ভূমিকা : মুঘল শাসনামলে বঙ্গদেশ ব্যবসায় বাণিজ্যে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করেছিল। এর প্রধান কারণ ছিল কৃষি ও শিল্পজাত পণ্যের প্রাচুর্য এবং সমুদ্র ও নদীপথে পণ্য পরিবহণের সুবিধা। পারসিক, আবিসিনীয়, চীনা, তুর্কি, মুর, ইহুদি, আর্মেনীয় প্রভৃতি ব্যবসায়ীরা বঙ্গে আসত এবং এখানকার বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পজাত পণ্য জাহাজে বোঝাই করে নিজ নিজ দেশে রপ্তানি করত।
মুঘল আমলে রপ্তানি বাণিজ্য : মুঘল আমলে বাংলা হতে রপ্তানিকৃত পণ্য সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. বস্ত্র ঃ সুতিবস্ত্র ছিল সবচেয়ে মূল্যবান রপ্তানি পণ্য। গুরুত্বের দিক থেকে রেশমি কাপড় ছিল দ্বিতীয় প্রধান পণ্য দ্রব্য । বার্নিয়ার বলেছেন, “বাংলায় এত বিপুল পরিমাণ সুতি ও রেশমি পণ্য দ্রব্যাদি রয়েছে যে, কেবল হিন্দুস্থান বা বিখ্যাত মুঘলদের সাম্রাজ্যেরই নয় বরং পার্শ্ববর্তী সকল রাজ্য এবং এমনকি ইউরোপের এ রাজ্যের এ দুটি পণ্য দ্রব্যের জন্য একই সাধারণ গুদাম ঘর বলে অভিহিত করা চলে। চিকন ও মোটা, সাদা ও রঙ্গিন ইত্যাদি সবরকম সুতি বস্ত্রের বিরাট স্তূপ দেখে আমি মাঝে মাঝে বিস্ময়াভিভূত হয়েছি যে, কেবল ডাচ বণিকরা একাই বিভিন্ন প্রকারের ও মানের সাদা ও রঙ্গিন সুতিবস্ত্র বিপুল পরিমাণে বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে জাপান ও ইউরোপে রপ্তানি করে থাকে। ইংরেজ, পর্তুগিজ ও দেশীয় বণিকগণও এসব দ্রব্যের বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ব্যবস্থা করে। রেশম ও নানান প্রকার রেশমিজাত দ্রব্যাদি সম্পর্কে এ একই কথা বলা যেতে পারে।”
২. যবক্ষার : সপ্তদশ শতকে বার্নিয়ার বাংলার যবক্ষার রপ্তানির কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, “বাংলা হচ্ছে যবক্ষারের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র।” তিনি আরো বলেছেন যে, “ইংরেজ ও ডাচ বণিকগণ বিরাট বিরাট জাহাজে যবক্ষারের পণ্য ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশে ও ইউরোপে পাঠাত।”
৩. চটদ্রব্য : অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দলিলপত্র হতে জানা যায় যে, নবাবি আমলে চটদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে বাংলা হতে রপ্তানি হতো। ১৭৫৩, ১৭৫৫, ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাই ও মাদ্রাজ হতে প্রচুর পরিমাণ চটের বস্তার জন্য কলকাতায় ফরমায়েশ আসত। পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে কলকাতা হতে ৯০ লক্ষ ৩৫ হাজার ৭১৩টি বস্তা রপ্তানি করা হয় । এর মূল্য হিসেবে ২১ লক্ষ ৫৯ হাজার ৭৮২ টাকা আয় হয় ।
৪. লবণ : বাংলা থেকে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে বিপুল পরিমাণ লবণ রপ্তানি করা হতো। সমুদ্রের ও আন্তভূমির লবণাক্ত পানি থেকে লবণ উৎপাদন ছিল মুসলিম আমলের বাংলার অন্যতম শিল্প। আসাম, বিহার, নেপাল ছিল এ লবণের বাজার । মিঃ গ্রান্টের মতে, বছরে ৮ লক্ষ মণ লবণ আসাম ও বিহারে বিক্রয় করা হতো। প্রতি বছর বাংলা উপকূলীয় জেলাগুলোতে ২৮ লক্ষ মণ লবণ উৎপাদিত হতো ।
নীল : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকে বাংলায় নীলের চাষ শুরু হয় এবং প্রচুর পরিমাণে তা রপ্তানি হতে থাকে। ফরিদপুর, ঢাকা, রাজশাহী, যশোহর, পাবনা, নদীয়া, দিনাজপুর, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি অঞ্চল নীল উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল । ৬. আফিম : উত্তরবঙ্গ ও বিহারে উৎপন্ন আফিম ইংল্যান্ড ও চীনে রপ্তানি হতো। বিদেশী পর্যটক বার্নিয়ার বলেছেন যে, বাংলা হতে প্রচুর আফিম বিদেশে রপ্তানি হতো ।
৭. চাউল : মুঘল আমলে বাংলার রপ্তানি বাণিজ্যে চাউলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল । বার্নিয়ার বলেছেন, “বাংলায় এত বেশি পরিমাণ চাউল উৎপন্ন হয় যে, এটি কেবল প্রতিবেশী দেশগুলোতেই নয়, দূরবর্তী রাজ্যগুলোতে রপ্তানি করা হয়ে থাকে। গঙ্গার পথে এ চাউল পাটনা পর্যন্ত আনা হয় এবং সমুদ্রপথে মসলিপত্তন ও কারামণ্ডলের অন্যান্য বহু বন্দরে রপ্তানি হয়ে থাকে । এটা বিদেশী রাজ্যসমূহ বিশেষ করে সিংহল ও মালদ্বীপ পাঠানো হয় ।
৮. তুলা : তুলার উৎপাদন ও রপ্তানি সম্বন্ধে ইংরেজ ব্যবসায়ী টেইলর বলেছেন যে, সপ্তদশ শতাব্দী হতে বঙ্গদেশে তুল উৎপন্ন হতো এবং তা বিদেশে রপ্তানি হতো। সে সময়কার ঢাকার ইংরেজ রেসিডেন্ট বেব বলেছেন যে, ঢাকার তুলা পৃথিবীর সবদেশের তুলার চেয়ে উচ্চমানের ছিল। সে তুলা হতে খুব সূক্ষ্ম বস্ত্র মকমল, ডুড়িয়, তনজেব ও নয়নমুখ রপ্তানি তৈরি হতো ।
৯. চিনি : বার্নিয়ার চিনির ক্ষেত্রেও বাংলার বিপুল পরিমাণ রপ্তানি বাণিজ্য দেখতে পান। তিনি লিখেছেন, “বাংলা চিনি উৎপাদনেও একই রকম সমৃদ্ধশালী; এ চিনি গোলকুন্ডা ও কর্ণাটির রাজ্যে (যেখানে সামান্যই জন্মে) এবং মক্কা ও বসরা মাধ্যমে আরব ও মেসোপটেমিয়ায় এবং এমনকি বন্দর আব্বাসের মধ্য দিয়ে পারস্য পর্যন্ত সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ”
১০. রেশম ঃ নবাব ও ওমরাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় রেশমশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে কাঁচা রেশম ইউরোপে রপ্তানি হতো। নবাব আলীবর্দী খানের আমল হতে ইংরেজরা তুঁত চাষকে উৎসাহিত করতে থাকে। তাদের উৎসাহ দানের ফলে বালিয়া, রংপুর, জঙ্গীপুর, মালদহ, কুমারখালী, রাধানগর, রাঙ্গামাটি প্রভৃতি রেশম উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে । রিয়াজ-উস-সালাতীনের লেখক গোলাম হুসাইনের মতে, মালদহে খুব উৎকৃষ্ট মানের রেশম উৎপন্ন হতো ।
১১. লাক্ষা ঃ বার্নিয়ারের মতে, “বাংলায় সবচেয়ে উত্তম ধরনের লাক্ষা উৎপন্ন হতো এবং তা বিদেশে রপ্তানি করা হতো।” ১২. মিঃ বাংলা হতে ঘি রপ্তানি হতো। ঘি রপ্তানি উল্লেখ করে বার্নিয়ার লিখেছেন, “ঘিয়ের উৎপাদন এত প্রচুর যে, রপ্তানির ব্যাপারে এটা খুব ভারী দ্রব্য হওয়া সত্ত্বেও এটি সমুদ্রপথে বহুস্থানে প্রেরণ করা হয়।”
১৩. ঘৃতকুমারী গাছ । ঘৃতকুমারী গাছ ছিল রপ্তানির একটি মূল্যবান পণ্য। এটা আসাম ও সিলেট অঞ্চলে প্রচুর জন্মাত।
১৪. মিষ্টান্ন ও ফল । বার্নিয়ার বিপুল পরিমাণে মিষ্টান্ন ও ফল যেমন ঃ আম, আনারস, হরীতকী, লেবু ও আদা ইত্যাদি রপ্তানিও উল্লেখ করেন। মিষ্ট দ্রব্যের রপ্তানির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “বাংলা মিষ্ট দ্রব্যাদির জন্য বিখ্যাত । বিশেষত পর্তুগীজ বসতি এলাকায় এর উৎপাদন প্রচুর। এসব দ্রব্য তৈরি করতে এরা খুবই নিপুণ। এটা তারা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রপ্তানি করে। "
১৫. অন্যান্য দ্রব্য । উপরিউক্ত দ্রব্যাদি ছাড়াও অন্যান্য আরো বহু দ্রব্য ছিল, যা বাংলা হতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে রপ্তানি করা হতো। এর মধ্যে ছিল পাট বস্ত্র, শুকনা মাছ, পান-সুপারি, নারিকেল, রসুন, পিঁয়াজ, কর্পূর, মোম, মরিচ, গন্ধ দ্রব্য ও ঔষধপত্র রপ্তানি করা হতো । পাখি যেমন : কবুতর ইত্যাদি এবং পশু যেমন : ছাগল, মেষ এবং হরিণও বাংলা হতে রপ্তানি করা হতো।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, মুঘল আমলে রপ্তানি বাণিজ্য বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বিদেশে বাংলার উৎপন্ন পণ্যের চাহিদা এতই বৃদ্ধি পায় যে, ইউরোপীয় বণিকগণ পণ্যদ্রব্য সংগ্রহের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেন। ইংরেজ, ফরাসি, ওলন্দাজ প্রভৃতি জাতি বাংলাদেশে বাণিজ্য বিস্তার করায় বহু অর্থাগম হওয়ার ফলে বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিল।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত