পানিপথের প্রথম যুদ্ধের বিবরণ দাও। বাবরের সাফল্যের কারণ বর্ণনা কর।

ভূমিকা ঃ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতে মুসলমানদের ইতিহাসে তাৎপর্যময় ঘটনা। এ যুদ্ধে মোঙ্গল নেতা বাবর লোদী সুলতান ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে ভারতে এক নব ধারার সংযোগ করেন। এ ধারাই মুঘল বংশ । এ মুঘল বংশ বংশপরম্পরায় প্রায় দু'শত বছর স্থায়ী হয়েছিল। ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেছেন, “পানিপথের যুদ্ধ দিল্লি সাম্রাজ্যকে বাবরের হস্তগত করে, লোদী বংশের ক্ষমতা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় এবং ভারতবর্ষের সার্বভৌমত্ব চাগতাই তুর্কিদের হস্তগত হয় ।
পানিপথের প্রথম যুদ্ধের কারণসমূহ : পানিপথের প্রথম যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বহুবিধ কারণ নিহিত ছিল। তবে হিন্দুস্থান ও কাবুলের সান্নিধ্য, ভারতীয় উপমহাদেশের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক অবস্থা, বাবরের অদম্য রাজ্যজয় লিপ্সা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং দৌলত খান ও আলম খানের বিশ্বাসঘাতকতাই ছিল পানিপথের যুদ্ধের অন্যতম কারণ। নিম্নে পানিপথের যুদ্ধের প্রধান কারণগুলো সংক্ষেপে আলোচনা করা হল :
ক. ভারতের ভৌগোলিক নৈকট্য : পানিপথের প্রথম যুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল ভৌগোলিক নৈকট্য। ভারত বাবরের নিজস্ব সাম্রাজ্যের নিকটবর্তী ছিল বলে তিনি তার প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতকে বেছে নেন এবং এ কারণে ইব্রাহিম লোদীর সাথে তার পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
খ. রাজনৈতিক অনৈক্য : সমকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থাও তখন বাবরের ভারত আক্রমণের জন্য সহায়ক ছিল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ঐক্যের একান্ত অভাব ছিল। রাজনৈতিক অরাজকতার এ পরিবেশে ভারতের নেতৃবর্গ বাবরকে ভারত আক্রমণের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ ও হেগ এজন্য ভারতের রাজনৈতিক অনৈক্যকে পানিপথের যুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
গ. অন্যান্য অভিযানের সাফল্য : অন্যান্য অভিযানের সাফল্যও বাবরকে পানিপথের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার প্রেরণা যোগায়। তিনি প্রাথমিক অবস্থায়ে ভারতের বেশ কয়েকটি অঞ্চল, যেমন- বজৌর দুর্গ, লাহোর, জলন্ধর, দীপালপুর, পাঞ্জাব, শিয়ালকোট ও কান্দাহার অধিকার করেন। পরপর এ বিজয় বাবরের পানিপথের প্রথম যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।
ঘ. ভারত জয়ের আনন্ত্রণ : ইব্রাহিম লোদীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পাঞ্জাবের গভর্নর দৌলত খান লোদী, সুলতানের চাচা আলম খান ও অপরাপর আফগান নেতা বাবরকে ভারতবর্ষ আক্রমণের আমন্ত্রণ জানালে উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাবর স্বীয় স্বার্থ হাসিলের জন্য আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করেন। ফলে ইব্রাহিম লোদীর সাথে বাবরের পানিপথ প্রান্তরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটে।
যুদ্ধের ঘটনা ঃ প্রথমত বাবর বারো হাজার পদাতিক ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অশ্বারোহী সৈন্য এবং ওস্তাদ আলী ও মুস্তাফার নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র গোলন্দাজ বাহিনী নিয়ে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ এপ্রিল পানিপথের প্রান্তরে উপস্থিত হন। বাবরের সাথে তার পুত্র হুমায়ুন ও কামরান সসৈন্যে যোগদান করেন। পানিপথের প্রান্তরে বাবরের সসৈন্যে আগমন বার্তা শ্রবণ করে দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদী প্রায় ১,০০,০০০ সৈন্য ও ১০০ হস্তীর একটি বাহিনীসহ পানিপথে উপস্থিত হলেন। বাবর যুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করেন। বাবরের গোলন্দাজ বাহিনী ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য বাহিনীর মধ্যে ত্রাসের সঞ্চার করে। আট দিন ধরে তুমুল যুদ্ধ চলে এবং পরিশেষে ইব্রাহিম লোদী বাবরের স্বল্পসংখ্যক যোদ্ধা দ্বারা গঠিত বাহিনীর সাথে শক্তি পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে নিহত হন। এভাবে ভারত লোদী বংশের শাসনের অবসানের মাধ্যমে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
পানিপথের যুদ্ধের ফলাফল : ফলাফল বিচারে পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এ যুদ্ধের ফলে লোদী বংশের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইব্রাহিম লোদীর ব্যক্তিগত দুর্বলতা, অকর্মন্যতা, “অপরিণামদর্শিতা এবং তাঁর সেনাবাহিনীর অপটুতা ও আত্মীয়স্বজনের বিরোধিতার ফলে বাবরের হস্তে তার শোচনীয়ভাবে পরাজয় ঘটে হন। জনৈক ঐতিহাসিকের মতে, পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করার পর ক্লাইভ যেমন ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন করেন, ঠিক তেমনি পানিপথের যুদ্ধে জয়লাভ করে বাবরও ভারতবর্ষে মুঘল রাজত্বের সূচনা করেন ।
বাবরের সাফল্যের কারণ : পথের প্রথম যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের কতকগুলো বিশেষ কারণ ছিল। এগুলো নিম্নরূপ :
১. বংশগত ঐতিহ্য : বাবর ভারতবর্ষের স্বীয় রাজ্য সম্প্রসারণ করার জন্য যে অদম্য স্পৃহা ও অসামান্য নির্ভীকতা প্রদর্শন করেন তা তার পূর্বসূরিদের অভিযান প্রবণতাকেই স্মরণ করে দেয়। ২. দক্ষ ও সাহসী সেনাবাহিনী : ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য সংখ্যা বেশি হলেও বাবরের সৈন্যদের ন্যায় তারা দক্ষ ও সাহসী ছিল না। তাদের ভালো প্রশিক্ষণও ছিল না। বাবরের মত ইব্রাহিম লোদী যুদ্ধবিদ্যায় অভিজ্ঞ ও পারদর্শী ছিলেন না।
৩. রাজনৈতিক অনৈক্য : প্রাক মুঘলযুগের বিশৃঙ্খলা রাজনৈতিক অবস্থা এবং আত্মকলহে লিপ্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির অভাবে বাবর সহজে সামরিক সাফল্য অর্জন করেন।
৪. কামান ও গোলাবারুদের ব্যবহার : পানিপথের যুদ্ধে বাবরের সাফল্যের মূলে ছিল ভারতে প্রথম সমর ক্ষেত্রে কামান ও গোলাবারুদের ব্যবহার এবং যুদ্ধক্ষেত্রে গোলন্দাজ বাহিনীর যুদ্ধ তৎপরতা। উন্নততর যুদ্ধাস্ত্রের ব্যবহার এবং যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ সমর কুশলী বাবরকে পানিপথের যুদ্ধে সাফল্যের সিংহদ্বারে নিয়ে যাবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু ছিল না ।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতে মুসলমানদের ইতিহাসে যেমন ঘটনাবহুল, তেমনি ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ। এ যুদ্ধে বাবর নিজ সমরকৌশল দক্ষতা প্রমাণ করে ইব্রাহিম লোদীর বিশাল সেনাবহিনীকে ব্যর্থতার জালে জড়িয়ে দেন। তবে বাবরকে এ যুদ্ধে বেশি সাফল্য এনে দেয় তাঁর গোলন্দাত্ত বাহিনী। যাহোক, বাবর পানিপথের যুদ্ধে সাফল্যের মাধ্যমে ভারতে এক নতুন বংশের ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হন, দীর্ঘকাল ভারতে স্থায়ী হয়েছিল।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]