ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বাবরের কৃতিত্ব মূল্যায়ন কর।

ভূমিকা : ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে বাবর ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন । বিজেতা ও শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ। ১৫২৬ খ্রিঃ পানিপথের যুদ্ধে তিনি ইব্রাহীম লোদীকে পরাজিত করে ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের সূচনা করেন। ঐতিহাসিক ভি, এ স্মিথ বলেন, "Babur was a most brilliant Asiatic prince of his age and worthy of a high place among the sovereigns of India." (বাবর তাঁর সমসাময়িক এশিয় যুবরাজদের মধ্যে উন্নত এবং ভারতের নৃপতিদের মধ্যে সুউচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত হবার যোগ্যতা সম্পন্ন ছিলেন । )
ক. পরিচয় : জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ ইতিহাসে বাবর নামেই সমধিক পরিচিত। ১৪৮৩ খ্রিঃ তিনি তুর্কিস্তানের ফরগনায় জন্মগ্রহণ করেন । পিতা ওমর শেষ মির্জা ছিলেন এ ক্ষুদ্র রাজ্যের আমীর। বাবর পিতার দিক দিয়ে তৈমুর লঙ এবং মাতার দিক দিয়ে চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। বাল্যজীবনে শিক্ষালাভ করে বাবর স্বভাবতই সাহসী, ধর্মভীরু, সদাচারী হন। তুর্কি ও ফারসি ভাষায় তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি হয়েছিল।
খ. প্রাথমিক কার্যাবলি : পিতার মৃত্যুর পর ১৪৯৪ খ্রিঃ মাত্র এগার বৎসর বয়সে বাবর পিতৃরাজ্য ফরগনার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু শীঘ্রই তিনি শত্রু দ্বারা বেষ্টিত হয়ে পড়েন। বাবর মধ্য এশিয়ায় পূর্বপুরুষ তৈমুরের সাম্রাজ্য সমরকন্দ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। কিন্তু পর পর দুবার সমরকন্দ অধিকার করেও স্থায়ী শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হন। এমনকি নিজ রাজ্য ফরগনাও তিনি হারান। এভাবে রাজ্যহীন ও ভাগ্যহীন হয়ে বাবর ১৫০৪ খ্রিঃ খোরাসানের রাজার সহায়তায় হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে কাবুল ও গজনী অধিকার করতে সমর্থ হন।
• গ. পাক-ভারত অভিযান : সমরকন্দ জয়ে ব্যর্থ হয়ে বাবর কাবুলে প্রত্যাবর্তন করে ভারতীয় উপমহাদেশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন। আমীর ওমরাহদের পরামর্শে বাবর কিছু এলাকা দাবি করে দিল্লীর সুলতান ইব্রাহীম লোদীকে দূত মারফত পত্র দেন। কিন্তু পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খান দূতকে আটকে রাখলে বাবর অভিযান প্রেরণ করে পেশোয়ার দখল করেন। ১৫২০ খ্রিঃ বাদাখসানের গোলযোগ দমন করে পুত্র হুমায়ুনকে সেখানকার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন । পুনরায় অভিযান পরিচালনা করে বাবর শিয়ালকোট ও কান্দাহার দখল করে পুত্র কামরানকে তথাকার শাসনকর্তা নিয়োগ করেন ।
ঘ. ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা : দিল্লীর শাসনকর্তা ইব্রাহীম লোদীর শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে পাঞ্জাবের শাসনকর্তা দৌলত খা এবং মেবারের রানা সংগ্রাম সিং বাবরকে ভারতীয় উপমহাদেশ আক্রমণের জন্য আহ্বান জানান। ১৫২৪ খ্রিঃ বাবর স্ব-সৈন্যে পাঞ্জাবে উপস্থিত হন এবং লাহোর অধিকার করেন ।
ঙ. পানিপথের প্রথম যুদ্ধ : পাঞ্জাব অধিকারের পর বাবর ১২,০০০ অশ্বারোহী সৈন্যসহ দিল্লী অধিকারের জন্য অগ্রসর হন। ইব্রাহীম লোদী দিল্লী রক্ষার জন্য ১ লক্ষ সৈন্য ও ১ হাজার হস্তীর এক বিরাট বাহিনী নিয়ে বাবরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।১৫২৬ খ্রিঃ পানিপথ নামক স্থানে উভয়ের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। দীর্ঘ আটদিন তুমুল যুদ্ধের পর ইব্রাহীম লোদী যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। এ সাফল্যজনক বিজয় একদিকে যেমন বাবরের রণদক্ষতার প্রমাণ রাখে অপরদিকে দিল্লী ও আগ্রা দখল করে ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার একটি উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব।
চ. খানুয়ার যুদ্ধ : দিল্লী ও আগ্রা জয়ের পর বাবরকে ভারতের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী রাজপুত জাতির মোকাবিলা করতে হয়। মেবারের রানা সংগ্রাম সিং ১৫২৭ খ্রিঃ বাবরকে ভারত হতে বিতাড়নের জন্য অগ্রসর হন। খানুয়ার প্রান্তরে বাবর ও সংগ্রাম সিংহের মধ্যে এক ভীষণ যুদ্ধ হল। মুঘল বাহিনীর দুঃসাহসিক আক্রমণে দুর্ধর্ষ রাজপুত যোদ্ধাগণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে রানা যুদ্ধ করতে করতে নিহত হলেন এবং রাজপুত প্রাধান্য স্থাপিত হওয়ার আশা চিরতরে বিনষ্ট হল। এ যুদ্ধে জয়লাভ করার ফলে বাবরের প্রাধান্য দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপিত হল। এ যুদ্ধে জয়লাভ করে মুঘলদের রাজধানী কাবুল হতে দিল্লীতে স্থানান্তরিত হল ।
