বাংলার বারভূঁইয়া কারা ছিলেন? কিভাবে তাদেরকে দমন করা হয়।

ভুমিকা : ১৫৭৬ খ্রিঃ আকবরের শাসনামলে বাংলা নামেমাত্র মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল এবং এর একটি ক্ষুদ্র অংশে মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। অবশিষ্ট বিরাট এলাকায় বার ভূঁইয়া বা জমিদার ও আফগানগণ স্বাধীনভাবে নিজ নিজ এলাকা শাসন করেছিলেন। ভূঁইফোর জমিদারগণ শক্তিশালী সৈন্যদল ও নৌবহর নিয়ে মুঘল সেনাপতিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বহুবার তাদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে নিজেদের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রেখেছে। জমিদারগণের অধিকাংশই মুসলমান ছিলেন এবং তারা বার ভূঁইয়া নামে পরিচিত ছিলেন। ১৫৭৬ খ্রিঃ থেকে ১৬১২ খ্রিঃ পর্যন্ত এই জমিদারগণই বাংলার প্রকৃত শাসক ছিলেন।
বারভূইয়া কারা : সংস্কৃত 'ভৌমিক' শব্দ হতে ভূঁইয়া শব্দের উৎপত্তি, যার অর্থ জমির মালিক। হিন্দু শাস্ত্রকারদের মতে, সম্রাট বারজন সহকারী শাসক দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। প্রচুর জমির মালিক এই বারজন সর্বোতভাবে স্বাধীন ছিলেন। এই বারজনই বার ভূঁইয়া বলে মনে হলেও এই মতকে গ্রহণ করা যায় না। কেননা, কখন কিভাবে এবং কার দ্বারা তারা মনোনীত হয়েছিলেন তা সঠিকভাবে জানা যায় না। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ভূঁইয়াদের উল্লেখ পাওয়া যায়। তারা ছোট ভূঁইয়া, মধ্যম ভূঁইয়া এবং বড় ভূঁইয়া হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সম্ভবত বড় ভূঁইয়া হতে বার ভূঁইয়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। মুঘল অভিযানের প্রাকালে রঙের নিম্নাঞ্চলীয় এলাকাসমূহ নিজেদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে নিয়ে এই বার ভূঁইয়াগণ বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। কিন্তু এই বিষয়ে মতভেদ আছে যে, তারা কি ঠিক বার জন ছিলেন এবং একই সময়ে গুরুত্ব লাভ করেন। হিন্দু শাস্ত্র মনুসংহিতা ও প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে সম্রাট ও রাজা বাদশাহগণ কর্তৃক বার জন সর্দার বা অধীনস্থ শাসক দ্বারা শাসনকার্য পরিচালনার কথা উল্লেখ থাকলেও এবং কোন লেখক নির্দিষ্ট বার জনের ধারণা দিলেও তাদের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য নেই। সুতরাং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। বার ভূঁইয়াদের অবস্থান : বিভিন্ন তথ্যানুযায়ী প্রতীয়মান হয় যে, বার ভূঁইয়া নদীনালা বেষ্টিত পূর্ববাংলার ভাটি অঞ্চলের লোক ছিলেন। ভাটির অন্তর্ভুক্ত লঙ্কা থেকে ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা পর্যন্ত এলাকা ভাটির অন্তর্ভুক্ত ছিল এতে কোন সন্দেহ নেই। বার ভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খানের বাসস্থান ছিল কাতবার, খিজিরপুর ও সোনারগাঁ। ঐতিহাসিকদের মতে ভাটি অঞ্চল বলতে বাংলার বর্তমান ঢাকা জেলার অধিকাংশ ময়মনসিংহ জেলা, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও যশোর এলাকা ।
১. ঈসা খান : বার ভূঁইয়াদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন ভাটি অঞ্চলের ঈসা খান। তিনি পূর্ব বাংলার প্রতাপশালী জমিদার ছিলেন। রণনৈপুন্য ও শৌর্যেবীর্যে ঈসাখান ছিলেন সমকালীন ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ তার রাজধানী ছিল কাতরাবু।
২. মুসা খান : পিতা ঈসা খানের মৃত্যুর পর পুত্র মুসা খান যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে ভাটি অঞ্চলের অধিপতি হন। তার রাজধানী ছিল সোনারগাও। তিনি ছিলেন স্বাধীনতা প্রিয় সাহসী রণনায়ক এবং মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে বারভূঁইয়াদের শ্রেষ্ঠ।
৩. চাঁদরায় ও কেঁদার রায় : চাঁদরায় ও কেদার রায় ছিলেন দুধভাই। বিক্রমপুরের জমিদার হিসেবে তাদের রাজধানী ছিল শ্রীপুর । কেদা রায় বীরত্বের সাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে মুঘলদের নিকট পরাজিত হন এবং তার রাজ্য মুঘলদের দখলে চলে যায়,।
৪. প্রতাপাদিত্য : যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন বার ভূঁইয়াদের অন্যতম প্রধান। আনুঃ ১৫৯৭ খ্রিঃ প্রতাপাদিত্য যশোরের রাজা হন। তাঁর রাজধানী ছিল ইছামতি নদী সংলগ্ন ধুমঘাটে। ৫. বাহাদুর গাজী : ভাওয়ালের জমিদার বাহাদুর গাজী ছিলেন সমকালীন ভূঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম এবং তার শক্তিশালী নৌবহর ছিল।
৬. রাজা কন্দর্পনারায়ন ও রামচন্দ্র : যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের পূর্ব সীমান্তের জমিদার ছিলেন কন্দর্পনারায়ন । রামচন্দ্র ছিলেন তাঁর পুত্র এবং প্রতাপাদিত্যের জামাতা ।
৭. সোনাগাজী : যুদ্ধ জাহাজ সমৃদ্ধ সোনাগাজী ছিলেন ত্রিপুরার উত্তরাংশের সরাইল পরগনার ভূঁইয়া ।
৮. উসমান খান : ময়মনসিংহের বোকাইনগর অঞ্চলের ভূঁইয়া উসমান খান ছিলেন মুঘল সুবাদার ইসলাম খানের সময়ের সর্বাপেক্ষা প্রতাপশালী ।
৯. রাজা অনন্ত মানিক্য : নোয়াখালী জেলার ভুলুয়ার রাজা অনন্ত মানিক্য এবং মুসা খান মিলিতভাবে মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন।
বারভূঁইয়াদের দমন : বার ভূঁইয়াদের দমন করে বাংলায় মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সম্রাট আকবর ১৫৮৩ খ্রিঃ তাঁর অন্যতম সেনাপতি শাহবাজ খানকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। শাহবাজ খান বার ভূঁয়াদের নেতা ঈসা খান ও মামুন কাবুলীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানের আয়োজন করেন। এই সময় ঈসা খান কুচবিহারের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত ছিলেন। ঈসা খানের অনুপস্থিতিতে মুঘল সেনাপতি তাঁর জমিদারী আক্রমণ করেন এবং সোনারগাও কাতরার ও এগারসিন্ধু হস্তগত করে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরে টোক নামক স্থানে দুর্গ নির্মাণ করেন। ঈসা খান ও মামুন কাবুলী কুচবিহার হতে ফিরে মুঘল সৈন্যদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং বাজিতপুরের নিকট এক যুদ্ধে শাহবাজ খানের সহকারী তারসুন খানকে পরাজিত ও নিহত করেন। ভাওয়ালের নিকট এক যুদ্ধে তাঁরা শাহবাজ খানকে পরাজিত করেন এবং বহু মুঘল করেন ও এদের ধনরত্ন হস্তগত করেন (১৬৮৪)। শাহবাজ খান তাণ্ডায় ফিরে যান ।
১৫৯৪ খ্রিঃ সম্রাট আকবর রাজা মানসিংহকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। মানসিংহ তাণ্ডার অদূরে রাজমহলে বাংলার রাজধানী স্থাপন করেন। কুচবিহারের রাজা লক্ষী নারায়ন ঈসা খানের আক্রমণ হতে রাজ্য রক্ষার জন্য মানসিংহের শরণাপন্ন হন। তিনি তাঁর ভাগ্নিকে মানসিংহের সাথে বিবাহ দেন এবং সম্রাট আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন। মানসিংহ ঈসা খান ও মামুন কাবুলীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। বিক্রমপুরের ১২ মাইল দূরে এক নৌযুদ্ধে মানসিংহের পুত্র দুর্জয় সিংহ নিহত এবং অনেক মুঘল সৈন্য শত্রুদের হাতে বন্দী হয়। অতঃপর মানসিংহের সাথে ঈসাখানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৫৯৯ খ্রিঃ ঈসা খানের মৃত্যু হয় । পুত্র মুসা খান বার ভূঁইয়াদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মানসিংহ পুনরায় বাংলায় আসেন।
বারভূঁইয়াদের দমনে ইসলাম খানের ভূমিকা : সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর শাহজাদা সেলিম জাহাঙ্গীর নাম ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৬০৮ সালে তিনি ফতেহপুর সিক্রির শেখ সেলিম চিশতির দৌহিত্র ইসলাম খানকে বাংলার সুবাদার নিয়োগ করেন। শাসনভার গ্রহণ করে তিনি বুঝতে পারেন যে, বার ভূঁইয়াদের নেতা মুসা খানকে দমন করতে পারলে তার পক্ষে অন্যন্য জমিদারকে বশীভূত করা সহজ হবে এবং সেজন্য তিনি রাজধানী রাজমহল হতে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন। জমিদারদের নৌবাহিনীকে মোকাবিলা করার জন্য তিনি শক্তিশালী নৌবহরের ব্যবস্থা করেন। ইসলাম খান স্থল ও জলপথে মুসা খান ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযানের আয়োজন করেন।
মুসা খানের পরাজয় : ১৬০৯ খ্রিঃ ইসলাম খান ঘোড়াঘাট হতে করতোয়া নদীর তীর ধরে শাহজাদাপুর পৌঁছেন এবং এর পূর্ব তীরে অবস্থিত মুসা খানের দুর্ভেদ্য দুর্গ যাত্রাপুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হন। মুসা খান ও তার মিত্র বাহিনী যাভাপুরের তিন মাইল দূরে ডাকচড়ায় আরো একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। মুঘল বাহিনীর তীব্র আক্রমণে মুসা খান, মির্জা মুমিন, মধুরার ও বিনোদ রায় দুর্গে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ইসলাম খান রাতে হঠাৎ দুর্গ আক্রমণ করেন এবং তা হস্তগত করেন। এরপর মুঘলরা একটি খাল খনন করে জল ও স্থল পথে ডাকচড়া অবরোধ করেন। একমাস অবিরাম সংঘর্ষের পর ডাকচড়া মুঘলদের অধীন চলে আসে এবং ঢাকার দিকে অগ্রসর হন ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার সবশেষে বলা যায়, ইসলাম খান তার বিচক্ষণতা, সাহসিকতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, উদ্যম কর্মকৌশলতা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক কূটকৌশলের দ্বারা বাংলা হতে বার ভূঁইয়াদের আধিপত্য সমুলে উৎপাটন করেন এবং বাংলায় মুঘল আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সম্রাট আকবরের সময়েও বিদ্রোহ দমন করা হয়েছিল সত্য কিন্তু বিদ্রোহ দমন করে বাংলায় মুঘল শাসনের ভিত্তি সুদৃঢ় করার কৃতিত্ব একমাত্র সুবাদার ইসলাম খানের প্রাপ্য।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]