সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণসমূহ লিখ।

ভূমিকা : সুদূর অতীতের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী সভ্যতা সিন্ধু সভ্যতা। যে সভ্যতা নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশ গর্ববোধ করতে পারে এবং পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতা থেকে প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতার দাবি করতে পারে। সে সিন্ধু সভ্যতা দীর্ঘকাল উজ্জ্বল অস্তিত্বের পর খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ অব্দের অল্পকাল পরে ধ্বংসের সম্মুখীন হয় এবং এক সময়ে তা বিলিন হয়ে যায়। কিন্তু তার ঐতিহ্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন ।
১. ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন : সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ সম্পর্কে পণ্ডিতবর্গের ধারণা, সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলের শাখা নদীসহ অপরাপর অংশ শুষ্ক মরু অঞ্চলে পরিণত হয়েছিল। অরেল স্টাইন এর মতে, “তাম্রযুগ থেকে সিন্ধুর উপত্যকা ক্রমান্বয়ে শুষ্ক হতে শুরু করে এবং কৃষিজমির উপরিভাগ সাদা, শুষ্ক এবং ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।" সুতরাং, সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তনের প্রয়োজনীয় জলাভাবে ভূ-পৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান শুষ্কতা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণ ।
২. জলবায়ুর পরিবর্তন : ভূপ্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে জলবায়ুরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তাছাড়া সিন্ধুর উপত্যকা ছিল বনকীর্ণ। ফলে প্রচুর পরিমাণে বারিপাত হতো। কিন্তু পরবর্তীকালে বন জঙ্গল পরিষ্কার করা হলে বারিপাতের পরিমাণ কমে যায় । বৃষ্টির স্বল্পতা হেতু ক্রমেই কৃষি অঞ্চল মরুময় হয়ে উঠে। প্রাচীনকালে সিন্ধুদেশ ছিল উর্বর ও শস্যশ্যামল। কিন্তু ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ুর পরিবর্তনে তার অধিকাংশ অঞ্চল শুষ্ক ও মরুভূমি হয়ে উঠলে কৃষি অর্থনীতি ধ্বংস হয়। ফলে কৃষিনির্ভর সিন্ধু সভ্যতাও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ।
৩. বনবৃক্ষের ধ্বংস সাধন : সিন্ধুর উপত্যকা এক সময় যে জঙ্গলাকীর্ণ ছিল, তা বুঝা যায় সীলমোহরে উৎকীর্ণ বন জঙ্গল, জলাশয় এবং হাতি, গণ্ডার, মহিষ প্রভৃতির ছবি দেখে। কিন্তু একদিকে বালুভূমির প্রথার উদ্ভব ও অপরদিকে ইট পোড়ানোর জন্য গাছ গাছড়ার যথেষ্ট ব্যবহার সমগ্র অঞ্চল ক্রমেই জনশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে কৃষি অর্থনীতির বিপর্যয় ঘটলে সিন্ধু উপত্যকার মানুষ অন্যত্র সরে যেতে শুরু করে।
৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : ইতিহাসবেত্তাদের মতে, সিন্ধু নদের ধ্বংসের অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সিন্ধু নদে পলি পড়ে নদীগর্ভ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষার সময় নদীর পানি শহরকে প্লাবিত করত। মহেঞ্জোদারো ও চানাহুদরো শহর দু'টির ধ্বংসাবশেষ দেখে সহজেই বুঝা যায় যে, শহর দু'টি বহুবার প্লাবিত হয়েছিল। এছাড়া সিন্ধুর প্লাবন থেকে মহেঞ্জোদারো শহরটি রক্ষা করার জন্য ৫০ ফুটের বেশি চওড়া একটি বাঁধ নির্মাণের নিদর্শন পাওয়া যায়। ঐতিহাসিকদের মতে, প্লাবন ছাড়াও প্রাকৃতিক ভূমিধস, ভূমিকম্প, জমিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ ছিল।
৫. অভ্যন্তরীণ অবক্ষয় : সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস প্রক্রিয়া যে দীর্ঘদিনে সম্পন্ন হয়, বিভিন্ন স্থানে আবিষ্কৃত নগর পরিকল্পনার অবনতি লক্ষ্য করলে তা বলা চলে। মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা ও অন্যান্য নগরের জনস্ফীতি ঘটার ফলে বৃহৎ অট্টালিকার স্থলে বাসস্থানগুলোর আকার ক্ষুদ্র হয়ে আসে। এমনকি সেগুলো রাজপথের উপরেও এসে পড়ে। এতে মনে হয় পৌরসংস্থার নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়ে। ব্যবসায় বাণিজ্যেও ক্রমে ভাটা পড়ে। মৃৎশিল্পের পূর্ব গৌরব ম্লান হয়ে যায়। সিন্ধু সভ্যতার এ অবক্ষয়ের কারণ হচ্ছে বন্ধ্যত্ব অর্থাৎ, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে হরপ্পা সংস্কৃতির 'কোন পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে এ সভ্যতার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠে।
৬. সিন্ধু সভ্যতার সম্প্রসারণ : নগর ভিত্তিক সিন্ধু সভ্যতা অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ক্রমেই পূর্বেকার নাগরিক উৎকর্ষতা হারিয়ে যায়। বড় বড় অট্টালিকাগুলোকে ছোট ছোট কক্ষে ভাগ করে নেওয়া হয়। দরিদ্রের বাসস্থান ঘিঞ্জি বস্তিতে রূপান্তরিত হয়। এভাবে মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা শহর দু'টি এভাবে পূর্বের সৌন্দর্য হারিয়ে শ্রীহীন ও শৃঙ্খলা বর্জিত শহরে পরিণত হয়েছিল।
৭. সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তন : সিন্ধুদের গতিপথ পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে সিন্ধু বা সিন্ধু নদের এবং তার শাখা নদীর অববাহিকা অঞ্চল ভিন্ন অপরাপর অংশ শুষ্ক মরু অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ৮. রাজপুতনার মরু অঞ্চলের এম প্রসার : রাজপুতনার মরু অঞ্চলের ক্রম প্রসার সিন্ধু সভ্যতা বিনাশের বা ধ্বংসের অন্যতম কারণ হিসেবে পণ্ডিতগণ মনে করেন। সিন্ধু উপত্যকাকে আর্দ্রতাহীন, শুল্ক মরু অঞ্চলে পরিণত করে সে সভ্যতা ধ্বংসের জন্য রাজপুতনার মরুভূমির সম্প্রসারণ অনেকাংশে দায়ী ছিল।
৯. কৃষি ও অপরাপর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অবনতি : প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তনই সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের প্রধান বা একমাত্র কারণ একথা যুক্তিসিদ্ধ নয়। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় ক্রমে কৃষির গুরুত্ব ও উৎকর্য হ্রাস পেতে থাকলে অর্থনৈতিক কারণও এ সভ্যতার ধ্বংসের পথ উন্মুক্ত করেছিল।
১০. জল নিকাশী ব্যবস্থার সংস্কারের অভাব : মহেঞ্জোদারো শহরটি পরপর সাতটি স্তরে একই স্থানে বারবার নির্মাণ হয়েছিল। হরপ্পা শহরটি অনুরূপ বারবার একই ভিত্তির উপর স্তরে স্তরে নির্মাণ হয়েছিল। সিন্ধু নদের জল নিকাশের ক্ষমতা পলিমাটি জমার ফলে ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকলে মহেঞ্জোদারো শহরটি প্লাবনের কবলে পড়ে। এজন্য পরপর এটি উচ্চ হতে উচ্চতর ভিত্তির উপর পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন হয়। অন্তত তিনবার এ শহরটি প্লাবনে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়েছিল। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে প্লাবন হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য বাঁধ নির্মাণ ও জল নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা তৈরি করা হয়েছিল বটে, কিন্তু এগুলোর বিশেষভাবে জল নিকাশ ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কার ঠিকমতো না করার ফলে প্লাবন হতে রক্ষা পাওয়ার সুযোগ আর ছিল না।
১১. লোকসংখ্যা বৃদ্ধি : লোকসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বড়বড় দালানের ঘরগুলোকে ছোটছোট ঘরে ভাগ করে নিয়েছিল। দরিদ্রের বাসস্থান ঘিঞ্জি বস্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। মহেঞ্জোদারো শহরটি ক্রমে তার পূর্বেকার শ্রেষ্ঠত্ব হারিয়ে এক শ্রীহীন, শৃঙ্খলাহীন শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল।
১২. বিদেশী শত্রুর আক্রমণ : বহিরাগত আক্রমণ সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অন্যতম কারণ মনে করা হয়। উত্তরপশ্চিম দিক থেকে নানা বিদেশী শত্রুর আক্রমণের ফলে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশ ঘটে। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর বিভিন্ন স্থানে খননকার্যের ফলে যেসব নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে, তাদের মাথার খুলিতে আঘাতের চিহ্ন আছে। প্রাপ্ত কঙ্কালগুলো কেবল আর্য-অনার্যদেরই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কঙ্কাল দৃষ্টে অনুমান করা হয় যে, সিন্ধুর জনগণ একাধিক বহিরাগত শত্রুর আক্রমণের শিকার হয়েছিল।
১৩. আর্যদের আক্রমণ : সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে আর্যদের আক্রমণ। আর্যদের আক্রমণের ফলে এ সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এইচ.জি. ওয়েলস মন্তব্য করেছেন যে, “ব্যাবিলনের সম্রাট হাম্বুরাবির আমলে আর্যভাষী জনগোষ্ঠী পারস্য ও আফগানিস্তান দখল করে উত্তর ভারতের কৃষ্ণবর্ণের জনগোষ্ঠীকে বিধ্বস্ত করে সমগ্র অঞ্চলে প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করে।” আর্যদের আক্রমণের ফলে উত্তর ভারতের নগরগুলোর সাথে নাগরিকরাও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ঋগবেদে হরিওপিয় (হরপ্পার ) যে যুদ্ধ কাহিনী বর্ণিত আছে, তা সম্ভবত বৈদিক আর্য ও সিন্ধুবাসীর মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। অবশ্য সিন্ধু সভ্যতা সম্পূর্ণ বিলুপ্তির কাহিনী আজও রহস্যাবৃত।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, কোন সভ্যতাই চিরদিন টিকে নি। কোনকিছু চিরদিন থাকবেও না। সিন্ধু সভ্যতা খনন কার্যের ফলে প্রাপ্ত বিভিন্ন নিদর্শন থেকে এ সভ্যতার উত্থান সম্পর্কে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা যেমন অনুমানের উপর নির্ভর করেছেন, তেমনি এর বিলুপ্তি সম্পর্কেও অনুমানের আশ্রয় নিয়েছেন। তবে উপরিউক্ত কারণের সমন্বয়ে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে। •

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]