সমুদ্র গুপ্তের চরিত্র বা রাজ্য বিস্তারের বিবরণ দাও। তাকে কি ভারতীয় নেপোলিয়ন বলা যায়?

উত্তরা ভূমিকা : প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পাটরানী কুমার দেবীর গর্ভে সমুদ্র গুপ্তের জন্ম হয়। 'এলাহাবাদ স্তম্ভলিপি' হতে জানা যায় যে, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্র গুপ্তকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান এবং চন্দ্রগুপ্ত গুপ্তের মনোনয়নের কথা প্রকাশ্যভাবে ঘোষণা করলে তার আরীয় বৰ্গ মর্মাহত হন। সমুদ্র গুপ্তের সিংহাসনের আরোহণকাল সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। সম্ভবতঃ তিনি ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন ।
১. বিজেতা হিসেবে : সমুদ্র গুপ্ত প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে একজন শ্রেষ্ঠ নরপতি এবং প্রতিভাবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি একাধারে দিগ্বিজয়ী, বীর, সুশাসক, রাজনীতিবিদ, সুকবি, সুনাগরিক ও উদার ধর্ম মতাবলম্বী ছিলেন। তাঁর পিতা প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন একজন ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি, কিন্তু সমুদ্র গুপ্ত স্বীয় বাহু বলে এই ক্ষুদ্র রাজ্যকে একটি বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। উত্তর ভারতের শক্তিশালী নাগশক্তিকে পরাজিত করে তিনি গাঙ্গেয় উপত্যকায় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে যে বিক্রম প্রদর্শন করে ছিলেন দাক্ষিণাত্য অভিযানে তা অপেক্ষা অনেক বেশি পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। দক্ষিণের যুদ্ধের প্রবল পরাক্রান্ত পল্লব শক্তিকে পরাস্ত করে তিনি এক বিস্ময়কর কৃতিত্বের পরিচয় দেন। সমুদ্র গুপ্তের সাম্রাজ্য হিমালয় হতে নর্মাদা এবং ব্রহ্মপুত্র হতে চম্বল নদ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার এই দিগ্বিজয়ের জন্য ঐতিহাসিক স্মিথ তাকে ভারতীয় নেপোলিয়ান নামে আখ্যায়িত করেছেন ।
২. সামরিক প্রতিভা : হরি সেন রচিত প্রশস্তি হতে সমুদ্র গুপ্তের সামরিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। কৌটিল্য কর্তৃক প্রচারিত রাষ্ট্রীয় নীতির তিনি ছিলেন মূর্ত প্রতীক । শক্তিমান মাত্রই যুদ্ধ করবে ও শত্রু নিপাত করবে। কৌটিল্যের এই নীতি সমুদ্রগুপ্ত অনুসরণ করে চলেছিলেন ।
৩. উত্তর ভারত অভিযান : এলাহ বাদ হস্তলিপি অনুসারে সমুদ্র গুপ্ত উত্তর ভারতের নয় জন রাজাকে পরাজিত করে তাদের রাজ্য নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। হরিসেন প্রসস্থিতে বলা হয়েছে যে, এই সকল নৃপতিদের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করে সমুদ্র গুপ্ত পুষ্পগণের আনন্দ উপভোগ করেন। অচ্যুত সম্ভবত বেরিলির সন্নিকটে অহিচ্ছত্র রাজ্যের অধিপতি ছিলেন । নাগ সেন ছিলেন
গোয়ালিয়রের অন্তর্গত পদ্মারতীর নাগ বংশের রাজা। চন্দ্রবর্মন ছিলেন সুশুনিয়া অধিপতি। তবে প্রথমবারেই সমুদ্র গুপ্ত এই রাজ্যগুলোকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন নাই। কারণ, হরিসেন ১৩-১৪ অনুচ্ছেদ অধি গ্রহণের কথা বলেন নাই । সম্ভবতঃ এ রাজাদের বশ্যতা লাভ করেই সমুদ্র গুপ্ত সন্তুষ্ট ছিলেন এবং দক্ষিণ ভারতে অভিযানে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে তিনি আর্যবতের এই রাজ্যগুলোকে পুরাপুরি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে নিষ্কণ্টক হয়েছিলেন।
৪. দক্ষিণ ভারত অভিযান : আর্যাবর্তে একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করে সমুদ্র গুপ্ত দক্ষিণ ভারতের দিকে অগ্রসর হন । ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি' হতে জানা যায় যে, দক্ষিণ ভারতে সমুদ্রগুপ্ত যে সকল রাজাকে পরাজিত করেছেন তাদের মধ্যে কৌশলের মহেন্দ্র, মহাকান্তাষের ব্যাঘ্র রাজা কৌরলের মন্তারাজ, কোত্তরের স্বামী দত্ত এরন্তের দমন, কাঞ্চীর বিষ্ণু গোপ অভমুক্তার নীল রাজ, কুস্তালা পুরের ধনঞ্জয় সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। দক্ষিণ ভারতের এই অভিযান সামরিক দিক হতে সাফল্যমণ্ডিত হলেও সমুদ্র গুপ্ত বিজিত রাজ্যগুলোকে নিজ রাজ্যভুক্ত না করে বিজিত রাজন্য বর্গের নিকট হতে আনুগত্যের শপথ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন। সম্ভবতঃ সুদূর পাটলিপুত্র হতে দক্ষিণ ভারতের উপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখা সম্ভব নহে উপলদ্ধি করে তিনি এরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। ইহা তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচায়ক ৫. আটবিক রাজ্য জয় : সে সময় গাজীপুর ও জব্বলপুরের অরণ্য অঞ্চলের রাজ্যসমূহ আটবিক রাজ্য বা অরণ্যরাজ্য নামে পরিচিত ছিল। উত্তর ভ ত অধিকার করার পর তিনি আটবিক রাজ্য দখল করায় তিনি মনোনিবেশ করেন। লিপি অনুসারে সমুদ্রগুপ্ত সমস্ত আটা রাজ্যের রাজাদিগকে পরাজিত করে বিজয়কার্য সম্পন্ন করেন। এ অঞ্চলের বিজয়াভিযান সম্বন্ধে সমুদ্রগুপ্তের এরানলিপিতে প্রমাণ পাওয়া যায় ।
৬. সীমান্ত রাজন্যবর্গের আনুগত্য লাভ : আর্যবর্ত ও দক্ষিণ ভারতে সমুদ্র গুপ্তের দিগ্বিজয়ে আতঙ্কিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের সীমান্তবর্তী রাজ্য ও উপজাতিগুলো সমুদ্র গুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করে করপ্রদানে সম্মত হয়। এই রাজ্যগুলোর মধ্যে প্রধান হল সমতট বা পূর্ব বাংলা, কামরূপ বা আসাম, দভাক বা পূর্ব বাংলার ঢাকা, নেপাল, মালব, আর্জুনায়ন, দাভীর প্রভৃতি। এমনকি উত্তর পশ্চিম ভারতের কৃষাণ ও গুজরাটের শকরাজাও তার বশ্যতা স্বীকার করেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত উপজাতি রাজ্যগুলোকে সমুদ্র গুপ্ত অধীনস্থ মিত্র হিসেবে গণ্য করতেন বলে পণ্ডিতদের ধারণা। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিক রোমিরা থাপারের মতে, সমুদ্র গুপ্ত উপজাতিগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন এবং এই পথে আক্রমণের পথকে সহজ করে দেন।
৭. শাসক হিসেবে কৃতিত্ব : শাসক হিসেবেও তিনি সাফল্য অর্জন করেন। তিনি বৈদেশিক প্রভাব হতে শাসন ব্যবস্থাকে মুক্ত করে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করেন। তার সময় রাজ্যকর্মচারীদের উপাধী, ক্ষমতা ও উহাদের পদবিন্যাস সুনিয়ন্ত্রিত ও সুস্পষ্ট করা হয়েছিল। উত্তর ভারতে মুসলমানদের অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত তাঁর প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা মোটামুটিভাবে অবস্থিত ছিল। দিকদর্শন গাইড সিরিজ
পরধর্ম সহিষ্ণুতা। ধর্মের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন উদার। সিংহল রাজ মেঘবর্ণকে বৌদ্ধ গয়ায় বৌদ্ধ মঠ নির্মাণের প্রদান ও বৌদ্ধ পণ্ডিত বসুবন্ধুকে মন্ত্রী পদে নিয়োগ করার ব্যাপারে তার পরধর্ম সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়। ন, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও সুশাসক হিসেবে তিনি সমগ্র ভারতের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করে আছেন।
ব্যক্তিগত চরিত্র ও গুণাবলি । সমুদ্র গুপ্ত নিজে বিবিধ গুণের অধিকারী ছিলেন। হরিসেনের মতে, তিনি কাব্য জীত, শিল্প এবং রণ বিদ্যা প্রভৃতি সকল গুণের অধিকারী ছিলেন। তাঁর বীনাবাদনরত মূর্তি যুক্ত মুদ্রা তার সঙ্গীত সাক্ষ্য দিচ্ছে। তার রণ পণ্ডিত্যের জন্য স্মিথ তাকে ভারতের নেপোলিয়ান বলে আখ্যা দিয়েছেন। তিনি ভারতীয় এর মূর্তি যুক্ত উন্নতমানের স্বর্ণ মুদ্রা প্রচলন করে তার শিল্প বোধের পরিচয় দিয়েছেন। . রায় চৌধুরী তাকে মৌর্য সম্রাট অশোকের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অশোক ধর্ম বিজয় দ্বারা প্রাধান্য পান, সমুদ্র একার বিজয় দ্বারা প্রাধান্য পান। তার কাছে ধর্ম বিজয়ের অর্থ অন্য রকম ছিল। অশোক অহিংসা নীতিকে
। সমুদ্র তপ্ত পরাক্রম অর্থাৎ, রক্ত ও লৌহ, নীতিকে কম প্রজা হিতৈষী ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন না। তবে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও রা ছিল ভিন্নতর।
১০. শিল্প সংস্কৃতির পৃষ্টপোষকতা : সমুদ্র গুপ্তের সভাকবি হরিসেন। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে সমুদ্র গুপ্তের ভূয়সী প্রশংসা ছেন। সভাকবি হিসেবে প্রশংসার সম্ভাব্য আতিশ্যের প্রশ্ন বাদ দিলেও হরিসেনের প্রশস্তি সমুদ্র গুপ্তের ব্যক্তিত্ব ও ত্বের এক বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন। সমুদ্র গুপ্ত সম সাময়িককালের শ্রেষ্ঠ সমর কুশল সেনাপতি: বার তাই কেবল ছিলেন না, তিনি একজন দূরদর্শি রাজনীতিক এবং অন্যন্য সাধারণ কুটনৈতিক ছিলেন।
তিনি সাম্রাজ্য বৃদ্ধি করে রাজ্য জয়ই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেন নি। তার চরিত্রের অপেক্ষাকৃত রুত্বপূর্ণ দিক ছিল সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি গভীর অনুরাগ। তিনি ছিলেন বিদ্যা ও বিদ্বানের পৃষ্ঠপোষক এবং স্বয়ং কজন সুকবি ও সঙ্গীতজ্ঞ। এই সকল হরিসেনের প্রশস্তিতে অতিশয়োক্তি নয়, সমুদ্র গুপ্তের মুদ্রা হতেও এই সকলের মাণ আমরা পেয়ে থাকি। তার কবি প্রতিভার জন্য তাকে কবিরাজ উপাধীতে ভূষিত করা হয়েছিল।
১১. ভারতীয় নেপোলিয়ন : এলাহাবাদ লিপির ভাষায় সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন ত্রিভুবন বিজয়ী। ভিনসেন্ট এ স্মিথও তাকে ভারতীয় নেপোলিয়ন বলে আখ্যায়িত করেছেন। সমুদ্রগুপ্তের বীরত্বপূর্ণ দিগ্বিজয়ের গৌরবের কথা চিন্তা করলে মনে হয় স্মিথের এরূপ মন্তব্য সঠিক হয়েছে। বাহুবলের সহিত সুপরিকল্পিত উপায়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের আনুগত্য লাভ তাঁকে একজন সফল রাজনীতিক হিসেবে এ উপমহাদেশের ইতিহাসে গৌরবের আসন দান করেছে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
উপসংহার : উপসংহারে বলা যায় যে, সমুদ্র গুপ্ত সম্ভবতঃ ৩৭৫-৩৮০ খ্রিঃ মধ্যে কোন সময় মৃত্যু মুখে পতিত হয় তার রাজত্বকাল সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। যাই হোক মৃত্যুর পূর্বে পিতা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের নীতি অনুসরণ করে তিনি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নিজ উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]