ভূমিকা : পৃথিবীর বুকে যেসব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অন্যতম সভ্যতা হচ্ছে প্রাচীন ভারতের সিন্ধু সভ্যতা। প্রতিটি সভ্যতায় যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনপ্রণালী গড়ে উঠেছিল, ঠিক তেমনি সিন্ধু সভ্যতায়ও তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনপ্রণালী গড়ে উঠেছিল। এসব জীবনপ্রণালীতে ছিল আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। নিম্নে সিন্ধু সভ্যতার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থার' আলোচনা করা হল
রাজনৈতিক অবস্থা : সিন্ধু উপত্যকার নগর, অট্টালিকা, দুর্গ, পূর্তকার্যাদি এবং অন্যান্য আরও অনেক নিদর্শন থেকে তাদের রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা লাভ করা হয়। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন : সিন্ধুর অববাহিকায় প্রায় ৮০টি অঞ্চলে আবিষ্কৃত নিদর্শনগুলো একই রকমের ছিল। এ থেকে মনে হয় সিন্ধুর সমগ্র বিস্তীর্ণ অঞ্চল শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে ছিল। এ সম্পর্কে এস. কে. সরস্বতী বলেছেন, “সিন্ধু উপত্যকা নগরগুলোর সংগঠন দেখে মনে হয় যে, সেখানে একই ধরনের শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত প্রশাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল এবং প্রশাসন জনগণের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ করত।”
২. উন্নত পৌর শাসনব্যবস্থা : সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরভিত্তিক সভ্যতা। এ সভ্যতার শহর দু'টি একই ধরনের নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছিল এবং নগর বিন্যাসের পদ্ধতি দেখে মনে হয় নগর দু'টি উন্নত পৌর ব্যবস্থার অধীনে ছিল। নগরের অভ্যন্তরে বড় বড় দালান, স্নানাগার, শস্যভাণ্ডার ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এছাড়াও উন্নত পয়ঃপ্রণালী ল্যাম্পপোস্ট, ডাস্টবিন ইত্যাদি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তখনকার পৌরব্যবস্থা উন্নত ছিল ।
৩. শাসক শ্রেণী : রাষ্ট্রীয় আধিপত্য পুরোহিতদের উপর ন্যস্ত ছিল। পুরোহিত নিজে কিংবা পুরোহিতদের অনুমোদিত ব্যক্তি শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। শাসনকার্যে রাজাকে সাহায্য করার জন্য ছিল পুরোহিত মণ্ডলী এবং অমাত্যবর্গ। এদের ছিল দরবার গৃহ ।
৪. দুর্গ নগরী : সিন্ধুর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দু'টি নগরী হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো এবং তৃতীয় রাজধানী কালিবঙ্গানে দুর্গের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। দুর্গগুলোর অস্তিত্ব থেকে মনে হয় মাঝে মাঝে বহিরাক্রমণ হতো এবং তা প্রতিরোধ করার জন্য এ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল।
অর্থনৈতিক অবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিম্নে উল্লেখ করা হল :
১. কৃষি ও পশুপালন : কৃষি ও পশুপালন ছিল সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের প্রধান উপজীবিকা। তবে তাদের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষিকাজ। তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে গম, বার্লি, তুলা ও ধান ছিল অন্যতম। কৃষিকাজে সার ব্যবহার করা হতো। উর্বর উপত্যকায় উৎপাদিত অতিরিক্ত ফসল অবকাশ শ্রেণীদের চাহিদা পূরণ করত। অর্থাৎ, এ সভ্যতার জনগণ কৃষির উপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছিল। তারা গরু, মহিষ, টিয়াপাখি ইত্যাদি পালন করত।
২. কারিগরি শিল্প : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত নানা ধরনের কারুপণ্য ও চারুশিল্প তৈরি করত। তারা বিভিন্ন দ্রব্য প্রস্তুত করত। ধাতব শিল্প হিসেবে তামা ও ব্রোঞ্জের বিভিন্ন অস্ত্র ও ব্যবহার্য জিনিস তৈরি করত। তবে এখানে লোহা ব্যবহারের কোন অস্তিত্ব মেলে না।
৩. বয়ন শিল্প : সিন্ধু সভ্যতায় বয়ন শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। তারা তুলা ও পশম দিয়ে কাপড় বুনতে পারত ।
৪. শিল্পদ্রব্য : সিন্ধুর অধিবাসীরা কিছু কিছু শিল্পপণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার করত। শিল্প দ্রব্যের মধ্যে মৃৎপাত্র, বস্ত্র, সোনা, রুপার অলংকার, হাতির দাঁতের অলংকার, ধাতু নির্মিত দ্রব্য উল্লেখযোগ্য।
৫. ব্যবসায় বাণিজ্য : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা, আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, মেসোপটেমিয়া, মিশর ও ক্রীট দ্বীপের অধিবাসীদের সাথে ব্যবসায় বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।
৬. পরিবহণ ব্যবস্থা : স্থল পথে কাঠের গাড়ি এবং নৌপথে নৌকা ছিল সিন্ধু অধিবাসীদের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম। এতে মালপত্র আনা নেওয়া করা হতো। উট ও গাধা ছিল স্থলপথের অন্য দু'টি পরিবাহক।
সামাজিক অবস্থা : সিন্ধু সভ্যতার প্রাপ্ত বিভিন্ন অলংকার, স্বর্ণ, রৌপ্য ও মূল্যবান ধাতু দেখে মনে হয় এ সভ্যতার জনগোষ্ঠী বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। কৃষি, বয়ন শিল্প, মৃৎপাত্র, ইট তৈরি ইত্যাদি দেখে মনে হয় এরা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিল। নিম্নে তাদের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. গৃহ ঃ বড় বড় ঘরবাড়ি শহরবাসীদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা পরিচয় বহন করে এবং বুঝা যায় যে, এ সভ্যতার লোকেরা আরামে বসবাস করত।
২. খাদ্য ঃ তাদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, বার্লি, চাল, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ, মাংস ইত্যাদি ।
৩. পোশাক পরিচ্ছদ : তারা সুতা, পশম ও চামড়ার তৈরি ধূতি, চাদর নির্মাণ ইত্যাদি পোশাক পরিধান করত। পোশাক সেলাই হতো হাড়ের সুচ দ্বারা ।
৪. অলংকার : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের মধ্যে নারী পুরুষ সবাই অলংকার পরত। তারা সোনা, রুপা ও মূল্যবান পাথর দ্বারা অলংকার তৈরি করত। সে যুগে আংটি, চুড়ি, বালা, বাজু, হার, নাকফুল, দুল, মল, বিছা ইত্যাদি বহুল ব্যবহার লক্ষণীয় ।
৫. প্রসাধনী : সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা ব্রোঞ্জের আয়না ও চিরুনি, ক্ষুর, সুরমা প্রভৃতির ব্যবহার জানত এবং নানারকম প্রসাধনী ব্যবহার করে তারা সাজত।
৬. চিত্তবিনোদন : সিন্ধু সভ্যতায় চিত্তবিনোদনের প্রচলনও ছিল। তারা পশু ও মৎস্য শিকার, পাশা খেলা ইত্যাদি নানা উপায়ে চিত্তবিনোদন করত।
৭. নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী : সিন্ধু সভ্যতার লোকদের নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের মৃৎপাত্র ও তৈজসপত্র, চীনা মাটির বাসন কোসন, তামা ও রুপার তৈরি জিনিসপত্রের প্রচলন ছিল।
৮. গৃহপালিত জীবজন্তু : সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসীরা গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া, হাতি, শূকর ইত্যাদি জীবজন্তু
লালনপালন করত।
৯. সামাজিক শ্ৰেণী : মহেঞ্জোদারো থেকে প্রাপ্ত খননকার্যের ফলে পাওয়া তথ্য থেকে জানা যায় যে, এখানে বসবাসকারী মানুষ বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল । যথা :
ক. শিক্ষিত শ্ৰেণী : শিক্ষিত শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল পুরোহিত, চিকিৎসক, জ্যোতিষী এবং মানবগোষ্ঠী ।
যোদ্ধা শ্ৰেণী : যোদ্ধা শ্রেণী নিরাপত্তা ও দুর্গ রক্ষার কাজ করত। জনসাধারণকে রক্ষা করাই ছিল তাদের কাজ! ব্যবসায়ী ও কারিগরি : ব্যবসায়ী ও কারিগরি শ্রেণীর মধ্যে বিভিন্ন পেশার লোক অন্তর্ভুক্ত হতো। যেমন- রাজমিস্ত্রী, লিপিকার, শাঁখারি, স্বর্ণকার, তাঁতি ইত্যাদি ।
ঘ. শ্রমজীবী শ্রেণী : শ্রমজীবী শ্রেণীর মধ্যে গৃহকার্যে নিয়োজিত শ্রমিক ও মেকার, জেলে, কুটিরশিল্পের শ্রমিক, কৃষক, মুটে ইত্যাদি। তারা তামা ও ব্রোঞ্জের তৈরি কুঠার, কাস্তে, ছুরি, ক্ষুর, মাছ ধরার বড়শি প্রভৃতি ব্যবহার করত।
ধর্মীয় অবস্থা ঃ সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মীয় চিন্তাচেতনা, আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে জানা কঠিন। কারণ এখানে কোন ধর্মীয় মন্দির বা উপাসনালয় পাওয়া যায় নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে যা ধারণা করা যায় সেগুলো নিম্নরূপ ঃ
১. মাতৃপূজা : অসংখ্য টেরাকোটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূর্তির অধিকাংশই ছিল মহিলা। এ থেকেই ধারণা করা হয় তারা মাতৃপূজা করত। সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রে পাওয়া গেছে শিশু ক্রোড়ে উপবিষ্ট এক নারীমূর্তি। এ থেকে ষষ্ঠী পূজার আভাস পাওয়া যায়।
২. শিব পূজা : সীলগুলোর উপর গবেষণা চালিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকগণ পুরুষ দেবতা হিসেবে শিবের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা কালে তিনমুখবিশিষ্ট একটি পুরুষ দেবতার মূর্তি খুঁজে পাওয়া গেছে। এতে দেখা যায় বৈচিত্র্যময় পোশাক পরিহিত দেবতা সিংহাসনে গেড়ে বসে আছেন। এ দেবতা বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছেন, ত্রিমুখা, যোগেশ ওয়ারা, মহাযোগী অথবা পশুপতি চূড়ান্তভাবে শিব।
৩. প্রকৃতি ও মনসা পুজা : সিন্ধু সভ্যতার পশু গাছপালা খোদিত মূর্তি পাওয়া গেছে, যা থেকে অনুমান করা যায় এখানে বিভিন্ন প্রকৃতি পূজা করা হতো। তাছাড়া মৃৎপাত্রে অলংকারবিশিষ্ট ফলক পাওয়া গেছে, সেখানে চিত্রিত আছে দু'পাশে দু'জন সর্পের কর্ণধার ভক্ত এক দেবতার সম্মুখ। এ নাগ ভক্তি দেখে মনে হয় তখন মনসা পূজা হতো এবং এরাই প্রথম মনসা পূজার প্রবর্তন করেছিল।
৪. ধর্মীয় বিশ্বাস : সিন্ধু সভ্যতার লোকজন ভালোমন্দ ও দৈব শক্তিতে বিশ্বাসী ছিল। তারা মৃত দেহকে কবর দিত এবং কবরের ভিতর জীবদ্দশায় ব্যবহার্য বিভিন্ন দ্রব্যাদি মৃত ব্যক্তির পাশে রেখে দিত। কারণ তারা মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী ছিল। মৃত দেহ সৎকারের জন্য তারা বিশেষ ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করত। তা হল মৃত দেহকে পশুপাখি ভক্ষণের জন্য রেখে দিত এবং মাংস খাওয়া হয়ে গেলে হাড় ও মাথার খুলি পোড়ানো হতো। এ ভষ্ম ব্যবহার্য দ্রব্যাদিসহ কবরস্থ করা হতো।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা একটি দেশজ সভ্যতা। কোন আগন্তুক সভ্যতা নয় । এ সভ্যতার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় কোন অংশে কম উন্নত ছিল না। তাই তো অধ্যাপক গ্রেগরী রুপসেল বলেছেন, “চীন, সুমের ও মিশরের প্রাচীন সভ্যতাসমূহের তুলনায় সিন্ধু সভ্যতা অনেক উন্নত ছিল। তার প্রমাণ পয়ঃপ্রণালীর নিষ্কাশন আবিষ্কার।"
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত