ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার বিবরণ দাও। বখতিয়ার খলজির সহজ বাংলা বিজয়ের কারণ কি? কর।

উত্তরা ভূমিকা : একজন ভাগ্যান্বেষীয় অসীম সাহসী তুর্কি বীর হিসেবে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুতে পূর্ব ভারতে অভিযান চালিয়ে প্রথমে দক্ষিণ বিহার ও পরে পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অধিকাংশ এলাকা জয় করে বাংলায় মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তনকারী হিসেবে ভারতবর্ষ তথা বাংলার ইতিহাসে তারকা উজ্জ্বল খ্যাতিতে স্বর্ণাক্ষরে নিজের নাম স্বাক্ষর করেন।
পরিচয় ঃ ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি আফগানিস্তানের গরমসির বা আধুনিক দশত-ই- মার্গের অধিবাসী ছিলেন। তিনি জাতিতে ছিলেন তুর্কি এবং বংশে খলজি। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। শুধু নিজ যোগ্যতা ও ধৈর্যের উপর ভর করে সামান্য সৈনিক থেকে নিয়ন্ত্রার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ।
প্রথম জীবন : বখতিয়ার খলজির পরিচয় ও বাল্যজীবন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর পরিচয় সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তা হল তিনি স্বদেশভূমি ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে বের হন। প্রথমে তিনি গজনীতে এসে শিহাবউদ্দিন ঘুরীর কাছে চাকরি প্রার্থী হন। কিন্তু কুৎসিত চেহারা ও অজানুলম্বিত হাতের জন্য চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। এরপর সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের সৈন্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর বখতিয়ার খলজি বাদাউনের শাসনকর্তা হিজবর উদ্দিনের অধীনে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন। এখানে বেতন অতি সামান্য হওয়ায় তিনি চাকরি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে অযোধ্যায় হুসাম উদ্দিনের অধীনে ভগবত ও ভিউলী নামক দু'টি পরগনার (জেলার) জায়গিদার নিযুক্ত হন। এ জায়গির পাওয়ায় তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি ভগবত ও ভিউলীকে শক্তির কেন্দ্রে পরিণত করেন।
বখতিয়ার খলজি কর্তৃক বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা : বখতিয়ার খলজি একমাত্র নিজ দূরদর্শিতার জন্য বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠায় সফল হন। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল ঃ
১. সৈন্যদল গঠন ও যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতি : অযোধ্যার শাসনকর্তা হুসামউদ্দিন বখতিয়ারের প্রতিভার কথা বিবেচনা করে তাকে মুসলিম বাজারে সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব দেন এবং বিনিময়ে তাকে মির্জাপুর জেলার ভগবত ও ভিউলী নামক দু'টি পরগনার জায়গির দান করেন। এরপরই উচ্চাভিলাষী বখতিয়ার খলজি উন্নতির পথ খুঁজে পেয়ে নিজশক্তি তথা বিশাল সৈন্যবাহিনী গঠনের লক্ষ্যে সম্পদ বৃদ্ধির জন্য পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজ্যগুলোতে লুণ্ঠন চালিয়ে বিপুল ধনরত্ন যোগাড় করেন। ভগবত ও ভিউলী হয়ে উঠে তাঁর শক্তির ভরকেন্দ্র। এভাবে বখতিয়ার খলজির সুনাম ছড়িয়ে পড়লে স্বদেশত্যাগী নিজ বংশের যুবকরা তাঁর সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে একটি দক্ষ সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। এ দক্ষ বাহিনীই তাঁর পরবর্তী অভিযানসমূহে সাফল্য বয়ে আনে।
২. বিহার জয় : বখতিয়ার খলজি তাঁর জায়গিরের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১২০৩ সালের দিকে মাত্র ২০০ জন সৈন্য নিয়ে এক অভিযানের মাধ্যমে পাল বংশীয় রাজা গোবিন্দ পালকে পরাজিত ও নিহত করে বিহারের রাজধানী উদন্তপুর বিহার দখল করেন এবং পরে সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার সীমান্তের দিকে দৃষ্টি দেন !
৩. বাংলা বিজয় : সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে বখতিয়ারের বাংলা বিজয় আমাদের ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী এক স্মরণীয় ঘটনা। এ সময় বাংলার রাজধানী ছিল গৌড় এবং নদীয়া ছিল দ্বিতীয় রাজধানী। তবে নদীয়া আক্রমণের তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও তাবাকাত-ই-নাসিরিতে বলা হয়েছে বিহার বিজয়ের পরের বছর তিনি নদীয়া অভিযানে আসেন। আধুনিক ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিম ঐ মতে সায় দিয়ে ১২০৪ সালকে নদীয়া আক্রমণের তারিখ উল্লেখ করেছেন এবং হাসান নিজামীর মতে ১২০৩ সালে বখতিয়ারের বিহার জয়ের বর্ণনা দিয়েছেন ।
৪. লক্ষণ সেনের পলায়ন : আক্রমণের সংবাদ শুনে মধ্যাহ্নভোজরত লক্ষণ সেন অবস্থা বেগতিক দেখে নিজ জীবন রক্ষার্থে নগ্নপদে পিছনের দরজা দিয়ে পূর্ববঙ্গে পলায়ন করেন। লক্ষণ সেনের সৈন্যরাও আক্রমণ প্রতিহত বা যুদ্ধ করার প্রয়োজন মনে করেন নি বা সাহস পান নি ।
৫. লখনৌতি জয় : নদীয়ার মত অরক্ষিত না থাকলেও বাংলার ঐতিহাসিক রাজধানী গৌড় বা লখনৌতি বিনা বাধায় বখতিয়ারের দখলে আসে। গৌড় বিজয়ের পর বখতিয়ার এখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। গৌড় জয়ের পর তিনি আরো পূর্বদিকে এগিয়ে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুশাসনে মনোযোগী হন ।
বখতিয়ারের সহজ বাংলা জয়ের কারণ : একজন সমরনায়ক বা বাংলায় প্রথম মুসলিম বিজেতা হিসেবে বখতিয়ার খলজি মাত্র অল্প কয়েকজন সৈন্য নিয়ে বাংলার রাজধানী দখল করার পেছনে নিচের কারণগুলো কাজ করেছিল : ১. ছদ্মবেশী আক্রমণ : ১৮ জন ছদ্মবেশী সৈন্য নিয়ে বখতিয়ার খলজি নগরীতে প্রবেশ করলে তাদেরকে অশ্ব ব্যবসায়ী মনে করে রক্ষীরা কোন বাধা দেয় নি ।
২. প্রচলিত পথে না আসা : বখতিয়ার খলজি বাংলায় প্রবেশ করতে প্রচলিত তেলিয়াগড়ের গিরিপথ পরিত্যাগ করে অত্যন্ত চতুরতার সাথে দুর্গম গিরিপথ দিয়ে বাংলা আক্রমণ করায় লক্ষণ সেনের বাহিনী কোনরকম পূর্ব প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি ।
৩. লক্ষণ সেনের গুপ্ত দপ্তরের অযোগ্যতা : কর্মতৎপরহীন লক্ষণ সেনের অদক্ষ গুপ্তচর বিভাগ বহিঃশত্রুর গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ব্যর্থ হলে বখতিয়ারের বাংলা বিজয় সহজ হয়।
৪. গণঅসন্তোষ : লক্ষণ সেনের অত্যাচারী শাসনের ফলে জনগণ তাঁর প্রতি অতিষ্ঠ ছিল, ফলে এমন দুর্যোগকালে তারাও রাজাকে সাহায্য করার প্রয়োজন অনুভব করে নি ।
৫. অরক্ষিত রাজধানী : নদীয়া লক্ষণ সেনের উপরাজধানী হওয়ায় সামরিক দিক দিয়ে তেমন সুরক্ষিত ছিল না যা বখতিয়ারের বিজয়কে সহজ করে দিয়েছিল।
৬. দক্ষ তুর্কি সেনা ঃ বখতিয়ার খলজি তথা তুর্কি সেনাবাহিনী অত্যন্ত দ্রুতগামী, ক্ষিপ্ত, তরিৎকর্মা ও সুকৌশলী চৌকষ বাহিনী ছিল বলে অতর্কিত আক্রমণের প্রতিরোধ ক্ষমতা লক্ষণ সেনের সৈন্যদের ছিল না।
৭. পরিষদবর্ণের পশ্চাৎপসারণ : বিহার বিজয়ের পর বখতিয়ার বাংলা আক্রমণ করতে পারে এ ভয়ে লক্ষণ সেনের অমাত্য ও মন্ত্রীবর্গ আগেই পূর্ববঙ্গে চলে যায় ।
৮. মোক্ষম সময় : বখতিয়ার খলজি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়ে নদীয়া আক্রমণে দিনের আলোয় দুপুরের অলস সময়কে বেছে নিয়েছিলেন।
৯. বখতিয়ারের মূল বাহিনীর দ্রুততা : বখতিয়ার একদিকে যখন ১৮ জন সৈন্য নিয়ে প্রাসাদে ঢুকে পড়েছেন তখনই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে তাঁর মূল বাহিনী নগরীর তোরণদ্বারে পৌঁছে যায়। এমতাবস্থায় কোন প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই লক্ষণ সেনের পালিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না ।
১০. গুজব : বখতিয়ারের বাংলা আক্রমণের সময় গুজব রটে যায় যে, বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রখতিয়ার বাংলা বিজয়ে আসছেন; এটাও তার সাফল্যের একটি সহজ কারণ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইসলামের ইতিহাসে বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। অফুরন্ত আশাবাদী, উচ্চাভিলাষী, অসীম সাহসী বীর, নিপুণ যুদ্ধকৌশলী ও চতুর শাসক হিসেবে এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে চির উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে থাকবেন ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]