ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে সিন্ধু সভ্যতা একটি গৌরবময় সভ্যতা। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীন সভ্যতায় রোমানদের পূর্বে সিন্ধু সভ্যতার মত উন্নত সভ্যতা আর ছিল না। সিন্ধু উপত্যকায় খননকার্যের ফলে এক বিস্তীর্ণ এলাকায় হরপ্পা সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়, যার নগর পরিকল্পনা ছিল অসাধারণ ও অভাবনীয় ।
সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা : বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে সিন্ধু সভ্যতা তাদের পরিকল্পিত নগর প্রতিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে। তাদের নগর ব্যবস্থা যেমন ছিল পরিকল্পিত ঠিক তেমনি ছিল সুসংঘটিত। নিম্নে সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. তাম্র প্রস্তর যুগের সভ্যতা : অনেকের মতে, হরপ্পা সংস্কৃতি হল তাম্র প্রস্তর যুগের সংস্কৃতি। তাম্র প্রস্তর যুগে পাথরের ব্যবহার হ্রাস পায় এবং ব্রোঞ্জ ও তাম্রের ব্যবহার দেখা যায়। জন মার্শাল এর মতে, “পশ্চিম এশিয়ার মত সিন্ধু দেশও ছিল সে সময় তাম্র প্রস্তর যুগের অন্তর্ভুক্ত, সে যুগে পাথরের হাতিয়ার ও সরঞ্জামের পাশাপাশি তাম্র ও ব্রোঞ্জের প্রচলন ছিল।”
২. নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা : সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা। হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো, কালিবাঙ্গন, রূপার ও লোথাল সকল স্থানেই নগরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। এ নগরগুলোর গঠনরীতি ছিল প্রায় একই ধরনের। স্টুয়ার্ট পিগট নামে প্রত্নতাত্ত্বিক বলেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতা যেরূপ বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল, তাতে মনে হয় এ অঞ্চলে দু'টি রাজধানী ছিল । হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো, যা উন্নত নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার পরিচয় দেয়।
৩. দু'টি বিকল্প রাজধানী : গর্ডন চাইল্ড এর মতে, “এ সভ্যতার ব্যাপ্তি প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার বিস্তৃতির প্রায় দ্বিগুণ এবং সুমেরীয় সভ্যতার চতুর্গুণ।” আবিষ্কৃত শহর ও নগরের সংখ্যাও বহু। এ সভ্যতার নিদর্শন যেখানে যত আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো শহর দু'টি সবচেয়ে বড়। এ দু'টি শহরের মধ্যে জলপথেও যোগাযোগ ছিল। এজন্যে প্রধানত স্টুয়ার্ট পিগট বলেছেন, “সিন্ধু সভ্যতার যুগে হয়ত দু'টি রাজধানী ছিল। কিন্তু এটি খুব সামান্য এবং এটি যুক্ত বলে অনেক পণ্ডিতগণসহ মর্টিমার হুইলার এর বিরোধিতা করেন।
৪. উন্নত সড়ক যোগাযোগ : মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও কালিবাঙ্গালে দেখা গেছে যে, শহরের রাস্তাগুলো ছিল সোজা উত্তর হতে দক্ষিণে বা পূর্ব হতে পশ্চিমে বিস্তৃত। একদিকে রাস্তা, অন্যদিকে রাস্তার সাথে সমকোণে সংযুক্ত। বড় রাস্তার পাশ হতে গলিগুলো বেড় হয়ে গেছে। বড় রাস্তাগুলো ৯ হতে ৩৪ ফুট চওড়া, যা গাড়ি চলাচলের উপযোগী।
৫. লোকসংখ্যা : মহেঞ্জোদারো শহরটি প্রায় আড়াই বর্গ কি.মি. স্থান নিয়ে গড়ে উঠেছিল এবং এর জনসংখ্যা ৩৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ পর্যন্ত ছিল বলে পণ্ডিতগণ মনে করেন। হরপ্পা নগরীও ছিল সুসমৃদ্ধ জনবহুল নগরী।
৬. নগরের গৃহ নির্মাণ পদ্ধতি : মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার নগর দু'টি ছিল সুসমৃদ্ধ ও জনবহুল। নগরী দু'টিতে সামান্য কুটির থেকে বিরাট অট্টালিকা পর্যন্ত শোভা পেত। রাস্তার দু'পাশ দিয়ে সরকারি ও বেসরকারি গৃহগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। গলিতেও গৃহ নির্মাণ করা হতো। তবে রাস্তা অবরোধ করে বাড়ি তৈরি করা হতো না। সর্বত্র পোড়া ইটের বাড়ি তৈরি করা হতো । পাথরের তৈরি বাড়ি পাওয়া যায় নি। বাড়িগুলো কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় । যথা ঃ
বৃহৎ প্রাসাদ বা সরকারি বাড়ি,
১.
২.
বাসগৃহ,
৩.
স্নানাগার ও
৪. দুৰ্গ।
বাসগৃহগুলো বিভিন্ন আকৃতির ছিল। দু'কামরাযুক্ত ছোট গৃহ থেকে ত্রিশ কামরাযুক্ত সরকারি বাড়ি। প্রায় বাড়িতে তিন থেকে চারটি আঙ্গিনা, একটি স্নানাগার ও পাকশালা থাকত। বাসগৃহের আঙিনায় দু'কক্ষবিশিষ্ট ছিল। ঘর দেখে বুঝা যায় যে, এটি শ্রমিকদের আবাসস্থান, যা থেকে শ্রেণী বৈষম্যের ব্যাপারটি ধরা পড়ে। মাঝারি বাড়ি দেখে এ. এল. বাসাম বলেছেন, “নগরগুলোতে মধ্যবিত্তের বাস ছিল বলে মনে হয়।”
৭. পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি : মার্শালের মতে, “নগর দু'টি সুচিন্তিত পরিকল্পনা অনুসারে নির্মিত হয়েছিল।” হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো আবিষ্কৃত প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ হতে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, উভয় শহরেই বিশ ফিট উঁচু কাঁচা ইট দ্বারা প্রস্তুত ভিত্তির উপর নির্মাণ করা হয়েছিল । মহেঞ্জোদারো শহরের ভগ্নাবশেষের উপর খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের মাঝামাঝি একটি বৌদ্ধস্তূপ নির্মিত হয়েছিল। এ স্তূপ খনন করতে গিয়ে মহেঞ্জোদারো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়।
৮. উচ্চ ভিত্তির উপর নগর দুর্গ, নিচে শহর : হরপ্পা এবং মহেঞ্জোদারো শহর দু'টি একই ধরনের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছিল। এ দু'টি শহরেরই পশ্চিমাংশে ছিল এক একটি নগর দুর্গ। এটি উচ্চ ভিত্তির উপর নির্মিত ছিল এবং চারদিকে প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। প্রশাসনিক দালান প্রভৃতি এ নগর দুর্গের অভ্যন্তরে ছিল। এখানে প্রশাসক শ্ৰেণী বাস করত এবং নিচে সাধারণ জনগণ বাস করত।
৯. সিন্ধু সভ্যতার দুর্গ : মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও কালিবাঙ্গান প্রভৃতি শহরে একটি করে দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে। মহেঞ্জোদারো দুর্গের ভিতরের অংশে এখনও খোঁড়ার কাজ হয় নি। হরপ্পা দুর্গ সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। এ দুর্গের বাইরে দেওয়াল ছিল ১৩ মিটার চওড়া। এটি বাইরের দিকে পোড়ামাটির ইট হলেও ভিতরের দিক ছিল কাঁচা ইটের তৈরি। দেওয়ালের কোন কোন স্থানে গম্বুজ বা বুরুজ ছিল। এ দুর্গকে প্রাচীন গ্রিক নগর বা এক্সোপলিসের সাথে তুলনা করা যায়।
১০. উচ্চতর দালান, শস্যাগার ও সভাগৃহ : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো দু'টি শহরেরই বড় বড় দালান ছিল। সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দালান হল একটি বিশাল শস্য ভাণ্ডার, যার দৈর্ঘ্য ছিল ১৬৯ ফুট, প্রস্থ ছিল ১৩৫ ফুট। (মতান্তরে ১৫০ X ২০০ ফুট)। উঁচু পোড়া মাটির স্তম্ভের উপর বন্যার পানি যাতে ক্ষতি করতে না পারে, সেজন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। এখানে একটি উঁচু বাঁধানো চাতাল ছিল, যেখানে শ্রমিকরা শস্য মাড়াই এর কাজ করত। আর শস্যাভাণ্ডারের পাশেই দু'কামরাযুক্ত শ্রমিকদের আবাসকেন্দ্র ছিল। স্যার মর্টিমার হুইলার এরূপ দুর্গ এবং তৎসংলগ্ন শস্যাগার নির্মাণের প্রশংসা করেছেন।
১১. বৃহৎ স্নানাগার : সিন্ধু সভ্যতার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল মহেঞ্জোদারোর বৃহৎ স্নানাগার। স্নানাগারের বাইরের মাপ ছিল ১৮০ X ১০৮ ফুট। স্নান করার জলধারাটি ছিল ৩৯ × ২৩ ফুট এবং গভীরতা ছিল ৮ ফুট। জলধারাটিতে জল প্রবেশ করা ও বের করার ব্যবস্থা ছিল। একটি প্রশস্ত প্রাঙ্গণের মধ্যভাগে স্নানাগারটি অবস্থিত ছিল। এর একপাশে একটি মঞ্চ ছিল। জলধারার অন্য তিনপাশে বারান্দা এবং তার পাশে ছোট ছোট ঘর ছিল। মর্টিমার হুইলারের মতে, “এ স্নানাগারটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নির্মিত হয় এবং পূজারিরা স্নান সেরে ছোট কক্ষে গিয়ে পোশাক পরত এবং স্নানাগার সংলগ্ন মার্তৃদেব তার মন্দিরে পূজা দিত। গবেষক ডি. ডি. গোস্বামী অবশ্য মনে করেন যে, এ কক্ষগুলো অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো।”
১২. পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা : সিন্ধু নগরীতে প্রত্যেক দালান হতে জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল খুবই উন্নত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো প্রতিটি শহরেই পয়ঃপ্রণালী নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল আধুনিক ধরনের। প্রতি বাড়ির জল বের হওয়ার জন্য পোড়ামাটির ইটের তৈরি নালা, যা রাস্তার তলদেশে অবস্থিত তা হতে ময়লা আবর্জনা পয়ঃপ্রণালীতে পড়ত। যেসব ময়লা
আবর্জনা জলের সাথে যায়, সেগুলো আটকানোর জন্য নর্দমায় মাঝে মাঝে গর্ত করা থাকত। ডি.ডি গোশাস্বামী মনে করেন যে, "হরপ্পার পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল যে, এ কারণে হরপ্পা সভ্যতাকে মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা থেকে আলাদা বলা চলে।
১৩. শিল্পের মূল উদ্দেশ্য উপযোগ নির্মাণ : সিন্ধু সভ্যতার স্থাপত্য শিল্প কৌশল অপেক্ষা ব্যবহারিক সুবিধার দিকে বেশি মনোযোগ ছিল। সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণ শিল্পের মূল কথা ছিল ঐশ্বর্য ও উপযোগ বৃদ্ধি করা, সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা এর লক্ষণ ছিল বলে মনে হয় না ।
১৪. উন্নত নাগরিক সংস্কৃতি : সিন্ধুর জনগণ সচেতন ছিল। কারণ বাড়ির জঞ্জাল ফেলার জন্য রাস্তা বা রাজপথে বড় বড় আবর্জনা কুও থাকত। অনুমিত হয় যে, নগরের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নাগরিকগণ যথেষ্ট সচেতন ছিল। তাছাড়া রাস্তাঘাট, নর্দমা, কুপ, দেওয়াল, দালান সবকিছুই পোড়া ইট দ্বারা নির্মিত ছিল। কেবল দালানের ভিত্তি নির্মাণে রৌদ্রে পোড়া ইটের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শহরের দালানকোঠার ভগ্নাবশেষ থেকে এ কথা সহজেই বুঝা যায় যে, সিন্ধু উপত্যকাবাসী অতি
• উন্নত ধরনের নাগরিক জীবনযাপন করত।
১৫. পানি সরবরাহ : হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোতে শহরের পানি সরবরাহের চমৎকার ব্যবস্থা ছিল। এ শহরগুলোর শাসকবৃন্দ রাস্তার পাশে স্থাপিত কূপ থেকে নগরবাসীদের জন্য পানি সরবরাহ করত। অনেক বাড়ির উঠানেও কূপ ছিল। বেশিরভাগ কূপ হতে পানি সরবরাহ করা হতো। গলিগুলোতে জলের কুপ খোঁড়া হতো। তবে মহেঞ্জোদারোর তুলনায় হরপ্পাতেই পানির কূপ বেশি ছিল।
১৬. পৌরসভার অস্তিত্ব ঃ সিন্ধু সভ্যতার পয়ঃপ্রণালী, ডাস্টবিন, লাইট পোস্ট, ড্রেন ছিল। এ থেকে পণ্ডিতগণ অনুমান করেন যে, সেখানে উন্নমানের পৌরসভার অস্তিত্ব ছিল।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা ভারতীয় উপমহাদেশের অতীব প্রাচীন ও সুপরিচিত সভ্যতা। প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্যে ভরপুর হরপ্পা ও মেহেঞ্জোদারো নগর দু'টি সিন্ধু সভ্যতাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা ছিল আধুনিক পরিকল্পনার ন্যায়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হল নিজ ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা । তাই সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলো যে কোন সভ্যতার চেয়ে উন্নত ছিল বলে অনুমান করা যায়।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত