মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলো বিশ্লেষণ কর।

ভূমিকা : বিশ্বের ইতিহাসে ভাঙ্গা-গড়ার চিরন্তন নিয়মই স্বাভাবিক। উত্থান-পতন প্রাকৃতিক নিয়ম, এ চিরন্তন নিয়ম হতে কেউ নিষ্কৃতি পায়নি। মুঘল সম্রাটগণ ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ তিনশত বছরেরও অধিক সময় রাজত্ব করে ভারতবর্ষের ইতিহাসকে শুধুমাত্র সমৃদ্ধই করেন নি, বরং এক অবিস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায়ে পৌঁছে দিয়েছেন। যদিও অনেক পূর্বে অর্থাৎ, ১৭০৭ খ্রিঃ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর পতন শুরু হয়েছে কিন্তু দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের রেঙ্গুনে নির্বাসন মুঘল বংশের পতনের সিল গলিত হয়। নানাবিধ অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণে মুঘল বংশের পতন ঘটে।
মুঘল সাম্রাজ্য পতনের কারণ : যে সমস্ত কারণে জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবরের প্রতিষ্ঠিত মুঘল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল তা নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. স্বাভাবিক স্থিতিকাল অতিক্রান্ত : প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের মতে, “একটি রাজবংশ ১০০ বছরের অধিক সৌর্যবীর্য বজায় রাখতে সক্ষম হয় না। তারপর তার অবনতি ও বিলোপ সাধন শুরু হতে থাকে।" এ নিয়মেই মুঘল বংশের স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়ায় উহার পতন ঘটে। এতে কোন প্রকার অবকাশ নেই ।
২. পরবর্তী সম্রাটগণের অযোগ্যতা : বাবর হতে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত সুযোগ্য সম্রাটগণের শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করে কিন্তু পরবর্তী মুঘল সম্রাটগণ ছিলেন দুর্বল, অযোগ্য, অকর্মণ্য, দুর্নীতিপরায়ণ ও বিলাসপ্রিয়। তাঁদের অনেকেই স্বার্থপর মন্ত্রীদের হাতে শাসনভার অর্পণ করে মদ ও নারীতে আসক্ত হয়ে কালাতিপাত করেন । সে সুযোগে বহিঃশত্রু বার বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
৩. সুষ্ঠু উত্তরাধিকার নীতির অভাব : মুঘল বংশে উত্তরাধীকারী মনোনয়নের ব্যাপারে কোন প্রকার সুনির্দিষ্ট ও সুষ্ঠু নিয়ম বিদ্যমান না থাকায় 'জোর যার মুল্লুক তার' এ নীতির উপর সিংহাসন লাভ করতো। এটা নিঃসন্দেহে সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব ও সংহতির পক্ষে মারারক হুমকিস্বরূপ ছিল। ৪. সামরিক শক্তির অবনতি : পরবর্তীকালে মুঘল সামরিক শক্তির এতই অবনতি ঘটে যে, তারা বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা হতে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হননি। ঐতিহাসিক আরভিন বলেন, 'অবৈজ্ঞানিক সমরাস্ত্র, সেনাবাহিনীর রসদ বিভাগের অবহেলায় সামরিক শক্তির অবনতি ঘটেছিল।'
৫. অভিজাতবর্গের অবনতি : অভিজাতবর্গের স্বার্থপরতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও চারিত্রিক অবনতি মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। স্যার যদুনাথ সরকার বলেন, "To the thoughtful students of Mughal history nothing is more striking than the decline of the peerage.” (মুঘল ইতিহাসের চিন্তাশীল পাঠকের নিকট আভিজাত্যের পতনের মত অন্য কিছু অধিকতর হৃদয়গ্রাহী হবে না।)
৬. নৌবাহিনীর দুর্বলতা: আকবর ব্যতীত কেউই নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন নি। মুঘল সাম্রাজ্যে নৌশক্তির অভাব ছিল প্রকট। ঐতিহাসিক ডি.ডি.মহাজন বলেন, "Another cause of Mughal downfall was the neglect of the sea power by the Mughals.” 'নৌ-শক্তির প্রতি অবহেলা প্রদর্শনই ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি কারণ।
৭. সাম্রাজ্যের বিশালতা : আওরঙ্গজেবের সময় মুঘল সাম্রাজ্য অধিক বিস্তৃতি লাভ করেছিল। ফলে একজন পরাক্রমশালী সম্রাট ব্যতীত উহাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা দুর্বল উত্তরাধীকারীদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। এছাড়াও তখন দ্রুত যানবাহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাব ছিল ।
৮. প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের অবাধ্যতা : পরবর্তী সম্রাটগণের দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরা ছিলেন নিজামুল মুলক, সাদ খান, আলীবর্দী খান প্রমুখ। তাদের অবাধ্যতা রাজ্যের সংহতির উপর মারারক আঘাত হানে।
৯. আর্থিক অবনতি ঃ আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য অভিযানে প্রচুর অর্থ ব্যয়, শাহজাহান কর্তৃক বহু অর্থ ব্যয়ে ইমারত নির্মাণ এবং পরবর্তী শাসকগণের বিলাসিতার ফলে আর্থিক অবনতি দেখা দেয়। এতে মুঘল সাম্রাজ্য ধ্বংসের মুখে চালিত হয়।
১০. শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব : মুঘলদের সময় ধর্মীয় বিদ্বেষ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য অন্যতম দায় ছিল। শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে যে গৃহযুদ্ধ হয় তা ছিল মূলত শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব বা যুদ্ধ। দারা উদার প্রকৃতির মুসলমান ছিলেন অপরদিকে আওরঙ্গজেব ছিলেন সুন্নী মুসলমান। সম্রাট ফররুখ শিয়ারের রাজত্বকালে শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয়ের যে প্রতাপ ছিল তাতেও সুন্নী উমরাহগণ ঈর্ষান্বিত হতো। ফররুখ শিয়ার মুহম্মদ শাহের প্ররোচনায় নিযাম উল মুলক ও সাদাদ খান নির্মমভাবে হত্যা করেন।
১১. হিন্দুদের আন্দোলন : ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর হতে যদিও হিন্দুগণ সর্বপ্রকার নাগরিক ও ধর্মীয় সুবিধা লাভ করে কিন্তু মুসলিম শাসনের দুর্বলতার সুযোগে তারা মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠে। সম্রাট আকবরের হিন্দু প্রীতি সত্ত্বেও মুঘল যুগে হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, মারাঠা শিখ ও রাজপুতদের তীব্র প্রতিরোধমূলক কার্যকলাপ চরম শিখরে উপনীত হয়। মেবারের রানা আকবরের বিরুদ্ধে, গুরু অর্জুন শিখ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কার্যকলাপ চালায় । ছত্রপতি শিবাজী হিন্দু নব জাগরণের আন্দোলন পরিচালনা করে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিমূল প্রকম্পিত করে তোলেন। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মারাঠারা মুঘলদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনা করে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল করে দেয় ।
১২. বৈদেশিক আক্রমণ : অভ্যন্তরীণ কারণ ব্যতীত মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের মূলে ছিল বহিরাক্রমণ। মুঘল সাম্রাজ্য যখন দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে অন্তিম শয্যায় শায়িত তখন পারস্যের নাদির শাহ ও আফগান রাজ আহমদ শাহ আবদালী পর্যায়ক্রমে মুঘল সাম্রাজ্যকে আক্রমণ করে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলেন ।
নাদির শাহের আক্রমণে মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ শুধু পরাজিত ও লাঞ্ছিতই হননি বরং, অফুরন্ত ধন সম্পদও হারান। তারা ৫৭ দিন পর্যন্ত অগণিত সম্পদ লুণ্ঠন করে ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেন। ১৬০০ খ্রিঃ সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ইংরেজগণ বণিকের বেশে ভারতবর্ষে এসেও ভারতের ধনসম্পদ তাদেরকে এদেশের রাজশক্তি দখলে ইন্ধন যোগায়। ১৭৬৫ খ্রিঃ লর্ড ক্লাইভ বাংলার শাসনভার গ্রহণ করেন। এভাবে পরবর্তীতে তারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেন। অবশেষে ১৮৬২ খ্রিঃ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের রেঙ্গুনে নির্বাসনের মধ্য দিয়ে মুঘল শাসনের সমাপ্তি ঘটে।
উপসংহার: নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, জাতীয় জীবনে দুর্নীতি, অনাচার ও অসাধুতা অনুপ্রবেশ করলে কোন দেশ বা জাতি টিকে থাকতে পারে না। মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাসও তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জহির উদ্দীন মুহাম্মদ বাবর মাত্র ১১ বছর বয়সে ফরগনার অধিপতি থেকে ভারতে যে বিশাল মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, পরিশেষে সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের ক্ষমতাচ্যুতির সঙ্গে সঙ্গে মুঘল শাসনের পতন ঘটে।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]