ভূমিকা : প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের চর্চা যখন শুরু হয়, তখন সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না। কারণ বিংশ শতকের গোঁড়ার দিক পর্যন্ত এ ধারণা প্রচলিত ছিল যে, প্রাচীন ভারতের সভ্যতা বৈদিক যুগ হতে ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন, “হিন্দু সভ্যতার শিকড় বৈদিক যুগ হতে দেখা যায়।” কিন্তু ১৯২২ সালে যখন ভি ি হয়, তখন ইতিহাস ২০০০ বছর পিছিয়ে যায়। এ সভ্যতা সিন্ধুনদের অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল বলে একে সিন্ধু সভ্যতা' নামে অভিহিত করা হয় । প্রাচীনকালের উল্লেখযোগ্য সভ্যতাগুলোর মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
সিন্ধু সভ্যতার পরিচয় ঃ ১৯২০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসবেত্তা ও প্রত্নতাত্ত্বিকগণের মধ্যে ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডিরেক্টর স্যার জন মার্শালের এক ঘোষণায় বিপুল আগ্রহের সৃষ্টি করে। তিনি রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের চেষ্টায় বর্তমান পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলার মহেঞ্জোদারো নামক স্থানে ১৯২২-২৩ খ্রিস্টাব্দে এবং প্রায় একই স বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবের মন্টেগোমারি জেলায় ডি আর সাহানির চেষ্টায় হরপ্পা নামক স্থানে অতি প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে বলে জানান। হরপ্পা নগরটি গড়ে উঠেছিল সিন্ধুর উপনদী রাভীর তীরে। আর মূল সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠেছিল মহেঞ্জোদারো নগরী। ২৩০০-১৭০০ খ্রিঃ পূর্ব এ সময়ের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য : সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন দিক বা বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা
১. সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল : সিন্ধু সভ্যতার সর্বাধিক সমৃদ্ধির কাল ছিল ২৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ থেকে ২০০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত। ২৫০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দের পূর্বে কয়েকশ বছরব্যাপী সিন্ধু সভ্যতা ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে। অপরপক্ষে, ২৩০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দের পরে ক্রমশ সিন্ধু সভ্যতার অবক্ষয় হতে থাকে। অবশেষে ১৫০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দের মধ্যেই বহিরাগত আর্যদের আক্রমণে সিন্ধু সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
২. সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি : সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, রাজপুতনা, গুজরাট এবং কাশ্মীর ও উত্তর প্রদেশের অংশবিশেষ জুড়ে সিন্ধু সভ্যতা বিস্তৃত ছিল। বিশাল এলাকা জুড়ে সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার এ সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
৩. সিন্ধু সভ্যতার জাতি : সিন্ধু সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এ সভ্যতা গড়ে তুলেছিল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ একত্রে মিলিত হয়ে। যেমন- অস্ট্রিক, ভূমধ্যসাগরীয়, মঙ্গোলীয় ও আলপাইন জাতির মানুষ এখানে বাস করত। তাদের মধ্যে দ্রাবিড় ও সুমেরীয় জাতিগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট।
৪. ব্রোঞ্জযুগীয় সভ্যতা : সিন্ধু সভ্যতার একটি অনন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ সভ্যতা ছিল ব্রোপ্তযুগীয় সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় হাতিয়ার ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল মূলত ব্রোঞ্জ দ্বারা তৈরি। তারা লোহার ব্যবহার জানত না।
৫. উন্নত নাগরিক সভ্যতা : সিন্ধু সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এ সভ্যতা ছিল অত্যন্ত উন্নত নাগরিক সভ্যতা। নগরগুলো তৈরি হয়েছিল সুপরিকল্পিতভাবে।
৬. নগরপরি না : সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলো বিশেষত হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো নগর দু'টি ইটের ভিত্তিভূমির উপর নির্মিত হয়েছি । উভয় নগরের একাংশ ছিল প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত। অপর অংশ ছিল সাধারণ নগরী। সামষ্টিক স্নানাগার, বিশাল শস্যাগার, ব্যাংক কোষাগার ইত্যাদি নাগরিক সভ্যতার উপকরণগুলোও পরিকল্পিতভাবে তৈরি হয়েছিল।
৭. উন্নত রাস্তাঘাট : সিন্ধু সভ্যতার যুগে শহরের রাস্তাঘাটগুলো ছিল পাকা, রোজা ও চওড়া। মহেঞ্জোদারোতে ৯ ফুট হতে ৩৪ ফুট পর্যন্ত প্রশস্ত রাস্তা আবিষ্কার হয়েছে। রাস্তার দু'পাশে সারিবদ্ধভাবে নির্মিত হয়েছিল ইটের তৈরি দালান।
৮. উন্নত পয়ঃপ্রণালী : সিন্ধু সভ্যতার যুগে পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল উন্নত এবং আধুনিক ধরনের। পাকা রাস্তার নিচ দিয়ে ছিল আচ্ছাদিত নৰ্দমা । নর্দমার স্থানে স্থানে ছিল সোকপিট ।
৯. রাজনৈতিক জীবন : সিন্ধু সভ্যতার জনগণের রাজনৈতিক জীবন ও শাসনপ্রণালী সম্বন্ধে ধারণা করা কঠিন। কেননা, মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার নগর বিন্যাস একই রকম ছিল। প্রতিটি নগরের ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক দুর্গ ছিল। সিন্ধু নগরগুলোর শক্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করত তাদের প্রশাসনের দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের উপর এবং নিম্ন সভ্যতার গোড়াপত্তনের বৈশিষ্ট্যই হল মূল কারণ।
১০. অর্থনৈতিক জীবন। হরপ্পার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই ছিল কৃষিজীবী এবং তারা শিল্প ও বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। সিন্ধু শহরগুলোর বাইরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কৃষিকাজও চলত। শাসকগোষ্ঠীর প্রতি তারা মোটেই বিপজ্জনক ছিল না এবং অর্থনৈতিক কারণে এটা ছিল অপরিহার্য।
১১. সামাজিক জীবন। সিন্ধু উপত্যকার সমাজ কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। যথা ঃ ধনী, পুরোহিত, মধ্যবিত বণিক, কারিগর ও শ্রমিক। তবে বর্তমানকালের জনগণের ন্যায় সিন্ধু উপত্যকার শ্রমিক ও নাগরিকগণ অনেক বেশি
মুখস্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করত।
১২. ধর্মীয় জীবন। সিন্ধু উপত্যকায় অসংখ্য পোড়ামাটির নারীমূর্তি পাওয়া গেছে। তাতে মনে হয় সিন্ধুবাসীদের মধ্যে মূর্তিপূজা খুবই জনপ্রিয় ছিল। তাছাড়া কতকগুলো ধ্যানমগ্ন মূর্তি পাওয়া যায়। এ ধ্যানমগ্ন যোগীর সভায় তিনটি শির ও নানা জীবজন্তু দ্বারা পরিবেচিত। তাতে বুঝা যায় তারা শিবের পূজাও করত।
১৩. ব্যবসায় বাণিজ্য : সিন্ধু উপত্যকার মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি। তাদের অপর পেশা ছিল ব্যবস বাণিজ্য। ভারতের ভিতরে তারা ব্যবসায় বাণিজ্য করত। সুমেরীয় শিল্পজাত ও বিলাস দ্রব্যসামগ্রী দিয়ে সিন্ধুজাতি ব্যবসা করত। বিনিময় প্রথা অনুসারে তারা ব্যবসায় বাণিজ্য করত। কারণ তখনও মুদ্রার প্রচলন আরম্ভ হয় নি।
১৪. কৃষিকাজ : সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও বেশিরভাগ মানুষ কৃষিকার্যে নিযুক্ত ছিল। এরা প্রধানত গম, ধান ও তুলার চাষ করত। সিন্ধু উপত্যকায় অনেক বাড়িতে সুতা কাটার চাকু পাওয়া গেছে। তারা এর দ্বারা তুলা ও পশমের সুতা কাটত।
১৫. পোশাক পরিচ্ছেদ : পোশাক পরিচ্ছদের জন্য তারা প্রধানত সুতা ও পশম ব্যবহার করত। তখন দু'অংশবিশিষ্ট পোশাকের প্রচলন ছিল। তাদের উপরের দিকটা অনেকটা বড় ছিল এবং নিম্নের অংশ ছিল ছোট কাপড়। স্ত্রী পুরুষের পোশাকের তেমন পার্থক্য ছিল না। তারা উভয়ই অলংকার ব্যবহার করত।
১৬. জীবজন্তু ঃ সিন্ধু উপত্যকার গৃহপালিত জীবজন্তুর মধ্যে মহিষ, উট, ভেড়া, ষাড় প্রভৃতির কংকাল পাওয়া গেছে। তাছাড়া এদের ছবিসহ বিভিন্ন সিলমোহরও পাওয়া গেছে।
১৭. মৃৎশিল্প : মৃৎশিল্প ও রঙের শিল্পে সিন্ধুবাসী উন্নত ছিল। মৃৎশিল্পীগণ কলসি, থালা ও অন্যান্য মৃৎপাত্র তৈরি করত । সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে মজবুত করত। তারপর বিভিন্ন রং পোড়ামাটির গায়ে লাগাত ।
১৮. ভাস্কর্য শিল্প : সিন্ধুযুগের অসংখ্য পাথর ও ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য পাওয়া গেছে। এছাড়া এতে মানুষ, গরু, বিভিন্ন জীবজন্তুর ভাস্কর্য চিত্র মাটির পাত্রে আঁকত ।
১৯. সিলমোহর : সিন্ধু সভ্যতার সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন অবশ্যই সিলমোহর। প্রায় ২০০০ সিলমোহর এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে, যাদের অধিকাংশের গায়ে ছোট ছোট লিপি খোদাই করা ছিল।
২০ লোহার অনুপস্থিতি : সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কোথাও লোহা পাওয়া যায় নি। স্বর্ণ, তামা, ব্রোঞ্জ ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়, কিন্তু লোহার কোন ব্যবহারই দেখা যায় না। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, লোহার ব্যবহার সিন্ধু সভ্যতায় ছিল না।
২১. ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা : সিন্ধু সভ্যতার উপর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা। মহেঞ্জোদারোতে কোন পাথরের তৈরি ঘরবাড়ি পাওয়া যায় নি। সর্বত্র পোড়া ইটের ব্যবহার দেখা যায়। ফলে সময় সঃ । অট্টালিকাগুলো মাটির নিচে ধসে গেলে সে স্থানে অনুরূপ অট্টালিকা তৈরি করার প্রথা মহেঞ্জোদারোতে ছিল ।
২২. শস্যাগার : হরপ্পা দুর্গের উত্তরে প্রতিষ্ঠিত বিরাট শস্যাগার ছিল। আয়তন (১৬৯ × ১৩৫) বর্গফুট । বাসাম একে রাষ্ট্রীয় গুদামঘরের সাথে তুলনা করেছেন। পাথরের উপর তৈরি উঁচু মঞ্চ থেকে বুঝা যায় যে, এখানে শস্য মাড়াই করা হতো। সংলগ্ন গৃহগুলোতে শ্রমিকদের বাসস্থান ছিল। হুইলার বলেছেন, “কি পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য, কি বিস্ময়কর উৎকর্ষ সিন্ধু উপত্যকার।” শস্যাগারগুলোর সাথে তুলনীয় কোন শস্যাগার খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বে পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যায় নি 1
২৩. পরিবহণ ব্যবস্থা : স্থলপথে কাঠের গাড়ি এবং নৌ পথে নৌকা ছিল সিন্ধু অধিবাসীদের প্রধান পরিবহণ বাহন । এতে মালপত্র আনানেওয়া হতো। উট ও গাধা ছিল স্থলপথের অন্য দু'টি বাহক।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বা বিভিন্ন দিক এ সভ্যতাকে স্বতন্ত্র সভ্যতা হিসেবে বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছে। এ সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীন নদীমাতৃক সভ্যতাসমূহের মধ্যে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত