ভূমিকা ঃ ভারতবর্ষ হল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। ভারতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ধনসম্পদের প্রাচুর্যে আকৃষ্ট হয়ে আদিকাল থেকে ভারতে একাধিক বিদেশীর আগমন ঘটেছিল। এদের মধ্যে কারো উদ্দেশ্য ছিল ভারতে স্থায়ী আবাসভূমি গড়ে তোলা, কারো উদ্দেশ্য ছিল ধনসম্পদ লুণ্ঠন করে নিজ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করা, কারো উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় রাজাদের পরাজিত করে নিজ ভিত্তিকে মজবুত করা। ভারতের এহেন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে ভারতে আগমন ও লোদী শাসনের নীতিতে যখন ভারতের শাসনব্যবস্থা সমস্যার ঘূর্ণিজালে জর্জরিত তখন দুর্ধর্ষ বাবর (পিতৃ পরিচয়ে তুর্কি এবং মাতৃ পরিচয়ে মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খানের বংশধর) ভারতবর্ষে অভিযান পরিচালনা করে এক নব ধারার সূচনা করেন। এ নব ধারাই মুঘল বংশ। এ বংশ ভারতবর্ষে ক্রমান্বয়ে দোর্দন্ড প্রতাপে কয়েক শতাব্দি বহাল ছিল।
মুঘলদের আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের অবস্থা : পরিবর্তন হল ইতিহাসের ধর্ম। ইতিহাসের ধর্মের ধারাবাহিকতায় ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা যখন অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত তখন বৈদেশিক শক্তি যে সুযোগ গ্রহণ করবে তা ধারণা করা অমূলক নয়। ভারতে ষোড়শ শতকের দিকে চরম শাসনতান্ত্রিক গোলযোগ দেখা দেয়। এ সময় উত্তর ভারতে অনেক স্থানে আফগান শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। একপর্যায়ে এ আফগান শক্তি ভারতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। আফগানদের পাশাপাশি রাজপুত রাজারাও শক্তিশালী হয়ে উঠে। কিন্তু রাজপুত রাজাদের মধ্যে কোন ঐক্যবোধ ছিল না। তাই তারা বহিঃশত্রু দ্বারা যে আক্রান্ত হবে তা স্বাভাবিক ছিল। এ সময় দিল্লি ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন লোদি শাসকরা। এ লোদি সুলতানরা ছিলেন খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী। কিন্তু আকাঙ্ক্ষার তুলনায় তাদের তেমন ক্ষমতা ছিল না। আফগান সামন্তরা সুলতানের কেন্দ্রীয় শক্তিকে অগ্রাহ্য করে স্থানীয় স্বাধীনতা ভোগ করত । এ ধরনের অবস্থায় জায়গিরদার ও করদ রাজারাও সুলতানকে নামেমাত্র বশ্যতা জানাত। সুলতান ইব্রাহিম লোদি তাঁর শাসনামলে এ সামন্ত শ্রেণীকে নিজ আওতায় আনার চেষ্টা করলে শাসনতান্ত্রিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ গ্রহণ করে তুর্কি বীর জহিরউদ্দিন মুহম্মদ বাবর (পিতৃ পরিচয়ে তুর্কি বীর তৈমুর লঙ্গ এর বংশধর এবং মাতৃ পরিচয়ে চেঙ্গিস খানের বংশধর) ভারতে অভিযান পরিচালনা করেন ও সফল হন ।
মুঘলদের আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের সমকালীন অবস্থা ছিল নানাবিধ শাসনতান্ত্রিক সমস্যায় জর্জরিত। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হল :
১. ইব্রাহিম লোদীর শাসনামলে ভারতের অবস্থা : ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে উত্তর ভারতের বহু স্থানে আফগান শক্তি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। এর পাশাপাশি রাজপুতরাও বেশ ক্ষমতাশালী ছিল। দিল্লি ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন সুলতান ইব্রাহিম লোদী। এ লোদী সুলতান খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন কিন্তু তাঁর ক্ষমতা তেমন কিছু ছিল না। আফগান সামন্ত রা সুলতানের কেন্দ্রীয় শক্তিকে অগ্রাহ্য করে স্থানীয় স্বাধীনতা ভোগ করত। করদ রাজা ও জাগিরদাররা সুলতানকে নামে মাত্র বশ্যতা জানাত। সুলতান ইব্রাহিম লোদী তাঁর সামন্তদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করায় তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত আরম্ভ হয়।
২. আফগান শাসনাধীনে ভারতের অবস্থা : আফগান সর্দাররা ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষী, স্বাধীনতাপ্রিয় ও উপজাতি মনোভাবাপন্ন । তারা নিজেদের সুলতানের সমমর্যাদাশীল ও সমকক্ষ বলে মনে করত। ইব্রাহিম লোদী তাঁর সামন্ত শক্তি ও প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উপর তাঁর কেন্দ্রীভূত স্বৈরতন্ত্র চাপাবার চেষ্টা করায় লোদী রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। ইব্রাহিম লোদী সাহসী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও কৌশলী ও কূটনীতিতে দক্ষ ছিলেন না। বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন যে, ইব্রাহিম রণকৌশল ভাল করে রপ্ত করতে পারেন নি । দ্বারদেশে শত্রু উপস্থিত জেনেও তিনি অভ্যন্তরীণ ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেন নি
৩. দৌলত খাঁ লোদীর শাসনামলে ভারতের অবস্থা : পাঞ্জাবে দৌলত খাঁ লোদী স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতেন। দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদী পাঞ্জাবে দৌলত খাঁর এ স্বাধীন আচরণের বিরোধিতা করায় উভয়ের মধ্যে দারুণ শত্রুতা দেখা দেয়। দৌলত খা লোদী ইব্রাহিমের খুল্লতাত আলম খা লোদীর সাথে যোগ দিয়ে ইব্রাহিমকে পদচ্যুত করার চেষ্টা করে। এ দুই আফগান সর্দার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে বাবরের সাহায্য চান।
৪. মালবের রাজনৈতিক অবস্থা : দিল্লি লোদী সাম্রাজ্যের বাইরে কয়েকটি স্বাধীন স্বয়ং-শাসিত অঞ্চল ১৬ শতকের গোড়ায় ছিল। এগুলোর মধ্যে- ক. মালবের মেদিনী রায়ের কথা উল্লেখ্য। মালব রাজ্যটি ছিল রাজপুতানা ও বুন্দেলখণ্ডের মধ্যবর্তী। সামরিক দিক থেকে মালব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দিল্লি অঞ্চল থেকে রাজপুতানায় এবং মধ্যপ্রদেশে প্রবেশের দরজা ছিল মালব। মালবের প্রধান নগর ও দুর্গের নাম ছিল চান্দেবী। মধ্যভারত ও উত্তর ভারতের বাণিজ্য চান্দেরী নিয়ন্ত্রণ করত। চান্দেরীর ভিতরে বিশাল বাজার, অসংখ্য মসজিদ ও কয়েক হাজার বাসগৃহ ছিল। চান্দেরী দুর্গ ছিল দুর্ভেদ্য। ফিরোজ তুঘলকের রাজত্বকালে মালব স্বাধীনতা ঘোষণা করে। মালবে একটি তুর্কি বংশ ক্ষমতা অধিকার করে। ১৬ শতকে মালবের সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে তাঁর রাজপুত সামন্ত সকল ক্ষমতা অধিকার করেন। এ প্রাক্তন সামত্ত মেদিনী রায় চান্দেরী দুর্গে নিজ শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেন ।
৫. গুজরাটের রাজনৈতিক অবস্থা : এছাড়া গুজরাট ছিল এক স্বাধীন রাজ্য। গুজরাট ছিল খুবই সমৃদ্ধিশালী রাজ্য। গুজরাটের বন্দর হতে বহু পণ্য পশ্চিম এশিয়ায় রপ্তানি হতো। এজন্য পর্তুগীজ বণিকরা গুজরাটের উপকূলে আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করে। গুজরাটের সুলতান শেষ পর্যন্ত পর্তুগীজদের দমন করতে সক্ষম হন।
৬. মেবারের অবস্থা : রাজপুতানায় অনেকগুলো স্বাধীন রাজপুত রাজ্য ছিল। দিল্লি সুলতানির দুর্বলতার সুযোগে এ রাজ্যগুলো শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ রাজপুত রাজ্যগুলোর মধ্যে মেবার ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। শিশোদিয়া, বংশীয় রানা সঙ্গ ছিলেন মেবারের রানা। তিনি ছিলেন রাজপুতদের নেতা। রানা সঙ্গ ছিলেন প্রখ্যাত যোদ্ধা। রাজপুতানা ও মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তৃত ছিল। ইব্রাহিম লোদীর দুর্বলতার সুযোগে রানা সঙ্গ দিল্লি অধিকারের ইচ্ছা পোষণ করতেন ।
৭. বাংলার হুসেন শাহী শাসনামল : পূর্ব ভারতে, বাংলায় সুলতান হুসেন শাহের পুত নসরৎ শাহ রাজত্ব করতেন। নসরৎ শাহের রাজ্যের সীমানা বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিহারের লোহানী আফগানরা বাবরের কাছে পরাস্ত হয়ে নসরৎ শাহের আশ্রয় নেন। নসরৎ শাহ তাঁর পিতার মতই উদার, ধর্মসহিষ্ণু সুলতান ছিলেন। এছাড়া সিন্ধু, কাশ্মীর, উড়িষ্যায় স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল।
উপসংহার : পরিশেষে বলা যায়, ষোড়শ শতকের প্রারম্ভ পর্যায়ে ভারতে একাধিক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব লক্ষ্য করা যায়। তবে এ সময় আফগান ও লোদী শাসকদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। আর ভারতের এ ধরনের রাজনৈতিক অবস্থায় বাইরের শত্রু দ্বারা যে ভারত আক্রান্ত হবে তা অমূলক ছিল না। এ অবস্থায় মোঙ্গল নেতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাবর ভারত আক্রমণ করেন এবং স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন ।
FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত