তিতুমীরের আন্দোলন আলোচনা কর। এই আন্দোলনের প্রকৃতি কি ছিল?

ভূমিকা : পাশ্চাত্য শিক্ষার ও সভ্যতার প্রভাবে হিন্দু সমাজে যেমন সংস্কার আন্দোলন দেখা দেয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও সেরূপ সংস্কারের আন্দোলন দেখা দেয়। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতীয় মুসলিম সমাজ দুভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখান। প্রথম গোষ্ঠী পাশ্চাত্য শিক্ষা ও আধুনিক ভাবধারা গ্রহণ করে মুসলিম সমাজকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয় গোষ্ঠী ইসলামের শুদ্ধিকরণ' দ্বারা পবিত্র কোরআনের আদর্শকে রূপায়িত করার কথা ভাবেন। এ ভাবধারাকে ইসলামের পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন বলা হয়। সংস্কারবাদী মুসলিম নেতাদের মধ্যে নিসার আলী খান (তিতুমীর) ছিলেন একজন সংস্কার মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিত্ব। তার নেতৃত্বে বাংলায় কৃষক, শ্রমিক তথা সাধারণ শ্রেণীর দাবি আদায়ের জন্য ওয়াহাবি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।
তিতুমীরের প্রাথমিক পরিচয় : বাংলার ওয়াহাবি আন্দোলনের প্রধান নায়ক তিতুমীরের পুরো নাম মীর নিসার আলী খান। ১৭৮২ সালে ২৪ পরগনার বাদুড়িয়া থানার হায়দরপুর গ্রামে তিতুমীরের জন্ম হয়। আবদুল গফ্ফর সিদ্দিকীর মতে, তিতুমীরের চাঁদপুর গ্রামে জন্ম হয়। এ সময় বাদুড়িয়া নদীয়া জেলার অন্তর্গত ছিল। তিতুমীরের পিতার নাম ছিল সৈয়দ হাসান আলী এবং মাতার নাম রোকেয়া বেগম। মীর নিসার আলীর নাম তিতুমীর হয় কেন সে সম্পর্কে এক মজার কাহিনী আছে। তিতুমীরের বাল্যকালে একনাগাড়ে জ্বর হলে তিতুমীরকে শিউলী পাতার রস খাওয়ানো হতো। তিতুমীর সে - তিক্ত রস পান করতেন বলে তার নাম হয় তিতুমিয়া। পরে তা দাঁড়ায় তিতুমীর নামে। তিতুমীর বাল্যকালে গ্রামের বিদ্যালয়ে বাংলা, আরবি, ফার্সি পড়তেন। তিনি মল্লযুদ্ধ, অসি ক্রিয়া আয়ত্ত করেন। তিতুমিয়া হায়দরপুর গ্রামে মুন্সী আমির আলীর কন্যাকে বিবাহ করেন । তিতুমীর ও ওয়াহাবি আন্দোলন ঃ তিতুমীর ১৮২৩ সালে মক্কায় যান। মক্কায় সৈয়দ আহমদের সাথে দেখা হলে তিতুমীর সৈয়দ আহমদের ওয়াহাবি আন্দোলনের দীক্ষা নেন। জেমস ওকিনলের মতে, এর আগে সৈয়দ আহমদের সাথে ১৮১১ সালে কলকাতায় তিতুমীরের একবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। যাহোক মক্কায় সৈয়দ আহমদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর তিতুমীর, ওয়াহাবি আদর্শ বাংলায় প্রচার শুরু করেন। তিনি হায়দরপুর থেকে ওয়াহাবি আন্দোলন আরম্ভ করেন। ওয়াহাবি আদর্শের মূলকথা ছিল 'ইসলামের শুদ্ধিকরণ। এজন্য তিতুমীর প্রচার করেন যে, পীর পয়গম্বর মানার দরকার নেই,
মন্দির-মসজিদ তৈরির দরকার নেই,
ফয়তা বা শ্রাদ্ধ শান্তির দরকার নেই,
সুদে টাকা খাটানো উচিত নয়,
তিতুমীরের ধর্ম প্রচারক বা মৌলবিগণ পীরদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নিষেধ করেন এবং দরগা নির্মাণের প্রতিবাদ করেন। তিতুমীর তার আন্দোলনের নাম দেন শরিয়ত-ই মহম্মদী ওয়াহাবি। ধর্মশাস্ত্রে সিরাত-ই মুস্তাকিন তিনি মান্য করতেন। ৭. তিতুমীর তার অনুগামীদের এক বিশেষ ধরনের দাড়ি রাখার নির্দেশ দেন । জোলা, নাকারি, পটুয়া ও বাদ্যকর প্রভৃতি নিম্নশ্রেণীর মুসলমানরা তিতুমীরের ধর্মমতের প্রতি আকৃষ্ট হন । তিতুমীরের আন্দোলনের জনপ্রিয়তা : তিতুমীরের ওয়াহাবি শিষ্যদের মধ্যে জোলা ও রায়ত চাষিরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সকল শ্রেণীর মুসলমান তার মতামত গ্রহণ করেন নি। বিলেতি কাপড়ের আমদানির ফলে বাংলার জোলা বা তাঁতিরা কর্মহীন ও বেকার হয়ে যায়। তাদের তাঁতশিল্প ধ্বংস হয়। এজন্য এ শ্রেণী তিতুমীরের আদর্শের মধ্যে তাদের সমস্যার সমাধানের ইঙ্গিত খোঁজেন। কৃষক বা রায়তরা ছিলেন শোষিত। এজন্য তারা তিতুমীরের ধর্ম মতের মধ্যে শোষণ মুক্তির সম্ভাবনা অনুভব করেন। কারণ, তিতুমীর প্রচার করেন যে, মুসলিমদের হাত থেকে ইংরেজ ভারতের রাজশক্তি কেড়ে নিয়ে ভারতবর্ষকে দারউল হারাবে পরিণত করেছে। ওয়াহাবিরা ভারতবর্ষকে দারউল ইসলামে পরিনত করতে চান। ইছামতী নদীর উপত্যকা অঞ্চলে ২০×১৪ মাইল পরিধির মধ্যে গ্রামবাসীদের উপর তিতুমীরের প্রভাব স্থাপিত হয়। তিতুমীরের প্রভাবে ওয়াহাবিগণ সাহসী ও বেপরোয়াভাবে তাদের মত প্রচার করেন এবং অন্য মতাবলম্বীদের সমালোচনা করেন । রক্ষণশীলদের তিতুমীরের মতের বিরোধিতা : তিতুমীরের ওয়াহাবি মত সকল শ্রেণীর মুসলমান গ্রহণ করে নি। বহু সুন্নি মুসলিম ছিলেন হানাফি মতের অনুরাগী এবং অনেকে ছিলেন পীর পয়গম্বরের ভক্ত। তারা তিতুমীরের
• ওয়াহাবি ও মৌলবি মতের বিরোধিতা করেন। বহু মুসলিম মোল্লা ও ধনাঢ্য ব্যক্তি তার মতবাদে ভীত হন। স্থানীয় হিন্দু- মুসলিম জমিদাররাও ওয়াহাবিদের এ নবোদিত শক্তি ও নির্ভীক আচরণে শঙ্কাবোধ করেন। তারা আশঙ্কা করেন যে, এর ফলে গ্রামাঞ্চলে তাদের প্রভাব কমে যাবে এবং জমিদারতন্ত্র ঘোষিত হবে। ডঃ বিনয় চৌধুরীর মতে, ওয়াহাবিদের ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তি জমিদার শ্রেণীর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বের পথে বাধা স্বরূপ দাঁড়ায়।
মুসলিম কৃষকদের মধ্যে তিতুমীরের জনপ্রিয়তা এবং হিন্দু জমিদারদের দমননীতি : তিতুমীরের ওয়াহাবি আন্দোলনে সাধারণ মুসলিম রায়ত, জোলা, ঢালী, পটুয়া প্রভৃতি বঞ্চিত শ্রেণী যতই আকৃষ্ট হয়, ততই হিন্দু-মুসলিম জমিদার মহাজন শ্রেণী এমনকি নীলকরগণ ওয়াহাবিদের দমনের জন্য বদ্ধপরিকর হন। ওয়াহাবি বিরোধী মুসলমানগণ স্থানীয় জমিদারদের কাছে ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে থাকেন। ২৪ পরগনার ও নদীয়ার অধিকাংশ প্রধান জমিদার ছিলেন হিন্দু। হিন্দু জমিদারগণ ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে যে দমননীতি নেন, তার পশ্চাতে কোন সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল বলে মনে করা যায় না। মুসলিম কৃষকদের মধ্যে যারা ওয়াহাবি মতের অনুরাগী ছিলেন তাদের প্রতি জমিদারদের ক্রোধ বর্ষিত হয়। সকল শ্রেণীর মুসলমানদের প্রতি হিন্দু জমিদারদের দমননীতি প্রযুক্ত হয় নি
পুড়ার জমিদারের দমননীতি ও সংঘর্ষ : পুড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় এ বিষয়ে হিন্দু জমিদারদের মুখপাত্র ছিলেন। তিনি ওয়াহাবিদের উপর বিভিন্ন প্রকার দমননীতি চালু করেন। তিনি ওয়াহাবিদের দাড়ির উপর দাড়ি পিছু ২.৫০ টাকা কর ধার্য করেন। তিনি দাড়ির উপর কর ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে কর ধার্য করেন। যথা ঃ
১. নতুন পাকা বাড়িতে ওয়াহাবি মসজিদ স্থাপনের জন্য ১০০০ টাকা এবং কাঁচা বাড়ির জন্য ৫০০ টাকা কর দিতে হবে।
২. তিতুমীরের শিষ্যদের আরবি নাম গ্রহণের জন্য ৫০ টাকা কর দিতে হবে। কোন হিন্দু তিতুমীরের সম্প্রদায়কে আশ্রয় দিলে তার জমি বাজেয়াপ্ত করা হবে। কৃষ্ণদেব রায় এর এ ঘোষণার সাথে অন্যান্য জমিদাররাও দাড়ির উপর কর ধার্য করেন। পুড়া গ্রামে দাড়ির খাজনা আদায়ের পর জমিদারের পাইক, কোশান, সিং ও আরো কয়েকজন সর্পরাজপুর গ্রামে এ কর আদায়ের জন্য গেলে তিতুমীরের অনুগামীদের সাথে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনার পর কৃষ্ণদেব রায় ২/৩ শত লাঠিয়ালসহ সর্পরাজপুর গ্রাম আক্রমণ করেন এবং একটি কাঁচা ঘরের মসজিদ ভস্মীভূত করেন এবং বেশ কয়েকটি বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেন। কিন্তু এ ঘটনার বিচারের সময় রায় যায় হিন্দু জমিদারদের পক্ষে। এ ঘটনার পর জমিদার ও নীলকররা জোটবদ্ধ হয়ে ওয়াহাবিদের উপর আক্রমণ চালান। মিস্কিন শাহ নামে এক ফকিরের সহায়তায় তিতুমীর লাঠিয়াল ও লোকজন জোগায় করেন এবং পুড়া গ্রামে কৃষ্ণদেব রায়ের গৃহ আক্রমণ করেন। জমিদার বাড়ির প্রতিরোধে পিছু হটে তিতুমীর পুড়া গ্রামের বারোয়ারী তলায় একটি মন্দির আক্রমণ করেন এবং একটি গোহত্যা করে সেই রক্ত মন্দিরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এক পুরোহিত বাধা দিলে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর দাঙ্গাকারীরা স্থানীয় বাজার লুট করে।
তিতুমীরের নেতৃত্বে জমিদার ও নীলকরদেরকে আক্রমণ : পূর্বে হিন্দু জমিদাররা মুসলিম তথা ওয়াহাবিদের দাড়ির উপর কর আরোপ করেছিলেন। কিন্তু এবার তিতুমীর নিকটবর্তী হিন্দু জমিদারদের উপর রাজস্ব দাবি করেন। জমিদাররা এর ফলে জোটবদ্ধ হয় এবং নীলকররাও এর সাথে যুক্ত হয়। মোল্লাহাটির নীলকর ডেভিস তিতুমীরের বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে পরাজিত হন। লাউহাটির জমিদারদের সাথে সংঘর্ষে জমিদার দেবনাথ রায় নিহত হন। ফলে তিতুমীরের শক্তি আস্তে আস্তে বেড়ে যায়। তার লোকেরা জমিদার, মহাজন, নীলকর ও ওয়াহাবি বিরোধীদের কাছে রাজস্ব দাবি করেন। তিতুমীরের নির্দেশে প্রজাগণ খাজনা দেওয়া বন্ধ করেন। ১৮৩১ সালে তিতুমীরের নির্দেশে খাসপুরের এক ধনী মুসলমানের গৃহ লুণ্ঠিত হয়। নীলকরের প্রজাগণও খাজনা প্রদান বন্ধ করেন। এ পর্যায়ে তিতুমীর ২৪ পরগনার নারকেলবাড়িয়া গ্রামে ভরতপুরের জাঠদের অনুকরণে বাঁশের তৈরি এক সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করেন। তার বাহিনীকে ভাগিনেয় গোলাম মাসুমের নেতৃত্বে পরিচালনা করা হয় । তিতুমীর নিজেকে 'বাদশাহ' বলে ঘোষণা করেন।
নারকেলবাড়িয়ার সংঘর্ষ :
তিতুমীরের বিদ্রোহের কথা প্রকাশিত হলে বারাসত ও নদীয়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের রিপোর্ট পাওয়ার পর সরকার তিতুমীরের বিদ্রোহ সম্পর্কে অবহিত হন এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য ব্যবস্থা নেন। বারাসতের ম্যাজিস্ট্রেট আলেকজান্ডারকে ২০ জন সিপাহী ও স্থানীয় নীলকুঠি এবং জমিদারের বরকন্দাজসহ তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান করার আদেশ দেওয়া হয়। তিতুমীরের বাহিনীর আক্রমণে ম্যাজিস্ট্রেটের বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয় এবং আলেকজান্ডার কোন রকমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যান। নদীয়ার ম্যাজিস্ট্রেট এডওয়ার্ড এর পর শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন। এরপর কর্তৃপক্ষ কলকাতা থেকে দশম পদাতিক বাহিনীকে কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে পাঠান। কর্নেল স্টুয়ার্ট নারকেলবাড়িয়া কেল্লার সামনে এসে তিতুমীরকে বার বার আত্মসমর্পণের আদেশ দেন। এ আদেশ অগ্রাহ্য করা হলে তিনি গোলার আঘাতে দুর্গটি উড়িয়ে দেন। তিতুমীর গোলার আঘাতে নিহত হন। তিতুমীরের পক্ষে প্রায় ৬০ জন নিহত হন এবং ৩৮০ জন বন্দি হয়। পরে গোলাম মাসুমের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় এবং অন্যান্য বন্দিদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এভাবে তিতুমীরের বিদ্রোহের অবসান হয়। ক
তিতুমীরের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের প্রকৃতি ও লক্ষ্য ঃ নিয়ে তিতুমীরের আন্দোলনের প্রকৃতি সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. তিতুমীরের বিদ্রোহ সাম্প্রদায়িক আন্দোলন ছিল কি না । তিতুমীরের বিদ্রোহ নিছক ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক বিদ্রোহ অথবা কৃষক বিদ্রোহ এবং ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল কিনা এ বিষয়ে দারুণ বিতর্ক দেখা দেয়। সমকালীন লেখক বিহারী লাল সরকার, কুমুদনাথ মল্লিক প্রমুখ তিতুমীরের আন্দোলনকে মরণোন্মাদ মুসলমানদের কা এবং হিন্দু বিরোধী আন্দোলন বলে বর্ণনা করেছেন। ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে, এ আন্দোলন ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর মুসলিম সম্প্রদায়ের আক্রমণ। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, তিতুমীরের আন্দোলন ছিল নিছক সাম্প্রদায়িক মুসলিমদের আন্দোলন। অধুনা ডঃ অভিজিত দত্ত নামে এক গবেষক মুসলিম সোসাইটি ইন ট্রানজিশন গ্রন্থে বলেছেন যে, বারাসত বিদ্রোহ ছিল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ভাবধারায় সমান্তরাল আন্দোলন ।
২. তিতুমীরের আন্দোলনের অর্থনৈতিক চরিত্র ঃ ঐতিহাসিক থর্নটন, হান্টার প্রভৃতি লেখকদের মতে, এ আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ছিল না। কারণ, তারা কেবল হিন্দু জমিদারদের আক্রমণ করেন নি মুসলমান জমিদারদেরও আক্রমণ করেছিলেন। এছাড়া নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল না। বহু মুসলিম জমিদার তিতুমীরের বিরোধিতা করেছিল। এছাড়া হিন্দু জমিদাররা দাড়ির উপর কর ধার্য করেছিল সত্য। তাই বলা যায়, তিতুমীরের আন্দোলন সাম্প্রদায়িক ছিল না এটা ছিল অত্যাচারী জমিদারদের প্রতি আন্দোলন। তাদের ধর্ম বিশ্বাসের উপর আঘাত করা মূলকথা নয়, অত্যাচারী জমিদারদের আক্রমণ করাই ছিল তাদের মূল শর্ত।
৩. তিতুমীর আন্দোলন সামন্ত শ্রেণীর বিরোধী ছিল কিনা : নরহরি কবিরাজ প্রভৃতির মতে, ওয়াহাবি আন্দোলন ছিল জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের শ্রেণী সংগ্রাম। ক্যান্টওয়েল স্মিথ, কুয়েমুদ্দিন আহম্মদ জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহরূপে ওয়াহাবি আন্দোলনকে দেখতে চেয়েছেন। এ কথা সত্য যে, তিতুমীরের বিদ্রোহ জমিদার ও নীলকরদের বিরোধী ছিল। যখনই জমিদারদের নীলকররা সমর্থন করেন তখনই তিতুমীর তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অনেকের মতে, এটা কৃষক আন্দোলন ছিল। কারণ, তিতুমীর কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনে অগ্রসর হন।
৪. রাজনৈতিক লক্ষ্য ভিত্তিক আন্দোলন ঃ তিতুমীর নিজেকে বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। সুতরাং, এ আন্দোলন ছিল একটি স্বাধীনতা আন্দোলন। তার চিন্তা চেতনা ছিল জমিদারদের অত্যাচার থেকে বাংলার কৃষক সমাজকে রক্ষা করে নতুন এক সমাজ গঠন করা কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তার আন্দোলন ব্যর্থ হয় । তিতুমীরের আন্দোলন ব্যর্থতার কারণ : তিতুমীরের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন নিম্নোক্ত কারণে ব্যর্থ হয় । তিনি সকল শ্রেণীর কৃষককে তার পক্ষে আনতে পারেন নি। তার অনুচররা মাঝে মাঝে ধর্মীয় গোঁড়ামির কথা বলায় হিন্দুদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । তিনি কেবলমাত্র কয়েকটি গ্রাম নিয়ে তার সংগঠন করায় আন্দোলনের ব্যাপকতা ছিল না । অনবরত দলত্যাগ এবং সীমান্তের উপজাতিদের আক্রমণাত্মক মনোভাব ।
আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবে সৈয়দ আহমদ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল বেছে নিয়েছিল এবং উপজাতিদের সাহায্য ও সমর্থন পাওয়ার আশাও ছিল । কিন্তু উপজাতিদের অসহযোগিতা ও আক্রমণাত্মক মনোভাবের ফলে তার আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায় । অস্ত্রশস্ত্র, অর্থ ও রসদের যোগানের জন্য ইংরেজদের কৃপার উপর নির্ভরশীল ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত ঘাঁটিগুলোর উপর নির্ভর করা । ৭. তিতুমীরের আধুনিক শিক্ষা না থাকায় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয় রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা তার মনে স্থান পায় নি। তার পরিবর্তে তিনি মধ্যযুগের আদর্শ অনুযায়ী একটি মুসলিম রাজ্য স্থাপনের পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। এ জন্য তার আন্দোলন ব্যর্থ হয় ।
উপসংহার : তিতুমীর ছিলেন বাংলার মুসলমানদের মুক্তির দিশারী। তিনি সমকালীন ব্রিটিশ সরকারের তাবেদার জমিদারদের বিরুদ্ধে বাংলার মুসলমানদের সংঘটিত করেন। কিন্তু সকল শ্রেণীর মুসলমানের এতে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ না থাকায় তা ব্যাপকতা লাভ করে নি। এছাড়া তার যে নীতি ও আদর্শ তা যুগের সাথে সামঞ্জস্য ছিল না। তাই তার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও তিনি সফল করতে পারেন নি। তাই ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক তিনি আন্দোলন করতে গিয়ে পরাজিত ও নিহত হন । প্রশ্না৪৫। আলীগড় আন্দোলন সম্পর্কে একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ লেখ। অথবা, আলীগড় আন্দোলন কি? আলীগড় আন্দোলনের প্রেক্ষা
পট ব্যাখ্যা কর । উত্তরঃ ভূমিকা : ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ব্রিটিশ বেনিয়াদের হাতে চলে যায়। ফলে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হয়। আর বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে পরিণত হওয়ার ফলে এ উপমহাদেশে মানুষের উপর চলতে থাকে শোষণ ও নির্যাতন। তবে ব্রিটিশ শোষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মুসলমান সম্প্রদায়। কারণ, ব্রিটিশ শাসনকে মুসলমানরা কখনও মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেন নি। আর না পারার কারণেই মুসলমানরা সবদিক থেকে পিছিয়ে পড়েন। ঠিক এ ধরনের অবস্থার প্রেক্ষাপটে মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসেবে বা মুসলমানদের জন্য নব আশার আলো নিয়ে আবির্ভূত হন সৈয়দ আহমদ খান। আর এ সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বেই আলীগড় আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল। নিম্নে আলীগড় আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে যার নেতৃত্বে আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল তাঁর পরিচয় দেওয়া হল :
সৈয়দ আহমদ খানের পরিচয় : সৈয়দ আহমদ খান ১৮১৭ সালে (১৭ অক্টোবর) দিল্লির এক প্রখ্যাত সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ মুহম্মদ তকী। তিনি একজন দরবেশ প্রকৃতির লোক ছিলেন। সৈয়দ হাদী তাঁর প্র- প্র-পিতামহ হিরাতের অধিবাসী ছিলেন এবং পরে ভারতে চলে আসেন। সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীর তাঁকে এক হাজারি মনসবদার নিযুক্ত করেন। সৈয়দ আহমদের মাতামহ খাজা ফরিদ উদ্দিন আহমদ প্রথম ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চাকরি করেন। এভাবে উত্তরাধিকার সূত্র থেকে তিনি ১৮৩৭ সালে পড়াশুনা ত্যাগ করে আত্মীয়স্বজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোম্পানির চাকরি গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি দিল্লির সদর আমীনের দপ্তরে ফৌজদারি বিভাগে সেরেস্তাদারের চাকরি গ্রহণ করেন। ১৮৩৯ সালে আগ্রার কমিশনারের নায়েব মুনশি হিসেবে তাঁকে বদলি করা হয়। ১৮৪১ সালে তাঁকে ফতেহপুর সিক্রির মুন্সেফ বা সাব জজ নিয়োগ করা হয়। ১৮৪৬ সালে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর তিনি দিল্লিতে বদলি হন ও ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত দিল্লিতে থাকেন। তিনি তাঁর কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক 'নাইন কমান্ডার অব দি স্টার অব ইন্ডিয়া' উপাধিতে ভূষিত হন। তখন থেকেই তিনি স্যার সৈয়দ বলে খ্যাত হন। তিনি ১৮৯৮ সালে ২৭ মার্চ মারা যান।
আলীগড় আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ভারতে মুসলমানদের অবস্থা বিভিন্ন দিক থেকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ বিদ্রোহের অবসানের পর ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদের প্রতি কঠোর দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন। বাংলা, বিহার ও উত্তর প্রদেশে তাদের ভূসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি ভাষা চালু হলে মুসলমানরা সরকারি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। রাজনীতির পরিবর্তন, কুটিরশিল্পের ধ্বংস সাধন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন প্রভৃতি কারণে মুসলমানদের অর্থনৈতিক অবনতি ঘটে। অন্যদিকে, ভারতীয় হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানিয়ে শিক্ষা সংস্কৃতির সবদিক থেকে এগিয়ে যান এবং সরকারি প্রশাসনের উচ্চপদগুলোও দখল করে। দেশ ও জাতির এ সন্ধিক্ষণে স্যার সৈয়দ আমহদ খানের আবির্ভাব হয়। তিনি ভারতীয় মুসলমানদের জন্য নব আশার আলো নিয়ে হাজির হন। তিনি এ অভিমত পোষণ করেন যে, একমাত্র ব্রিটিশ শাসকদের সাথে সহযোগিতা স্থাপনের মাধ্যমেই ভারতে মুসলমানদের অবস্থার উন্নতি করা সম্ভব। তিনি ব্রিটিশ শাসকদের সাথে মুসলমানদের সমঝোতা স্থাপনের চেষ্টা করেন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে ব্রিটিশ সরকার মুসলমানদেরকেই দায়ী করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের এ মনোভাব দূর করার জন্য চেষ্টা করেন। তিনি তাঁর ভারতে বিদ্রোহের কারণ গ্রন্থে লেখেন যে, ভারতীয়দের সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসক শ্রেণীর অজ্ঞতা সিপাহি বিদ্রোহের মূল কারণ। তিনি ভারতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও মতামতের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষার জন্য বড়লাটের আইন পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব থাকার প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্বারোপ করেন। তাঁর পরামর্শ অনুসারে ১৮৬১ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইনে বড়লাটের আইন পরিষদে ভারতীয় সদস্যদের গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়। এভাবে মুসলমানদের অবস্থার উন্নয়ন সাধন করতে গিয়ে আলীগড় আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ।
আলীগড় আন্দোলনের স্বরূপ : সৈয়দ আহমদ ১৮৬০ সালে ভারতের 'রাজভক্ত মুসলমান' নামে একটি পুস্তিকা রচনা করে ইংরেজদের ভুল ধারণা নিরসনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি উপলব্ধি করেন যে, মুসলমানদের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষা। ইংরেজদের সাথে সহযোগিতা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করে অন্যান্য সম্প্রদায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মুসলমানরা আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে টিকে থাকতে পারবে না। তাই তিনি বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, ব্রিটিশ শাসনের বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে শাসকদের মধ্যে সম্প্রীতি ও আনুগত্য স্থাপনের মাধ্যমে তাদের দেওয়া সুবিধাগুলো সদ্ব্যবহার করা উচিত। তাই মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য ভাবধারা বিকাশের লক্ষে গাজীপুরে একটি Scientific Society গঠন করেন। ১৮৬৪ সালে উর্দু ও হিন্দু ভাষায় ইউরোপীয় গ্রন্থের অনুবাদ করাই ছিল এ সমিতির প্রধান লক্ষ্য। পরবর্তীকালে এ সমিতির দপ্তর আলীগড়ে স্থানান্তরিত করা হয়, তখন সৈয়দ আহমদ খান সরকারি কর্মসূত্রে আলীগড়ে বদলি হন। রাজনীতির প্রশ্নে স্যার সৈয়দ আহমদ খান ইংরেজ শাসকদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটলে এবং ইংরেজদের প্রতি মুসলমান সমাজের আনুগত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে পৌছাতে চান। এ প্রসঙ্গে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রতিষ্ঠিত উত্তরপশ্চিম প্রদেশের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এরপর তিনি কর্মজীবনের ধারাবাহিকতায় লন্ডন যান। পরে তিনি মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে চেষ্টা করেন যা আলীগড় আন্দোলনের সূচনা হয়।
আলীগড় আন্দোলন : স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজে যে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা করেন তা একটি সর্বাত্মক আন্দোলন ছাড়া সম্ভব ছিল না। মুসলমানদের পুনরুজ্জীবনের জন্য এ যে আন্দোলন তাই আলীগড় আন্দোলন নামে অভিহিত। আলীগড় নামকরণ এ কারণে যে, স্যার সৈয়দ আহমেদ ইতোমধ্যেই আলীগড়ে Scientific Society গঠন করেছিলেন। আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেট পত্রিকা আলীগড়ের জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এছাড়া আলীগড় ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল। আবার আলীগড় আন্দোলনের যে সামাজিক ভিত্তি মুসলিম উচ্চ শ্রেণীর জমিদার এবং প্রাক্তন মুঘল রাজকর্মচারীদের পরিবার এটা সংখ্যাগতভাবে জোরদার ছিল আলীগড়েই। এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা : বিলাত থেকে ফিরে এসে সৈয়দ আহমদ ১৮৭০ সালে 'তাহজীব আল আখলাক' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। মুসলমানদের মানসিকতার পরিবর্তন ও বুদ্ধির বিকাশ সাধনেও ইউরোপীয়দের মধ্যে আধুনিকতা আনয়নে এ পত্রিকার অবদান ছিল অসামান্য। আর এ 'তাহজীব' আলীগড় আন্দোলনের ভিত্তি। এছাড়া সৈয়দ আহমদ ১৮৭৭ সালে মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। সৈয়দ আহমদের ইচ্ছা ছিল অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুকরণে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি না পাওয়ায় তিনি একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২১ সালে কলেজটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। ইংরেজ অধ্যক্ষদের তত্ত্বাবধানে এ কলেজে কলা ও
বিজ্ঞান সমন্বিত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে প্রগতিমূলক মনোভাবের উন্মেষ ঘটাতে এ কলেজের অবদান ছিল অপরিসীম। এ কলেজ প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে আলীগড় মুসলমানদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। এ কলেজকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে মুসলমানদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা আবর্তিত হয়। আর এ কলেজে এমন কয়েকজন জাতীয় নেতার সৃষ্টি হয় যারা আলীগড় আন্দোলনকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান । দৃষ্টান্তস্বরূপ খিলাফত নেতা মৌলানা মোহাম্মদ আলী, লিয়াকত আলী খান প্রমুখ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
অল ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা : সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের মধ্যে পাশ্চাত্য উদারনৈতিক ভাবধারা প্রসারের উদ্দেশ্যে ১৮৮৬ সালে ২৭ ডিসেম্বর আলীগড় অল ইন্ডিয়া মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন। এ সমিতি দেশের সর্বত্র সভা সমাবেশ করে আলীগড় আন্দোলনের বার্তা পৌছে দেয়। শেষ পর্যন্ত সৈয়দ এ সমিতি মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তির একটি হাতিয়ারে পরিণত হয়। সমগ্র ভারতে এর শাখা গড়ে উঠে। প্রকৃতপক্ষে, আহমদ মুসলমান জনগণেরর মধ্যে নবজাগরণের সূত্রপাত করেন। এভাবে তিনি আলীগড় আন্দোলনের সূচনা করেন। আলীগড় আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষ্য : নিম্নে আলীগড় আন্দোলনের আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পর্কে আলোচনা করা হল : ভারতীয় মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা ও শাসকদের প্রতি আগ্রহী করে তোলা । আধুনিক শিক্ষার বিস্তার সাধান এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের বাধাবিপত্তি দূর করা। নৈতিক শিক্ষার উন্নতির মাধ্যমে মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা। মুসলিম সংস্কৃতিকে যুগোপযোগী করে উপস্থাপন করার গ্রহণযোগ্য উপায় উদ্ভাবন করা। মুসলমানদের প্রকৃত অবস্থা এবং দুর্দশা সম্পর্কে ব্রিটিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য সৃষ্টির মাধ্যমে উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করা ।
আলীগড় আন্দোলনকে সম্প্রসারিত করার জন্য সৈয়দ আহমদ ১৮৮৫ সালে 'মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স' নামে একটি সমিতি গঠন করেন। এ সমিতি দেশে সভা সমাবেশের মাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা সর্বত্র পৌঁছে দেয় এবং মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের হাতিয়ারে পরিণত হয়।
