বখতিয়ার খলজির উত্থান ও পতনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও ।

ভূমিকা : খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি বাংলার উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাংশে সেন শাসনের অবসান ঘটিয়ে মুসলমান রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বখতিয়ার খলজির এ বিজয়ের মাধ্যমেই বাংলার ইতিহাসে সমাধি রচিত হয় এক অধ্যায়ের এবং যাত্রা সূচিত হয় নব যুগের। এ নব যুগ হল মধ্যযুগ। তাঁর আক্রমণের ফলে যেহেতু মধ্যযুগের সূচনা হয় তাই তাকে মধ্যযুগের ইতিহাসের স্রষ্টা বলা হয় ।
পরিচয় ঃ ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি আফগানিস্তানের গরমসির বা আধুনিক দশত-ই-মার্গের অধিবাসী ছিলেন। তিনি জাতিতে ছিলেন তুর্কি এবং বংশে খলজি। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন ভাগ্যান্বেষী সৈনিক। শুধু নিজ যোগ্যতা ও ধৈর্যের উপর ভর করে সামান্য সৈনিক থেকে নিয়ন্ত্রার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন ।
বখতিয়ার খলজির উত্থান : নিম্নে বখতিয়ার খলজির উত্থানের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হল :
১. প্রথম জীবন : বখতিয়ার খলজির পরিচয় ও বাল্যজীবন সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তাঁর পরিচয় সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তা হল তিনি স্বদেশভূমি ত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে বের হন। প্রথমে তিনি গজনীতে এসে শিহাবউদ্দিন ঘুরীর কাছে চাকরি প্রার্থী হন। কিন্তু কুৎসিত চেহারা ও অজানুলম্বিত হাতের জন্য চাকরি পেতে ব্যর্থ হন। এরপর সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের সৈন্য বিভাগে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
২. জায়গিদার পদ লাভ : অতঃপর খলজি বাদাউনের শাসনকর্তা হিজবর উদ্দিনের অধীনে সৈন্যবাহিনীতে যোগদান করেন। এখানে বেতন অতি সামান্য হওয়ায় তিনি চাকরি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরে অযোধ্যায় হুসাম উদ্দিনের অধীনে ভগবত ও ভিউলী নামক দু'টি পরগনার (জেলার) জায়গিদার নিযুক্ত হন। এ জায়গির পাওয়ায় তাঁর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। তিনি ভগবত ও ভিউলীকে শক্তির কেন্দ্রে পরিণত করেন।
৩. বিহার জয় : বখতিয়ার খলজি তাঁর জায়গিরের সীমান্তবর্তী এলাকায় ১২০৩ সালের দিকে মাত্র ২০০ জন সৈন্য নিয়ে এক অভিযানের মাধ্যমে পাল বংশীয় রাজা গোবিন্দ পালকে পরাজিত ও নিহত করে বিহারের রাজধানী উদন্তপুর বিহার দখল করেন এবং পরে সুজলা-সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার সীমান্তের দিকে দৃষ্টি দেন।
৪. বাংলা বিজয় : সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে বখতিয়ারের বাংলা বিজয় আমাদের ইতিহাসের গতি পরিবর্তনকারী এক স্মরণীয় ঘটনা। এ সময় বাংলার রাজধানী ছিল গৌড় এবং নদীয়া ছিল দ্বিতীয় রাজধানী । তবে নদীয়া আক্রমণের তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও তাবাকাত-ই-নাসিরিতে বলা হয়েছে বিহার বিজয়ের পরের বছর তিনি নদীয়া অভিযানে আসেন। আধুনিক ঐতিহাসিক ড. আবদুল করিম ঐ মতে সায় দিয়ে ১২০৪ সালকে নদীয়া আক্রমণের তারিখ উল্লেখ করেছেন, এবং হাসান নিজামীর মতে ১২০৩ সালে বখতিয়ারের বিহার জয়ের বর্ণনা দিয়েছেন ।
৫. গৌড় জয় : নদীয়ার মত অরক্ষিত না থাকলেও বাংলার ঐতিহাসিক রাজধানী গৌড় বা লখনৌতি বিনা বাধায় বখতিয়ারের দখলে আসে। গৌড় বিজয়ের পর বখতিয়ার এখানে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। গৌড় জয়ের পর তিনি আরো পূর্বদিকে এগিয়ে বরেন্দ্র বা উত্তর বাংলায় নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুশাসনে মনোযোগী হন।
৬. তিব্বত অভিযান : পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গে মুসলিম প্রভুত্ব স্থাপন করার পরে বৃখতিয়ার তিব্বত অভিযানে বের হন। তিব্বত অভিযান ছিল তাঁর জীবনের শেষ সমরাভিযান। বখতিয়ার খলজি কেনই বা আশপাশে একাধিক হিন্দু রাজ্য আক্রমণ না করে বিপদসঙ্কুল তিব্বত অভিযানে বের হন তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। সম্ভবত এ অঞ্চলের ধনৈশ্বর্যের কথা তার জানা ছিল। তাছাড়া দুঃসাহসিক কর্মের উন্মাদনা, নতুন দেশ জয়ের মোহ, তিব্বতের মধ্যদিয়ে হিন্দুস্থান ও তুর্কিস্থানের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন ও ইসলাম প্রচারের আবেগ তাকে এ অভিযানে উদ্বুদ্ধ করেছিল । তিনি তিব্বত অভিযানের জন্য ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে দশ হাজার সৈন্যের বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে লখনৌতি থেকে তিব্বত অভিযানে বের হন। অবশ্য অনেকের মতে, তিনি দেবকোট থেকে তিব্বত অভিযানে বের হন। গোলাম হোসেন, নিজামউদ্দিন, বদায়ূনী প্রমুখ ঐতিহাসিকের মতে, তাঁর সৈন্য সংখ্যা ছিল বারো হাজার। বখতিয়ার খলজি যে উদ্দেশ্যে তিব্বত আক্রমণ করেন তা সফল তো হয় নি বরং অযথা কালক্ষেপণ করে কোনক্রমে দেবকোটে ফিরে আসতে সক্ষম হন। গৌহাটির কাছে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে কানাইবরশী বোয়া নামক স্থানে প্রাপ্ত শিলালিপিতে ১১২৭ শতাব্দীতে তুর্কি সৈন্যদলের বিধ্বস্ত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায় ।
প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল বাংলার ইতিহাসে তিব্বত অভিযানে ব্যর্থতার প্রভাব ছিল। এ অভিযানের ফলে, বাংলার হিন্দুরাজগণ কিছুকালের জন্য মুসলমান আক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পায়। গৌড়ে মুসলমান রাজ্যের সম্প্রসারণের পথরুদ্ধ হয়। মুসলমান প্রভুত্ব থেকে বিহার বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ।
৪. খলজিদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় । বখতিয়ার খলজির শাসনব্যবস্থা : বখতিয়ার খলজি বাংলায় যে মুসলিম শাসনের ভিত্তি স্থাপন করে যান তা প্রায় পাঁচশত বছর স্থায়ী হয়েছিল। শাসক হিসেবেও তিনি সফল হয়েছিলেন । তিনি নিজ ইচ্ছামত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। সম্ভবত তিনি 'সুলতান' উপাধি গ্রহণ করেন নি। তবে সুলতান উপাধি গ্রহণ না করলেও তিনি সুলতানোচিত সব অধিকার ও ক্ষমতা ভোগ করতেন। তিনি যে কেবল রাজ্যজয়ে ব্যস্ত ছিলেন তা সত্য নয়। বিজিত অঞ্চলে তিনি এক যুগোপযোগী শাসনব্যবস্থারও প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর শাসনব্যবস্থায় ইসলামি রীতিনীতির প্রতিফলন ছিল। মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বহু মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকাহ নিৰ্মাণ করেছিলেন। বখতিয়ার খলজির চরিত্র : বখতিয়ার খলজি ছিলেন অসম সাহসী যোদ্ধা, অফুরন্ত আশাবাদী ও অদম্য উৎসাহী। জীবনে চলার পথে কোন বাধাই তার গতিরোধ করতে পারে নি। ভাগ্যান্বেষণে সিস্তান থেকে তিব্বত পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ড তিনি অশ্বপৃষ্ঠে পরিভ্রমণ করেছেন। বিন্ধ্যা অঞ্চলের ঘন বনানী, তরঙ্গ সঙ্কুল গঙ্গা, খরস্রোতা বেগমতী এবং হিমালয়ের তুষারবৃত্ত গিরিপথ তিনি দুর্বার গতিতে অতিক্রম করেন। তিনি একজন বিজেতা হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং চিরকাল তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বখতিয়ার খলজির পতন : তিব্বত অভিযানের ব্যর্থতা তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তিব্বত থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরাজয়ের ক্ষোভ ও অপমানে বখতিয়ার সমাজ ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গ পরিহার করে চলেন। অন্যদিকে, সৈন্যদলের মধ্যেও বিরোধ দেখা দেয়। তিনি ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুবরণ সম্পর্কে মতভেদও লক্ষ্য করা যায়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ইসলামের ইতিহাসে বখতিয়ারের বঙ্গ বিজয় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। অফুরন্ত আশাবাদী, উচ্চাভিলাষী, অসীম সাহসী বীর, নিপুণ যুদ্ধকৌশলী ও চতুর শাসক হিসেবে এবং বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে চির উজ্জ্বল ও ভাস্বর হয়ে থাকবেন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]