দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও । তাকে প্রাচীন ভারতের বিক্রমাদিত্য বলা হয় কেন?

উত্তরঃ ভূমিকা : সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর সুযোগ্য পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ৩৮০ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি গ্রহণ করেন। তাঁর মুদ্রায় তাঁকে শ্রী বিক্রম, সিংহ বিক্রম, বিক্রমাভু • বিক্রমাদিত্য উপাধিতে উল্লেখ করা হয়। সামরিক শক্তিমত্তা, বিচক্ষণতা ও বিদ্যানুরাগের জন্য তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন। তাঁর গৌরবময় শাসনকালের বহুলিপি পাওয়া গিয়েছে। এসব লিপি হতে তার শাসনকাল সম্বন্ধে অনেক কিছু জানা যায়। তিনি পিতার যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন। পিতা সমুদ্রগুপ্তের অসমাপ্ত কাজ তিনি সমাপ্ত করেন। বিদেশী আধিপত্যবাদ হতে উপমহাদেশকে রক্ষা করে তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যকে সুসংহত করেন। চীনের খ্যাতনামা পরিব্রাজক ফাহিয়েন ছয় বছর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যে অবস্থান করে তাঁর শাসনব্যবস্থার উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের বিবরণ ঃ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল : বৈবাহিক সম্পর্ক দ্বারা প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি : গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রথমদিকে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের নীতি অবলম্বন করেন। তিনি স্বয়ং নাগ বংশীয় রাজকন্যা কুবের নাগকে বিবাহ করে নাগ বংশের প্রীতি লাভ করেন। দাক্ষিণাত্যের কুণ্ডল রাজ্যের কদম্ব বংশের রাজা কাকুস বর্মণের কন্যাকে নিজ পুত্রবধু করে আনেন এবং স্বীয় কন্যা প্রভাবতী গুপ্তকে বকাকট বংশীয় রাজা দ্বিতীয় রুদ্র সেনের সঙ্গে বিবাহ দেন। ঐতিহাসিক স্মিথের মতে, পশ্চিম ভারতের শক শক্তিকে পরাজিত করার জন্য নাগ ও রকাকট রাজদের সহায়তা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল।
বকাকট রাজ্যের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের পর তিনি শকদের সহজে পরাজিত করেন। এছাড়া বকাকট রাজ্যে মিত্র থাকার ফলে ভবিষ্যতে শত্রুশক্তির পক্ষে বিদ্রোহ করা সম্ভব হয় নি। তাছাড়া বিবাহের অল্পকালের মধ্যে দ্বিতীয় রুদ্রসেনের অকাল মৃত্যু হলে প্রভাবতী গুপ্তই রাণী হিসেবে বকাকট রাজ্য শাসন করতে থাকেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বকাকট রাজ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রভাব বৃদ্ধি পায় ।
বিজেতা হিসেবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত :
উত্তরাধিকার সূত্রে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এক বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক হন। এ সাম্রাজ্যের পরিধি আরো সম্প্রসারিত করার জন্য তিনি পরিকল্পিত বিজয়াভিযান শুরু করেন। মালব ও সৌরাষ্ট্র বিজয় : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী বীর সেনসহ অগ্রসর হয়ে শক-ক্ষত্রপগণকে পরাভূত করে মালব ও সৌরাষ্ট্র (বর্তমান কাথিয়াবার) অধিকার করেন এবং 'শকারি' নামে পরিচিত হন। শক শাতি এ দুটি রাষ্ট্র বিজয় দ্বারা তিনি উপমহাদেশ হতে বিদেশী প্রভুত্বের শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত করে খ্যাতি অর্জন করেন।
শুজরাট বিজয় : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত গুজরাটও জয় করেন। তাঁর আমলের মুদ্রা হতে গুজরাট বিজয়ের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে । ফলাফল : মালব, সৌরাষ্ট্র ও গুজরাট বিজয়ের ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। উপমহাদেশ হতে বৈদেশিক শক-ক্ষত্রপদের প্রভুত্বের অবসান ঘটে। এ বিজয়ের ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সীমা পূর্বে বঙ্গোপসাগর হতে পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের খ্যাতি সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দ্বারা খুলে যায় ।
উজ্জয়নীতে দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন : পাটলীপুত্র ছিল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী। পশ্চিম ভারতে স্বীয় কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখা এবং শাসনকার্যের সুবিধার জন্য মালবের অন্তর্গত উজ্জয়নীতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত রাজধানী স্থাপন করেন ।
