বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহের কৃতিত্ব বিচার কর । হাজী ইলিয়াস শাহকে 'শাহে বাংলা' বলা হয় কেনা উত্তরঃ

ভূমিকা : ইতিহাসের পাতায় যুগে যুগে বিভিন্ন বংশের রাজত্বকালে কতিপয় অনন্য প্রতিভা, বিরল ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল। যেসব ব্যক্তি স্বীয় নগণ্য অজানা অবস্থা থেকে নিজ সাধনা, পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তন্মধ্যে বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাসে ইলিয়াস শাহ অন্যতম। তিনি প্রথম মুসলিম শাসক যিনি সমগ্র বাংলাকে একীভূত করার বা একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। যাকে ঐতিহাসিকগণ শাহ-ই বাঙ্গালা, শাহ-ই-বাঙ্গালীয়ান ও সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ বলে অভিহিত করেন। তাঁর প্রথম জীবনের কথিত কুকীর্তি দ্বিতীয় জীবনের সুকীর্তি দ্বারা মলিন হয়ে যায়। তিনি শুধু বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে ক্ষান্ত হন নি বাংলার বাইরেও রাজ্যসীমা বিস্তার ও সুষম শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন, এমনকি দিল্লির সুলতানের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েও মাথা নিচু করেন নি। তাই এ বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক জনসাধারণ কোন দিক দিয়ে বিচার করবে এটা বিচার্য বিষয়।
প্রাথমিক পরিচয় : প্রাপ্ত তথ্যের অভাবে ইলিয়াস শাহ ও তাঁর বংশ পরিচয় সম্পর্কে সঠিকভাবে তেমন কিছু জানা যায় না। তারপরও যেটুকু জানা যায়, আইন-ই আকবরী → আবুল ফজল, রিয়াজ উস-সালাতিন → গোলাম হোসেন সলিম চৈতন্য চরিত্রামৃত, বুকাননের পাণ্ডুলিপি ও আরব ঐতিহাসিক ইবনে হজর ও আল সখাভীর বিবরণ এবং সমকালীন প্রাপ্ত মুদ্রা ও লিপি প্রভৃতি থেকে। ইবনে হজর ও আল সখাভীর মতে, “তিনি পূর্ব ইরাকের সিজিস্তানের লোক ছিলেন।” রিয়াজ উস-সালাতিনের বিবরণ অনুযায়ী, আলী মোবারক ও হাজী ইলিয়াস ছিলেন দু'ভাই। তারা দু'জনে মালিক ফিরোজ বিন রজবের অধীনে চাকরি করেন। এক সময় হাজী ইলিয়াস কোন অপকর্ম করে পালিয়ে যান। ফলে সুলতান আলী মোবারককে হাজী ইলিয়াসকে ধরে আনতে প্রেরণ করেন। কিন্তু আলী মোবারক এ কাজে ব্যর্থ হন। তাই আলী মোবারকও বিতাড়িত হন। পরবর্তীতে আলী মোবারক কদর খানের অধীনে চাকরি করেন ও পরে লখনৌতির সুলতান হন। এক সময় হাজী ইলিয়াসকে বন্দি করেন এবং মাতার অনুরোধে ছেড়ে দেন ও সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করেন। পরে হাজী ইলিয়াস খোজাগণের সাহায্যে আলী মোবারককে হত্যা করে শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ উপাধি ধারণ করে সিংহাসনারোহণ করেন।
রাজ্যবিস্তার ঃ নিম্নে ইলিয়াস শাহের রাজ্যবিস্তারের বিবরণ দেওয়া হল :
১. সাতগাঁও অধিকার : ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনারোহণের পর ইলিয়াস রাজ্যজয়ের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ তখনও তাঁর কর্তৃত্বের বাইরে ছিল। সেখানে সে সময় ফখরউদ্দিনও দিল্লির শাসন চলছিল। তাই পূর্ব বাংলার দিকে রাজ্যবিস্তারের চেষ্টা না করে ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দে বা তাঁর পূর্বে সাতগাঁও অধিকার করে নিজ রাজ্যসীমা বৃদ্ধি করেন। ১৩৪৬ সালে সাতগাঁও টাকশাল থেকে মুদ্রিত মুদ্রা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায় ।
২. নেপাল আক্রমণ : ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ কর্তৃক নেপাল অধিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় নেপালের রাজবংশাবলিতে। কাঠমণ্ডুর নিকটস্থ স্বয়ম্ভুনাথের মন্দিরে প্রাপ্ত শিলালিপিতে এ আক্রমণের প্রমাণ পাওয়া যায়। এ আক্রমণের তারিখ ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে বলে উল্লেখ আছে। ঐতিহাসিক জয়সওয়াল বলেছেন, “ইলিয়াস পশুপতি নাগের ধনরত্ন লুণ্ঠন করেন।” যাহোক ইলিয়াস শাহের নেপাল আক্রমণ ও যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে কেবল ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে তিনি ফিরে আসেন।
৩. ত্রিহুত অধিকার ঃ নেপাল জয়ের পূর্বে ইলিয়াস শাহ ত্রিহুতের কিছু অংশ অধিকার করেন। এ সময় ত্রিহুতে শক্তিসিংহ ও কামেশ্বর এ দু'জনের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে ত্রিহুতে অভিযান প্রেরণ ও অধিকার করেন (১৩৪৪)।
৪. সোনারগাঁও অধিকার : ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ পূর্ব বাংলার দিকে সাফল্যজনক অভিযান প্রেরণ করেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। সোনারগাঁওয়ে ফখরউদ্দিন মোবারক শাহের পর সুলতান ইখতিয়ার উদ্দিন গাজীশাহ রাজত্ব করেন ১৩৪৯-১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত। ১৩৫২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহ সোনারগাঁও অধিকার করেন, তাঁর প্রমাণ পাওয়া যায় সোনারগাঁও টাকশাল থেকে।
৫. জাজনগর ও বিহার আক্রমণ : সোনারগাঁও অধিকারের পর ইলিয়াস শাহ বাংলার বাইরে রাজ্যসীমা বৃদ্ধিকল্পে অভিযান প্রেরণ করার মত শক্তি অর্জন করেন। তারিখ-ই ফিরিশতা ও তবকাত-ই আকবরীতে উল্লেখ আছে যে, ইলিয়াস শাহ জাজনগর আক্রমণ করে চিলকা নদের সীমা পর্যন্ত অগ্রসর হন ও বহু ধনসম্পদ করায়ত্ত করেন। এ বিজয়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে ইলিয়াস শাহ পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশ বিহার জয় করেন। বাজগীরের পাহাড়ে একটি মন্দিরে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, মালিক ইব্রাহীম বায়ু মগধে দিল্লির সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলকের গভর্নর ছিলেন। পাণ্ডুয়ায় প্রাপ্ত ফার্সি পাণ্ডুলিপির উপর ভিত্তি করে বুকানন বলেছেন, ইলিয়াস শাহ ও ফিরোজ শাহ তুঘলকের মধ্যে যুদ্ধ হয়। বিহারের মালিক ইব্রাহীম বায়ুর সমাধি ভবনের প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায়, ইব্রাহীম বায়ু ৭৫৩ হিজরির ১৩ জিলহজ তারিখে মৃত্যুবরণ করেন। কারও মতে, ইলিয়াস শাহের আক্রমণ এ মৃত্যুর কারণ । •
৬. চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী অধিকার : সিরাত ই ফিরোজ শাহি নামে একটি সমসাময়িক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ইলিয়াস শাহ পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে বিহার ছেড়ে চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশী জয় করে এক বিশাল ভূখণ্ড তাঁর রাজ্যভুক্ত করেন ও বাহরাইনের শায়খ মাসুদ গাজীর সমাধিতে গিয়ে দু'বার ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন । ৭. কামরূপ ও ত্রিপুরা আক্রমণ : এছাড়া ইলিয়াস শাহ ১৩৫৭ সালে কামরূপ আক্রমণ করে তথাকার শাসনকর্তা ইন্দ্র নারায়ণকে পরাজিত করে কামরূপ জয় করেন এবং ত্রিপুরা রাজার পুত্র রত্নদাকে ত্রিপুরা সিংহাসন লাভে সহযোগিতা করেন ।
৮. দিল্লির সুলতানের সাথে সংঘর্ষ : ইলিয়াস শাহের সাফল্য বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক একটি 'নিশান' জারি করে বাংলা আক্রমণ করেন। তবে নিশানের বর্ণনা কতটুকু সত্য জানি না । তবে ফিরোজ শাহ যে বাংলা আক্রমণ করেন তা প্রমাণ সাপেক্ষ
