নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সাথে কোম্পানির বিরোধের কারণ কি ছিল? পলাশীর যুদ্ধ কি অবশ্যম্ভাবী ছিল? উত্তরা

ভূমিকা : ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে মহারানীর অনুমতি নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য উদ্দেশ্যে আগমন করেন। এ বাণিজ্য প্রতিনিধি দল বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আগমন করলেও তাদের আশা-আকাঙ্খায় বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। তাই তারা অবস্থায় পরিবর্তনে বাংলার শাসনক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। ফলে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সাথে ইংরেজদের সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। এ সংঘর্ষে ইংরেজরা লাভবান হন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নবাবের বিরোধের কারণ : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। ভারতবর্ষের সাথে বাণিজ্য করাই তাদের উদ্দেশ্য হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যের পাশাপাশি শাসনক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার ফলে নবাবের সাথে বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। নিম্নে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হল :
১. রাজনৈতিক কারণ ঃ নবাব আলীবর্দী খান ইংরেজ ও ফরাসিদেরকে যদিও বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছিলেন, তথাপি তিনি তাদের এ দেশে দুর্গ নির্মাণ ও যুদ্ধ করার জন্য নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু দেখা গেল নবাবের মৃত্যুর পর ইংরেজ ও ফরাসিগণ চন্দন নগরে দুর্গ নির্মাণ আরম্ভ করলে নবাব সিরাজ উদ-দৌলা তাদের এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নির্দেশ করেন। ফরাসিরা এ আদেশ মানলেও ইংরেজগণ এ আদেশ মানেন নি। এ পরিস্থিতিতে নবাব সিরাজ উদ- দৌলা তাদের উপর ক্রুদ্ধ হন।
২. অর্থনৈতিক কারণ : ইংরেজরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যেসব বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল তারা এ সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করতে থাকে। ফলে নবাব তাদের উপর বিদ্বেষী ভাব পোষণ করতে থাকেন।
৩. অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র নবাব আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান না থাকায় আমির ওমরাগণ পরবর্তী নবাব নিয়োগের জন্য গোপনে যড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের ইচ্ছা ছিল বৃদ্ধ নবাবের মৃত্যু হলে মীরজাফর সিংহাসনে বসবে। তাদের এ মনোবাসনা পরবর্তীতে ষড়যন্ত্রের রূপ ধারণ করেছিল।
৪. ঘসেটি বেগম ও শওকত জন এর ষড়যন্ত্র । আলীবর্দী খানের মৃত্যু হলে তাঁর মনোনয়নক্রমে সিরাজ উদ-দৌলা বাংলার নবাবি লাভ করেন। আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা তাৎকালীন ঢাকায় বসবাসরত বিধবা ঘসেটি বেগম এবং পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা নবাবের পতন ঘটানোর জন্য অসন্তোষ সৃষ্টি করেন এবং ষড়যন্ত্র করতে থাকেন ।
C. ইংরেজগণ কর্তৃক রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণ দাসকে আশ্রয় দান । ইংরেজরা নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিদ্রোহী কর্মচারী কৃষ্ণ দাসকে প্রচুর ধনরত্নের বিনিময়ে আশ্রয় দিলে নবাব তাকে ইংরেজদের কাছ থেকে ফেরত চাইলে ইংরেজরা অস্বীকৃতি জানায় ফলে ইংরেজরা নবাবের বিরাগভাজন হালেন। ৬. ইংরেজগণ কর্তৃক কলকাতা পুনঃদখল : নবাব কর্তৃক কলকাতা জয়ের খবর মাদ্রাজে পৌঁছালে রবার্ট ক্লাইভ ও নৌ-সেনাপতি ওয়াটসন কলকাতা রওয়ানা হন। ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্লাইভ আবার খুব সহজে কলকাতা পুনঃদখল করে ফেলেন। নবাব তাদের দমন করার জন্য আবার সৈন্য পাঠান। কিন্তু নবাব দেখতে পেলেন চারদিকে শুধু ষড়যন্ত্র, তাই তিনি সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। আর এ সন্ধিটি 'আলী নগর' সন্ধি নামে পরিচিত।
৭. ইংরেজ কর্তৃক শওকতজঙ্গের পক্ষাবলম্বন : পুনিয়ার শাসনকর্তার পুত্র শওকত জঙ্গ নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন এবং নবাবের সিংহাসনচ্যুতি কামনা করতে থাকলে ইংরেজরা তার প্রতিপক্ষ হিসেবে শওকত জঙ্গকে সমর্থন করতে থাকে। ফলে নবাব ইংরেজদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। ৮. সিরাজের প্রতি ইংরেজদের বৈরী মনোভাব : ইংরেজরা নবাবের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে বাণিজ্য কুঠির নির্মাণ করতে থাকে এবং নানারূপ অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করে। এমনি ইংরেজ বাহিনী নবাবের প্রতি কোনরূপ সৌজন্যমূলক আচরণ করে নি এবং কোন প্রকার উপঢৌকন পাঠায় নি, তারা নবাবের আনুগত্য অস্বীকার করেন।
৯. নবাবের আদেশ অমান্য করা : নবাব ইংরেজ ও ফরাসি বাহিনী কে অবৈধভাবে দুর্গ নির্মাণ না করার জন্য নির্দেশ দেন। নবাবের এ আদেশ ফরাসিরা মান্য করে, কিন্তু ইংরেজরা এ আদেশ মান্য করে নি। ইংরেজরা নবাবের দূতকে অপমান করে। এসব দিক অনুধাবন করে নবাব ইংরেজদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করেন।
১০. নবাবের অদূরদর্শিতা : বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করে নবাব বিচক্ষণতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের পরিবর্তে উদারতা ও বিশ্বস্ততা বেশি প্রদর্শন করেন। 'তাঁর এ উদারতা ও বিশ্বস্ততার সুযোগ নিয়ে বিরুদ্ধপক্ষ তাকে পদচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু সরল বিশ্বাসী নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের কঠোর হস্তে দমন করার কোন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ না নেওয়ায় শত্রুপক্ষ শক্তিশালী হতে থাকে।
১১. কলকাতা অধিকার : নবাব সিরাজ উদ-দৌলা ইংরেজদের শাস্তি দেওয়ার জন্য হঠাৎ আক্রমণ পরিচালনা করলে ইংরেজ গভর্নর ও তার অনুচরেরা ভয় পেয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পরিত্যাগ করে ফলতা নামক স্থানে আশ্রয় নেন। নবাব ১৭৫৬ সালের ২০ জুন কলকাতা জয় করে তার নাম দেন আলীনগর ।
১২. কাল্পনিক কাহিনী : ফোর্ট উইলিয়াম দখলকে কেন্দ্র করে ইংরেজ চিকিৎসক হলওয়েল নবাবের বিরুদ্ধে অন্ধকূপ হত্যা নামক এক বীভৎস কাল্পনিক কাহিনী সৃষ্টি করেন। নবাবের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার জন্যই হলওয়েল এ কাহিনী রচনা করেন। কাহিনীতে আছে ১৪৬ জন ইংরেজ বন্দিকে ১৮ ফুট লম্বা ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রশস্থ একটি ঘরে রাখা হলে তাদের মধ্যে ১২৩ জন বন্দি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। ইতিহাসে এটা অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। এটা অসম্ভব ছিল। কারণ ১৪৬ জনকে এমন ক্ষুদ্র কক্ষে রাখা যায় না। ঐতিহাসিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয় যে, হলওয়েল যে বর্ণনা দিয়েছেন তার কোন সত্যতা নেই। এটি একটি কাল্পনিক কাহিনী ।
নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা : এভাবে ইংরেজরা চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সিরাজের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। ষড়যন্ত্র যখন পরিপক্ক, তখন ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে সন্ধিভঙ্গের মিথ্যা অভিযোগ তুলে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন এবং সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁর সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজারের কিছু বেশি। নবাব ইংরেজদের আক্রমণের খবর পেলে ৫০ হাজার পদাতিক ও ২৮ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ইংরেজদের মোক। বলা করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হলে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে ভাগীরথী নদীর তীরে উভয়ের মধ্যে এক যুদ্ধ : ংঘটিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মীরজাফর ও রায়দুর্লভের ষড়যন্ত্রে ও বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের বিরাট বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে। মোহন লাল ও মীরমদন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। হতভাগ্য সিরাজ ধৃত হয়ে মীরজাফরের পুত্র মীরনের আদেশে মোহম্মদী বেগের হাতে নিহত হন।
পলাশীর যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবিতা :
ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬০০ সালে মহারানী সনদ নিয়ে ভারতবর্ষে আসলেও ১৬৩১-৩২ সালে বাংলায় কোম্পানির ব্যবসায় বাণিজ্যের সূত্রপাত হয়। ১৬৫০ সালে ইংরেজরা নবাবের নিকট থেকে বাংলায় বাণিজ্য করার সনদ পায়। ১৬৬৮ সালে শাহ সুজা কোম্পানিকে বার্ষিক তিন হাজার টাকার বিনিময়ে বিনা শুল্কে বাংলায় বাণিজ্য করার অধিকার দেন। ১৭১৭ সালে ইংরেজগণ ফররুখ শিয়ারের নিকট থেকে বাংলায় অবাধ বাণিজ্য করার ফরমান লাভ করে। কিন্তু নবাব মুর্শিদকুলী খান দস্তকের ব্যাপারে আপত্তি তুললে কোম্পানির বাণিজ্য কিছুটা ব্যাহত হয়। নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে তারা স্বাধীনভাবেই ব্যবসায় বাণিজ্য করতে থাকে। তবে ইংরেজগণ যাতে বাংলার রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতেন। নবাব আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজ উদ-দৌলা সিংহাসনে আরোহণ করলে তারা প্রথানুযায়ী উপঢৌকন না পাঠিয়ে নবাবের বিরুদ্ধে হয়। এ সময় ইউরোপে সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগণ বাংলায় দুর্গ নির্মাণ শুরু করে। সিরাজ উদ-দৌলা তাদেরকে নিরস্ত্র হতে আদেশ দেন। উদ্ধত ইংরেজ বণিকগণ সিরাজের আদেশকে উপেক্ষা করে চলে। তারা এদেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ঘসেটি বেগম, রাজবল্লত, শওকত জঙ্গ, মীরজাফরের সাথে ষড়যন্ত্রে শরিক হয়ে নবাবকে পদচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইংরেজগণ কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় আশ্রয় প্রদান করলে নবাব তাকে ফেরত চেয়ে দূত পাঠান। ইংরেজগণ কৃষ্ণদাসকে ফেরত দেয় নি, বরং নবাবের দূতকে অপমান করে। ফলে নবাব ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের কারিন বাজার কুঠি এবং কলকাতার ফোর্ট ইউলিয়াম দুর্গ দখল করেন। নবাব মুর্শিদাবাদে ফিরে আসলে ইংরেজগণ পুনরায় কলকাতা দখল করে নেয় এবং হুগলিতে লুণ্ঠন চালায়। নবাব পুনরায় ইংরেজদের শায়েস্তা করার জন্য কলকাতার উপকণ্ঠে শিবির স্থাপন করলে ইংরেজগণ রাতের বেলায় অতর্কিতে নবাবের শিবিরে আক্রমণ করে ১৩০০ লোককে হত্যা করে। এতে নবাব দুর্বল হয়ে পড়েন এবং ইংরেজদের সাথে আলীনগরের সন্ধি নামে একটি কালো সন্ধি সম্পাদন করে মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন। এতে ইংরেজগণ নবাবের দুর্বলতা ভেবে তাঁকে পদচ্যুত করার জন্য সসৈন্যে অগ্রসর হয়। নবাবও ষড়যন্ত্রের কথা জেনে ইংরেজদের মোকাবিলার প্রস্তুতি নেন। ফলে পলাশীর যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। তাই ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় নবাব সিরাজ উদ- দ্দৌলা পরাজিত হন এবং বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সাথে ইংরেজদের সংঘর্ষের জন্য ইংরেজদের দূরদর্শিতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাই দায়ী ছিল। তবে সমকালিন সময়ে নবাব তথা বাংলার শাসনক্ষেত্রে যে দুর্বলতা ছিল এটা ইংরেজদের জন্য অনেকটা সহায়ক হয়েছিল। এ ধরনের অবস্থালগ্নে ইংরেজরা নিজ শক্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার সকল আয়োজন পাকাপোক্ত করেন। ফলে বাংলার ইতিহাসে সমাধি রচিত হয় এক ঐতিহ্যময় অধ্যায়ের এবং যাত্রা সূচিত হয় নতুন অধ্যায়ের।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]