রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাধারা বিশ্লেষণ কর। তাঁকে বাংলার প্রথম আধুনিক পুরুষ বলা হয় কেন?

ভূমিকা : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে দেশ যখন কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, অন্ধবিশ্বাস তার জীবনধারাকে করেছিল রুদ্ধ; সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা সকল ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা লুপ্ত হয়ে জাতি যখন একটি ক্ষয়ধরা প্রথাকে সারসত্য বলে মনে করে আঁকড়ে ধরেছিল সে সংকট সময়ে রাজা রামমোহন রায় ভারতের রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হন। বাঙালি জনসমাজ তথা ভারতবাসীকে যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক মনোভাব, সাম্য ও মানবতাবাদের আদর্শ এবং আধুনিক স্বাতন্ত্র্যবাদে উদ্বুদ্ধকরণের অভিপ্রায়ে তিনি ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে সর্বপ্রথম নবজাগরণের সৃষ্টি করেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার সমন্বয়ে উনিশ শতকে যে আধুনিকতার সৃষ্টি হয়, তিনি ছিলেন তার অগ্রদূত। এজন্য তাঁকে বাংলার প্রথম আধুনিক পুরুষ বলা হয় ।
রাজা রামমোহন রায়ের প্রাথমিক পরিচিতি ঃ
১. জন্ম : রাজা রামমোহন রায় ১৭৭৭ সালে (মতান্তরে ১৭৭৪) হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রামকান্ত রায় ছিলেন একজন মুঘল কর্মচারী। মা ছিলেন তারানী; তবে সবাই তাকে 'ফুলঠাকুরাণী' বলে ডাকতেন। রামমোহন রায় বাল্যকাল থেকেই ছিলেন মেধাবী। তিনি বারানসীতে সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন এবং পাটনায় আরবি ও ফার্সি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। এছাড়া ইংরেজি, হিব্রু, গ্রিক, সিরিয় প্রভৃতি ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন। তিনি ১৮৩০ সালে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর কর্তৃক রাজা উপাধি লাভ করেন। ঐ বছর তিনি বিলেতে যান এবং ১৮৩৩ সালে ২৪ সেপ্টেম্বর মারা যান।
২. বাংলার জনজাগরণের অগ্রদূত : ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অগ্রদূত ইতালির সাথে বাংলাদেশের নানা দিক দিয়ে সামঞ্জস্য ছিল; পেত্রাক বোক্কাচো প্রভৃতি হিউম্যানিস্টগণ যেমন ইতালির রেনেসাঁস সূচনা করেছিলেন সেরূপ বাংলাদেশের নবজাগরণের সূচনা করেছিলেন হিউম্যানিস্ট বা মানবধর্মী রাজা রামমোহন রায়। ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার সংমিশ্রণে যে আধুনিক ভারতের আধুনিক মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল, তাদের অগ্রদূত ছিলেন রাজা রামমোহন রায়। হিউম্যানিস্ট সুলভ অনুসন্ধিৎসা, সংস্কারসুলভ মনোভাব এবং ঋষিসুলভ প্রজ্ঞা নিয়ে রামমোহন এক যুগ প্রবর্তকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সমন্বয়ের এক অভূতপূর্ব মূর্তপ্রতীক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়।
. ৩. চিন্তাধারার মুক্তি: নবজাগরণের প্রধান শর্তই হল চিন্তাধারার মুক্তি। গতানুগতিকতার স্থলে অনুসন্ধানী ও সমালোচক দৃষ্টি না জন্মিলে নবজাগরণের সূচনা হতে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন আত্মবিলুপ্তির স্থলে আত্মচেতনার। রক্ষণশীলতা ত্যাগ করে যুক্তিতর্কের দ্বারা সকল কিছুর মূল্য নির্ধারণ করা এবং বৃহত্তম স্বার্থের জন্য যা প্রকৃত সহায়ক তা গ্রহণ করার মধ্যেই নবজাগরণের বীজ নিহিত থাকে।
৪. সমন্বয়ের প্রতীক : মানবসভ্যতার মাপকাঠি হল সমন্বয় সাধনের ক্ষমতা। ইতিহাসের স্রোত যখন বিভিন্ন শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতির প্রভাব একই স্থলে এসে সমবেত হয় তখন শুরু হয় সংঘর্ষ ও দ্বন্দ্বের। এ সংঘর্ষের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারলেই সভ্যতা অগ্রগতির পথে অগ্রসর হতে পারে। ভারত ইতিহাসের এরূপ এক যুগ সন্ধিক্ষণে যখন তিনটি ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতা যেমন— হিন্দু, ইসলামী ও ইউরোপীয় একই স্থলে আশ্রয়গ্রহণ করতে চাইল তখন স্বভাবতই প্রয়োজন হল এক বিরাট সমন্বয়ের। আর এ ঐতিহাসিক প্রয়োজন মিটাবার জন্য রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাব হয়েছিল ।
৫. শিক্ষাজীবন : রাজা রামমোহন রায় ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল বারানসীতে সংস্কৃতশাস্ত্র অধ্যয়ন ও পাটনায় আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষা করেন। তিব্বতে গিয়ে তিনি তিব্বতীয় বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন। এছাড়া ইংরেজি, হিব্রু, গ্রিক, সিরিয় প্রভৃতি ভাষায়ও তাঁর ব্যুৎপত্তি জন্মেছিল। ধর্ম ও যুক্তিবাদ এর সমন্বয় সাধন করা, রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আনয়ন করা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে কুসংস্কারমুক্ত স্বাধীন ও বলিষ্ঠ চিন্তাধারার সূচনা করা ছিল তাঁর জীবনের আদর্শ। ইংরেজ হিউম্যানিস্ট ফ্রান্সিস বেকন হতে আরম্ভ করে লক, নিউটন, হিউম, গিবন, ভলতেয়ার, টমস, পেইন প্রভৃতি মনীষীগণের চিন্তাধারার সাথে তিনি পরিচিত ছিলেন। বাঙালি নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান : বাঙালি নবজাগরণে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল :
ক. সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান : নিম্নে সামাজিক ক্ষেত্রে রামমোহন রায়ের অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. নারী মুক্তি ঃ একজন সমাজসংস্কারক হিসেবে রাজা রামমোহন রায় প্রথম স্থান দিয়েছিলেন নারী মুক্তিকে। সে যুগে ধর্মের নামে নারীদের উপর যে সীমাহীন নির্যাতন চলছিল এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তিনি তাঁর পাণ্ডিত্যকে ব্যবহার করেন। রামমোহন দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে, নারী নির্যাতন শাস্ত্র বিরোধী সুতরাং এটা কোন ধর্মের অঙ্গ হতে পারে না। তাই তিনি এটা প্রতিহত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান।
২. সতীদাহের বিরোধিতা : সতীদাহ প্রথা নিবারণের ব্যাপারে রামমোহন যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এর পশ্চাতেও একই কারণ কাজ করেছিল। তিনি সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন যে, সতীদাহ পবিত্র কার্য বলে হিন্দুদের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে, একে কেবল আইন প্রণয়নের দ্বারা নির্মূল করা সহজ হবে না। অবশ্য লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক ১৮২৯ সালে সতীদাহের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে রামমোহনের পরামর্শ নিয়েছিলেন। তবে রামমোহন আইন প্রণয়ন অপেক্ষা সতীদাহের মত জঘন্য প্রথাকে নির্মূল করতে সক্রিয় কর্মসূচির পক্ষপাতী ছিলেন- যাতে এ ব্যাপারে জনমতে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় ৷
৩. জাতিভেদ প্রথার বিরোধিতা : রাজা রামমোহন রায় জাতিভেদ প্রথাকে হিন্দু সমাজের কলঙ্ক বলে মনে করতেন। এছাড়া জাতিভেদ প্রথাকে তিনি ভারতীয়দের ঐক্যের জন্য বাধা বলে চিহ্নিত করেন। তিনি সতীদাহ নিবারণের ব্যাপারে যেমন আইন প্রণয়নের পক্ষপাতী ছিলেন না তেমনি জাতিভেদ প্রথা দূরীকরণের জন্যও আইনের দাবি জানান নি। বরঞ্চ পত্রপত্রিকা, প্রবন্ধ রচনা এবং প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার পন্থা গ্রহণ করেন ।
৪. কৌলীণ্য ও বহুবিবাহ প্রথার বিরোধিতা : সমাজে সে সময় উচ্চবর্ণের লোকেরা স্ত্রীর সম্পত্তি লাভের আশায় বহুবিবাহ করত, এমনকি কেউ এটাকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করত। অথচ স্ত্রীর ভরণপোষণের কোন দায়িত্ব পালন করত না। সে দায়িত্ব পালন করতে হতো পিতাকে। এ কৌলীন্য ও বহুবিবাহের ফলে সমাজে নারী জাতিকে কেবল নিগৃহীতই হতে হয় নি বরং তাদের ভোগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচনা করা হতো। রামমোহন রায় এ ঘৃণিত প্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। ৫. বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ : সমাজের সকল স্তরে তখন বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল। কন্যার বয়স দশ এগার বছর পূর্ণ হলেই বিবাহ দিতে না পারলে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা সমাজে নিগৃহীত হতেন। তাই রামমোহন এ প্রথাকে অন্যায় বিবেচনা করে এর বিরুদ্ধে ভারতবাসীকে সোচ্চার করে তুলেন।
৬. বিধবা বিবাহের প্রচলন : তিনি হিন্দু সমাজের মধ্যে বিধবা বিবাহের রীতি প্রচলনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এজন্য তিনি প্রথম ব্রাহ্মসমাজের সভ্যদের মধ্যে বিধবা বিবাহের প্রচলন ঘটান। ক্রমে এটি সার্বজনীন সামাজিক সংস্কার আন্দোলনরূপে আত্মপ্রকাশ করে এবং পরবর্তীকালে সরকারি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পায় ।
খ. ধর্মীয় ক্ষেত্রে অবদান : নিম্নে রাজা রামমোহন রায়ের ধর্মীয় অবদানের বিবরণ দেওয়া হল : ১. একেশ্বরবাদের ভিত্তিতে হিন্দু ধর্মের পুনর্গঠন : রাজা রামমোহন রায় হিন্দু সমাজকে কুসংস্কার থেকে মুক্ত করে একেশ্বরবাদে পরিণত করার মনস্ত করেন। তিনি হিন্দু ধর্মের নিরর্থক আচার অনুষ্ঠান, বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাস প্রভৃতি যে মূল্যহীন তা বেদ ও উপনিষদ থেকে প্রমাণ করাতে সক্ষম হন। তবে তাঁর এ ধরনের মতবাদ ভারতের রক্ষণশীলদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। তিনি এতে হতোদ্যম না হয়ে তীব্র ভাষায় মূর্তিপূজা ও অর্থহীন আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করেন। ধর্মীয় কুসংস্কারের জন্য তিনি পুরোহিত সম্প্রদায়কে দায়ী করেন এবং একেশ্বরবাদই ধর্মের মূলকথা তা প্রচার করেন।
২. আত্মীয় সভা : একেশ্বরবাদের বাণী প্রচারের জন্য রামমোহন রায় ১৮১৫ সালে আত্মীয়সভা নামে একটি সমিতি গঠন করেন। ফলে স্বল্পকালের মধ্যেই একদল কুসংস্কারমুক্ত আধুনিক শিক্ষিত হিন্দু তাঁর প্রচারকার্যে আকৃষ্ট হয়ে তাঁকে সমর্থন দেন। এ সুযোগে তিনি ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং স্বীয় মতবাদ প্রচারে জোর আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর এ সমিতির সদস্যদের মধ্যে দারকানাত ঠাকুর, প্রসন্ন কুমার, নন্দ কিশোর বসু, কালী শংকর ঘোষাল ইত্যাদি লোকজন ছিলেন।
৩. বেদান্ত কলেজ ও হিন্দু কলেজ স্থাপন : কুসংস্কার মুক্ত মনের অধিকারী রাজা রামমোহন রায় বেদান্ত ও উপনিষদে মূর্তিপূজা বিরোধী বক্তব্যকে বাংলায় অনুবাদ করেন। তিনি ১৭২৫ সালে বেদান্ত কলেজ স্থাপন করেন। এ কলেজের উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান, দর্শন ও বেদান্ত শিক্ষা দেওয়া। রামমোহন রায় ১৮১৭ সালে ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন। পরে তার নামকরণ প্রেসিডেন্সি কলেজ করা হয়।
৪. সংস্কৃত মুক্ত বাংলা ব্যাকরণ রচনা : প্রগতিশীল মনের অধিকারী রামমোহন স্বীয় ধর্মমত প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলা ভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এছাড়া সংস্কৃত মুক্ত একখানা বাংলা ব্যাকরণও তিনি রচনা করেন। বাংলা ভাষায় কমা, সেমিকোলন প্রভৃতি যতিচিহ্ন তিনি প্রথম প্রচার করেন ।
৫. ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা : রামমোহন রায় হিন্দু ধর্ম সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১৮২৮ সালে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর তিনি ১৮৩০ সালে সমাজের নিজস্ব উপাশনালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এ উপাশনালয়ে তিনি সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সমান অধিকারদানের কথা প্রচার করেন। এ সমাজের মাধ্যমে রামমোহন রায় হিন্দু সমাজকে সচেতন করতে চান ।
গ. শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদান : আধুনিক বা পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তিনি উপলব্ধি করতে পারেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যতীত এ ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করা সম্ভব নয়। এছাড়া গত অর্ধ শতাব্দীর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে দেশের জনসাধারণের সার্বিক মুক্তির জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন। আর এ সময় রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুরাগী। এজন্য তিনি একজন সংস্কৃত পণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও ১৮২০ সালে কলকাতায় এ্যাংলো হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ইংরেজি ভাষা, দর্শন, বিজ্ঞান শিক্ষা দেওয়া হতো। অবশ্য পূর্বে তিনি ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা করেন। কলকাতার স্কটিশ চার্চ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁর অবদান ছিল ।
ঘ. সাহিত্য ক্ষেত্রে অবদান : বাংলা গদ্যের স্রষ্টা হিসেবে রামমোহন রায়ের অবদান কম নয়। তাঁর রচিত "দিকদর্শন, সমাচার দর্পণ' প্রভৃতি রচনাগুলো বাংলা গদ্যের উন্নতি সাধনে সাহায্য করেছিল। ১৮২৬ সালে প্রকাশিত একখানি বাংলা ব্যাকরণ আধুনিককালের পণ্ডিতদের প্রশংসা অর্জন করেছে। ও. রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবদান : রামমোহন রায় সমাজসংস্কারক হলেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি মহৎ প্রচেষ্টার পরিচয় দেন। তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। তিনি জীবনের প্রথম দিকে ইংরেজ সরকারের ভক্ত হলেও পরবর্তীতে সরকারের কোন কোন নীতির তীব্র সমালোচনা করেন। এরূপ প্রতিবাদ ও সমালোচনা থেকে তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় পাওয়া যায়।
চ. সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে রামমোহন : সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে রামমোহন রায় অত্যন্ত সচেষ্ট ছিলেন । তিনি মনে করতেন যে, স্বাধীন ও বলিষ্ঠ জনমত সৃষ্টি ও প্রকাশের দায়িত্ব সংবাদপত্রের। ১৮১৭ সালে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস সংবাদপত্রের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি হিন্দু ও খ্রিস্টান মিশনারীদের সমালোচনার মুখে স্বীয় মতামত ব্যক্ত করার জন্য ১৮২১ সালে ৪ ডিসেম্বর 'সংবাদ কৌমুদী' নামে একটি সপ্তাহিক পত্রিকা এবং ১৮২২ সালে 'মিরাত-উল আখবার' নামে আরেকটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এছাড়া তিনি ছিলেন 'বেঙ্গল হেরাল্ড' পত্রিকার সম্পাদক। তিনি বাংলা গেজেট, ইন্ডিয়ান গেজেট, বেঙ্গল ডাকহরকরা ইত্যাদি পত্রিকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন।
ছ. কৃষকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে রামমোহন রায় : কৃষকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থে রামমোহন রায় যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। জমিদারশ্রেণীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি পার্লামেন্টে এক অভিযোগপত্র প্রেরণ করেন। ভারতীয়গণকে সরকারি উচ্চপদে নিয়োগের দাবি উপেক্ষিত হলে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে Board of Control এর কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। ১৮৩০ সালে জমির উপর কর ধার্য করায় তিনি প্রতিবাদ জানান এবং জনমত গঠন করেন। ফলে সরকার মসজিদ, মন্দির প্রভৃতি ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত জমির উপর থেকে কর প্রত্যাহার করেন। এছাড়া তিনি ভারত থেকে সম্পদ পাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন।
ভারতীয়দের দাবি দাওয়া নিয়ে তিনি ১৮৩০ সালে ১৫ নভেম্বর ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সা দ্বিতীয় আকবরের প্রতিনিধি ও ভারতীয় আভিজাত্য রক্ষার জন্য তাঁকে রাজা উপাধি দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডে তার আগমন ব্যাপক সাড়া জাগায়। তিনি সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের ভ্রাতাবন্ধের ব্যাপারে পার্লামেন্টে অভিযোগ করেন। তিনি কোম্পানির শোষণে ভারতীয়দের দূরবস্থা ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদার ও কৃষকদের নির্যাতনের কথা পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন। ১৮৩২ সালে তিনি কমন্সসভার বিতর্কে যোগ দেন।
উপসংহার : অতএব রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ভারতের আধুনিক যুগের অগ্রদূত, বিপ্লবের মূর্ত প্রতীক এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সমন্বয় প্রসূত নতুন যুগের নতুন মানুষ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তার বরিশাল ব্যক্তিত্বের প্রভাব তদানীন্তন বাংলার মনীষীদের প্রভাবিত করেছিল। তিনি ছিলেন চিন্তাবিদ ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তিনি ভারতবর্ষে বিভিন্ন আন্দোলন করে ভারতীয়দের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথ প্র করেছিলেন। তাই বলা যায় যে, এ মনীষী আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে বাঙালি সমাজ নিঃসন্দেহে আরও উপকৃত হতো।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]