শাসক হিসেবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত :
বিখ্যাত চীনদেশীয় পরিব্রাজক ফাহিয়েনের বিবরণ হতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনকাল সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। ফাহিয়েন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজধানী পাটলীপুত্রে তিন বছর অবস্থান করেন 'এবং পরে তার লিখায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসন সম্পর্কে উচ্চসিত প্রশংসা করেন। তার বিবরণ হতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল ও সে সময়ের জনসাধারণের শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায় ৷
সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা : সে সময় প্রজাসাধারণ পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতেন। সাম্রাজ্যের এক স্থান হতে অন্যস্থানে যাতায়াতের জন্য কোন অনুমতির প্রয়োজন হতো না। প্রজাগণ উৎপন্ন শস্যের একাংশ রাজস্ব দিত। সম্রাটের দেহরক্ষী ও অনুচর বর্গকে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। ফাহিয়েনের বিবরণ হতে বুঝা যায় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যে সুষ্ঠু ও সুদক্ষ শাসনব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল । পরধর্মে সহিষ্ণুতা : ফাহিয়েনের বিবরণ হতে জানা যায় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতা বিদ্যমান ছিল। তিনি ব্রাহ্মণ ধর্মাবলম্বী হয়েও বৌদ্ধ মঠগুলোতে পর্যাপ্ত সাহায্যদানে ত্রুটি করেন নি ।
শাস্তির কঠোরতা ছিল না : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে দণ্ডবিধির কোন কঠোরতা ছিল না। সাধারণ অপরাধের শাস্তি ছিল অর্থদণ্ড। কোন অপরাধের জন্যই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো না। এমনকি বার বার রাজদ্রোহিতার অপরাধেও অপরাধীর শাস্তি ছিল দক্ষিণ হস্ত ছেদন। •
জনগণের শান্তিপূর্ণ জীবন : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে জনসাধারণ শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করত। দেশের সর্বত্র শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজমান ছিল। রাত্রে ঘরের দরজা খোলা রাখলেও কোন জিনিস চুরি হতো না। দস্যু তস্করের উপদ্রব ছিল না। রাস্তার কোন স্থানে ভুলে কোন মূল্যবান জিনিস ফেলে গেলেও দীর্ঘকাল পর সে স্থানেই তা পাওয়া যেত ।
জনগণের উন্নত অর্থনৈতিক অবস্থা : সাম্রাজ্যের জনসাধারণ বিত্তশালী ও সমৃদ্ধশালী ছিল। নাগরিকগণ ব্যবসায়- বাণিজ্যে খুবই উৎসাহী ছিল। বহু দেশের অম্রলিপ্ত সে যুগের একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। এখন হতে রাণিজ্য কাফেলা বড় বড় জাহাজে সিংহল/মালয়/সুমাত্রা, চম্পা, বার্মা প্রভৃতি দূর-দূরান্তে বাণিজ্য ব্যাপদেশে গমনাগমন করত।
সড়ক, জনপথ, সরাইখানা ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের সুব্যবস্থা : গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বত্র যাতায়াতের জন্য সড়ক ও জনপথ ছিল। পথচারীদের সুবিধার্থে জনপথের স্থানে স্থানে সরাইখানা নির্মিত হয়েছিল। রাজধানী পাটলীপুত্রে একটি সুন্দর দাতব্য চিকিৎসালয় ছিল। সেখানে অতিযত্নসহকারে দরিদ্র ও অসহায় রোগীদের চিকিৎসা করা হতো। তাদেরকে প্রয়োজনীয় ঔষধ পথ দওয়া হতো এবং এর জন্য কোন খরচ নেওয়া হতো না ।
উপসংহার : শেষে বলা যায় যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ সম্রাটদের অন্যতম । তিনি দীর্ঘকাল এ বিশাল সাম্রাজ্য শাসন করেন। এ উপমহাদেশ হতে শকদিগের শাসন বিলোপ তাঁর রাজত্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি । বিখ্যাত কবি কালিদাস তাঁর যুগকে গৌরবদান করেন। সমসাময়িক মুদ্রা লিপিতে তাকে সূর্যের মত বিক্রমশালী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি সাহিত্য ও সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ফাহিয়েনের বিবরণ হতে তাঁর রাজত্বকালের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রমাণ পাওয়া যায়। বস্তুত রাজনৈতিক মহত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণকে পূর্ণতা দান করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসনকে অমর করে রেখেছেন। ড. রাখাল দাস যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত তার পিতার রেখে যাওয়া রাজ্য এক সাম্রাজ্যে পরিণত করেছিলেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]