ভূমিকা : মুঘল পূর্ববর্তী যুগে হোসেন শাহি আমল বাংলার স্বর্ণযুগ হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এবং তাঁর বংশধরগণ প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল বাংলা শাসন করেন। রাজ্য সীমা সম্প্রসারণ, প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা এবং ধর্ম সাহিত্য ও শিল্পকলার ক্ষেত্রে তাদের উল্লেখযোগ্য কীর্তি প্রশংসার দাবি রাখে। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলেই ইতিহাসে এটা হোসেন শাহি বংশ নামে পরিচিত। ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দের মুদ্রা থেকে জানা যায় ঐ সময়ই এ বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তা মোট চারজন শাসকের দ্বারা দীর্ঘ ৪৫ বছর যাবৎ স্থায়ী ছিল।
হোসেন শাহি বংশের উত্থানপতন : হোসেন শাহি বংশের উত্থানপতন সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল : আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর পরিচয় ঃ আলাউদ্দিন হোসেন শাহের পূর্ব পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায় না। সুখময় মুখোপাধ্যায়ের মতে, “তিনি ছিলেন বাঙালি এবং রংপুরে তাঁর জন্ম।” কিন্তু রিয়াজ-উস-সালাতিনের লেখক সলিমের মতে, “হোসেন শাহ তার ভ্রাতা ও পিতার সাথে সুদূর তুর্কিস্তান হতে বাংলাদেশে আসেন। রাঢ় এর চাঁদপাড়া মৌজা ছিল তাঁর বসতি স্থান। সেখানকার কাজীর অধীনে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং উচ্চ বংশ মর্যাদার কথা শুনে তাঁর সাথে কাজীর কন্যার বিবাহ দেন। তিনি বাংলার রাজধানী গৌড়ে যান এবং হাবশি সুলতান মুজাফফর শাহের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন।
১. সিংহাসনারোহণ : হোসেন শাহ সম্ভবত নিজ যোগ্যতাবলে সামান্য চাকরি হতে উচ্চ রাজপদে উন্নীত হন এবং সুলতান মুজাফ্ফর শাহের রাজত্বেই তিনি ওয়াজির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুজাফফর শাহের হত্যার সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল কি না তা স্পষ্ট বলা যায় না। তবে হাবশি অত্যাচার যখন চরমে তখন মুজাফফর শাহের মৃত্যু ঘটলে রাজ্যের প্রধান অমাত্যগণ মিলিত হয়ে হোসেন শাহকে সুলতান হিসেবে মনোনীত করেন ।
২. রাজ্য সম্প্রসারণ : অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পর হোসেন শাহ রাজ্যসীমা সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ করেন। যেমন- ক্ষমতারোহণের দু'বছরের মধ্যে দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদী এবং জৌনপুরের শাসনকর্তা ইব্রাহীম শর্কির মধ্যে সংঘর্ষ হলে ইব্রাহীম শর্কি পরাজিত হয়ে বাংলায় পলায়ন করেন। বাংলার সুলতান হোসেন শাহ তাকে আশ্রয় দান করলে সিকান্দার লোদীর বিরাগভাজন হন। পরবর্তীতে অজ্ঞাত এক কারণে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়। এতে উত্তর বিহার হোসেন শাহের রাজ্যভুক্ত হয়।
হোসেন শাহ নতুন শক্তি সঞ্চার করে কামতা ও কামরূপ রাজ্যের দিকে অগ্রসর হন। তাঁর বাহিনী কামরূপ আক্রমণ করে হেজো পর্যন্ত সমস্ত অঞ্চল স্থায়ীভাবে বাংলা রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে। সমকালীন শিলালিপি ও মুদ্রা থেকে জানা যায় যে, হোসেন শাহ নিজেকে কামতা ও কামরূপ বিজয়ী বলে মনে করেন। এরপর তিনি আসাম, ত্রিপুরা, উড়িষ্যা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি রাজ্য দখল করেন ।
৩. শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা : সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে হোসেন শাহ সর্বপ্রথম শান্তিশৃঙ্খলার দিকে মনোনিবেশ করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যে তিনি রাজ্যে পূর্ণ শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । তিনি অরাজকতা সৃষ্টিকারী সৈন্যদলকে কঠোর
হস্তে দমন করেন।
৪. কৃতিত্ব : আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর বহু হাবশিদের হত্যা ও বিতাড়িত করেন এবং সাম্রাজ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হাবশিদের শোষণ ও অত্যাচার রহিত হয়। সাম্রাজ্যের শান্তি ও জনগণের কল্যাণের দিক বিবেচনা করে তিনি সাম্রাজ্যের শাসন কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন। নিজের নিষ্ঠা ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে তিনি প্রজাদের কল্যাণার্থে একটি যুগোপযোগী ও নবাবভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
তাঁর প্রবর্তিত শাসন কাঠামোর ফলশ্রুতিতে প্রজাদের সুখশান্তি বৃদ্ধি পায় এবং এ কারণেই তিনি অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠেন। বাংলার অন্যান্য রাজারা সাধারণত গৌড় ও পাণ্ডুয়ায় তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। কিন্তু হোসেন শাহ গৌড় নগরীর সংলগ্ন এলাকায় তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। রিয়াজ-উস-সালাতিন ও তাবাকাত-ই-আকবরীতে এর প্রমাণ উল্লেখ আছে। শিক্ষার উন্নয়ন ও বিস্তার লাভের জন্য তিনি রাজ্যের বহু স্থানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, কলেজ নির্মাণ করেন। জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি বহু রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ, পুকুর খনন, ভেড়ি বাঁধ নির্মাণ, সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন করেন। তিনি জনগণের কল্যাণের জন্য উৎপাদন ও বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেন। কৃষক ও বণিকগণকে তিনি যথেষ্ট উৎসাহিত করেন। দুস্থ লোকের জন্য তিনি নোঙ্গরখানা নির্মাণ করেন।
৫. মৃত্যু : হোসেন শাহি বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন। ড. হবিবুল্লাহ তাঁর কৃতিত্ব সম্পর্কে বলেছেন, "Alauddin Hussain Shah unquestionably the best if not the greatest, of the medieval rulers of Bengal,"
নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ আলাউদ্দিন হোসেন শাহের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যেষ্ঠা পুত্র নাসিরউদ্দিন নসরত শাহ ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। পিতার উত্তরাধিকারী হিসেবে অর্জিত সিংহাসন তিনি সসম্মানে রক্ষা করে এর সীমানা বৃদ্ধি করেন। সিকান্দার লোদীকে পরাজিত করে তিনি নিহত জয় করেন। মুঘল সম্রাট বাবরের সাথে তাঁর সংঘ হলে তিনি সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ইসলামের উন্নতির জন্য সুফি, দরবেশ ও কবি সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এ জ্ঞান তাপস ও প্রজাহিতৈষী শাসক ১৫৩২ সালে ইহলোক ত্যাগ করেন।
আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ নসরত শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি মাত্র তিন মাস ক্ষমতায় ছিলেন। পিতৃব্য গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ কর্তৃক তিনি সিংহাসনচ্যুত হন।
গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ : গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহ ভ্রাতুষ্পুত্র ফিরোজ শাহকে হত্যা করে ১৫৩৩ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি ছিলেন শেরশাহ ও হুমায়ুনের সমসাময়িক এবং তাদের সাথে ভাগ্য পরিণামে তিনিও এক সূত্রে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি আফগান রাজ্য আক্রমণ করে শেরশাহের কাছে পরাজিত হন। পরবর্তীতে তিনি পরাজিত হয়ে ১৩ লক্ষ স্বর্ণ মুদ্রা দিয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে ১৫৩৮ সালে শের খান কর্তৃক বাংলার সর্বশেষ স্বাধীন সুলতান হিসেবে তিনি বিতাড়িত হন।
হোসেন শাহি বংশের কৃতিত্ব : ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতানদের ন্যায় হোসেন শাহি বংশের সুলতানগণও বাংলার স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য সংরক্ষণে কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। হোসেন শাহি বংশের কৃতিত্বসমূহ নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সম্প্রসারণ : এ বংশের প্রথম দুই সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ও নসরত শাহ বাংলার রাষ্ট্রীয় সীমানা সম্প্রসারণে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। এ আমলে বাংলার সীমানা পশ্চিমে ত্রিহুত, দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়িষ্যার কিয়দংশ, উত্তর পূর্বে কুচবিহার ও দক্ষিণে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
২. ধর্ম নিরপেক্ষ শাসন : হোসেন শাহি সুলতানগণ দিল্লির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের সীমানা সম্প্রসারণ ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এক ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রয়োজন মনে করেন। বিদেশী বংশোদ্ভূত সামরিক শাসকগণ মুখ্য প্রশাসক ছিলেন বটে কিন্তু প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের জন্য স্থানীয় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত করেন। ইলিয়াস শাহি যুগ থেকে হোসেন শাহি যুগ পর্যন্ত এ ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি ছিল অপরিহার্য। Dr. MR. বলেছেন, "Such a secular policy was in here in the logic of Bengal history." সরকারের উচ্চপদগুলোতে অভিজ্ঞ ও দক্ষ হিন্দুদের নিয়োগ সে সময় দেখা যায় ।
৩. শিক্ষা-সংস্কৃতি ঃ হোসেন শাহি আমলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল স্থানীয় মনীষার ভিত্তির উপর বাংলা সাহিত্যের নব জাগরণ। এ জাগরণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং তাঁর মূলে ছিল মহাকাব্য ও পৌরাণিক উপাখ্যানের প্রতি জনগণের আকর্ষণ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি হোসেন শাহি বংশের পৃষ্ঠপোষকতা, ব্রাহ্মণ ধর্মের পুনরভ্যুত্থান ও চৈতন্য দেবের অভ্যুত্থান। বাংলা ভাষা ভাবের আদ প্রদানের বাহন হয়ে উঠে এ সময়। এ যুগে বাংলায় মানবতাবাদী ও ভাবপ্রবণ কাব্যের বিশেষ উৎকর্ষ দেখা যায় ।
৪. শিল্প স্থাপত্য : পঞ্চদশ শতাব্দীতে মাহুয়ান একাধিক শিল্পীর কথা উল্লেখ করেন। যদিও তাদের শিক্ষা নিদর্শন বিশেষ কিছু পাওয়া যায় নি। রাজদরবারে উচ্চাঙ্গ সংগীতের যথেষ্ট প্রচলন ছিল। স্বর্ণ, রৌপ্য, মুদ্রা থেকে নানা ধরনের হস্তলিপির পরিচয় পাওয়া যায়। এ যুগে স্থাপত্য শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। গৌড়ের সোনা মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ উল্লেখযোগ্য।
উপসংহার ঃ উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, হাবশি শাসন বাংলার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করে। মোজাফ্ফর শাহের মৃত্যু ও সৈয়দ হোসেন শাহের আবির্ভাব বাংলার ইতিহাসে নতুন সূর্যোদয়ের মুখ দেখায়। হোসেন শাহি যুগে বাংলার রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক পরিমণ্ডল অনেকটা সচ্ছল ও নির্মল ছিল। চমৎকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল সে সময়কার জনগোষ্ঠীকে সাহিত্য, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চায় মনোনিবেশ করেছিল। এটি ছিল এমন একটি যুগ যেখানে দেশীয় ভাষা সাহিত্যের মাধ্যম হিসেবে যথার্থ স্বীকৃতি লাভ করেছিল, যেখানে বাঙালিদের মেধা ও ধীশক্তি স্বাধীন চিন্তা ও সংস্কার মুক্ত বৃদ্ধি বিকাশ লাভ করার সুযোগ খুঁজে পেয়েছিল। এসব কারণে ঐতিহাসিকগণ হোসেন শাহি রাজত্বকালকে বাংলার ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত