হাজী শরীয়তুল্লাহর অবদান বিশেষ উল্লেখপূর্বক ফরায়েজি আন্দোলনের বিবরণ দাও ।

ভূমিকা : পলাশীর আম্রকাননে সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ে বাংলাদেশবাসীর তথ্য ভারতবাসীর উপর নেমে আসে পরাধীনতার গ্লানি ও অত্যাচারের স্টিমরোলার। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দী ছিল ভারতীয় মুসলমানদের জন্য অত্যাচার ও নির্যাতনের এক বিশেষ অধ্যায়। বিশেষ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারয়ে জমিদার, নীলকর ও মহাজনদের জুলুম ও শোষণে এদেশের সাধারণ কৃষকদের অবস্থা অত্যন্ত দুর্বিসহ হয়ে উঠে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার কুসংস্কার ও কুপ্র তাদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনকে বিষময় করে তোলে। বাংলার এ উপেক্ষিত, অত্যাচারিত, নির্যাতিত, বঞ্চিত ও শোধিত গণমানুষের মুক্তির জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৮১৮ সালে এক ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। তার এ আন্দোলনকে ফরায়েজি আন্দোলন বলা হয়।
হাজী শরীয়তুল্লাহ ও ফরায়েজি আন্দোলন ঃ নিম্নে এ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করা হল : পরিচয় : ফরায়েজি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৭৮১ সালে ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার প্র শ্যামায়েল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। আট বছর বয়সকালে তাঁর পিতা আবদুল জলিল তালুকদার মারা যান। অনেকটা নিম্নস্তরে জন্ম বিধায় তিনি বেশি পড়াশোনা করতে পারেন নি। ১৭৯৯ সালে তিনি মক্কায় হজ্ব করতে যান এবং ১৮১৮ সালে বাংলায় ফিরে আসেন। সমসাময়িক ইংরেজ কর্মচারী জেমস টেলরের মতানুসারে তিনি দুবার হজ্ব করতে যান এবং ১৮২৮ সালে স্বদেশে এসে তার মতবাদ প্রচারে আত্ম নিয়োগ করেন। টেলরের ধারণা মতে, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এর এক ষষ্ঠাংশ মুসলমান এবং ঢাকা শহরের এক-তৃতীয়াংশ মুসলমান তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। প্রথম পর্বে মক্কায় বসবাসকারী মাওলানা মুরাদ নামক একজন বাঙ্গালীর কাছে তিনি আরবি সাহিত্য ও ইসলামি আইন শাস্ত্রে জ্ঞান লাভ করেন। দ্বিতীয় পর্বে তাহের সম্বাল নামক একজন হানাফি আইন শাস্ত্রবিদের কাছে চৌদ্দ বছর ধর্মীয় বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় জ্ঞান লাভ করেন। তৃতীয় ও শেষ পর্বে দুবছর তিনি কায়রোয় আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে তর্কশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। টেলরের মতে, মক্কায় থাকাকালে হাজী শরীয়তুল্লাহ আরবের ওহাবিদের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের মধ্যেই দিনযাপন করেন। মক্কা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি মুসলমান সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন শিরক ও বিদআতের বিরুদ্ধে সংস্কার আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ফরায়েজি আন্দোলন : ফরায়েজি শব্দটি আরবি ফারায়েজ শব্দ থেকে উদ্ভূত। ফারায়েজের একবচন ফরিজাহ অর্থাৎ ইসলাম কর্তৃক অবশ্য পালনীয় কর্তব্য'। অতএব, যারা ইসলাম ধর্মের অবশ্য পালনীয় কর্তব্যগুলোর উপর গুরুত্ব আরোপ করে তারাই হল ফরায়েজি। তবে তারা ফরায়েজ শব্দটিকে আল্লাহ ও রসূল কর্তৃক প্রবর্তিত গুরুত্ব নির্বিশেষে সমস্ত ধর্মীয় কর্তব্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। অবশ্য তারা পাঁচটি মৌলিক বিধান পালনের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন।
এগুলো হল- ক. কলেমা, থ নামায, গ. রোযা, ঘ, হজ্ব ও যাকাত। বাংলার মুসলমানরা বিভিন্ন স্থানীয় আচার অনুষ্ঠানের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার দরুন ইসলামের এসব মৌলিক বিধানের উপর তেমন একটা গুরুত্ব দিত না। তাই তারা যেন এ পাঁচটি মৌলিক বিধান পালনের উপর গুরুত্ব দেন, এদিকে ফরায়েজিরা সচেতন ছিলেন। ফরায়েজিরা তৌহিদ ও আল্লাহর একত্বের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তৌহিদের উপর শুধু মৌখিক বিশ্বাসে তারা সন্তুষ্ট নয় বরং ব্যবহারিক জীবনে প্রদর্শনের প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করেন। ফলে এমন কোন আচার-অনুষ্ঠান যা একত্ববাদকে সামান্যভাবে প্রভাবিত করে, তারা তা বর্জন করেন। তাই হাজী শরীয়তুল্লাহ আল্লাহ ও রসূল কর্তৃক প্রবর্তিত নয় এ ধরনের যে কোন আচার-অনুষ্ঠানকে শিরক ও বিদ'আত বলে প্রত্যাখ্যান করেন। অর্থ শুধু আল্লাহ ও রসূলের অনুশাসন পালন নয় বরং মুসলিম সমাজ এর বাইরের যেসব আচার-অনুষ্ঠান প্রবেশ করেছে ঐগুলোকেও বর্জন করা। মহরম উৎসব যেরূপ হযরত মুহাম্মদ (স) ও তাঁর পূর্ববর্তী পয়গাম্বরগণ কর্তৃক পালিত হয়েছে বলে ফরায়েজিরা দাবি করেন তা অর্থাৎ ঐ মাসের দশম তারিখে অপরিবর্তনীয়ভাবে রক্ষা করা হয়। ফরায়েজিরা পুতি, ছাতি ও চিল্লার আচার-অনুষ্ঠানও বর্জন করে চলেন। তারা একমাত্র আকিকা উৎসব পালন করত। এছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ অনুসরণ করে চলত।
দুদুমিয়া ও ফরায়েজি আন্দোলন : হাজী শরীয়তুল্লাহ মূলত ছিলেন একজন ইসলামের সংস্কারবাদী প্রচারক, কিন্তু তাঁর পুত্র দুদুমিয়া সংস্কার ও কর্মবাদকে একসূত্রে গ্রথিত করেছিলেন। তিনি ফরায়েজি আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণের পরে পিতার অনুসৃত শাস্তিবাদী নীতি পরিহার করেছিলেন। দুদুমিয়া এ অত্যাচারিত ও নিষ্পেষিত মুসলিমদের সম্মুখে ন্যায্য অধিকার আদায় করার যে আদর্শ তুলে ধরেন তার ফলে ফরায়েজি সমর্থকদের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি ফরায়েজিরা এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। আর এ সুযোগে তিনি ফরায়েজি আন্দোলনকে ধর্মীয় গণ্ডির বাইরে জমিদার নীলকর বিরোধী আন্দোলনে রূপান্তরিত করেন।
ফরায়েজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ঃ নিম্নে ফরায়েজি আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা করা হল : নিপীড়িতদের কাছে আকর্ষণীয় আদর্শ : ফরায়েজি আন্দোলন যে মূলত ইসলামি সংস্কার আন্দোলন হিসেবে শুরু হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু ধর্মান্দোলন অপেক্ষা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ছিল ফরায়েজিদের পবিত্রতা এবং সমতার আদর্শ। কারণ, ঢাকা, ফরিদপুর প্রভৃতি অঞ্চলের দলিত মুসলিম কৃষকদের ফরায়েজি আদর্শ নতুনভাবে উজ্জীবিত করেছিল। সমসাময়িক জনৈক ইংরেজ লেখকের বর্ণনা হতে জানা যায় যে, বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্গত ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ এবং ময়মনসিংহ জেলার মুসলিমদের এক বিরাট অংশ হাজী শরীয়তুল্লাহর আমলেই ফরায়েজি সমর্থকে পরিণত হয়। পরবর্তীকালে স্বাভাবিকভাবে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছিল। হিন্দু বিরোধিতা : হাজী শরীয়তুল্লাহ বিধান দেন যে, হিন্দু সমাজে প্রচলিত কিছু আচারাদি, যা মুসলিম সমাজেও অনুপ্রবেশ করেছে তা ফরায়েজিরা পালন করবে না এবং ফরায়েজিরা হিন্দুদের অনুষ্ঠানে যোগদানও করবেন না। এটা নিঃসন্দেহে ফরায়েজিদের ধর্মীয় উন্মাদনা ও গোঁড়ামির পরিচায়ক। কিন্তু সাথে সাথে এটাও স্মরণ রাখতে হবে যে, ফরায়েজি অধ্যুষিত এলাকার হিন্দু জমিদাররা মুসলিম রায়তদের কাছ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে হিন্দু পূজা-পার্বন যেমন- দুর্গা পূজা, কালী পূজা, স্বরসতী পূজা প্রভৃতিতে বাধ্যতামূলক অর্থ আদায় করতেন। বলা বাহুল্য যে, গরিব মুসলিম রায়তদের কাছ থেকে হিন্দু পূজা-পার্বনে অর্থ না দেওয়ার আহ্বান তাদের বিশেষভাবে ফরায়েজি আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল ।
ফরায়েজিদের ভ্রাতৃত্ববোধ ঃ ফরায়েজি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল ফরায়েজিদের একতা। হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজিদের কাছ থেকে পরিশ্রমের দ্বারা অর্থ উপার্জনের আদর্শ তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি সৎ পথে অর্থ উপার্জনের উপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলতেন, জুলুমবাদী দ্বারা বা অত্যাচারের মাধ্যম্যে যারা অর্থ সংগ্রহ করে তাদের প্রার্থনা আল্লাহ গ্রহণ করেন না। ফরায়েজিদের মধ্যে শ্রমের মর্যাদা সৃষ্টির লক্ষ্যে সকল পেশার মানুষকেই 'শ্রমিক' বলে সম্মান জানানো হতো। এসব আদর্শ পালনের মধ্য দিয়ে ফরায়েজিদের মধ্যে এক প্রকার ভ্রাতৃত্ববোধ জাগরিত হয়েছিল। আর এ ভ্রাতৃত্ববোধ তিনটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল । যথা : সাম্য বা সমতা, শ্রমের মর্যাদা এবং সখ্যতা। .
সুসংবদ্ধ প্রতিষ্ঠা : ফরায়েজি আন্দোলনের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, দুদুমিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজিরা একটি সুসংবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলেন। ঢাকার তদানীন্তন কমিশনার সরকারের নিকট যে রিপোর্ট প্রেরণ করেছিলেন তাতে ফরায়েজি সংগঠনের চিত্রটি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, পূর্ববঙ্গের যেসব জায়গায় ফরায়েজিরা বসবাস করত সেখানেই দুদুমিয়ার একজন প্রতিনিধিকে খুঁজে পাওয়া যেত। এক একটি এলাকায় এ এজেন্ট বা প্রতিনিধির নাম ছিল এক এক রকমের। যেমন- মুন্সি, সরদার প্রভৃতি। তার প্রধান কাজ ছিল এলাকার ফরায়েজিদের ঐক্যবদ্ধ করা। এভাবে ফরায়েজিরা কেবল একটি সংঘবদ্ধ সম্প্রদায় ছিল না। আটসাট সংগঠনের আওতায় একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ দল হয়ে পড়েছিল।
পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা : ফরায়েজিদের পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা তাদের আন্দোলনকে যে বিশিষ্টতা দান করেছিল তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। হাজী শরীয়তুল্লাহই প্রথম মুসলিম সমাজে পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র দুদুমিয়ার নেতৃত্বে পূর্ববঙ্গের ফরায়েজি অধ্যুষিত অঞ্চলে রীতিমত একটি সরকারি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে, সমান্তরালভাবে। প্রত্যেক ফরায়েজি গ্রামের অধিবাসীরা একজন খলিফাকে নির্বাচিত করত যিনি গাঁও খলিফা নামে অভিহিত হতেন। অনুরূপভাবে গাঁও খলিফারা মিলিতভাবে প্রত্যেক থানার জন্য একজন গিদ খলিফা নামে অভিহিত হতেন। একইভাবে জেলা পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে খলিফা নির্বাচন করা হতো। ফরায়েজিদের সাথে সংঘর্ষ : ফরায়েজিরা কেবল অত্যাচারিত জমিদার নয় ইংরেজ সরকার এবং এর সহযোগী নীলকর সাহেবদেরও ঘোর বিরোধী ছিলেন। ফরিদপুরে অত্যাচারিত জমিদারদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষের সূত্রে দুদুমিয়া এবং বেশ কিছু ফরায়েজিকে আসামি হিসেবে আদালতে পেশ করা হয়। কিন্তু প্রমাণাভাবে দুদুমিয়া ছাড়া পায়। এতে তাঁর জনপ্রিয়তা ও প্রতিপত্তি উভয়ই বৃদ্ধি পায়। দুদুমিয়া ফরিদপুরের নীলকর সাহেব ডানলপের অত্যাচারের বিরুদ্ধেও ফরায়েজিদের প্ররোচিত করেন এবং ডানলপের নীলকুঠী ছারখার করে দেন। এছাড়া দুদুমিয়া ও তাঁর সহযোগীরা অত্যাচারীদের শায়েস্তা করার জন্য তাদের উপর আক্রমণ চালানো মোটেই গর্হিত কাজ মনে করত না। ইংরেজ সরকার ফরায়েজি আতঙ্কে এমনই আতঙ্কিত ছিলেন যে, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়ে ফরায়েজিরা পাছে বিদ্রোহী সিপাহিদের সাথে যোগদান করে সেহেতু সরকার দুদুমিয়াকে কারারুদ্ধ করেছিলেন। ফরায়েজি আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ : ফরায়েজি আন্দোলন সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণীর সমর্থন লাভ করেছিল। ফলে তাদের পক্ষে সুবিধা হয় ব্রিটিশ সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার। তবে এ আন্দোলনের কিছু ত্রুটি ছিল। যার জন্য জনপ্রিয়তা লাভ করা সত্ত্বেও এ ফরায়েজিরা সফল হতে পারেন নি। নিম্নে ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা করা হল :
রক্ষণশীল মুসলিমদের বিরোধিতা : ফরায়েজিরা নিজেদের সম্প্রদায়গতভাবে যে ভিন্ন আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাতে রক্ষণশীল মুসলিমরা সমর্থন জানায় নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হাজী শরীয়তুল্লাহর বিরুদ্ধে রক্ষণশীল মুসলিমরা হিন্দুজমিদারদের নিকট ফরায়েজিদের শায়েস্তা করার জন্য আবেদন করেছিলেন। রক্ষণশীল মুসলিমদের বিরোধিতা ফরায়েজি আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
হিন্দুদের সমর্থনের অভাব : ফরায়েজি আন্দোলনের সামনে ধর্মান্দোলন বা ধর্মসংস্কারই ছিল মুখ্য। অর্থাৎ, বিশুদ্ধ ইসলামকে জনসাধারণের সামনে উপস্থিত করার যে আদর্শ নিয়ে ফরায়েজিরা আন্দোলনের পথে নেমেছিল রক্ষণশীল মুসলিম ছাড়া হিন্দুদেরও সমর্থন এতে ছিল না। হিন্দুদের মন্দির আক্রমণ, প্রকাশ্য কোরবানি প্রভৃতির প্রকাশ্য অনুষ্ঠান গরিব হিন্দু কৃষকদের বিছিন্ন করেছিল। জমিদার, বিত্ত লী ও নীলকরদের বিরোধিতা : বিত্তশালী, জমিদার, নীলকর এবং মহাজনের বিরোধিতা ফরায়েজি আন্দোলনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ। এ তিন শ্রেণী ইংরেজ সরকারের সাথে মিলিতভাবে ফরায়েজিদের শায়েস্তা করার জন্য সকল প্রকার পন্থা অবলম্বন করেছিল । তিতুমীর সম্প্রদায়ের সমর্থনের অভাব : ফরায়েজিদের নীতি ও আদর্শের সাথে তিতুমীর সম্প্রদায়ের আন্দোলনকারীদের কোন মিল ছিল না। তিতুমীর সম্প্রদায়ের সমর্থন না থাকায় নিঃসঙ্গভাবে ফরায়েজিরা যে আন্দোলন চালিয়েছিলেন তা সরকার ও সমাজের উপরতলার মানুষদের সমর্থনের অভাবে ব্যর্থ হয়।
সরকারের বিরোধিতা ঃ ফরায়েজিদের বিরোধিতায় হিন্দু ও রক্ষণশীল মুসলমানরা যেভাবে নেমেছিল তার পূর্ণ সুযোগ” গ্রহণ করে ইংরেজ সরকার ও তার পুলিশ বাহিনী। অন্যদিকে, ফরায়েজি আন্দোলনের নেতারা মুখে ইংরেজ সরকারের বিরোধিতার কথা বললেও বাস্তবে কিন্তু তারা কোন দিন বিদ্রোহ করার সাহস পায় নি। নেতৃবর্গের উদ্যম ফরায়েজিদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা এবং সংগঠিত করা ছাড়া আদালতে মামলা মোকদ্দমার তদবিরেই নিঃশেষিত হয়েছিল। যার ফলে ফরায়েজি আন্দোলনের ব্যর্থতা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল।
ফরায়েজি আন্দোলনের ফলাফল/প্রভাব:
আঠারো শতকের শেষার্ধে যেসব আন্দোলন বাংলার সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক জীবনে বিপুল প্রভাব বিস্তার করেছে তার মধ্যে ফরায়েজি আন্দোলন অন্যতম। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে, পতনন্মোখ মুসলিম সমাজের পুনরুজ্জীবন কল্পে হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে শুরু হলেও মুসলিম সমাজে যেসব কুসংস্কার ও ধর্মবিরুদ্ধ সামাজিক অনাচার অনুষ্ঠানের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল হাজী শরীয়তুল্লাহ তার মূলোৎপাটনে ব্রতী হয়েছিলেন। তিনি এমন একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন যেখানে অন্যায় অবিচার থাকবে না। মানুষ সম্যের ভিত্তিতে জীবনধারণ করবে। এজন্য বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার অসঙ্গতিসমূহ দূর করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। তার চেষ্টায় বাংলার মুসলমানগণ অধিকার সচেতনতা ও মর্যাদাবান ব্যক্তিত্বের প্রতি সজাগ হয়ে উঠেন এবং তাদের মৌলিক অধিকারের উপর অন্যের হস্তক্ষেপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠেন। তিনি ইসলামি সাম্রাজ্যবাদের যে আদর্শ প্রচার করেন স্বাভাবিকভাবেই নিম্নবিত্ত নির্যাতিত পেশাজীবী শ্রেণীসমূহ এতে আকৃষ্ট হয়। তারা মুক্তির আলোর সন্ধান পায় এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠে। শক্তিশালী শোষক শ্রেণীর প্রবল আক্রমণে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়লেও বলা হয় যে, ১৮৬৯ সনের খাজনা আইন ও ১৮৮৫ সনের প্রজাস্বত্ত্ব আইন পাশের মধ্যবর্তী সময়ে এ আন্দোলন প্রবল অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। ধর্মীয় ও সমাজজীবন থেকে অনৈসলামিক রীতিনীতি দূর করে ইসলামি আদর্শে পরিচালিত হওয়ার জন্য দুদুমিয়া যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন পরবর্তীকালে সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে বহুকাল তা বাংলার মুসলমানদের অনুপ্রেরণা দান করেছিল এবং এ সংগ্রামী ধারা তৎকালে এবং পরবর্তীকালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। দুদুমিয়ার মৃত্যুর পর নেতৃত্বের অভাবে আন্দোলন ক্ষীণতর হয়ে গেলেও অত্যাচারী জমিদার নীলকরদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পদ্ধতি এবং বলিষ্ঠ কৃষকপ্রজা আন্দোলন পূর্ব বাংলার সংগ্রামী মানুষের পথ প্রদর্শকরূপে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। উপসংহার ঃ উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, হাজী শরীয়তুল্লাহ ও দুদুমিয়ার নেতৃত্বে মুসলমানদের মধ্যে অত্যাচারের বিরুদ্ধে ন্যায়, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার এক অনির্বাণ প্রদীপ জ্বালানোর মন্ত্র রচনা করেন। আর এ মন্ত্রে উৎফুল্ল হয়ে ভারতবাসী অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, কোন আন্দোলনই সফল হয় নি। কারণ, দুদুমিয়ার পর কোন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে নি। যে ব্যক্তিত্ব এ আন্দোলনকে সফলভাবে পরিচালনা করবে। তবে সমকালীন অবস্থার প্রেক্ষাপটে এ আন্দোলনের যে প্রয়োজন ছিল তা বলা যায়। এর ফলে বাঙ্গালীদের মধ্যে চেতনাবোধ জাগ্রত হয়েছিল ।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]