প্রাথমিক বৈদিক যুগে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অব বর্ণনা দাও। পরবর্তী বৈদিক যুগে এ সকল ক্ষেত্রে কি কি পরিবর্তন লক্ষ করা যায়?

ভূমিকা : আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্যের নাম বেদ। 'বিদ' শব্দের অর্থ (জ্ঞান) হতেই 'বেদ' নামের উৎপত্তি। বেদ চারটি- ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অর্থর্ববেদ। এই চারটি বেদের মধ্যে অদের সর্বপ্রথম রচিত । ঋগ্বেদ ব্যতীত অপরাপর সব যথা ঃ সামবেদ, যজুর্বেদ, অর্থর্ববেদ, উনিষদ প্রভৃতি পরবর্তী বৈদিক যুগের রচনা ।
সামাজিক অবস্থা ঃ আর্যগণ যখন প্রথমে এ দেশে প্রবেশ করেন তখন তাদের মধ্যে কোন প্রকার না। তারা ছিলেন গৌরকান্তি, দীর্ঘকায়, উন্নত নাসিকাযুক্ত এবং দেখতে সুন্দর। ভারতের আদিম অধিবাসীরা দিল কৃষ্ণকায়। কৃষ্ণকায় আদিম অধিবাসীগণকে পরাজিত করে আর্যগণ যখন ভারতে অধিকার স্থাপন করতে
খ আর্য ও অনার্য এই দুই শ্রেণির সৃষ্টি হল। প্রথমে কেবল বর্ণ অর্থাৎ দেহের রঙের ভিত্তিতেই শ্রেণিবিভাগ হয়েছিল। কিন্তু ক্রমে সমাজজীবন জটিল হতে লাগল এবং লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল। ফলে কর্মক্ষমতা ও বৃত্তি অর্থ অনুসারে সমাজ চারিটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়ল। পূজা-পার্বণ, যাগ-যজ্ঞ এবং শাস্ত্রপাঠ যারা পারদর্শী ছিলেন, তারা হলেন 'ব্রাহ্মণ': অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার, দেশরক্ষা ও দেশ শাসনে যারা পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন, তারা '' নামে পরিচিত হলেন। যারা ব্যবসায়-বাণিজ্য, কৃষি ও পশুপালন করতেন, তাদের নাম হল 'বৈশ্য'। এই তিন শ্রেণির সেবার কার্যে যারা রত ছিল তারা 'শূদ্র' নামে পরিচিত হল। এভাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের বা শ্রেণির উত্তর হলেও তাদের মধ্যে জাতিপ্রথার কোন অস্তিত্ব প্রাচীন বৈদিক যুগে ছিল না। এক শ্রেণির লোক নিজ বৃত্তি ত্যাগ করে অপর শ্রেণির বৃত্তি গ্রহণ বা বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে বিবাহাদি সম্বন্ধ স্থাপনের কোন বাধা ছিল না। ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণত্ব লাভ, ক্ষত্রিয় কন্যা সুকন্যার সাথে চ্যবনের বিবাহ জাতি বা জন্মের উপর নির্ভরশীল ছিল না। কাজ ও কাজের প্রয়োজনীয় ক্ষমতার উপর নির্ভর করত, এটা প্রমাণ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, আর্যপুরুষদিগের জীবন চারটি "আশ্রম'-এর মধ্য দিয়ে কাটাবার যে রীতি তা পরবর্তী বৈদেকি যুগেই সৃষ্টি হয়।
আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন : আর্যদের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল নিম্নরূপ-
১. কৃষি ও পশুপালন প্রধান বৃত্তি : স্বভাবতই বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবনের ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন প্রত্যেক পরিবারেরই একখণ্ড কৃষিজমি ছিল। ইহা ভিন্ন, প্রত্যেক গ্রামের একটি করে 'খিল্য' অর্থাৎ পশুচারণভূমি ছিল। ছিল সকলের সাধারণ সম্পত্তি। সকলেরই এতে পশু চরাবার সমান অধিকার ছিল। আর্যগণ যব, গম, বার্লি, ধান, শিম প্রভৃতি খাদ্যশস্যের চাষ করত। বৈদিক সাহিত্যে কৃষি জমিতে লাঙলের চাষ, বীজ বপন, ফসল মাড়াই প্রভৃতি কাজের এবং সেচের জন্য খাল ও বাঁধ-দিয়ে-রাখা জলের উল্লেখ আছে।
২. বৈদেশিক সভ্যতা গ্রান-কেন্দ্রিক : প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা, অর্থাৎ আর্য-সভ্যতার আদিপর্ব ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। ঋগ্বেদে 'পুর' নামক সামরিক প্রয়োজনে সংরক্ষিত স্থানের উল্লেখ পাওয়া গেলেও নগর বা শহরের কোন উল্লেখ নেই। পরবর্তী যুগে নগরাদি স্থাপিত হলেও প্রাচীন বৈদিক সভ্যতা গ্রামকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। গ্রাম ছিল রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি।
৩. বিনিময়ের মাধ্যম : ঐ সময়ে আধুনিক কালের ন্যায় মুদ্রার প্রচলন ছিল না। গরু এবং 'নিষ্ক' নামক একপ্রকার স্বর্ণখণ্ড ছিল বিনিময়ের মাধ্যম। ঋগ্বেদের যুগে 'মনা' নামক একপ্রকার স্বর্ণখণ্ডের উল্লেখ পাওয়া যায়। কেউ কেউ একে ব্যাবিলনের 'মানা' এবং ল্যাটিন 'মিনা'র ভারতীয় সংস্করণ বলে অনুমান করেন ।
৪. পরিবহণ ব্যবস্থা : বৈদিক যুগের পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল রথ ও গরুর গাড়ি। ঘোড়ার সাহায্যে রথ টানা হতো। বৈদিক যুগে সমুদ্রপথে চলাচল বা ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনা করা হতো কিনা সে বিষয়ে পণ্ডিতগণ একমত নয়। ঋগ্বেদে সমুদ্রের উল্লেখ হতে এবং 'মনা' নামক স্বর্ণখণ্ডের সাথে ব্যাবিলনের 'মানা' ও ল্যাটিন 'মিনা'র সাদৃশ্য হতে অনেকে মনে করেন যে, সমুদ্রপথে চলাচল ঐ সময়ে অবিদিত ছিল না। তবে প্রাচীন আর্যদিগের ব্যবসায়-বাণিজ্য সম্পর্কিত নতুন কোন তথ্য আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সমীচীন নয় ।
৫. আর্যদের আহার্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ : প্রাচীন আর্যগণ যব, গম প্রভৃতি শস্য, দুগ্ধ, ফলমূল, মৎস্য ও মাংস আহার করতেন। সুরা বা সোমরস নামক একপ্রকার মাদক পানীয় তাদের অতি প্রিয় ছিল। যাগ-যজ্ঞের কালে বা উৎসবাদিতে সোমরস পানের রীতি ছিল। আর্যদের পোশাক-পরিচ্ছদ ভুলা ও পশম উভয় প্রকারের জিনিস হতে প্রস্তুত হতো। কোন কোন ক্ষেত্রে চামড়ার পোশাকও ব্যবহারের রীতি ছিল। আর্যদের পরিচ্ছদ তিনটি সুস্পষ্ট অংশে বিভক্ত ছিল। 'নাবি' নামক একখণ্ড কৌপিন জাতীয় বস্ত্রখণ্ডের উপর 'পরিধান' অর্থাৎ বস্ত্র 'এবং 'অধিবাস' উত্তলীয় আর্যগণ পোশাক হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর্য নারী ও পুরুষ সকলেই অলঙ্কার ব্যবহার করতেন। অলঙ্কার নির্মাণে প্রধানত স্বর্ণ ব্যবহৃত হতো বটে, কিন্তু অন্যান্য ধাতুর অলঙ্কারের উল্লেখও পাওয়া যায়।
৬. গৃহপালিত পশু : গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ঘোড়া, কুকুর, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গাভী 'হতে দুগ্ধ পাওয়া যেত। দুগ্ধ ছিল আর্যদের খাদ্যদ্রব্যের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। ষাঁড়ের সাহায্যে জমি চাষ করা হতো যমুনা উপত্যকা গাভীর দুগ্ধের জন্য এবং গান্ধার অঞ্চল পশমের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বৈদিক মুক্তগুলোর কয়েকটিতে "গোধনা অর্থাৎ গবাদিপশু যাতে বৃদ্ধি পায় সেজন্য প্রার্থনা করা হয়েছে। যুদ্ধবিগ্রহে পরাজিত শত্রুর পশু অধিকার করা একটি স্বীকৃত রীতি ছিল।
৭. শিল্প ও ব্যবসায়-বাণিজ্য : প্রধানত কৃষি ও পশুপালন বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক ভিত্তি হলেও শিল্পকর্ম ঋগ্বেদের যুগে যে ছিল না এমন নয়। বৈদিক যুগের জনসমাজ নানাপ্রকার শিল্পদ্রব্য প্রস্তুত করতে জানত। অবশ্য ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রচলন সম্পর্কে ঐতিহাসিকগণ একমত নন। শিল্পের মধ্যে বস্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প, কারুশিল্প, ধাতুশিল্প এবং আরও নানাপ্রকার কারুকার্যের দ্বারা প্রাচীন বৈদিক সমাজের বহু লোক জীবিকা অর্জন করত। আর্যদের রাজনৈতিক ব্যবস্থা : আর্যদের রাজনৈতিক অবস্থার একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা নিম্নে পেশ করা হল-
১. 'রাজা বা 'রাজন' গোষ্ঠীনেতা : ঋগ্বেদ বা প্রাচীন বৈদিক যুগে আর্যদের রাজনৈতিক জীবনের মধ্যমণি ছিলেন 'রাজন' বা 'রাজা'। ঋগ্বেদে বিভিন্ন শ্লোকে রাজা বা রাজন শব্দটির উল্লেখ থাকলেও সাধারণভাবে 'রাজা' বা 'রাজতন্ত্র' বলতে যা বুঝায় প্রাচীন বৈদিক যুগের 'রাজন' বা 'রাজা' মোটেই তা ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন গোষ্ঠীনেতা মাত্র কারণ, 'রাষ্ট্র' বলতে যা বুঝায় তার উদ্ভব ঋগ্বেদের যুগে হয় নাই। আর্যরা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে বসবাস করছিল এবং ভারতের আদিম অধিবাসী অনার্য ব্যতীত আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠী আবার নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। ঋগ্বেদে আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠী যেমন : পুরু, ৎসু, ভরত প্রভৃতির উল্লেখ আছে। ২. সভা, সমিতি প্রভৃতি গণপরিষদ ঃ ঋগ্বেদের যুগে রাজা বা রাজন একজন গোষ্ঠীপ্রধান হলেও তিনি বংশানুক্রমে গোষ্ঠীর নেতৃত্বপদে অধিষ্ঠান করতেন। তবে তিনি মোটেই অপ্রতিহত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন না। 'গণ', 'সভা', 'সমিতি' বা 'বিদথ' প্রভৃতি নামে অভিহিত গণপরিষদ রাজনের স্বেচ্চাচারিতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকস্বরূপ ছিল। বিভিন্ন গণ- পরিষদগুলোর মধ্যে অবশ্য 'সভা' এবং 'সমিতি' ছিল প্রধান। 'সভা', 'সমিতি' প্রভৃতির সভায় রাজন সভাপতিত্ব করলেও তাকে সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোকে মেনে চলতে হতো। ‘সভা' ছিল গোষ্ঠীর বয়োবৃদ্ধের সমাবেত এবং 'সমিতি'তে জনসাধারণমাত্রেই সমবেত হতে বাধ্য ছিল না।
৩. নির্বাচিত রাজন : নারীদেরও গণ-পরিষদে অংশগ্রহণের সুযোগ ঋগ্বেদের যুগে ছিল। বংশানুক্রমিক 'রাজন' ব্যতীত সেই আমলে প্রজাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্তাও প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। ঋগ্বেদের যুগে এমনও অনেক আর্যগোষ্ঠী ছিল যার প্রধান কর্মকর্তা (রাজন) 'সমিতি'র সদস্য কর্তৃক নির্বাচিত হতেন। যা হোক, পরবর্তী বৈদিক যুগে যখন গোষ্ঠী ব্যবস্থার অবসান ঘটে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটতে থাকে তখন রাজা বা রাজনের ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং গণ- পরিষদসমূহের রাজনৈতিক ভূমিকা হ্রাসপ্রাপ্ত হয় ।
৪. রাজনের কর্তব্য ও রাজকর্মচারী : ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ক্রমাগত চলত বলে রাজন ছিলেন মূলত একজন সামরিক নেতা। তিনি গোষ্ঠীর রক্ষাকর্তা বলে বিবেচিত হতেন। গো-সম্পদ রক্ষা করা ব্যতীত রাজনের প্রধান কর্তব্য ছিল গোষ্ঠীর লোকজনদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। তিনি গোষ্ঠীর মঙ্গলার্থে দেবতাদের পূজা অর্চনার আয়োজন করতেন। দৈনন্দিন শাসনকার্যে সাহায্যের জন্য রাজা (রাজন) একাধিক কর্মচারীর সাহায্য গ্রহণ করতেন। কর্মচারীদের মধ্যে 'পুরোহিত' ছিলেন বিশেষ উল্লেখযোগ্য। পুরোহিতদের পরে ছিল সেনানী নামক কর্মচারীদের স্থান। তবে ঋগ্বেদে 'বলি' নামক রাজস্বের যে উল্লেখ পাওয়া যায় উহা আদায়ের জন্য বিশেষ কোন কর্মচারীর কথা জানা যায় না। অনুমিত হয় যে, 'বলি' প্রকৃতপক্ষে ছিল রাজনকে স্বেচ্ছায় দান করা উপহার।
পরবর্তী বৈদিক যুগে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন : বৈদিক যুগে আর্যদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় জীবনে ব্যাপকতর পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। নিম্নে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আলোচনা করা হল :
সামাজিক পরিবর্তন :
১. শ্রেণিবিভাগ জাতি বিভাগে রূপান্তরিত : পূর্বেকার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের মধ্যে যেখানে গুরুতর প্রভেদ ছিল না, এই চারটি শ্রেণি একই সমাজব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিদ্যমান ছিল, পরবর্তী বৈদিক যুগে সেগুলো বহুলাংশে রক্ষণশীল পৃথক জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। শ্রমবিভাজনের ও কর্মদক্ষতার উপর নির্ভরশীল পূর্বেকার শ্রেণিবিভাগ তখন পৃথক জাতিতে পরিণত হয়েছিল।
২. চতুরাশ্রম : পরবর্তী বৈদিক যুগে ধর্মের অঙ্গ হিসেবে যাগযজ্ঞের সঙ্গে সঙ্গে তপস্যাব্রত সমাদৃত হতে থাকে। এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে ব্রাহ্মণগণ আর্যপুরুষের ব্যক্তিগত জীবনকে চারটি পর্যায়ে ভাগ করেছিলেন । এই পর্যায়গুলো একত্রে চতুরাশ্রম' নামে অভিহিত হতো। তবে আর্যদের সমাজে প্রথম তিন বর্ণ বা শ্রেণির মানুষ যথা : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যদের জন্যই কেবল চতুরাশ্রম নির্দেশিত হয়। শূদ্ররা চতুরাশ্রমের আওতায় ছিল না । ৩. স্ত্রীজাতির সামাজিক মর্যাদা হ্রাস : সমাজে স্ত্রীজাতির যে স্বাধীনতা ঋগ্বেদের যুগে বা প্রাচীন বৈদিক যুগে পরিলক্ষিত হতো তা পরবর্তী কালে আর রইল না। পূর্বে বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ডের অনেক কিছুই স্ত্রীজাতির উপর ন্যস্ত ছিল। স্ত্রী স্বামীর প্রকৃত অর্ধাঙ্গিনীরূপেই মর্যাদা লাভ করতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে সেই মর্যাদা অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল।
→ অর্থনৈতিক পরিবর্তন :
১. কৃষিকার্য : ঋগ্বেদের যুগে পশুপালন কৃষিকার্য অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব পেত, কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষিকার্য আর্যদের প্রধান উপজীবিকা হয়ে দাঁড়ায়। শতপথ ব্রাহ্মণে ভূমি-কর্ষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ছয়, আট, বারো এমনকি চব্বিশটি বলিবর্দ একসঙ্গে লাঙল চালাবার কার্যে নিয়োগ করা হতো। গাঙ্গেয় উপত্যকার উর্বর জমিতে অতি সহজেই কাষ্ঠনির্মিত লাঙল চালানো যেত। অবশ্য কৃষি
কার্যে ব্যাপক আকারে লৌহনির্মিত যন্ত্রপাতির ব্যবহারও পরবর্তী বৈদিক যুগে অবিদিত ছিল না। ২. বিভিন্ন বৃত্তি ও ব্যবসাবাণিজ্য : পরবর্তী বৈদিক যুগে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বহুগুণ বৃদ্ধি পাবার ফলে নতুন নতুন জীবিকারও সৃষ্টি হয়েছিল। আর্যরা প্রাচীন বৈদিক যুগে লৌহের ব্যবহার জানলেও খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দের পর হতেই লৌহের ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। অবশ্য তামার ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরে জানা থাকবার ফলে তাম্র শিল্পীগণ নানাপ্রকার দ্রব্যসামগ্রী তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন। তাম্রনির্মিত যন্ত্রপাতি এবং হাতিয়ার ব্যতীত অলঙ্কারও প্রস্তুত হতো। চর্মশিল্প, মৃৎশিল্প, বয়নশিল্প প্রভৃতির মাধ্যমেও পরবর্তী বৈদিক যুগের আর্যরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করতেন। ] রাজনৈতিক পরিবর্তন :
১. শক্তিশালী রাজ্যের উত্থান : পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যবসতির বিস্তৃতির আনুষঙ্গিক কতকগুলো পরিবর্তন স্বাভাবিকভাবেই ঘটিয়েছিল। প্রথমে যে গোষ্ঠীগত বা উপদলীয় ব্যবস্থা ছিল, এর পরিবর্তে শক্তিশালী রাজ্য গড়ে উঠল। রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে রাজ্যবিস্তারের জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহ শুরু হল। একচ্ছত্র রাজশক্তি গঠনের দিকে অর্থাৎ রাজ্যকে সাম্রাজ্যে পরিণত করার দিকে শক্তিশালী রাজাগণ সচেষ্ট হলেন।
২. ঋগ্বেদ ও পরবর্তী যুগের সাথে তুলনা : ঋগ্বেদের যুগে রাজা (রাজন) ছিলেন গোষ্ঠীপ্রধান একজন সামরিক নেতামাত্র। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ঋগ্বেদের যুগে কর আদায়ের প্রশ্ন ছিল না বলে কর আদায়কারী কর্মচারীর কোন উল্লেখ ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে ‘ভাগদুঘা’ নামক কর্মচারীদের প্রধান কর্তব্যকার্য ছিল কৃষকদের নিকট হতে রাজার অংশ বা ভাগ আদায় করা।
৩. নতুন নতুন অনুষ্ঠান : রাজার ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষমতা জাহির করার জন্য পরবর্তী বৈদিক যুগে অশ্বমেধ, রাজসূয় প্রভৃতি যজ্ঞের আয়োজন করা হতো। শতপথ ব্রাহ্মণে ভরত দৌশন্তি ও শাতনানিক সত্রাজিৎ নামে দু'জন রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন এবং তারা গঙ্গা ও যমুনা নদী পর্যন্ত রাজ্যবিস্তার করেন বলে উল্লেখ আছে।
৪. স্বৈরাচারের পথে বাধা : যজুর্বেদে উল্লেখ আছে যে, রাজার অভিষেককালে তাকে শপথ গ্রহণ করতে হতো । এই শপথবাক্যে রাজা শক্তিশালী ও দুর্বল, উচ্চ-নীচ সকলকেই সমানভাবে বিচার করবেন, নিরলসভাবে দেশের জনসাধারণের মঙ্গলের চেষ্টা করবেন এবং সকল প্রকার আপদ-বিপদ ও দুর্দৈব হতে দেশবাসীকে রক্ষা করবেন এই অঙ্গীকার করতে হতো। মোটকথা, পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজশক্তি বৃদ্ধি পেলেও রাজতন্ত্র নিরঙ্কুশ স্বৈরাচারতন্ত্রে রূপান্ত রিত হয় নি।
উপসংহার : অতএব, প্রাথমিক বৈদিক যুগে আর্যদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক বিচারে প্রশংসনীয় ছিল। তবে পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের সামাজিক, অর্থনেতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ব্যাপকতর পরিবর্তনের সূচনা হয়। আর এ পরিবর্তনের প্রভাব সকল ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]