আন্দোলনে সৈয়দ আহমদ খানের কর্মসহচর ছিলেন ইসলামের প্রতি নিষ্ঠাবান উদারচেতা পণ্ডিতবর্গ। ইসলামের মহিমা প্রকাশের অপরিসীম উৎসাহ নিয়ে চিরাগ আলী ‘আযম আল কালাম' নামক গ্রন্থ রচনা করেন ।
আলতাফ হোসেন আলী তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'মোসাদ্দাস' এ মুসলমানদের অবস্থা তুলে ধরে আলীগড়ের সপক্ষে মুসলিম মতামত গঠনে সহায়তা করেন। আল্লামা শিবলী, ড. নজির আহমদ, নবাব মহশিনুল হক, নবাব ভিখারুলমূলক ব্যক্তিবর্গ প্রমুখ আলীগড়ের সভ্য ছিলেন। সৈয়দ আহমদের পুত্র সৈয়দ মাহমুদ তাঁর পারদর্শিতা দিয়ে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করেন। আলীগড় কলেজে শিক্ষকতায় এগিয়ে আসেন মিওডর বেক, স্যার ওয়াল্টার ব্যালে, টমাস আরনল্ডের মত উল্লেখযোগ্য ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ। আর এভাবেই আলীগড়ে নব বর্ধমান মুসলিম সমাজ, পাশ্চাত্য সমাজ এবং শিক্ষার পরিবেশ একীভূত হয়েছিল।
আলীগড় আন্দোলনের গুরুত্ব/তাৎপর্য : আলীগড় আন্দোলন ছিল ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে আলীগড়ের গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
আলীগড় আন্দোলনের কেন্দ্র আলীগড় কলেজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে তেমন সফল হয়েছিল একথা বলা সমীচীন নয়। কারণ, ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট যত সংখ্যক ছাত্রছাত্রী স্নাতক হিসেবে প্রতি বৎসর উত্তীর্ণ হতো এর তুলনায় আলীগড়ের সংখ্যা ছিল নগণ্য। তবে আলীগড় আন্দোলন এবং এর দ্বারা প্রভাবিত আলীগড়ের ছাত্রসমাজ হতে ভারতবর্ষে এমন এক শ্রেণীর অভিজাত মুসলিমের সৃষ্টি হয়েছিল যার পরবর্তীকালে ভারতীয় রাজনীতি তথা সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল ।
ইংরেজ সরকার আলীগড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে কেবল সাহায্য করেন নি, স্যার সৈয়দ আহমদকে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বেও স্থাপন করেছিল। যদিও তিনি ব্যক্তিগতভাবে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের সমর্থন লাভ করেন নি। মুসলিম কৃষক বা মুসলিম অভিজাত কোন পক্ষেরই ব্যাপক সমর্থন স্যার সৈয়দ আহমদের প্রতি ছিল না। ফ্রান্সিস রবিনসন তাই মন্তব্য করেছেন যে, “আলীগড় কলেজ ও স্যার সৈয়দ আহমদ উভয়ই ভারতের ইংরেজ সরকারের সৃষ্টি। আর এ সৃষ্টির দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায়কে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে মদদ জোগান দেয় ।
সবশেষে বলা যায় যে, স্যার সৈয়দ আহমদ প্রতিষ্ঠিত মোহামেডান এডুকেশন্যাল কনফারেন্স তাঁর জীবদ্দশায় রাজনৈতিক প্রস্তাব হিসেবে বিরত থাকলেও তার মৃত্যুর পরবর্তীকালে জাতীয় কংগ্রেসের বিপক্ষ হিসেবেই রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়। এছাড়া ১৯০৬ সালে যে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় সে ক্ষেত্রে সৈয়দ আহমদের অবদান ছিল।
উপসংহার : অতএব বলা যায় যে, স্যার সৈয়দ আহমদ খান ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের পরিত্রাণের জন্য আজীবন চেষ্টা করেন। এছাড়া তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন চেতনার সঞ্চার হয়। এছাড়া বলা যায় যে, সৈয়দ আহমদ খান শুধু ভারতে নয় উপমহাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তবে তাঁর কর্মপ্রেরণা ছিল অন্যতম। সৈয়দ আহমদ খান ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যে প্রেরণার সঞ্চার করেন তাঁর শিক্ষা থেকে তারা অধিকতর সচেতন হয়। তাই কৌশলে ব্রিটিশ শাসনকে পাস কাটিয়ে চলার নীতি ত্যাগ করেন। ফলে, তিনি বাঙালি মুসলমানদের জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক বলে খ্যাত হন।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]