বাংলার সীমানা নির্ধারণ কমিশন সম্পর্কে আলোচনা কর। (Discuss About the Boundary Commission of Bengal.)


খ. সীমানা চিহ্নিতকরণ (Identification of Border)
তৎকালীন সময়ে আসাম সংলগ্ন সিলেট জেলার ৩৫টি থানার মধ্যে মাত্র ৮টি থানায় অমুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ; তার মধ্যে ১টি থানা শাল্লা ও আজমিরীগঞ্জ-চারদিকে মুসলমান থানা দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল। বাকি ৬টি থানা সিলেটের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে একটানা অবস্থিত ছিল-তবে মূল সিলেটের সঙ্গে থানাগুলোর কোনো সংযোগ ছিল না। অপরদিকে কাছার জেলার হাইলাকান্দি মহকুমা ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানার সঙ্গে আসামের কোনো সংযোগ থাকে না, আবার ৬টি থানাই আসামের অন্তর্ভুক্ত করলে সিলেটের সঙ্গে পূর্ববাংলার রেল-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এমতাবস্থায় কমিশনের চেয়ারম্যান মনে করেন যে, কিছু মুসলমান এলাকা ও হাইলকান্দি মহকুমা ৬টি অমুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা পূর্ববাংলার অন্তর্ভুক্ত করে তার বিনিময়ে পাথরকান্দি, বাটাবাড়ি, করিমগঞ্জ এবং বদরপুর-এ চারটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ থানা আসামের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যদিও ১৫ আগস্টের পূর্বেই সীমানার কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ ও বাস্তবায়নের কথা ছিল স্বাধীনতা দিবসের কোনো কর্মসূচি যাতে সীমানা সংক্রান্ত ক্ষোভের কারণে ব্যাহত না হয় সেজন্য মাউন্টব্যাটেন তা ১৬ আগস্ট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। যথারীতি ১৬ আগস্ট বিকেল ৫ টায় ভাইসরয়ের বাড়িতে পার্টিশন কাউন্সিলের সভা আহ্বান করা হয়। উক্ত সভায় পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় যথাক্রমে লিয়াকত আলী খান ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু এবং সরদার বল্লভভাই প্যাটেল, সরদার বলদেব সিংহ, আবদুর রব নিশতার, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও ভি. পি. মেনন উপস্থিত হন। সভা শুরুর ৩ ঘণ্টা পূর্বে সীমানা কমিশনের রিপোর্ট প্রতিনিধিবর্গের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ রিপোর্ট কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং শিখ প্রতিনিধিদের কাউকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। ২ ঘণ্টা ধরে সভায় হট্টগোল এবং বাদ-প্রতিবাদ চলে। তবে শেষ পর্যন্ত সকলেই স্বীকার করেন যে, যেহেতু সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত কেউই খুশি হতে পারেন নি, তার অর্থ প্রত্যেক পক্ষ কোথাও না কোথাও কিছু সুবিধা লাভ করেছে যা অন্য পক্ষকে অসন্তুষ্ট করেছে। শেষ পর্যন্ত সকল পক্ষ সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্মত হয় এবং তা শান্তিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করার ঐকমত্য ঘোষণা করে ।
বাংলা সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নবগঠিত পূর্ববাংলা অবিভক্ত বাংলার মোট আয়তনের ৬৩.৮০% এবং মোট জনসংখ্যার ৬৪.৮৬% লাভ করে। বৃহত্তর বাংলার মুসলমান জনসংখ্যার ৮৩.৯৪% এবং অমুসলমান জনসংখ্যার ৪১.৭৮% পূর্ববাংলাভুক্ত হয়। নবগঠিত পূর্ববাংলার মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ৭০.৮৩ ঃ ২৯.১৭। নবগঠিত পশ্চিম বাংলার মুসলমান ও অমুসলমান জনসংখ্যার অনুপাত হয় ২৫.০১% : ৭৪.৯৯% । যাই হোক যেভাবেই ভাগ হোক না কেন তা যে কারও পক্ষেই সুবিধাজনক হবে না তা ব্রিটিশরা আগে থেকেই জানত ।
বাংলার সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত অনেক মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকার মুসলমানদেরকে অবাক ও বিস্মিত করে। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদীয়া প্রভৃতি এলাকার মুসলমান ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উৎসব করে, অথচ পরবর্তীতে তারা জানতে পারে যে, তারা ভারতভুক্ত হয়েছে। সরেজমিনে তদন্ত না করে দিল্লির অফিসকক্ষে বসে মানচিত্রের ওপর সীমানা চিহ্নিত করায় সীমানা কোনো ক্ষেত্রে একটি গ্রামকে দ্বিখণ্ডিত করে, কোথাও তা বাড়ির আঙিনার মাঝখান দিয়ে যায়। কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায় কারও ঘরের দরজা পড়েছে পাকিস্তানে, তো জানালা পড়েছে ভারতে। সীমানা কমিশনের সিদ্ধান্ত হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাময়িক ক্ষোভ সৃষ্টি করলেও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ চাপা পড়ে যায় দেশত্যাগ, দাঙ্গা ও লুটপাটের ঘটনার যাঁতাকলে।
২.৪.৭. পাকিস্তান সৃষ্টির প্রতিক্রিয়া
Reaction of Creation of Pakistan
বাংলা ভাষাভাষী হিন্দু-মুসলমানের চেয়ে ধর্মীয় চেতনার প্রাধান্যতায় পাকিস্তান ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পৃথক আবাসস্থল সৃষ্টি হওয়ার কারণেই এ দুই সম্প্রদায়ের মানসভুবন আলাদা এবং ধর্ম সেখানে একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। আসলে চিন্তাটা করা হয়েছে এ বোধ থেকে যে, প্যাগানিজমই উত্তম। তা লৌকিকে পরিবর্তিত হয়েছে এবং এতে ধর্মবোধের সমস্যা কম। এবং হিন্দুধর্মকে তার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে তার পরিপ্রেক্ষিতেই ইসলামকে বিচার করা হয়েছে যা ফ্যালাসি মাত্র। দুটি ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায় হলেও এরা প্রাক ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমলে পাশাপাশিই অবস্থান করেছে। ধর্মবোধ তাদের দুটি বিপরীতমুখী অবস্থান সৃষ্টি করে নি অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রে। হিন্দু-মুসলমানের ক্ষেত্রে বাঙালি পরিচয়টাই প্রাধান্য পেয়েছে বা এ পরিচয়ের ধারাবাহিকতা বিভিন্ন সময় এলিট বা রাষ্ট্র নষ্ট করতে চাইলেও পারে নি। এ বোধের কারণেই হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বদলে বাঙালিত্বের বিভিন্ন উপাদান রক্ষার ব্যাপারে যৌথ লড়াই হয়েছে। এ উপাদানগুলোকে বরং সমন্বয় ধর্মীয় উপাদান বলা যেতে পারে। আবার এ বোধকে অনেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে পারেন। বাঙালির জাতি রাষ্ট্র গঠনে তা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তাও অস্বীকার করার নয়।
ভাষা-সংস্কৃতি প্রাচীন থেকে আধুনিক সভ্যতায় একটা বড় স্থান দখল করে আছে একথা যেমনি সত্যি তেমনি সত্যি হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তান সৃষ্টির পেছনে কাজ করেছে হিন্দু-মুসলিম এ দ্বিজাতি তত্ত্বটি। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বেশিদিন টিকে থাকতে পারে নি এবং তা থেকে একথাই আবারও প্রমাণিত হয়েছে যে মানব সভ্যতার সৌহার্দের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশীল ভাষা ।
মাউন্টব্যাটেন তাঁর পরিকল্পনা প্রকাশের পূর্বে বাংলার বিষয়টি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃত্বের গোচরীভূত করেন। বাংলার ভবিষ্যৎ প্রশ্নে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ এপ্রিল দিল্লিতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনা করেন। ঐ আলোচনার পর পর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী ‘স্বাধীন বাংলা' পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এ পরিকল্পনায় বলা হয় যে-
S. বাংলায় এক নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হবে যার প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলমান
মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ মুসলমান ও পঞ্চাশ ভাগ অমুসলমান থাকবেন । এরপর— প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে পরিষদ নির্বাচিত হবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম থাকবে না পাকিস্তানে যোগদান করবে, না ভারতে করবে সে বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে উক্ত পরিষদ ।
বঙ্গভঙ্গ রোধ এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার গঠন কাঠামো কী ধরনের হবে সে প্রসঙ্গে হিন্দু-নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ- আলোচনার জন্য প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের ৩০ এপ্রিল, ১৯৪৭ তারিখের সভায় (মওলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে) একটি সাবকমিটি গঠন করা হয়। এ সাবকমিটির সদস্য ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, হাবিবুল্লাহ বাহার, হামিদুল হক চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী, ফজলুর রহমান ও নূরুল আমিন (আহ্বায়ক)। অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস ও উপমহাদেশের বিভক্তি, ১৯৪৭

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]