম্রশাসনে ত্রৈলক্যচন্দ্রের রাণী কাঞ্চিকার উল্লেখ আছে।
২. শ্রীচন্দ্র :
পরাক্রান্ত রাজা ত্রৈলক্যচন্দ্রের পর তাঁর পুত্র শ্রীচন্দ্র রাজা হন। তাম্রশাসনসমূহ তাঁর গুণকীর্তনে ভরপুর। তাম্রশাসন থেকে ধারণা করা যায়, তিনি এ বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন। তাঁর শাসনামলে চন্দ্রবংশের প্রতিপত্তি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছেছিল । তাঁর রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি এ সাম্রাজ্যের অধিপতি হন । তাঁর রাজ্যের পঞ্চম বছরে শ্রীহট্ট তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, তিনি শ্রীহট্ট প্রদেশও জয় করেন। শ্রীচন্দ্রের পুত্র কল্যাণচন্দ্রের ঢাকা তাম্রশাসন থেকে জানা যায়, শ্রীচন্দ্র পৃথ্বীপাল ও গোবর্ম রাজাকে পরাজিত করেন এবং রতন পালকে পরাজিত করে তাঁর স্ত্রীকে ফিরিয়ে দেন। এছাড়া লিপি প্রমাণে দেখা যায় ঢাকার মানিকগঞ্জ মহকুমা, ঢাকা ফরিদপুরে পদ্মা তীরবর্তী এলাকা, শ্রীহট্ট অঞ্চল ও কুমিল্লা, নোয়াখালী সমতট অঞ্চল তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। অর্থাৎ, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা তার শাসনাধীনে ছিল ।
শ্রীহট্টর রাজত্বকালের ছয়টি তাম্রশাসন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। সবগুলো বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার থেকে প্রদত্ত। এর একটিতে সমতট-পদ্মাবতী বিষয়ের উল্লেখ আছে। এতে প্রমাণিত হয়, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতেও পদ্মা নদীর আস্তিত্ব বজায় ছিল । "
৩. কল্যাণচন্দ্র :
শ্রীচন্দ্রের মৃত্যুর পর কল্যাণচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অন্তত ২৪ বছর রাজত্ব করেন। তাঁর রাজত্বকালেও চন্দ্রবংশের শৌর্যবীর্য অক্ষুণ্ণ ছিল বলে মনে করা হয়। তাঁর পুত্র ও পৌত্রের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, তিনি ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ম্লেচ্ছ ও গৌড়দেরকে পরাজিত করেন। তিনি কামরূপেও যুদ্ধ করেন। তিনি পিতার ন্যায় পালরাজাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন। তাকে দানেবলি, সত্যবাদিতায় যুধিষ্ঠির ও বীর অর্জুনের সাথে তুলনা করা হয়েছে ।
৪. লডহচন্দ্র :
কল্যাণচন্দ্রের পর তাঁর পুত্র লডহচন্দ্র রাজা হন। তিনি অন্তত ১৮ বছর রাজত্ব করেন। ময়নামতিতে লডহচন্দ্রের দুটি ও তাঁর পুত্র গোবিন্দ চন্দ্রের একটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হওয়ায় চন্দ্রবংশে তাদের স্থান সম্বন্ধে এখন কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তাঁর এবং তাঁর পুত্রের তাম্রশাসনের প্রশস্তি থেকে জানা যায়, তিনি ধর্মপ্রাণ কবি ও পণ্ডিত ছিলেন। তিনি বাসুদেবের উদ্দেশ্যে ভূমিদান করে অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তাঁর শাসনামলের প্রাপ্ত একটি মূর্তি থেকে ধারণা করা হয় যে, শিবের পূজার প্রচলন ছিল। ডঃ নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে, কুসুমদেব নামক জনৈক সামন্ত রাজা লডহচন্দ্রের অধীনস্ত রাজা ছিলেন। তিনি কুমিল্লা অঞ্চলে রাজত্ব করেন।
৫. গোবিন্দচন্দ্র ঃ
লডহচন্দ্রের পর তাঁর পুত্র গোবিন্দচন্দ্র সিংহাসনে আরোহণ করেন। গোবিন্দচন্দ্রের নাম দুটি মূর্তিলিপি তিরুমুলাই লিপি ও শব্দ প্রদীপ গ্রন্থ থেকে জানা যায়। কিন্তু ময়নামতিতে প্রাপ্ত তাঁর তাম্রশাসনে তাঁর বংশ পরিচয় ও কালানুক্রমিক সম্পর্ক সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ও গুণাবলির কথা, তাঁর তাম্রশাসনে বলা হয়েছে এবং আশা পোষণ করা হয়েছে, ব্রহ্মা বিষ্ণু তাঁর রাজত্বকে দীর্ঘস্থায়ী করবে।
গোবিন্দচন্দ্র সিংহাসনে বসার অল্পকাল পরেই চৌলরাজ রাজেন্দ্রচোল তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে পরাজিত করেন। চোলরাজের তাম্রশাসনে গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্য “অবিরাম বর্ষা বারিসিক্ত বঙ্গালদেশ" বলে অভিহিত করা হয়েছে। বঙ্গালদেশ বলতে সাধারণত পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ বুঝায়। চোলরাজার তাম্রশাসনে বলা হয়েছে, ঢোলসেনাপতির সাথে যুদ্ধে গোবিন্দচন্দ্র পরাজিত হন এবং হাতির পিঠ থেকে অবতরণ করে পলায়ন করেন। কুলচুরিরাজাগণ যখন পূর্ব বাংলা আক্রমণ করেন তখন বঙ্গদেশের রাজা ছিলেন গোবিন্দচন্দ্র। এ দুই বৈদেশিক আক্রমণে চন্দ্ররাজা দুর্বল হয়ে পড়েন এবং তার পতন ঘটেছিল । গোবিন্দচন্দ্র ২৩ বছর রাজত্ব করেন। গোবিন্দচন্দ্র চন্দ্রবংশের শেষ রাজা। তিনিও পিতা সড়হচন্দ্রের ন্যায় ধর্মের প্রতি উদার মনোভাব পোষণ করতেন।
উপসংহার :
আলোচনার শেষান্তে বলা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার চন্দ্রবংশের রাজত্বকাল এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এ চন্দ্র রাজবংশ প্রায় দেড় শতাব্দীকাল শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তবে ত্রৈলক্যচন্দ্র প্রথম রাজা হলেও শ্রীচন্দ্র ছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। তবে কল্যাণচন্দ্র লডহচন্দ্রের রাজত্বকালে এর প্রভাব কিছুটা বজায় থাকলেও গোবিন্দচন্দ্রের রাজত্বকালে বৈদেশিক আক্রমণের ফলে এ বংশ হীনবল হয়ে পড়েছিল। তাই ইতিহাসের পরম সত্য ঠেকাতে এ বংশ ব্যর্থ হয় ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]