স্বাধীন সুলতানের উত্থান ও পতনের কাহিনী বর্ণনা কর।

ভূমিকা । বখতিয়ার খলজি প্রথম বাংলায় মুসলিম শাসনের সূচনা করেন। কিন্তু বয় তেমন স্থায়ী মুসলিম শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারেন নি। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ প্রথম বাংলায় স্বাধীন মুলতানির সূচনা করেন। পরবর্তীতে এ স্বাধীন সুলতানির ধারা ইলিয়াস শাহি বংশ ও হোসেন শাহি বংশ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
স্বাধীন সুলতানির সুচনা : বাংলায় স্বাধীন সুলতানির সূচনা হয় ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ মুহাম্মদ তুঘলকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে পূর্ব বাংলায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন। সোনারগাও ছিল তার রাজধানী। ঠিক এ সময়ে আলাউদ্দিন শাহ পশ্চিম বাংলায় স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং তার রাজধানী লক্ষণাবতী থেকে মায়ায় স্থানান্তরিত করেন। এভাবে দু'টি স্বাধীন অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়।
১. ইলিয়াস শাহ সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের পূর্ব পরিচয় বা প্রথম জীবন সম্পর্কে তথ্য স্বল্পতা রয়েছে। গোলাম হোসেন গলিম লিখিত রিয়াজ-উস-সালাতিনে' তাঁর বাংলাদেশে আগমনের কাহিনী বর্ণিত আছে। আলী ফেবারকের (লক্ষণাবতীর শাসক আলাউদ্দিন আলী শাহ) দুধভাই ছিলেন হাজী ইলিয়াস। দু'ভাই দিল্লিতে এক মালিকের অধীনে চাকরি করতেন। হাজী ইলিয়াস এক অজ্ঞাত অন্যায় করে বাংলায় পালিয়ে আসেন। পরবর্তীতে আলী মোবারক লক্ষণাবতীর সিংহাসন এবং হাজী ইলিয়াস আলী মোবারককে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন।
ক. ক্ষমতা লাভ : ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে হাজী ইলিয়াস তাঁর দুধভাই আলী মোবারক (আলাউদ্দিন আলী শাহ) এর বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনীকে সংগঠিত করেন এবং খোজাদের সাহায্যে তাকে হত্যা করে নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন। তিনি সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। খ. রাজ্য সম্প্রসারণ : সুলতান ইলিয়াস শাহ তাঁর অজেয় সামরিক অভিযান দ্বারা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চল নিজ শাসনাধীনে আনেন। বাংলার বাইরেও তাঁর জয়যাত্রা পরিচালিত হয়েছিল। ইলিয়াস শাহ ফিরোজাবাদের সিংহাসনে আরোহণের পর প্রথমে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার দিকে অগ্রসর হন, যার কেন্দ্র ছিল সাতগাঁও। ৭৪৭ হিজরিতে (১৩৪৬ খ্রিঃ) সাতগাঁও টাকশাল হতে প্রকাশিত তাঁর মুদ্রা পাওয়া গিয়েছিল। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে কোন এক সময়ে ইলিয়াস শাহ দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা তাঁর রাজ্যভুক্ত করেন। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস কর্তৃক নেপালে অভিযান প্রেরণের প্রমাণ পাওয়া যায়। নেপাল জয়ের পূর্বেই সম্ভবত ইলিয়াস শাহ ত্রিহুতের কিছু অংশ (উত্তর বিহার উঞ্চল) জয় করেন। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ পূর্ব বাংলা যার কেন্দ্র ছিল সোনারগাঁও জয় করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ সময় সোনারগাঁওয়ের শাসক ছিলেন সুলতান ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁও জয়ের মধ্যদিয়ে ইলিয়াস শাহ বাংলাদেশের তিন অঞ্চলের একত্রীকরণ সম্পন্ন করেন। ইতঃপূর্বে বাংলার অন্য কোন মুসলমান সুলতান সমগ্র বাংলাদেশের সুলতান হওয়ার গৌরব অর্জন করতে পারেন নি। এর পর তিনি বিহার, উড়িষ্যা ও জাজনগর অভিযান করে তা দখল করেন। তাঁর সাথে ফিরোজ শাহের সংঘর্ষ হয়েছিল এবং উভয়ের সম্মতিতে এক সন্ধিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
গ. কৃতিত্ব : ইলিয়াস শাহ শুধু একজন সফল সমর নায়কই ছিলেন না, বরং তিনি একজন সফল শাসকও ছিলেন। তাঁর প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা সংহত ছিল বলেই তার উত্তরসূরিরা সফল হয়েছিলেন। তাঁর আমলেই বাংলার ভাটী অঞ্চল নিয়ে বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর রাজত্বকাল থেকেই বঙ্গ অঞ্চলের অধিবাসীরা বাঙালি বলে পরিচিত হয়। ইলিয়াস শাহের পূর্বে এখানকার অনেক শাসক দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দিল্লির সুলতানদের আক্রমণের মুখে তাদের এ স্বাধীনতা টিকে নি। ইলিয়াস শাহই ছিলেন প্রথম স্বাধীন সুলতান যিনি বাংলায় দৃঢ় ভিত্তির উপর একটি স্বাধীন রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যা দু'পর্যায়ে প্রায় ১২০ বছর স্থায়ী হয়েছিল। ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইহজীবন ত্যাগ করেন। ২. সিকান্দার শাহ ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তিনিও পিতার ন্যায় একজন শক্তিশালী শাসক ছিলেন। সিকান্দার শাহের আমলে বাংলায় শান্তি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি একজন প্রতিভাবান ও শিল্পানুরাগী শাসক ছিলেন। পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদ, গৌড়ের কোতোয়ালি দরওয়াজা ও গঙ্গারামপুরের মোল্লা আভার মসজিদ শিল্পানুরাগের ewnteÖKvk | ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর পুত্র গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের হাতে যুদ্ধে নিহত হন।
৩. গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ সিকান্দার শাহের মৃত্যুর পর ১৩৯৩ খ্রিস্টাব্দে গিয়াসউদ্দিন 'আজম শাহ' উপাধি ধারণ করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তাঁর সুদীর্ঘ রাজত্বকালে বিজেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে না পারলেও মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। চীনের সম্রাটের সাথে দূত বিনিময়, ইরানি কবি হাফিজের সাথে পত্র বিনিময় ইত্যাদি তাঁর রাজত্বকালে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ১৪০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা গণেশের চক্রান্তে নিহত হন ।
৪. সাইফুদ্দিন হামজা আজম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র সাইফুদ্দিন হামজা বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর আমলে বাংলার আমিরগণ প্রবল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠে। বলা হয়ে থাকে রাজা গণেশ নামে এক হিন্দু জমিদার হামজাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চক্রান্তে নামেন। ১৪১১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর নিহত হওয়ার মধ্যদিয়ে প্রথম ইলিয়াস শাহি বংশের সাময়িক পতন ঘটে। অনেকের মতে, ইলিয়াস শাহি বংশের বায়েজিদ শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ নামে দু'জন শাসকও এ সময় রাজত্ব করেন এবং তাঁরা ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ বংশ টিকিয়ে রাখেন।
৫. ইলিয়াস শাহি বংশে বিশৃঙ্খলা : ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা গণেশ নামক জনৈক জমিদার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১৪১৮ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁর মৃত্যুর পর যদু নামক গণেশের এক পুত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে জালালউদ্দিন মুহম্মদ শাহ নাম ধারণ করে সিংহাসনে বসেন এবং ১৪৩১ সাল পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁরই পুত্র শামসউদ্দিন ক্ষমতায় আরোহণ করেন। ১৪৪২ সালে তিনি আততায়ীর হাতে নিহত হলে এ বংশের পতন ঘটে এবং ইলিয়াস শাহি বংশ পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে ।
৬. নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ : ১৪৪২ সালে ইলিয়াস শাহের প্রপৌত্র নাসিরউদ্দিনকে বাংলার আমিরগণ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেন। তিনি বাংলাকে সুবিস্তৃত করেন ।
৭. রুকনউদ্দিন বরবক শাহ : নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রুকনউদ্দিন ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় আরোহণ করেন। তিনি বিদেশীদের হাত থেকে চাটগাঁওকে উদ্ধার করেন।
৮. পরবর্তী ইলিয়াস শাহি বংশ ঃ এভাবে পর্যায়ক্রমে ১৪৭৪ সালে শামসউদ্দিন ইউসুফ শাহ, ১৪৮১ সালে দ্বিতীয় সিকান্দার শাহ, পরে জালালউদ্দিন ফতেহ শাহ বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। জালালউদ্দিনের আমলে কৃতদাসদের ক্ষমতা বেড়ে যায় । ১৪৮৪ সালে তিনি জনৈক হাবশি কৃতদাসের হাতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যুর পর ইলিয়াস শাহি বংশের অবসান ঘটে।
৯. বায়েজিদ ও আলাউদ্দিন ফিরোজ : সাইফুদ্দিন হামজা শাহের মৃত্যুর পর তার পালক পুত্র বায়েজিদ শাহ পিতার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। এরপর ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলে দিনাজপুরের ভাতুড়িয়া পরগনার রাজা গণেশ নামক জনৈক জমিদার ফিরোজ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিংহাসন লাভ করেন ৷
১০. হাবসি শাসন : জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের মৃত্যুর পর তার সাথে সাথে ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে গৌড় রাজ্যে হাবসী শাসনামলের সূচনা হয়। প্রথম হাবসী সুলতান ছিলেন সাইফউদ্দিন ফিরোজশাহ। ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে অত্যন্ত নিষ্ঠুর, অত্যাচারী জালেম শাসক মুজাফফর শাহের সময়ে হাবসী শাসনামলের পতন ঘটে।
১১. আলাউদ্দিন হোসেন শাহ : আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পূর্ব পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে, “তিনি ছিলেন বাঙালি এবং রংপুরে তাঁর জন্ম।” কিন্তু 'রিয়াজ-উস-সালাতিনের' লেখক সলিমের মতে, “হোসেন শাহ তার ভ্রাতা ও পিতার সাথে সুদূর তুর্কিস্তান হতে বাংলাদেশে আসেন। রাঢ় এর চাঁদপাড়া মৌজা ছিল তাঁর বসতি স্থান। সেখানকার কাজীর অধীনে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চ বংশ মর্যাদার কথা শুনে তাঁর সাথে কাজীর কন্যার বিবাহ দেন । তিনি বাংলার রাজধানী গৌড়ে যান এবং হাবশি সুলতান মুজাফফর শাহের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন।”
সিংহাসনারোহণ : হোসেন শাহ সম্ভবত নিজ যোগ্যতাবলে সামান্য চাকরি হতে উচ্চ রাজপদে উন্নীত হন এবং সুলতান মুজাফ্ফর শাহের রাজত্বেই তিনি ওয়াজির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুজাফফর শাহের হত্যার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল কি না তা স্পষ্ট বলা যায় না। তবে হাবশি অত্যাচার যখন চরমে তখন মুজাফফর শাহের মৃত্যু ঘটলে রাজ্যের প্রধান অমাত্যগণ মিলিত হয়ে হোসেন শাহকে সুলতান হিসেবে মনোনীত করেন ।
রাজ্য সম্প্রসারণ : অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পর হোসেন শাহ রাজ্যসীমা সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করেন। যেমন- ক্ষমতারোহণের দু'বছরের মধ্যে দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদী এবং জৌনপুরের শাসনকর্তা ইব্রাহীম শর্কির মধ্যে সংঘর্ষ হলে ইব্রাহীম শর্কি পরাজিত হয়ে বাংলায় পলায়ন করেন। বাংলার সুলতান হোসেন শাহ তাকে আশ্রয় দান করলে সিকান্দার লোদীর বিরাগভাজন হন। পরবর্তীতে অজ্ঞাত এক কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। এতে উত্তর বিহার হোসেন শাহের রাজ্যভুক্ত হয় ।
হোসেন শাহ নতুন শক্তি সঞ্চার করে কামতা ও কামরূপ রাজ্যের দিকে অগ্রসর হন। তাঁর বাহিনী কামরূপ আক্রমণ করে হেজো পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল স্থায়ীভাবে বাংলা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। সমকালীন শিলালিপি ও মুদ্রা থেকে জানা যায় যে, হোসেন শাহ নিজেকে কামতা ও কামরূপ বিজয়ী বলে মনে করেন। এরপর তিনি আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি রাজ্য দখল করেন ।
শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা । সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে হোসেন শাহ সর্বপ্রথম শান্তিশৃঙ্খলার দিকে মনোনিবেশ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে তিনি রাজ্যে পূর্ণ শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অরাজকতা সৃষ্টিকারী সৈন্যদলকে কঠোর হস্তে দমন করেন।
কৃতিত্ব : আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বহু হাবশিদের হত্যা ও বিতাড়িত করেন এবং সাম্রাজ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হাবশিদের শোষণ ও অত্যাচার রহিত হয়। সাম্রাজ্যের শান্তি ও জনগণের কল্যাণের দিক বিবেচনা করে তিনি সাম্রাজ্যের শাসন কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। নিজের নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে তিনি প্রজাদের কল্যাণার্থে একটি যুগোপযোগী ও নবাবভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
তাঁর প্রবর্তিত শাসন কাঠামোর ফলশ্রুতিতে প্রজাদের সুখশান্তি বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণেই তিনি অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। বাংলার অন্যান্য রাজারা সাধারণত গৌড় ও পাণ্ডুয়ায় তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। কিন্তু হোসেন শাহ গৌড় নগরীর সংলগ্ন এলাকায় তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। রিয়াজ-উস-সালাতিন ও তাবাকাত-ই-আকবরীতে এর প্রমাণ উল্লেখ আছে। শিক্ষার উন্নয়ন ও বিস্তার লাভের জন্য তিনি রাজ্যের বহু স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, কলেজ নির্মাণ করেন। জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি বহু রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ, পুকুর খনন, ভেড়ি বাঁধ নির্মাণ, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য উৎপাদন ও বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেন। কৃষক ও বণিকগণকে তিনি যথেষ্ট উৎসাহিত করেন। দুস্থ লোকের জন্য তিনি নোঙ্গরখানা নির্মাণ করেন।
মৃত্যু : হোসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন। ড. হবিবুল্লাহ তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে বলেছেন, " Alauddin Hussain Shah unquestionably the best if not the greatest, of the medieval rulers of Bengal. "
১২. নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ ঃ আলাউদ্দিন হোসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠ্য পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে অর্জিত সিংহাসন তিনি সসম্মানে রক্ষা করে এর সীমানা বৃদ্ধি করেন। সিকান্দার লোদীকে পরাজিত করে তিনি ত্রিহুত জয় করেন। মুঘল সম্রাট বাবরের সাথে তাঁর সংঘর্ষ হলে তিনি সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ইসলামের উন্নতির জন্য সুফি, দরবেশ ও কবি সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এ জ্ঞান তাপস ও প্রজাহিতৈষী শাসক ১৫৩২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন ।
১৩. আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ : নসরত শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি মাত্র তিন মাস ক্ষমতায় ছিলেন। পিতৃব্য গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ কর্তৃক তিনি সিংহাসনচ্যুত হন।
১৪. গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ : গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ভ্রাতুষ্পুত্র ফিরোজ শাহকে হত্যা করে ১৫৩৩ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন শেরশাহ ও হুমায়ুনের সমসাময়িক এবং তাদের সাথে ভাগ্য পরিণামে তিনিও এক সূত্রে জড়িত হয়ে পড়ন। তিনি আফগান রাজ্য আক্রমণ করে শেরশাহের কাছে পরাজিত হন। পরবর্তীতে তিনি পরাজিত হয়ে ১৩ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৫৩৮ সালে শের খান কর্তৃক বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান হিসেবে তিনি বিতাড়িত হন।
১৫. বার ভূঁইয়া এবং নবাব আলীবর্দী খাঁ : বাংলাদেশ মুঘল সাম্রাজ্যের হস্তগত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই এখানে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বার ভূঁইয়া নামক কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী জমিদার দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করে স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় সুবাদার ইসলাম খান তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেন। মুঘলদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লে নবাব আলীবর্দী খাঁর আমলে পুনরায় বাংলা স্বাধীন হয় এবং ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার পতনের পর বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে চলে যায়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, বাংলার ইতিহাসে স্বাধীন সুলতানি শাসনামল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। মূলত ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ এর সূচনা করেন এবং এ স্বাধীন সুলতানি শাসনামল সুদীর্ঘকাল বাংলার ইতিহাসে সমহিমায় বিদ্যমান ছিল। কিন্তু এ স্বাধীন সালতানাতও ইতিহাসের নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটাতে ব্যর্থ হয়। ফলে পরবর্তী দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে স্বাধীন সুলতানির সমাধি রচিত হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]