বাংলার সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খানের কৃতিত্বসমূহ আলোচনা কর ।

: ভূমিকা ও বাংলার ইতিহাসে শায়েস্তা খানের সুবাদারি একটি গৌরবময় ও স্মরণীয় অধ্যায়। ১৬৬৪ সালের ৮ মার্চ তিনি সুবাদার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে সুবাদার মীর জুমলার মৃত্যুর পর বাংলার রাজনৈতিক গগনে যে অরাজকতা ও নৈরাজ্য দেখা দেয় সে সময় শায়েস্তা খানের আবির্ভাব হয় । তিনি অরাজকতার অবসান করে বাংলার সুবাদার হিসেবে গৌরবময় শাসনের সূচনা করেন।
শায়েস্তা খানের কৃতিত্ব : শায়েস্তা খান দায়িত্বভার গ্রহণ করেই শান্তিশৃঙ্খলা স্থাপনের জন্য সচেষ্ট হন। অবশ্য এজন্য তাকে কয়েকটি বিদ্রোহ দমন করতে হয়।
১. কুচবিহারে বিদ্রোহ দমন : শায়েস্তা খানের কৃতিত্বের অন্যতম ফসল হল কুচবিহারে বিদ্রোহ দমন। মীর জুমলা কুচবিহারকে মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত করে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ইস্কান্দার নামক একজন সেনাধ্যক্ষকে অস্থায়ী ফৌজদার নিযুক্ত করেন। মুঘল কর্মচারীরা উত্তর ভারতে রাজস্বব্যবস্থার প্রচলন করেন। এর ফলে কুচবিহারের অধিবাসীরা বিক্ষুব্ধ হন। এ সুযোগ গ্রহণ করে কুচবিহারের রাজ্যচ্যুত রাজা প্রাণ নারায়ণ পার্বত্যাঞ্চল থেকে বের হয়ে মুঘলদের আক্রমণ করেন। এ কাজে বিদ্রোহী প্রজারাও সাহায্য করেন। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে দেখে প্রাণ নারায়ণকে প্রতিহত না করে ইস্কান্দার মীর্জা কুচবিহার ত্যাগ করেন। এসময় প্রাণ নারায়ণ শায়েস্তা খানের কুচবিহারে অভিযান পরিচালনার কথা শুনে ভীত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন এবং ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেন। প্রাণ নারায়ণ যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন সম্রাটকে নিয়মিত কর দেন। প্রাণ নারায়ণের পর মধু নারায়ণ কুচবিহারের সিংহাসনে আরোহণ করে মুঘল সম্রাটকে কর প্রদানে অস্বীকৃতি জানান। শায়েস্তা খান কুচবিহারের মধু নারায়ণকে দমন করার জন্য নিজ পুত্রকে পাঠান। ফলে মধু নারায়ণ পরাজিত হয়ে পার্বত্যাঞ্চলে আশ্রয় নেন। ফলে কুচবিহার পুনরায় মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হয় এবং শায়েস্তা খান স্বীয় পুত্রকে কুচবিহারের ফৌজদার নিযুক্ত করেন। এছাড়া ঐসময় হিজলীর বিদ্রোহী জমিদারও মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন এবং এক লক্ষ টাকা কর প্রদান করেন।
২. সীমান্ত রক্ষার ব্যবহার ঃ সুবাদার মীর জুমলার সময় জয়ন্তিকা রাম নামক একজন অত্যাচারী শাসক সিলেটে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তবে শায়েস্তা খান সুবাদার নিযুক্ত হলে তিনি মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন। কিন্তু কিছুকাল পরে আবার অস্বীকার করেন। ফলে সুবাদার শায়েস্তা খান সিলেট আক্রমণ করে জয়ন্তিকা রামকে বিতাড়িত করেন। এদিকে ১৬৭৬ সালে কুচবিহারের পশ্চিম সীমান্তে পার্বত্য রাজা মুরাহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। শায়েস্তা খান মুরাং রাজ্য আক্রমণ করে বশ্যতা স্বীকার ও কর প্রদানে বাধ্য করেন।
৩. মগ বিতাড়ন ও চট্টগ্রাম বিজয়। বাংলাদেশ থেকে মগ দস্যুদের বিতাড়ন ও চট্টগ্রাম জয় শায়েস্তা খানের বড় কৃতিত্ব। ১৬১৭ সালে আরাকানের মগ রাজা পর্তুগিজদের কাছ থেকে সন্দ্বীপ কেড়ে নেন। ফলে মগ দস্যুদের লুটতরাজ করতে সুবিধা হয়। মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুরা মিলিতভাবে এ অঞ্চলে উৎপাত করত। সুবাদার শায়েস্তা খান মগ ও ফিরিঙ্গি জলদস্যুদের উপদ্রব হতে মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য রণতরী নির্মাণ ও বিভিন্ন স্থান থেকে রণতরী সংগ্রহ করেন। ৩০০ রণতরী সজ্জিত একটি নৌবাহিনী দ্বারা তিনি মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের বিপ্ত করেন।
শায়েস্তা খান জ্যেষ্ঠ পুত্র কুজগ উমেদ খানের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম বিজয়ের জন্য এক শাক্তিশালী বাহিনী প্রেরণ করেন। ১৬৬৬ সালে মগরা সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হন এবং মুঘলরা চট্টগ্রাম দখল করেন। মগদস্যুরা জোর করে মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়ে দাস বানাত। মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের পর এ দাসরা মুক্তি পায়। চট্টগ্রাম মুঘল সাম্রাজ্যভুক্ত হলে এর নাম পরিবর্তন করে ইসলামাবাদ রাখা হয়। ১৬৭৮ সালে শায়েস্তা খান পদত্যাগ করে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করেন।
৪. ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষ : শায়েস্তা খান সুবাদারির শেষভাগে ইংরেজদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। ইংরেজ বণিকরা কোন বাণিজ্য শুল্ক দিত না। ফলে মুঘল সরকার ন্যায্য বাণিজ্য শুল্ক থেকে বঞ্চিত হন। ইংরেজদের এ ধরনের একচেটিয়া সুবিধার ফলে দেশীয় বণিকদের অসুবিধা হয়েছিল। কারণ, ইংরেজদের কোন শুল্ক দিতে হতো না বলে দেশীয় বণিকরা তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারত না। সম্রাট আওরঙ্গজেব এটা উপলব্ধি করে আবার বাণিজ্য সুবিধা বাতিল করে তাদের পণ্য দ্রব্যের উপর শতকরা ৩ টাকা শুল্ক ধার্য করেন। ইংরেজ বণিকদের প্রতি এ ধরনের শুল্ক ধার্যের ফলে ইংরেজরা ক্ষুব্ধ হন। এছাড়া বিভিন্নভাবে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এদিকে শুল্ক বিভাগের কর্মচারীরা ইংরেজ বণিকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত শুল্ক আদায় এবং তাদের পণ্য দ্রব্যাদি বাজেয়াপ্ত করতে থাকেন। ফলে কোম্পানির বাণিজ্যের ক্ষতি হয়। এ অবস্থার অবসানকল্পে ইংরেজ কুঠির প্রধান কর্মকর্তা উইলিয়াম হেজ শায়েস্তা খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু আলাপ আলোচনায় কোন লাভ হল না। শায়েস্তা খানের সাথে একপর্যায়ে যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইংরেজরা বাংলা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
৫. শাসনক্ষেত্রে অবদান : শায়েস্তা খান বৃদ্ধ বয়সে দেশের শাসনভার গ্রহণ করলেও শাসনকার্যে তাঁর দক্ষতা ও কল্যাণকামিতা বাংলার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সাহসিকতার সাথে মগ-ফিরিঙ্গি দস্যুদের দমন করে তিনি যেমন জনজীবনে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনেন তেমনি কঠোর হস্তে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠা করেন। শাসক হিসেবে তিনি উদার ও ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। ঐতিহাসিক স্টুয়ার্ট তাঁর শাসন দক্ষতার প্রশংসা করে তাঁকে উদার, ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাহিতৈষী বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তাঁর শাসন আমল গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রবাদ আছে যে, তাঁর শাসনামলে টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। এ প্রবাদ দেশে কৃষি অগ্রগতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিচয় বহন করেছিল। শিল্পকলার ক্ষেত্রে শায়েস্তা খান উদার মনোভাবের প্রমাণ দেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় বড়কাটরা, ছোটকাটরা, পরিবিবির মাজার, হোসনী দালান ইত্যাদি নির্মিত হয়। ঢাকার লালবাগের কেল্লা এখনও শায়েস্তা খানের - অমর শিল্পকীর্তির পরিচয় বহন। তাঁর রাজপ্রাসাদের নির্মাণশৈলী, চারুকার্য ও স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ছিল অতুলনীয়। অনেক ঐতিহাসিক শায়েস্তা খানের শাসনব্যস্থার ভূয়সী প্রশংসা করেন। অনেকে শায়েস্তা খানের সুবাদারিকেই মুঘল শাসনের স্বর্ণযুগ বলে বর্ণনা করেছেন।
শায়েস্তা খান ন্যায়পরায়ণ প্রজাহিতৈষী, দানশীল, আরামপ্রিয় শাসক ছিলেন। তিনি গরিব দুঃখীদের মধ্যে প্রাত্যহিক খাবার ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বিতরণ করেন। তিনি এ কার্যগুলো তত্ত্বাবধানের জন্য কর্মচারীও নিয়োগ করেন। তিনি বিলাসবহুল জীবনযাপন পছন্দ করতেন। তবে কোন কার্যই তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির ত্রুটি ঘটাতে পারে নি । মূল্যায়ন : শাসক হিসেবে বিভিন্ন মানবিক গুণে বিভূষিত শায়েস্তা খান যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিলেও সমালোচনার ঊর্ধ্বে ছিলেন না। ইংরেজ কর্মচারীরা তাঁকে অর্থলোভী হিসেবে এবং ইংরেজ জনসাধারণ তাঁকে মানব জাতির নিগ্রহকারী বলে বর্ণনা করেছেন। তবে শায়েস্তা খান সম্পর্কে মানব জাতির নিগ্রহকারী বলে যে অবজ্ঞা করা হয়েছে তা ঠিক নয়। কারণ, মানুষি তাঁকে জনগণের শ্রদ্ধা ও ভালবাসার পাত্র বলে বর্ণনা করেছেন।
উপসংহার : আলোচনার শেষান্তে বলা যায়, সুবাদার শায়েস্তা খানের সুদীর্ঘ ২২ বছরের সুবাদারি আমল বাংলার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কারণ, মুঘলদের যে বিশ্বাস তাঁর উপর ছিল তিনি তা রক্ষা করতে সক্ষম হন। তিনি বিদ্রোহ দমন থেকে শুরু করে উদার ও জনকল্যাণকামী শাসক হিসেবে যোগ্যতার প্রমাণ দেন। তিনি কোম্পানির শাসনব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ ও মুঘল শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে অবদান রেখে যোগ্যতার প্রমাণ দেন। এছাড়া মুঘল শাসনামলের সুবাদারদের মধ্যে তুলনামূলক তিনি যথেষ্ট যোগ্যতর ছিলেন। তাঁর উপরিউক্ত কার্যকলাপ যোগ্যতার পরিচায়ক।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]