সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হোসেন শাহি বংশের অবদান আলোচনা কর।

ভূমিকা : ১৪৯৩ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত ৪৫ বছর ধরে হোসেন শাহি বংশের চারজন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, নসরৎ শাহ, আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ এবং গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ বাংলাদেশে রাজত্ব করেন। ড. ডি. সি সেন এর মতে, বাংলার শিল্প, সাহিত্য, ধর্ম ও সংস্কৃতি বিকাশের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান এবং সর্বাঙ্গীণ উন্নতির ক্ষেত্রে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের বিকাশ সাধিত হয়।
হোসেন শাহি আমলে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের কারণ ঃ আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হোসেন শাহি বংশ ও অভিজাতবর্গ সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশে এক উৎকর্ষতা সাধিত হয়। নিম্নে হোসেন শাহি আমলে বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি বিকাশের কারণসমূহ তুলে ধরা হল ঃ
১. শিক্ষানীতির উদারতা মুসলিম আমলের আগে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আধিপত্যের ফলে হিন্দু অভিজাত শাসক শ্রেণীর শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে ভাষা ও সাহিত্য চর্চা করত যা সংস্কৃতি বিকাশের সাধারণ গতিকে রুদ্ধ করে রেখেছিল। কিন্তু মুসলিম শাসনামলে বিশেষ হোসেন শাহির উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা সংস্কার ও প্রবর্তনের ফলে ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়।
২. ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা: বাংলার স্থানীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সাথে শাসকদের চিন্তাভাষার মিল না থাকায় মুসলিম শাসকগণ তাদের ইসলামি ধ্যানধারণা বিস্তারের জন্য আরবি ও ফার্সির বদলে বাংলা ভাষায় শিক্ষাও এ ভাষায় রচনাবলি প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।
৩. ব্যক্তিগত অবদান : বিশেষ করে হোসেন শাহির ব্যক্তিগত উৎসাহ অনুপ্রেরণা সাহিত্যিক রসিকতা ও সাংস্কৃতিক মনোভাবের কারণে তার আমলে প্রধান প্রধান সাহিত্যিকগণ বাংলায় আগমন করেন এবং সাহিত্য চর্চায় মনোনিবেশ করেন।
৪. বাংলা ভাষায় ইসলামি চিন্তার প্রসার : বাংলার মুসলমানদের আরবি ও ফার্সি ভাষার সাথে পরিচয় না থাকায় ইসলামি চিন্তার সাথে তাদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় করাতে বহু সংখ্যক হিন্দু ও মুসলিম কবি সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষায় রচনার জন্য এগিয়ে আসেন।
যাহোক সে সময়ে রচিত কাব্য-শিল্প-সাহিত্যের রচনাকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি। যথা ঃ ক. মুসলিম কবি সাহিত্যিকদের রচনা : হোসেন শাহি বংশের মুসলিম সাহিত্যের বিকাশ সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. রোমাঞ্চ সাহিত্য : এ সময়ে শাহ মোহাম্মদ সগীর কর্তৃক রচিত 'ইউসুফ জোলেখা' নামক প্রণয় উপাখ্যান কাব্য অন্যতম। অন্য রচয়িতাদের মধ্যে আব্দুল হাকিম, গরীবুল্লাহ, গোলাম সাদাত উল্লাহ, সাদেক আলী ও ফকির মোহাম্মদ অন্যতম। এছাড়াও সে সময়ে দৌলত ওয়াজির বাহরাম খানের প্রেমাপখ্যান লায়লী মজনু বাংলার সাহিত্যের একটি বিশেষ সংযোজন।
২. বিজয় কাব্য : মুসলমানদের রচিত বিজয় কাব্যগুলো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অগ্রগতির ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এ জাতীয় কাব্যের রচয়িতাদের মধ্যে শাহ বদিউদ্দিন, শেখ চাঁদ, নসরুল্লাহ খান এবং মনসুরের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। তাছাড়া ইউসুফ শাহ সভাকবি হিসেবে 'রসূল বিজয়' নামে মহানবীর জীবন কাহিনীভিত্তিক কাব্য রচনা করেন, কবি সৈয়দ সুলতান জ্ঞানপ্রদীপ, নবী বংশ এবং শবে মেরাজ রচনা করেন। শেখ ফয়জুল্লাহ গাজী বিজয় ও গৌরাক্ষ বিজয় কাব্য রচনা করেন। বিজয় কাব্যের মুখ্য বিষয় ছিল মহানবী ও তার সাহাবীদের জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলি ও মুসলিম বীর যোদ্ধাগণের কাহিনী ।
৩. পদাবলি কাব্য : পারসিক সাহিত্য 'মসনবীর' এর আলোকে বাংলার মুসলিম কবিরা যেমন চাদকাজী, কবি শেখর হোসেন শাহ, নসরত শাহ, গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ প্রমুখ সুলতানদের কর্মচারী থাকাকালে পদ রচনায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেন। চাঁদকাজী বাংলা সাহিত্যের প্রথম পদাবলি রচয়িতা এবং পদাবলি রচনায় বিশেষ দক্ষতার জন্য কবি শেখরকে 'ছোট বিদ্যাপতি' হতো।
৪. অন্যান্য : অত্র সময়ের অন্যতম কবি দৌলতকাজী আলাওল, পদ্মাবতী, সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী কাব্য রচনা করেন। ব্রজবুলি ভাষায় শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ের রচয়িতা ছিলেন যশোরাজ খা, ধরা হয় এটি আদি বাংলা ভাষা ব্রজবুলিতে প্রথম রচনা। তাছাড়া মুসলিম কবিরা হিন্দু সমাজের উপর তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি ও মাহাত্ম্য রচনা করে 'সত্যপীর' নামক বাংলায় এক কাব্যমূলক ধর্ম প্রচার রচনার উদ্ভব ঘটান। কবি ফয়জুল্লাহ বাংলা সাহিত্যে সংগীত বিদ্যার উপর প্রথম 'রাগমালা' রচনা করেন। কবি মোজাম্মেল 'নীতিশাস্ত্র' ও 'সাতনামা' নামক দু'টি জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ রচনা করেন।
খ. হিন্দু কবি সাহিত্যিকদের রচনা : যে সব হিন্দু কবি ও সাহিত্যিক হোসেন শাহিদের সুলতানী আমলে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রভূত অবদান রাখেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি ও সাহিত্যিকদের পরিচিতি ও সাহিত্যকর্ম নিম্নে আলোচনা করা হল ঃ ১. চণ্ডীদাস ও কৃত্তিবাস : রাধাকৃষ্ণের কাহিনী নিয়ে চণ্ডীদাসের 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য পদাবলি বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত অবস্থায় কীর্তন গানের মধ্যদিয়ে বঙ্গভাষীর কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাংলা সাহিত্যের এ শ্রেষ্ঠ সম্পদ রচনা করে তিনি যশস্বী হয়ে আছেন । এছাড়া কৃত্তিবাস এ সময়ে বাংলায় 'রামায়ণ' রূপান্তর করে বাংলা ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটান ।
২. মালাধর বসু ঃ 'শ্রীকৃষ্ণ বিজয়' ও 'লক্ষীচরিত' কাব্যের রচয়িতা মালাধর বসু সুলতান কর্তৃক 'গুণরাজ খান' উপাধি পান । ৩. বিদ্যাপতি ঃ চণ্ডীদাস ও কৃত্তিবাসের সমসাময়িক মিথিলা কবি বিদ্যাপতি বাঙালি না হয়েও বাংলাদেশে তার জনপ্রিয়তা কারণ বাংলা ভাষাকে ভালোবেসে অনেক গ্রন্থ রচনা করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে অবিচ্ছেদ্য সূত্রে জড়িয়ে আছেন ।
৪. বিজয়গুপ্ত ঃ হোসেন শাহের আনুকূল্যে বিজয়গুপ্ত 'পদ্মপুরাণ' ও 'মনসামঙ্গল' রচনা করেন। বিপ্রদাস 'মনসা বিজয়' ও 'মনসামঙ্গল' কাব্য রচনা করেন। এছাড়া কবি পরমেশ্বর কিছু কাব্যগ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি লাভ করেন এবং দ্বিজ নারায়ণ চণ্ডীর উপাখ্যান রচনা করেন ।
৫. দ্বিজবংশীদাস : পূর্ববঙ্গের অত্যন্ত জনপ্রিয় কাব্য 'মনসামঙ্গল' এর রচয়িতা ছিলেন দ্বিজ বংশীদাস। তার কন্যা চন্দ্রবতীও একই নামে আরেকটি কাব্য রচনা করেন। হোসেন শাহের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় এ সময়ের কবিদের রচনাবলি বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। ৬. শ্রীধর ঃ যুবরাজ ফিরোজ শাহের উদ্দীপনায় কবি শ্রীধর ‘বিদ্যাসুন্দর' ও অন্যান্য কাব্য রচনা করে স্বীয় কীর্তির জন্য ‘গুণরাজ খাঁ' উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন ।
৭. বৃন্দাবন ও জয়ানন্দ : বৈষ্ণব কবি হিসেবে বাংলা ভাষায় কবি বৃন্দাবনই প্রথম চৈতন্যদেবের জীবনী গ্রন্থ চৈতন্য ভাগবত রচনা করেন এবং এ ধারায় পরবর্তী বাংলা চৈতন্যচরিত হচ্ছে জয়ানদের চৈতন্য মঙ্গল'। তাছাড়াও জয়ানন্দের সমসাময়িক কবি লোচন দাস 'চৈতন্যমঙ্গল' এবং কবিরাজ কৃষ্ণদাস শ্রীচৈতন্য 'কারিতামৃত' রচনা করে বাংলা সাহিত্যে বিখ্যাত হয়ে আছেন ।
৮. অন্যান্য : অন্যদের মধ্যে এ সময় কানাহরি দত্ত 'মনসাবজন' ও রামাই পণ্ডিত, 'শূন্য পুরাণ' কাব্য রচনা করেন ৷ শ্রীকরনন্দী, 'জৈমিনি' রচিত মহাভারতের অশ্বমেধ পর্বকে বাংলা ভাষায় ভাবানুবাদ করেন। তাছাড়াও রঘুনাথ পণ্ডিত। কৃষ্ণপ্রেম তরঙ্গিনী এবং মাধবাচার্য শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল রচনা করে বাংলা সাহিত্যের বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেন ।
গ. সংস্কৃত সাহিত্য : সংস্কৃত সাহিত্যেও মুসলিম সুলতানদের যথেষ্ট অবদান ছিল। সংস্কৃত ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এজন্য অনেক মুসলিম শাসক এর প্রতি আগ্রহী ছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে কেউ কেউ সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের চর্চাও করতেন। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন :
১. রূপ ও সনাতন : হোসেন শাহির আমলে রূপ ও সনাতন নামের দুজন ব্রাহ্মণ সংস্কৃত সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখেন। রূপের গ্রন্থাবলির মধ্যে 'ভক্তি রসামৃত', 'লঘু ভগবদমৃত', 'ললিতমাধব' ও 'বিদগ্ধ মাধব' উল্লেখযোগ্য এবং সনাতন রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে, ‘শ্রীহরিভক্তি বিলাস', 'শ্রী বৈষ্ণব তোষিণী’, ‘লঘুহরি নাসামৃত ব্যাকরণ' ও 'শ্রীকৃষ্ণ লীলাস্তর' অন্যতম ।
২. স্মৃতিশাস্ত্র : স্মৃতিশাস্ত্র সংস্কৃত সাহিত্যের একটি স্মরণীয় ধারা। প্রথমদিকে শূলপানি স্মৃতিশাস্ত্র রচনা করেন এবং পরবর্তীতে রঘুনন্দের স্মৃতিশাস্ত্র রচিত হয়েছিল ষোড়শ শতকের দিকে । ৩. অন্যান্য ঃ ধ্রুবানন্দ ও আরও অনেকে মহাভাষ্যবলিসহ হিন্দুকৌলিণ্য প্রথাকে কেন্দ্র করে মুসলিম শাসনামলেও অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এছাড়া সংস্কৃত পণ্ডিত বৃহস্পতি মিশ্র স্মৃতিরত্নহার, গীতগোবিন্দ টিকা, কুমারসম্ভবটিকা ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন।
উপসংহার ঃ উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, হোসেন শাহি বংশের আমল ছিল এমন একটা যুগ, যেখানে বাংলা ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি কাব্য ও সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে যথার্থ স্বীকৃতি লাভ করেছিল এবং বাঙালিদের মেধা, ধীশক্তি, স্বাধীন চিন্তা ও সংস্কার মুক্ত পরিবেশ বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অনন্য বিকাশ ঘটেছিল। ড. হবিবুল্লাহ তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, "Alauddin Hossain Shah was unquestionably the best if not the greatest of the medieval rulers of Bengal."

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]