ছ. গোগরার যুদ্ধ : রাজপুত শক্তি বিনাশের পর বাবর দুর্ধর্ষ আফগান বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে ১৫২৯ খ্রিঃ পাটনার সন্নিকটে গোগরা নদীর তীরে সম্মিলিত আফগান শক্তিকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। পর পর এ তিনটি যুদ্ধের মাধ্যমে বাবর কাবুল হতে বঙ্গদেশ পর্যন্ত সমগ্র ভারতের মালিকানা লাভ করেন এবং মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
জ. বাবরের কৃতিত্ব : নিম্নে বাবরের কৃতিত্বগুলো আলোচনা করা হল :
১. সুদক্ষ সমর নায়ক : বাবর ছিলেন একজন সুদক্ষ সমর নায়ক ও রণকুশলী বীর। বিশ্ববিশ্রুত নেপোলিয়ন বোনাপার্টের ন্যায় অনলবর্ষী ও তেজোদীপ্ত ভাষণ দ্বারা অতি সহজেই তিনি সৈন্যদের অগ্নিমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন। সুশৃঙ্খল ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সৈন্যবাহিনীর দ্বারা ঝটিকা আক্রমণের সাহায্যে তিনি শত্রুদের পর্যুদস্ত রতেন। ত্রিপাঠির মতে, “বাবর ছিলেন প্রতিভাবান সেনাধ্যক্ষ, দক্ষ তীরন্দাজ, নিপুণ তরবারী চালক ও চতুর ঘাড়সওয়ারী।"
২. শাসক হিসেবে বাবর : বাবর ছিলেন একাধারে স্নেহময়ী পিতা, উদার বন্ধু, দয়ালু শাসক এবং পরহেজগার ব্যক্তি। সুশাসক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল প্রসিদ্ধ। দিল্লীর সিংহাসন লাভের পর অধিকাংশ সময় যুদ্ধ বিগ্রহে ব্যাপৃত থাকলেও তিনি প্রশাসনিক ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনয়ন করেন। তিনি একটি সুসংঘবদ্ধ তুর্কি একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং সুলতানের স্থলে 'বাদশাহ' উপাধি ধারণ করেন। প্রাদেশিক শাসনকার্য সম্পাদনের জন্য তিনি প্রাদেশিক শাসনকর্তা, দিওয়ান, শিকদার ও কোতোয়াল নিযুক্ত করেন।
৩. ধর্মীয় উদারতা : বাবর ধার্মিক ছিলেন বটে কিন্তু ধর্মান্ধ ছিলেন না। তিনি কোন অমুসলমানদের উপর নির্যাতন করেন নি। ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “তাঁর রাজত্বে হিন্দুদের নিয়মিতভাবে নিগ্রহ ভোগ করতে হয় নি এবং ধর্মের জন্য তিনি কোন ব্যক্তিকে শাস্তি দেন নাই ।”
৪. জনকল্যাণমূলক কার্য : জনকল্যাণের জন্য আগ্রায় ২০ টি উদ্যান, পার্ক, সেতু, ও বড় বড় অট্টালিকা তৈরি করেন। তিনি মক্তব, মাদ্রাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্প সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি রয়েছে। অযোধ্যায় তৈরি 'বাবরী মসজিদ' তাঁর স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। ঐতিহাসিক ইরিস্কিনের ভাষায় “তিনি এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও অত্যন্ত প্রশংসনীয় নৃপতি ছিলেন।”
৫. ঐতিহাসিকদের মতামত ঃ সকল ঐতিহাসিক বাবরের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। লেনপুল বলেন, “ভারত বিজয় দ্বারা তিনি যে রাজকীয় শাসকগোষ্ঠীর জন্য পথ উন্মুক্ত করেছেন তাই ইতিহাসে তাঁকে স্থায়ী আসনে প্রতিষ্ঠা করেছে।” ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “বাবর মধ্যযুগীয় ইতিহাসের পাতায় অতি আকর্ষণীয় ব্যক্তিদের অন্যতম ৷ ”
৬. বাবরের চরিত্র ঃ সমগ্র মধ্যযুগীয় ইতিহাসে বাবর একজন আকর্ষণীয় চরিত্রের অধিকার ছিলেন। যুবরাজ, যোদ্ধা এবং বিদ্বান হিসেবে সে যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের সাথে তিনি আসন লাভের অধিকারী, আর চরিত্রে অদম্য অধ্যবসায়, দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়, অসাধারণ সাহসিকতা, অটুট মনোবল, অতুলনীয় রণদক্ষতা, দূরদর্শিতা এবং চমৎকার শৈল্পিক গুণাবলির এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটেছিল। তিনি ফার্সি ভাষায় সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতেন। সঙ্গীত ও সুকুমার বিদ্যাতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। ‘তুযুক-ই-বাবরনামা' নামে বাবর তাঁর আত্মচরিত লিখেন।
উপসংহার : নিঃসন্দেহে বাবর ছিলেন একজন অসাধারণ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা। সামান্য অবস্থা হতে বাবর ভারতে এক বিশাল মুসলিম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত মুঘল বংশ দীর্ঘদিন ভারতে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, "Indeed, there are few princes in Asiatic History who can be ranked higher than Babur in genius and accomplishment." (প্রকৃতপক্ষে প্রতিভা ও গুণরাজির দিক দিয়ে এশিয়ার ইতিহাসে খুব কম শাসকই বাবর অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিলেন।)

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]