ভূমিকা : প্রাগৈতিহাসিককাল থেকে মানবসভ্যতার অগ্রগতির বর্তমানকাল পর্যন্ত ধারাবাহিক উন্নতিই হচ্ছে সভ্যতা। সভ্যতার কোন সঠিক সংজ্ঞা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। সাধারণ অর্থে, সভ্যতা বলতে বুঝায় মানবজাতির বিকশিত অবস্থার একটি। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সভ্যতা গড়ে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সভ্যতার চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, ধর্মীয় নেতাগণ মানবজীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধশালী করার জন্য মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবনধারার উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে সভ্যতার সৃষ্টি করেছেন।
সভ্যতা ঃ সভ্যতার ইংরেজি প্রতিশব্দ হল 'Civilization'। এ শব্দটি 'Civis' or 'Civitas' থেকে এসেছে, যার অর্থ নাগরিক। 'Civilization' শব্দটি আমাদের কাছে অতিপরিচিত, যার আভিধানিক অর্থ হল সভ্যতা। দার্শনিক ভলতেয়ার সর্বপ্রথম 'Civilization' শব্দটি ব্যবহার করেন। এছাড়া কোন অঞ্চল বা অঞ্চলসমূহে যখন একটি জনগোষ্ঠী নগরপত্তন করে এক উন্নততর জীবনব্যবস্থা গড়ে তোলে, তখন তার অগ্রগতির সহায়ক নিয়ামক হিসেবে উদ্ভাবিত হয় লিখন পদ্ধতি, আইন, সরকার ব্যবস্থা, বাণিজ্য, নব প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সুস্পষ্ট ধর্মীয় দর্শন, তখন তাকে সভ্যতা বলা হয়। এ সভ্যতা সাধারণত মৌলিক ও জটিল সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের মধ্যদিয়ে গড়ে উঠে ।
প্রামাণ্য সংজ্ঞা : বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী সভ্যতা সম্পর্কে বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। নিম্নে সে বিষয়ে আলোচনা করা হল :
মন্টেস্কু এবং হান্টিংটন বলেছেন, “সভ্যতা হচ্ছে ভৌগোলিক তথা প্রাকৃতিক পরিবেশের আশীর্বাদপুষ্ট এক ফসল।” মর্গান (Morgan) তাঁর 'Ancient Society' গ্রন্থে বলেছেন, “সভ্যতা হচ্ছে বিবর্তন নামক সিঁড়িটির শীর্ষ ধাপ । যে সমাজে লেখ্য ভাষা ও বর্ণমালা আছে, ধাতুর ব্যবহার ও লিখিত দলিলের প্রচলন আছে সে সমাজই সভ্য।”
Tylor, "A civilization is a culture which has attained a degree of complexity usually characterized by urban life. " অভাব, প্রয়োজন ও তাগিদ সভ্যতা উন্মেষের জন্য দায়ী।
ম্যাকাইভার ও পেজ এর মতে, “সভ্যতা অর্থে আমরা বুঝি মানুষ তার জীবনধারণের ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকল্পে যে যান্ত্ৰিক ব্যবস্থা বা সংগঠন সৃষ্টি করেছে তারই সামগ্রিক রূপ। কেবল যে আমাদের সামাজিক সংগঠনের নানারূপ নীতি সভ্যতার অন্তর্গত তা নয়, নানাবিধ কারিগরি কলাকৌশল ও বাস্তব যন্ত্রপাতি এর অন্তর্ভুক্ত।”
পাসকুলার জিসবার্ট এর মতে, “সংস্কৃতির সে স্তরকে সভ্যতা বলা হয়, যে স্তরে একটি অপেক্ষাকৃত উন্নত ও মিশ্র সমাজে বহুসংখ্যক জনমানবের সমাবেশ সৃষ্টি করেছে, যাদের আমরা নগর আখ্যা দিয়ে থাকি।”
জিসবার্টের আরও বক্তব্য হল, সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র হল বহু জনমানব অধ্যুষিত নগরগুলো এবং এ সভ্যতা মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের একটি পরিণত স্তর। কূরছুমের মা
ম্যাকাইভার সংস্কৃতি ও সভ্যতার পার্থক্য করতে গিয়ে বলেছেন, আমরা যা আছি তাই আমাদের সংস্কৃতি, আর আমাদের যা আছে তাই আমাদের সভ্যতা। সংস্কৃতি হচ্ছে সামাজিক আমিত্ব, আর সভ্যতা হচ্ছে মানব সৃষ্টি। যখন মানুষ প্রকৃতিতে জ্ঞানবিজ্ঞান ও কারিগরি পদ্ধতি দ্বারা আয়ত্তে আনতে সক্ষম হয় এবং শিক্ষাদীক্ষায়, জ্ঞানবিজ্ঞানের তথা দৰ্শন, সাহিত্য, শিল্প-বাণিজ্য, কলা কারিগরিতে মানুষের সামগ্রিক জীবনধারার পূর্ণ বিকাশ ঘটে সে অবস্থাকে সভ্যতা বলা হয় ।
সভ্যতা বিকাশে নদী ও সম্পদের ভূমিকা ঃ নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল :
১. মিশরীয় সভ্যতা : মিশরের ভৌগোলিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে হেরোডোটাস বলেছেন, “মিশর নীলনদের দান।” মধ্য আফ্রিকার উচ্চ ভূমিতে উৎপন্ন হয়ে নীলনদ ভূমধ্যসাগরে পতিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৭৫০ মাইল প্রবাহিত হয়েছে। নীলনদের পানি সঞ্চিত হয়ে বদ্বীপের ১২,৫০০ মাইল এলাকা কৃষিযোগ্য ভূমিতে পরিণত হয়েছিল, প্লাবনের সময় নীল অববাহিকায় পলি সঞ্চিত হয়ে উচ্চ হয়ে উঠত। কৃষিকাজের জন্য এ ঊর্ধ্ব ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল জনবসতি। নীল অববাহিকায় পলি সঞ্চিত হয়ে/বাঁধ দিয়ে অনেকে কৃষিকাজ করত ।
এছাড়া বাঁধ নির্মাণ কার্য পরিচালনার জন্য ফারিগর, শ্রমিক, পরিচালক ইত্যাদি অনেক ধরনের মানুষের দরকার হতো। নগরবাসী কারিগররা মানুষের উৎপন্ন উদ্বৃত্ত শস্য খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত। এ সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পর সভ্যতার জন্ম হতে পেরেছিল। মোহনার কাছাকাছি অববাহিকায় ছিল প্যাপিরাস জাতীয় নলখাগড়ার জঙ্গল, খেজুর, ডুমর ইত্যাদি নানা গাছ। এসব গাছ থেকে খাদ্য, ঘরবাড়ি তৈরির প্রচুর সরঞ্জাম পাওয়া যেত। মিশরের পার্বত্য অঞ্চলে গ্রানাইড, চুনাপাথর ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে ছিল। আর সুরিয়ান পাহাড়ে ছিল প্রচুর সোনা। নীল অববাহিকায় এ উর্বর জমি প্রাকৃতিক সম্পদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা।
২. মেসোপটেমীয় সভ্যতা : টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর জলধারাকে কেন্দ্র করে এ দুই নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ব্যাবিলনীয়, এসেরীয়, সুমেরীয় ও ক্যালডীয় প্রভৃতি সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল, যাকে এককথায় বলা হয় মেসোপটেমিয়া সভ্যতা। প্রতি বছর মার্চ থেকে জুলাই পর্যন্ত বরফগলা পানিতে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের দুই তীর প্লাবিত হয়ে যেত, তীরে পলি জমত এবং এখানকার উর্বর ভূমি ছিল কৃষিকাজের উপযোগী। এ অঞ্চলে প্রচুর চুনাপাথর ও কাদামাটি ছিল। উল্লেখযোগ্য পাহাড়সমূহে ছিল গবাদিপশু, ছাগল, সিংহ এবং নিচে ছিল প্রচুর মাছ। এ ভূখণ্ডের উত্তরে আর্মেনিয়ার পার্বত্যাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বে পারস্য উপসাগর, পূর্বে এলাম পাবর্ত্যাঞ্চল এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর অবস্থিত ছিল। দুই নদীর উৎসসমূহ থেকে শুরু করে পারস্য উপসাগরে পতিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নদী দু'টি নৌ বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
•
৩. সিন্ধু সভ্যতা : প্রাচীন ভারতের পঞ্চনদ বিধৌত অঞ্চল পাঞ্জাব ও ইন্ডাস নামে পরিচিত সিন্ধুনদ বিধৌত অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা। নদী তীরের উর্বর ভূমির অনুকূলে এবং পরিবহণে সুযোগ সৃষ্টির মধ্যদিয়ে এ সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল । ভারতের প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি ও বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সিন্ধুর বন্দরগুলো ব্যবহৃত হতো ।
৪. পারস্য সভ্যতা : প্রাচীন পারস্য সভ্যতার উন্মেষে সেখানকার নদী ও সম্পদ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। আরব মরুভূমির সীমান্ত রেখায় দক্ষিণাঞ্চলীয় তৃণভূমি ও দানিয়ুব নদীর নিম্ন অঞ্চলের পূর্বদিকে এবং কৃষ্ণ সাগরের উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিণ রাশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ উত্তরাঞ্চলীয় তৃণভূমি যাযাবর মানুষদের বসতি গড়ে তোলার উৎসাহ যোগায়। উপকূলীয় পৰ্বত শ্ৰেণী চাষের পক্ষে বাধাস্বরূপ হলেও পর্বতের পাদদেশে বনজ সম্পদ সোনা, রুপা, লোহা, তামা, সিসা ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে ছিল। দেশের অভ্যন্তরে গম, যব ইত্যাদির চাষ ও পশুপালনের সুবিধা ছিল।
৫. গ্রিক সভ্যতা : গ্রিসের সভ্যতা বিকাশে সমুদ্রের প্রভাব ছিল অপরিসীম। গ্রিসের তিনদিকের উপকূল আর্ডিয়াটিক সাগর, ভূমধ্যসাগর, ইজিয়ান সাগর বিধৌত। এশিয়া মাইনরের নৈকট্য এবং ইজিয়ান এর বক্ষে অসংখ্য দ্বীপমালার অস্তিত্ব গ্রিকদের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্যে উৎসাহিত করে তুলেছিল। গ্রিসের খনিজ সম্পদ যেখানে লোহা, রুপা, সোনা, কাদামাটি, মার্বেল পাথর ছিল সেখানে, ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার ও কারিগরি শিল্পে সহায়তা করেছিল।
৬. রোমক সভ্যতা : পূর্ববর্তী অন্যান্য সভ্যতার মত রোমক সভ্যতা গড়ে উঠার পিছনেও তার ভৌগোলিক অবস্থার প্রভাব ও নদনদী বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। টাইবার নদী ভূমধ্যসাগর, এড্রিয়টিক সাগর, ইট্রাকান সাগর, রোমক সভ্যতা বিকাশে সাহায্য করেছিল। প্রাপ্ত খনিজসম্পদ স্পেন, মর্মর পাথর, তামা, সোনা, লোহা প্রভৃতি কারিগরি শিল্প বিকাশে ও বহির্বাণিজ্যে সহায়তা করেছিল। উর্বর জমি থাকার কারণে এখানে কৃষিক্ষেত্রের বিকাশ ঘটেছিল ।
৭. চৈনিক সভ্যতা : এছাড়া চীনের তিনটি প্রধান অঞ্চলকে ঘিরে সভ্যতার চারণভূমি গড়ে উঠেছিল। প্রথমটি হোয়াংহো তীরবর্তী অঞ্চল, দ্বিতীয়টি ইয়াংসিকিয়াং তীরবর্তী অঞ্চল এবং তৃতীয়টি দক্ষিণ চীনের ভূখণ্ড। হোয়াংহো নদী ও ইয়াংসিকিয়াং নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের উর্বরতা ও পরিমিত বৃষ্টিপাত চীনের কৃষি সভ্যতাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়েগিয়েছিল। অন্যদিকে, বহির্বাণিজ্য পর্যন্ত হয়েছিল উন্মুক্ত। দক্ষিণ চীনের পার্বত্যাঞ্চল তামা, টিন, সীসা প্রভৃতি খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল ।
.
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায়, আদিম যুগ থেকে মানুষ কখন কিভাবে সভ্যতার আলোকপ্রাপ্ত হল তা বলা যায় না। তবে সভ্যতার উন্মেষের মূলে ছিল লোকসংখ্যা বৃদ্ধি, ক্রমহ্রাসমান নাগরিক উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ, সর্বোপরি প্রাচীন বর্বর যুগ থেকে বর্তমান বিংশ/একবিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অভাবনীয় উন্নতি তার মূলে রয়েছে ধারাবাহিক সভ্যতা। প্রাচীনকালে দুর্গম পথ উপযোগী বাহনের অভাব, উচ্চ পর্বত শ্রেণী, গভীর বর্ণ মরুভূমি এবং মহাসাগর মানুষের সামনে ছিল দুর্গম বাধা। তাই মানুষের জীবনযাপনের জন্য নদনদী ও দেশজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ছিল । তাই নদী তীরবর্তীতে অনেক সভ্যতার উদয় হয়েছিল ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত