“১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভারতবর্ষে মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূচনা”- তুমি কি এ মতকে সমর্থন কর?

ভূমিকা : মানবজাতির ক্রমবিকাশের ধারাই ইতিহাস। এ ক্রমবিকাশের ধারা সর্বদা একই গতি বা বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে চলে নি। কোন কোন ক্ষেত্রে মানবজাতি এত দ্রুত অগ্রসর হয়েছে যে, তা পূর্ববর্তী যুগ হতে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যার জন্যে ইতিহাসকে প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক এ তিন পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।
আধুনিক যুগ : মধ্যযুগের অবসানের পর থেকে শুরু হয় আধুনিক যুগের। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সাধারণত আধুনিক যুগের সূচনা হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনের পলাশীর যুদ্ধ এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পলাশীর যুদ্ধ ঃ নবাব আলীবর্দী খানের ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল মৃত্যু হলে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজ উদ-দৌলা বাংলার সিংহাসনে বসেন। কিন্তু তিনি বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেন নি । তিনি এক বছরের কিছু বেশি সময় রাজ্যশাসন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি ইংরেজ বাহিনীর কাছে পরাজিত হন।
পলাশীর যুদ্ধ ও আধুনিক যুগ : পলাশীর যুদ্ধ ও ভারতবর্গের ইতিহাসে আধুনিক যুগ অঙ্গাঙ্গিভাে আধুনিক যুগে আমরা ইতিহাসের যেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই, তা সাধারণত পলাশীর যুদ্ধের পর স্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয় । নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. ধর্মনিরপেক্ষতার বিকাশ : পলাশীর যুদ্ধের আগে অর্থাৎ, মধ্যযুগে ভারতবর্গ নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ডিল রাজনীতি করত ধর্ম নিয়ে। ফলে সাম্রাজ্যে অসাম্য পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধ থেকে দুই দশকের মধ্যে ওয় হেস্টিংস বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা চালু করেন। এতে মধ্যযুগীয় ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়কেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার পতন হয়। ইংরেজদের আদালত ও কর্মচারীরা আইনের চোখে সকলে সমান নীতি অনুসরণ করে প্রশাসন আধুনিক যুক্তিবাদ ও মানবিকতাবাদ প্রয়োগ করেন।
২. ভৌগোলিক ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও আধুনিক যুগের অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে পৃথিবীতে বিশেষ করে ভারতবর্ষে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। মানুষ বিজ্ঞানের দ্বারা অনেক অসম্ভব বস্তুকে সম্ভব করে তুলেছে। বিজ্ঞানের সাথে সাথে মানুষের মন শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে গড়ে উঠছে বিভিন্ন স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। যেমন- ১৮০০ সালে স্থাপিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষ জ্ঞান চর্চা করে নিজের জীবনকে প্রতিভাময় করে তুলেছে।
৩. রেনেসাঁ এর প্রভাব : রেনেসাঁ বা অগ্রগতির অপর নাম আধুনিক যুগ। রেনেসাঁ কথাটির অর্থ পুনর্জন্ম। সাধারণত রেনেসাঁ বলতে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতি সম্পর্কে জানার এক অদৃশ্য আগ্রহকে বুঝায়। ব্যাপক অর্থে রেনেসাঁ বলতে ব্যক্তিত্বের পুনর্জনা অর্থাৎ, মনের এক নতুন, স্বাধীন, সাহসপূর্ণ চেতনা এবং বলিষ্ঠ সমালোচনা ও অনুসন্ধিৎসার মনোবৃত্তিকে বুঝায়। মুহ্যমান ব্যক্তিত্বের পুনঃপ্রকাশকেই পুনর্জন্ম নাম দেওয়া হয়েছে। এ জাগরণের ফলেই ব্যক্তি মধ্যযুগীয় গতানুগতিকতার বন্ধন হতে সর্বপ্রকার মুক্ত হয়। ব্যক্তিত্বের অসাম্য দূর করে মানুষ সহনশীলতা লাভ করে। স্যার জে. এন. সরকার পলাশীর যুদ্ধের ফল হিসেবে বাংলায় রেনেসাঁস বা নবজাগরণের সূচনা হয় বলে মন্তব্য করেছেন। স্যার জে. এন. সরকার বলেছেন, “১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ জুন ভারতবর্ষের মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের সূচনা হয়। পলাশীর যুদ্ধের পর নাবিকের দিকদর্শন যন্ত্র নির্ণয়, ব্যবসায় বাণিজ্যের নতুন পথ আবিষ্কার সর্বোপরি নগরায়ণের পত্তন ইতিহাসে আধুনিক যুগের স্রষ্টা হিসেবে রেনেসাকে আখ্যায়িত করা যায়।”
৪. জাতীয়তাবোধ : দেশপ্রেমিক ভারতীয়দের মানসে পলাশীর যুদ্ধ এক বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছিল। মোহনলালের আত্মত্যাগ ভারতীয়দের আজও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে। ম্যালসন নামক ইউরোপীয় ঐতিহাসিক বলেছেন, "There are never was a battle in which the consequences were so vast, so immediate and so parmanent." পলাশীর প্রান্তরে নবাবের পরাজয় বাংলার জনগণ মেনে নিতে পারে নি, যার ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
" ৫. সামরিক শক্তির উন্নতি : সামরিক দিক থেকে পলাশীর যুদ্ধকে প্রকৃত যুদ্ধ বলা যায় না। পলাশীর যুদ্ধ ছিল একটি খণ্ডযুদ্ধ মাত্র। এ যুদ্ধে উভয়পক্ষের হতাহতের সংখ্যা ছিল অকিঞ্চিৎকর। ইংরেজদের পক্ষে ২৩ জন নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়। নবাবের বিশাল সেনাদলের মাত্র ৫০০ জন নিহত হয়। তাছাড়া এ যুদ্ধে উভয়পক্ষের সামরিক শক্তির প্রকৃত পরীক্ষা হয় নি। কারণ নবাবের প্রধান বাহিনী এ যুদ্ধে যোগ দেয় নি। ক্লাইভ কূটনীতি ও বিশ্বাসঘাতকতার দ্বারা প্রধানত এ যুদ্ধ জয় করেন। সুতরাং, ভারতীয়রা ইংরেজ অপেক্ষা সামরিক শক্তিতে হীন একথা প্রমাণিত হয় নি। এ জয়পরাজয়ের চূড়ান্ত মীমাংসা হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধের সাত বছর পর ১৭৬৪ খ্রিস্টাব্দে বক্সারের যুদ্ধ দ্বারা। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ মন্তব্য করেন যে, "Plassey was a cannonade but Buxar was a decisive battle."
৬. ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার : পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ কোম্পানি । তার কর্মচারীরা বিনা শুল্কে ব্যাপক বাণিজ্য চালাতে থাকে। বাংলার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য কোম্পানি, কোম্পানির কর্মচারী ও ইংল্যান্ড হতে আগত বেসরকারি বণিকদের একচেটিয়া অধিকারে চলে যায়। দত্তকের এ অপব্যবহারের ফলে বাংলার বণিকদের একাংশ প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে বাণিজ্য ছেড়ে মূলধনের টাকা জমিদারি ক্রয় ও কলকাতায় গৃহ নির্মাণে বিনিয়োগ করে। বাঙালিরা বাণিজ্য লক্ষ্মীর প্রাসাদ হতে বঞ্চিত হতে থাকে। বাংলার বণিকদের একটি ক্ষুদ্র অংশ ইউরোপীয় বণিকদের গোমস্তা, সরকার, বেনিয়ান হিসেবে টিকে থাকে। তবে এ কাজে তারা ছিল ইংরেজ বণিকদের ভৃত্য বা সহযোগী মাত্র। এ বিনা শুচ্ছে বাণিজ্য বাবদ বিরাট অঙ্কের অর্থসম্পদ বাংলা থেকে ইংল্যান্ডে চলে যেতে থাকে। নদীর জল যেমন ভাটার টানে সমুদ্রের দিকে চলে যায়, তেমনি বাংলার অফুরন্ত সম্পদ সমুদ্র পার হয়ে ইংল্যান্ডে চলে যেতে থাকে। এ ঘটনাকে ঐতিহাসিকরা 'Drain of Wealth' বা সম্পদের অপহরণ বলেছেন। পলাশীর পর সমুদয় সম্পদ বিদেশে অপহৃত হয় কিন্তু সাথে সাথে যে বাণিজ্য বিস্তার ঘটে তা অকল্পনীয়।
সমালোচনা : পলাশীর যুদ্ধের পর ভারতবর্ষে যে আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল সে সম্পর্কে স্যার জে. এন. সরকার বলেছেন, “এক জাদুকর যেন তার জাদুদণ্ডের স্পর্শে প্রাচ্যদেশের স্থবির, চলশক্তিহীন, শুষ্ক কঙ্কালগুলোকে নতুন প্রাণের বীজে সঞ্চারিত করে।" কিন্তু স্যার জে. এন. সরকারের এ উচ্ছ্বাসময় ব্যাখ্যা পুরোপুরি গ্রহণীয় নয়। প্রথমত এ যুগে বাংলার হিন্দু- মুসলিম নেতাদের মধ্যে নীতিবোধ ও মূল্যবোধের নিদারুণ অবক্ষয় দেখা যায়। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল স্পিয়ার যথার্থভাবে 'Bengalee Dissensions' বা বাঙালিদের অন্তর্দ্বন্দ্বের কথা বলেছেন। বাঙালি নেতাদের এ চারিত্রিক অবক্ষয় ব্যক্তিগত লাভক্ষতির হিসাবে প্রকটিত হয়েছিল। এজন্যই তারা সিরাজকে গদিচ্যুত ও মীরজাফরকে সিংহাসন পেতে সাহায্য করে। এ যুগে কলকাতায় অবস্থিত ইংরেজ কর্মচারীদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় ভীষণভাবে দেখা যায়। বাঙালি জাতিকে প্রেরণা দেওয়ার মত শক্তি এসব ইংরেজদের ছিল না। তাদের মধ্যে খ্রিস্টীয় নীতিবোধ ও ইংরেজ জাতিসুলভ মহত্বের দারুণ অভাব দেখা যায়। ক্লাইভ নিজে নির্লজ্জ অর্থলোভ ও লুণ্ঠনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তাঁর সহযোগিতাও এক্ষেত্রে কম ছিল না। ভারতবর্ষ যদি অধঃপতিত হয়, তবে পলাশীর যুগের ইংরেজরাও কম অধঃপতিত ছিলেন না। 'বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হতে বাংলা তথা ভারতকে বহু যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও যুক্তিবাদের আলোকে ভারতে ইংরেজ শাসন স্থাপিত হওয়ার বহু পরে ঊনবিংশ শতকে দেখা দেয়। পলাশীর অন্ধকার দূর হতে বহু দশক অতিক্রান্ত হয়। তবুও পি. জে মার্শালের মন্তব্য, “পলাশী শুধুমাত্র একটি যুদ্ধ ছিল না, পলাশীর ঘটনা ছিল একটি বিপ্লব।”
উপসংহার ঃ উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভারতবর্ষে মধ্যযুগের অবসান এর পক্ষে যেমন অনেক যুক্তি দেখানো যায়, তেমনি আবার বিপক্ষেও বেশকিছু যুক্তি রয়েছে। কিন্তু এসব যুক্তিকে খণ্ডন করে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ভারতবর্ষের মধ্যযুগের অবসান এবং আধুনিক যুগের সূচনা। স্যার জে. এন. সরকারের এ মত সমর্থনযোগ্য ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]