দিল্লির বাহিনী বাংলার নিকটবর্তী হলে ইলিয়াস শাহ রাজধানী প্রতিরক্ষার কোন ব্যবস্থা না করেই আত্মরক্ষার জন্য নিকটবর্তী একডালা দুর্গে আশ্রয় নেন। বিশাল দিল্লি বাহিনীর কাছে সম্মুখে টিকা সম্ভব হবে না মনে করে এ সমরনীতির পরিচয় দেন। এদিকে দিল্লি বাহিনী অতি সহজে পাওয়া দখল করে একডালা দুর্গ অবরোধ করেন কিন্তু জয় করতে পারলেন না। পরে ইলিয়াস শাহ ও দিল্লির বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হয়। কিন্তু কোন সাফল্য দেখতে না পেয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় ও উপঢৌকন বিনিময় হয়। এ যুদ্ধের ফলে ইলিয়াস শাহের মর্যাদা আরও বেড়ে যায়। তবে ইলিয়াস শাহ একডালা দুর্গের সাহায্যে আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।
কৃতিত্ব ঃ সুলতান শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ একজন শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন। নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার জন্য তিনি অতি সামান্য অবস্থা থেকে বাংলার সিংহাসন লাভ করেন। সুদক্ষ কূটনীতিবিদ হিসেবে তিনি সময় ও সুযোগ বুঝে বহিঃদেশসমূহ আক্রমণ করে দখল করেন। এছাড়া তিনি প্রথম সমগ্র বাংলাদেশ অধিকার করে স্বাধীন সার্বভৌম সুলতান হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং ১৫ বছর রাজত্ব করেন। সুদক্ষ সেনানায়ক হিসেবে তিনি একডালা দুর্গের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে সমরনীতিতে অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজিত ছিল।
একজন ধার্মিক ও নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবেও ইলিয়াস শাহ অনন্য সাধারণ ছিলেন। তিনি ফকির, সুফি ও দরবেশদের অতিশয় শ্রদ্ধা করতেন। তাঁর সময়ে তিনজন বিখ্যাত সাধক যথা : শয়খ আলী সিরাজউদ্দিন, তাঁর শিষ্য আলাউল হক এবং শয়খ খাজা বিয়াবানি দরবার অলংকৃত করেন। আলাউল হকের সম্মানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ।
‘শাহে বাংলা” বলা হয় কেন : ইলিয়াস শাহ নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার জন্য বাংলার ইতিহাসে যে বংশের সূচনা করেন তাই “ইলিয়াস শাহী বংশ নামে খ্যাত। তিনি কেবল একটি নতুন বংশ প্রতিষ্ঠা করেই ক্ষান্ত হন নি একটি নব প্রবতির্ত শাসনব্যবস্থারও প্রবর্তন করেন। তাঁর শাসনব্যবস্থার প্রশংসা করে আইন-ই-আকবরীতে তাকে আমীর ও তারিখ- ই-মোবারক শাহিতে মালিক রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া শামস-ই-সিরাজ আফিফ তাঁকে 'শাহ-ই-বাঙালাহ', 'শাহ- ই-বাঙ্গালীয়ান', 'সুলতান-ই-বাংলা' বলে উল্লেখ করেছেন। সুতরাং, তাকে ‘শাহে বাংলা' বলে আখ্যায়িত করা ও কৃর্তিত্বের স্বীকৃতি দেওয়া অবশ্যই যুক্তিযুক্ত।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, বাংলায় স্বাধীন সালতানাতের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ইলিয়াস শাহ একক শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। সমগ্র বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে, পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে রাজ্যবিস্তার করে এবং দিল্লি সুলতানের আক্রমণ প্রতিহত করে যে শৌর্যবীর্যের প্রমাণ দেন তা গুরুত্বপূর্ণ। কূটনীতি জ্ঞানের দ্বারা তিনি দিল্লির সুলতানের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বহাল রাখেন। তাঁর স্বল্পকাল স্থায়ী রাজত্বকাল যোগ্যতার পরিচায়ক। তাই ইলিয়াস শাহ বাংলার ইতিহাসে জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা বলে খ্যাত হন। তাঁর রাজত্বকালে বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হন। তবে দুর্ভাগ্য যে, তাঁর রাজত্বকাল সম্পর্কে তথ্যের অভাবে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। যা জানা যায় তা একমাত্র দিল্লি কেন্দ্রিক ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে। তাই স্বদেশে তিনি কোন কোন ঐতিহাসিকের বিবরণে কলঙ্কিত। তবে সার্বিক দিক বিবেচনায় তিনি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]