উত্তরা ভূমিকা : প্রায় দুশতাব্দীব্যাপী গুপ্ত শাসনকাল উপমহাদেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে এক অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে। গুপ্তযুগ ছিল ভারতীয় ইতিহাসের স্বর্ণযুগ। এ যুগে গুপ্ত সম্রাটদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও উদার পৃষ্ঠপোষকতার ফলে সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি ক্ষেত্রে ভারতীয় মনীষার আবির্ভাব ঘটে। সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অগ্রগতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতির অনবদ্য উৎকর্ষের জন্য. ঐতিহাসিক বার্নেট গুপ্তযুগকে এথেন্সের পৌরক্লিস, রোমের অগাস্টাস এবং বিলেতের এলিজাবেথ ও স্টুয়ার্টের যুগের সাথে তুলনা করেছেন ৷
গুপ্তযুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ ঃ নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
៖
১. রাজনৈতিক উৎকর্ষতা ও সুশাসন : গুপ্তযুগে উপমহাদেশের সার্বিক উন্নতির মূলে ছিল রাজনৈতিক উৎকর্ষতা ও সুশাসন। দ্বিবিধ ক্ষেত্রে এ উৎকর্ষতা সাধিত হয়। এ সময় ভারতবর্ষে বিশাল হিন্দু সাম্রাজ্য গঠিত হয়েছিল।
২. ঐক্যবদ্ধ বিশাল সাম্রাজ্য : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর উপমহাদেশের রাজনৈতিক গগনে যে তমসাচ্ছন্ন অবস্থা দেখা দিয়েছিল তা বিদুরিত করে গুপ্ত সম্রাটগণ খণ্ডিত উপমহাদেশে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করেন। তাদের ক্ষিপ্র বিজয়াভিযানের ফলে শক ও কুষান প্রভৃতি বৈদেশিক রাজবংশ নির্মূল হয় এবং প্রায় সমগ্র উপমহাদেশে শান্তি ও শৃংখলা স্থাপিত হয় ।
৩. সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা। গুপ্তযুগে শাসনব্যবস্থার প্রধান আদর্শ ি
ক্ষমতার অধিকারী ও সকও মওযুধের কর্তা হলেও স্বেচ্ছাচারী ছিলেন না। চীনা পরিব্রাজক ি ভূয়সী প্রসংসা করেছেন। গুপ্তযুগের বৈশিষ্ট্য ছিল কঠোর
হয়েছিল। শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকৃত হওয়ার ফলে সুনিধিষ্ঠিত ছিল। বিচারব্য জীবন ও সম্পদ ছিল নিরাপদ।
৪. অর্থনীতি । দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি স্বভাব বা তার সমৃদ্ধিই গুপ্ত সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সুসংহত করে।
কৃষি ব্যবহার উন্নতি । ৩৫ যুগে অর্থনৈতিক জীবনের মূলভিত্তি ছিল কৃষি কাজ। চা গুপ্ত যুগে কৃষিকাজে লাভজনক বৃত্তিতে পরিণত হয়। সমাজের সকল শ্রেণি
সরকারের আয়ের অধিকাংশই কার্য উৎপন্নের উপর কর হতে আসত।
৬. স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম। এযুগে কৃষি কাজ ছাড়াও ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রচলন ছিল। অবশ্য অর্থনীতির এ যুগে আভ্যন্তরীণ লেনদেন কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। তবে বৈদেশিক বাণিজ্যের যে চপ ছিল পাওয়া যায়। ফাহিয়েন গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কথা বুঝাতে গিয়ে লিখেছেন, মানুষ খুলে ঘুমাত। দস্যু, তস্কর, চোর, ডাকাতের কোন উপদ্রব ছিল না।
৭. হিন্দু ধর্মের উত্থান ও নবজীবন লাভ গুপ্ত সম্রাটগণ হিন্দু ধর্মকে রাজ ধর্মে পরিণত করে
নিশ্চিন্তে
লুপ্ত হিন্দু প্রথা সম্রাটগণ পুনঃজাগিয়ে তোলেন। হিন্দু ধর্মের নবজাগরণ গুপ্তযুগকে বিখ্যাত করে তোলে। আর্যধর্ম পরিবর্তিত হয়ে গুপ্ত যুগে যে আকার ধারণ করে তাই বর্তমান হিন্দু ধর্ম। কতকগুলো নতুন নতুন দেবতার পুজা, মুরুদ্বানের পরিবে জাঁকজমকপূর্ণ মন্দির নির্মাণ করে তাতে পূজার ব্যবস্থা প্রভৃতি ছিল গুপ্তযুগের বৈশিষ্ট্য।
৮. ধর্মীয় সহিষ্ণুতা : গুপ্ত রাজরা হিন্দু ব্রাহ্মণধর্মে বিশ্বাসী হলেও অপরাপর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। পরধর্ম সহিষ্ণুতা ছিল গুপ্তযুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এ যুগে হিন্দু ধর্মের পাশাপাশি বৈষ্ণব, শিব ও বৌদ্ধ ধর্মও প্রাধান্য ছিল। পালনের স্বাধীনতা সকলেই ভোগ করত। গুপ্তযুগের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার এরূপ মনোভাব তাদের উন্নত সভ্যতা সংস্কৃতি বিশেষ পরিচায়ক ছিল।
৯. সাহিত্য ও সংস্কৃত ভাষার অপূর্ব উন্নতি : গুপ্ত সম্রাটগণ সংস্কৃত ভাষাকে রাজ ভাষায় পরিণত করেন। সংস্কৃত সাহিত্যের অপূর্ব উন্নতি এ যুগকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিসন, চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের সার বীরসেন এবং সর্বোপরি 'মেঘদূত', 'অভিজ্ঞান শকুন্ডলম' প্রভৃতি গ্রন্থ রচয়িতা মহাকবি কালিদাস এ যুগে জন্মগ্রহণ করেন রামায়ন, মহাভারত এবং পুরাণগুলো এ যুগে বর্তমান আকার ধারণ করে। এককথায় গুপ্তযুগ ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের স্বর্ণযুগ। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত নিজেই কবি ছিলেন। তিনি বহু কবিতা রচনা করে 'কবিরাজ' উপাধি লাভ করেছিলেন।
১০. জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতি : জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগে যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়। এ যুগে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, গণিত, আয়ুর্বেদ প্রভৃতি বিজ্ঞানশাস্ত্রের প্রভূত উন্নতি হয়। গণিত ও জ্যোতিষের গ্রন্থ প্রণেতা আর্য জ্যোতিষ ও অন্যান্য জ্ঞানের কোষগ্রন্থ বৃহৎ সংহিতা রচয়িতা বরাহ মিহির প্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিদ গর্গ ও ব্রহ্মগুপ্ত এ যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। শৈল্যবিদ্যায়ও এ সময় যথেষ্ট উন্নতি সাধিত হয় ।
১১. শিল্পকলা ও ভাস্কর্য : গুপ্তযুগে সঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য প্রভৃতি শিল্পের অপূর্ব উন্নতি হয়। এ যুগে অজন্তা গুহার প্রাচীর চিত্রাবলি পৃথিবীর বিস্ময়ের বস্তু। সারনাথের বুদ্ধ প্রতিমা ভাস্কর্য শিল্পের চরম উন্নতির সাক্ষ্য বহন করছে। ঝাঁসী জেলার দেওগড়ে অবস্থিত দশাবতারের প্রস্তর মন্দির, কানপুর জেলার ভিটার গাঁয়ের মন্দির এবং বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির এ যুগের স্থাপত্য শিল্পের অবদান। দিল্লীর নিকটে চন্দ্ররাজ্যের লৌহস্তন্ত ও তার কারুকার্য কারুশিল্পের চরম উন্নতির নিদর্শন। সুলতানগঞ্জের বৌদ্ধ মূর্তিও ধাতব শিল্পে অনুরূপ উৎকর্যের পরিচয় দান করে। গুপ্তযুগের স্বর্ণমুদ্রাগুলো স্বর্ণ শিল্পের উন্নতির প্রকৃষ্ট প্রমাণ দিচ্ছে।
তৎকালীন সমাজে সংগীত চর্চার বিশেষ প্রচলন থাকায় সংগীতবিদ্যারও যথেষ্ট বিকাশ সাধিত হয়। সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত নিজেও একজন বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ ছিলেন। ঐতিহাসিক বার্নেট নির্ভুলভাবে গুপ্তযুগকে এথেন্সের পেরিক্লিয়ান, রোমের অগাস্টান এবং ইংল্যান্ডের এলিজাবেথিয়ান ও স্টুয়ার্টের যুগের যুগের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
উপসংহার : প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গুপ্তযুগ একটি গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা করে। গুপ্তযুগ উপমহাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ। বস্তুত এ যুগে শাসন, অর্থনীতি, সমাজজীবন, সাহিত্য সংস্কৃতি, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই চরম উৎকর্ষতা সাধিত হয়। মনে হয় এ কারণেই ঐতিহাসিকগণ গুপ্তযুগকে উপমহাদেশের ইতিহাসের স্বর্ণযুগ বলেছেন। ঐতিহাসিকদের এ মন্তব্য যে যথার্থ ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত