পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। এ যুদ্ধে সিরাজ উদ-দৌলার পরাজয়ের কারণ কি ছিল? নবাব সিরাজ কি এ যুদ্ধে পরাজয়ের জন্য দায়ী?

ভূমিকা ঃ ১৭৫৭ সালে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। কারণ এ যুদ্ধের মাধ্যমেই বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। শুরু হয় ইংরেজ বেনিয়াদের আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের দুঃশাসন। হতভাগ্য নবাব সিরাজ উদ-দৌলার পতনের মাধ্যমে আমরা হারাই আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব, হারাই কথা বলার অধিকার। তাই ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশীর যুদ্ধ এক তাৎপর্যময় ঘটনা । পলাশীর যুদ্ধের কারণসমূহ : পলাশীর যুদ্ধ সংঘটনের পিছনে কতকগুলো কারণ পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. রাজনৈতিক কারণ : নবাব আলীবর্দী খান ইংরেজ ও ফরাসিদেরকে যদিও বাণিজ্য করার অনুমতি দিয়েছিলেন, তথাপি তিনি তাদের এ দেশে দুর্গ নির্মাণ ও যুদ্ধ করার জন্য নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু দেখা গেল নবাবের মৃত্যুর পর ইংরেজ ও ফরাসিগণ চন্দন নগরে দুর্গ নির্মাণ আরম্ভ করলে নবাব সিরাজ উদ-দৌলা তাদের এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নিষেধ করেন। ফরাসিরা এ আদেশ মানলেও ইংরেজগণ এ আদেশ মানেন নি। এ পরিস্থিতিতে নবাব সিরাজ উদ- দৌলা তাদের উপর ক্রুব্ধ হন।
২. অর্থনৈতিক কারণ : ইংরেজরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যেসব বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা পেয়েছিল তারা এ সুযোগ সুবিধার অপব্যবহার করতে থাকে। ফলে নবাব তাদের উপর বিদ্বেষী ভাব পোষণ করতে থাকেন।
৩. অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র : নবাব আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান না থাকায় আমির ওমরাগণ পরবর্তী নবাব নিয়োগের জন্য গোপনে যড়যন্ত্র করতে থাকে। তাদের ইচ্ছা ছিল বৃদ্ধ নবাবের মৃত্যু হলে মীরজাফর সিংহাসনে বসবে। তাদের এ মনোবাসনা পরবর্তীতে যড়যন্ত্রের রূপ ধারণ করেছিল।
৪. ঘসেটি বেগম ও শওকত জঙ্গ এর ষড়যন্ত্র ঃ আলীবর্দী খানের মৃত্যু হলে তাঁর মনোনয়নক্রমে সিরাজ উদ-দৌলা বাংলার নবাবি লাভ করেন। আলীবর্দী খানের জ্যেষ্ঠ কন্যা তৎকালীন ঢাকায় বসবাসরত বিধবা ঘসেটি বেগম এবং পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ ইংরেজদের সাথে ঘড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। তারা নবাবের পতন ঘটানোর জন্য অসন্তোষ সৃষ্টি করেন এবং ষড়যন্ত্র করতে থাকেন ।
৫. ইংরেজগণ কর্তৃক রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণ দাসকে আশ্রয় দান : ইংরেজরা নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিদ্রোহী কর্মচারী কৃষ্ণ দাসকে প্রচুর ধনরত্নের বিনিময়ে আশ্রয় দিলে নবাব তাকে ইংরেজদের কাছ থেকে ফেরত চাইলে ইংরেজরা অস্বীকৃতি জানায় ফলে ইংরেজরা নবাবের বিরাগভাজন হলেন
৬. ইংরেজগণ কর্তৃক কলকাতা পুনঃদখল : নবাব কর্তৃক কলকাতা জয়ের খবর মাদ্রাজে পৌঁছালে রবার্ট ক্লাইভ ও নৌ-সেনাপতি ওয়াটসন কলকাতা রওয়ানা হন। ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে ক্লাইভ আবার খুব সহজে কলকাতা পুনঃদখল করে ফেলেন। নবাব তাদের দমন করার জন্য আবার সৈন্য পাঠান। কিন্তু নবাব দেখতে পেলেন চারদিকে শুধু ষড়যন্ত্র; তাই তিনি সন্ধির প্রস্তাব পাঠান। আর এ সন্ধিটি 'আলী নগর' সন্ধি নামে পরিচিত ।
৭. ইংরেজ কর্তৃক শওকতজনের পক্ষাবলম্বন : পুনিয়ার শাসনকর্তার পুত্র শওকত জঙ্গ নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন এবং নবাবের সিংহাসনচ্যুতি কামনা করতে থাকলে ইংরেজরা তার প্রতিপক্ষ হিসেবে শওকত জঙ্গকে সমর্থন করতে থাকে। ফলে নবাব ইংরেজদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। ৮. সিরাজের প্রতি ইংরেজদের বৈরী মনোভাব : ইংরেজরা নবাবের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে বাণিজ্য কুঠির নির্মাণ করতে থাকে এবং নানারূপ অস্ত্র সজ্জায় সজ্জিত করে। এমনি ইংরেজ বাহিনী নবাবের প্রতি কোনরূপ সৌজন্যমূলক আচরণ করে নি এবং কোন প্রকার উপঢৌকন পাঠায় নি, তারা নবাবের আনুগত্য অস্বীকার করেন।
৯. নবাবের আদেশ অমান্য করা : নবাব ইংরেজ ও ফরাসি বাহিনীকে অবৈধভাবে দুর্গ নির্মাণ না করার জন্য নির্দেশ দেন। নবাবের এ আদেশ ফরাসিরা মান্য করে, কিন্তু ইংরেজরা এ আদেশ মান্য করে নি। ইংরেজরা নবাবের দূতকে অপমান করে। এসব দিক অনুধাবন করে নবাব ইংরেজদের সমুচিত শাস্তি দেওয়ার জন্য ৫০ হাজার সৈন্য নিয়ে কলকাতা আক্রমণ করেন।
১০. নবাবের অদূরদর্শিতা : বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করে নবাব বিচক্ষণতা ও দক্ষতা প্রদর্শনের পরিবর্তে উদারতা ও বিশ্বস্ততা বেশি প্রদর্শন করেন। তাঁর এ উদারতা ও বিশ্বস্ততার সুযোগ নিয়ে বিরুদ্ধপক্ষ তাকে পদচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিন্তু সরল বিশ্বাসী নবাব ষড়যন্ত্রকারীদের কঠোর হস্তে দমন করা
র কোন বলিষ্ঠ পদক্ষেপ না নেওয়ায় শত্রুপক্ষ শক্তিশালী হতে থাকে । ১১. কলকাতা অধিকার : নবাব সিরাজ উদ-দৌলা ইংরেজদের শাস্তি দেওয়ার জন্য হঠাৎ আক্রমণ পরিচালনা করলে ইংরেজ গভর্নর ও তার অনুচরেরা ভয় পেয়ে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পরিত্যাগ করে ফলতা নামক স্থানে আশ্রয় নেন। নবাব ১৭৫৬ সালের ২০ জুন কলকাতা জয় করে তার নাম দেন আলীনগর।
১২. কাল্পনিক কাহিনী : ফোর্ট উইলিয়াম দখলকে কেন্দ্র করে ইংরেজ চিকিৎসক হলওয়েল নবাবের বিরুদ্ধে অন্ধকূপ হত্যা নামক এক বীভৎস কাল্পনিক কাহিনী সৃষ্টি করেন। নবাবের চরিত্রকে কলঙ্কিত করার জন্যই হলওয়েল এ কাহিনী রচনা করেন। কাহিনীতে আছে ১৪৬ জন ইংরেজ বন্দিকে ১৮ ফুট লম্বা ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রশস্থ একটি ঘরে রাখা হলে তাদের মধ্যে ১২৩ জন বন্দি শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। ইতিহাসে এটা অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। এটা অসম্ভব ছিল। কারণ ১৪৬ জনকে এমন ক্ষুদ্র কক্ষে রাখা যায় না। ঐতিহাসিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয় যে, হলওয়েল যে বর্ণনা দিয়েছেন তার কোন সত্যতা নেই। এটি একটি কাল্পনিক কাহিনী ।
পলাশীর যুদ্ধের ঘটনা : এভাবে ইংরেজরা চারদিকে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে সিরাজের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হতে লাগল । ষড়যন্ত্র যখন পরিপক্ক, তখন ক্লাইভ নবাবের বিরুদ্ধে সন্ধিভঙ্গের মিথ্যা অভিযোগ তুলে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন এবং সসৈন্যে মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হলেন। তাঁর সৈন্য সংখ্যা ছিল তিন হাজারের কিছু বেশি। নবাব ইংরেজদের আক্রমণের খবর পেলে ৫০ হাজার পদাতিক ও ২৮ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে ইংরেজদের মোকাবিলা করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হলে ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে ভাগীরথী নদীর তীরে উভয়ের মধ্যে এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মীরজাফর ও রায়দুর্লভের ষড়যন্ত্রে ও বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের বিরাট বাহিনী শোচনীয়ভাবে পরাজয়বরণ করে। মোহন লাল ও মীরমদন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। হতভাগ্য সিরাজ ধৃত হয়ে মীরজাফরের পুত্র মীরনের আদেশে মোহম্মদী বেগের হাতে নিহত হন।
পলাশীর যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব : পলাশীর যুদ্ধকে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধসমূহের অন্যতম বলা যেতে পারে। এটা ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্য বিবর্তনের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান ঘটনা, এ যুদ্ধের পরিণাম ছিল সুদূরপ্রসারী। এ প্রসঙ্গে আর.সি. মজুমদার বলেছেন, "The Battle of Palassey paned the way for British Conquest for Bengal and eventually the whole of India." নিম্নে এর ফলাফল আলোচনা করা হল :
ক. রাজনৈতিক ফলাফল : এ যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল নিম্নরূপ ঃ পলাশীর যুদ্ধের ফলে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। পলাশীর যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা কোম্পানির মর্যাদা লাভ করে। পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা এ দেশের ত্রাণকর্তা সেজে বসে। নবাবের ক্ষমতাপ্রাপ্তি কিংবা বিচ্যুতি তাদের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করতে থাকে।
৪. বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিদানস্বরূপ মীরজাফর নবাবি লাভ করে। কিন্তু ক্ষমতার কলকাঠি ক্লাইভের হাতেই থেকে যায় । ৫. স্বাধীনতা হারানোর পর এ দেশবাসী হারাল তাদের নাগরিক অধিকার, হারাল কথা বলার অধিকার।
খ. সম্প্রদায়গত ফলাফল : পলাশী যুদ্ধের সম্প্রদায়গত ফলাফল ছিল নিম্নরূপ : ভারতীয় মুসলমানগণ এতদিন প্রচণ্ড প্রতাপে নিজেদের মর্যাদাকে সমুন্নত রেখেছে। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর তাদের আধিপত্য ও প্রাধান্য শূন্যের কোটায় গিয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজরা ক্ষমতায় বসায় হিন্দুরা তাদের সমর্থন দানের প্রতিদানস্বরূপ নানারকম সুযোগ সুবিধা পেয়ে নিজেদের ভাগ্যের উন্নতি সাধন করে ।
গ. অর্থনৈতিক ফলাফল : অর্থনৈতিক ফলাফল নিম্নরূপ : মীরজাফরের সাথে চুক্তি মোতাবেক পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজরা প্রচুর অর্থ সম্পত্তির অধিকারী হয়। তাদের ব্যবসায় বাণিজ্য তখন সরগরমভাবে চলতে থাকে। এর ফলে এদের অর্থনৈতিক ভিত্তি সবল হতে থাকে । যেহেতু মুসলমানরা ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধপক্ষ, তাই পলাশীর যুদ্ধের পর তারা ইংরেজদের রোষানলে পড়ে। এতে করে তাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি নাজুক হয়ে পড়ে ।
ঘ. ইঙ্গ-ফরাসি সংঘাতের উপর প্রভাব : পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের জয়লাভের পর দাক্ষিণাত্য ইঙ্গ-ফরাসি সংঘাতের গতিপথে বিপুল প্রভাব বিস্তার করে। এর ফলে বঙ্গদেশের সম্পদ, জনবল ও অর্থবল সবই ইংরেজদের হাতে চলে যায়। কর্ণাটের যুদ্ধে এসব সম্পদ ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এভাবে কর্ণাটের তৃতীয় যুদ্ধে বঙ্গের সম্পদের বলে ইংরেজরা দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের পরাজিত করে।
ঙ. ভারতীয় উপমহাদেশে বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে : পলাশীর যুদ্ধ বঙ্গদেশে এবং পরে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজরা বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে ।
চ. শিক্ষার পরিবর্তন ঃ পলাশীর যুদ্ধের পর দেশে মুঘল ও ভারতীয় শিক্ষা সভ্যতার স্থানে ইউরোপীয় সভ্যতা আরপ্রকাশ করতে থাকে। কালক্রমে বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিপদের মধ্যে আবদ্ধ হতে থাকে। সিরাজ উদ-দৌলার পরাজয় বা কোম্পানির জয়লাভের কারণ : পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ- দৌলার পরাজয় বা কোম্পানির সাফল্যের জন্য একাধিক কারণ দায়ী ছিল। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল ঃ
১. মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা : পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ-দৌলার পরাজয়ের জন্য সিপাহসালার মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতাই প্রধানত দায়ী। কারণ তিনি কুরআন হাতে নিয়ে শপথ করলেও নিজ স্বার্থে বিশ্বাসঘাতকতা করেন ।
২. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উচ্চাকাঙ্ক্ষা : ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে বা বাংলায় বাণিজ্য করার সুবাদে দীর্ঘদিন অবস্থান করেন। এ অবস্থান করার কারণে তারা বাংলার শাসনক্ষেত্রে যে দুর্বলতা ছিল তা উপলব্ধি করে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েন এবং সে মোতাবেক অগ্রসর হন এবং সফল হন।
৩. ক্লাইভের চতুরতা : পলাশীর যুদ্ধ তথা নবাব সিরাজের সাথে যুদ্ধে যে ব্যক্তি বেশি লাভবান হন তিনি হলেন রবার্ট ক্লাইভ। তিনি ছিলেন কোম্পানির পক্ষে এ ঘটনার মূল নায়ক। পলাশীর যুদ্ধে তার স্বার্থপরতা ও কূটকৌশলের বাস্ত ব প্রয়োগ হয়েছিল। তার কূটকৌশলের কাছে নবীন নবাব সিরাজ কুলিয়ে উঠতে পারেন নি।
৪. নবাব সিরাজ উদ-দৌলার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব ঃ নবাব সিরাজের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার কারণ তিনি সমকালীন কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্রের পরিবেশ উপলব্ধি করতে পারেন নি। তাই তাকে এ খেসারত দিতে হয়।
৫. নবাব সিরাজের অতিরিক্ত স্বদেশপ্রীতি : নবাব সিরাজের কাছে বাংলার মাটি ও বাংলার মানুষ ছিল প্রিয় বস্তু । তিনি সবকিছুতে ছাড় দিতে রাজি ছিলেন কিন্তু বাংলার স্বাধীনতার জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। বাংলাকে এত ভালোবেসেছিলেন যে, তাঁর কাছে কোন ষড়যন্ত্রের কথাই নিজ বিশ্বাসকে আঘাত করতে পারে নি। এ অতিরিক্ত স্বদেশপ্রীতির খেসারত হল তার পরাজয়।
৬. অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা : নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সিংহাসন লাভ করার প্রাক্কালে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা ভালো ছিল না। তাই কারণে অকারণে তাকে অমাত্য ও জগৎশেঠের মত বিত্তশালীদের দারস্থ হতে হতো। অর্থনৈতিক দুর্বলতাও তার পতনের জন্য দায়ী। কারণ নবাব যদিও জগৎশেঠের চক্রান্ত বুঝতে পারেন কিন্তু করার কিছুই ছিল না।
৭. সিরাজের সামরিক শক্তির মধ্যে ঐক্যের অভাব সিরাজ উদ-দৌলার সামরিক বাহিনীর মধ্যে ঐক্যবোধের একান্ত অভাব ছিল। আর এজন্য বিশাল সৈন্যবাহিনী পলাশীর প্রান্তরে কেবল পরাজিত হয় নি, অযথা জীবন দেন। নবাবের সৈন্য বাহিনীতে যদি মীরমদন ও মোহনলালের ন্যায় সুদক্ষ সেনাপতিত্বের প্রতিফলন না ঘটত তাহলে হয়তবা বাংলার ইতিহাস অন্য খাতে প্রবাহিত হতো না।
৮. ষড়যন্ত্রের পরিবেশ : নবাব সিরাজের পতনের জন্য বাংলার সমকালীন পরিবেশও দায়ী ছিল। বাংলায় সে সময় একদিকে কোম্পানি, অন্যদিকে নবাবের নিজ আত্মীয়স্বজনরা যেভাবে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় তার ফলাফল হল এ ইতিহাস। এ ষড়যন্ত্রের পরিবেশে নবাব সিরাজ কেন, যে কোন শাসকই পরাজয় বরণ করতে বাধ্য ।
৯. নবাব সিরাজ কর্তৃক আকস্মিক যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ : পলাশীর প্রান্তরে যখন ইংরেজ ও নবাব সিরাজের বাহিনী মুখোমুখি অবস্থান নেয়, তখন নবাবের পরাজিত হওয়ার কোন পরিবেশ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ নবাব সিরাজ যড়যন্ত্রকে আঁচ করতে না পেরে যুদ্ধ বন্ধের যে নির্দেশ দেন তা পরাজয় ডেকে আনে। কারণ যেভাবে যুদ্ধ চলছিল তা সকল ষড়যন্ত্রকে উপেক্ষা করে নবাবের পক্ষে সহায়ক ছিল। কিন্তু নবাব আকস্মিক যে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন তা বাংলার জন্য বিরাট ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়ায়।
১০. নবাবের সিদ্ধান্তহীনতা : নবাব সিরাজের সিদ্ধান্তহীনতা পলাশীর পরাজয়ের জন্য বেশি দায়ী। তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করা থেকে পতন পর্যন্ত প্রতি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন। তিনি সিদ্ধান্তহীনতার জন্য মীরজাফরকে পদচ্যুত করতে পারেন নি। যুদ্ধক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের পরিবেশ বিরাজমান ছিল তা উপলব্ধি করেও যুদ্ধ বন্ধে ভুল সিদ্ধান্ত দেন। তাই তাঁর ভুল সিদ্ধান্তই পতনের জন্য দায়ী।
১১. জনসাধারণের নির্লিপ্ততা : পলাশীর যুদ্ধ ছিল জনসাধারণের সমর্থন ও সহযোগিতাহীন সেনাবাহিনী ও বেনিয়াদের মধ্যে প্রতিযোগিতার সমতুল্য। কারণ এ যুদ্ধে জনসাধারণ বুঝতে পারে নি কি হচ্ছে। তাই পলাশীর পরাজয়ের পরও দীর্ঘকাল বাংলার জনগণ বুঝতে পারে নি যে, এখন বাংলার নবাব, ইংরেজরা না অন্য কেউ ।
পতনের জন্য সিরাজ কতটুকু দায়ী : পলাশীর পতনের জন্য নবাব সিরাজ উদ-দৌলা অনেক ক্ষেত্রে দায়ী ছিলেন। কারণ বাংলার নবাব হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তিনি বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করতে কখনও চেষ্টা করেন নি, চেষ্টা করেন নি কোথায় কি হচ্ছে। সমকালীন ষড়যন্ত্রের পরিবেশে বাংলার অস্তিত্বকে টিকে রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল সুদক্ষ রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ও সমরকৌশলীর। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমিক কিন্তু কূটকৌশলে অজ্ঞ। তাই ষড়যন্ত্রের পরিবেশ হয়ত বা উপলব্ধি করেছিলেন কিন্তু সমাধান টানতে পারেন নি। তিনি যে বয়সে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন তা বাংলার জন্য যথোপযুক্ত ছিল না। কারণ যেখানে বাংলার অস্তিত্ব বিলীন করার ষড়যন্ত্রে জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ ও রাজবল্লভের ন্যায় কূটকৌশল জড়িত, সেখানে নবাবের কোন স্থান ছিল না। তাই পলাশীর যুদ্ধে বাংলার ইতিহাসের অধ্যায়ের পরিবর্তনে যদিও নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে এককভাবে দায়ী করা সমীচীন হবে না, তথাপিও নবাব যে দায়ী তা বলা যায়। কারণ তাঁর ব্যর্থতাই ছিল বেশি, যদিও অন্যান্য ঘটনা ও পরিবেশ দায়ী ছিল।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, পলাশীর যুদ্ধ হঠাৎ করে একক কোন কারণে সংঘটিত হয় নি। এটি ছিল কোম্পানির দীর্ঘদিন বাণিজ্য করার অভিজ্ঞতার সুবাদে সৃষ্ট উচ্চাঙ্খার বাস্তব প্রয়োগ। তবে এজন্য সমকালিন বাংলার রাজনৈতিক আবহাওয়া ও নবাবি শাসনের দুর্বলতাও দায়ী ছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]