শেরশাহ কর্তৃক প্রবর্তিত বিভিন্ন সংস্কারের মূল্যায়ন কর । শেরশাহ কিভাবে ক্ষমতায় আসেন?

ভূমিকা ঃ ১৫৪০ খ্রিঃ কনৌজের যুদ্ধে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে পরাজিত করে শেরশাহ দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অসাধারণ মেধা ও সাহসের অধিকারী ছিলেন। তাঁর রাজত্বকাল ছিল মাত্র ৫ বছর। এ সময় যুদ্ধ বিগ্রহ নিয়েই ক্রমাগত তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। এ অল্প সময়ে শাসনব্যবস্থার মঙ্গলজনক সংস্কারের ফলে মধ্যযুগীয় ভা তর ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে তিনি বিচক্ষণতা ও প্রজাহিতৈষীর দৃষ্টান্ত খেন। ঐতিহাসিক হেগ বলেন, "He was in truth one of the greatest rulers who ever sat upon the throne of Delhi, " ( ভারতে মুসলিম শাসকদের মধ্যে তিনি সর্বপ্রথম উদারতা ও মানবতাবাদী শাসন সংস্কার করে জনগণের আস্থা অর্জন করেন।)
শেরশাহের শাসনব্যবস্থা : সম্রাট শেরশাহ একজন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন। তিনি কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য সমগ্র প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় বিভিন্ন দপ্তর এবং প্রাদেশিক ইউনিটে বিভক্ত করেন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল ঃ
১. শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি : শেরশাহের শাসন নীতি স্বৈরাচারমূলক ছিল বটে কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য প্রজা নিপীড়ন নয় বরং, তা ছিল জনকল্যাণমুখী। এককেন্দ্রিক জনকল্যাণমুখী ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা ছিল তাঁর শাসনতন্ত্রের মূলনীতি। হিন্দু ও মুসলিম শাসন পদ্ধতি এবং হিন্দু ও মুসলিম জনগণের মধ্যে সমন্বয় সাধন তাঁর শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ছিল। পরবর্তীতে আকবর যেমন সকল শ্রেণীর জনগণের মনোরঞ্জনের মধ্যদিয়ে সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, শেরশাহও তেমনি জনগণের সদিচ্ছার উপর জোর দিয়েছিলেন যথেষ্ট।
২. কেন্দ্রীয় প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ : শেরশাহ ‘খলিফাতুজ্জামান' উপাধি গ্রহণ করে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সার্বভৌম শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। সাম্রাজ্যের সামরিক ও বেসামরিক শাসনব্যবস্থা তিনিই নিয়ন্ত্রণ করেন। শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে চারটি প্রধান দপ্তরে বিভক্ত করেন। যথা ঃ
ক. দিওয়ান-ই-আরিয (সামরিক বিভাগ)। খ. দিওয়ান-ই-ওজারত (অর্থ বিভাগ)।
গ. দিওয়ান-ই-রিসালাত (পররাষ্ট্র বিভাগ)।
ঘ. দিওয়ান-ই-ইনশা (রাষ্ট্রীয় ফরমান বিভাগ)।
ঙ.দিওয়ান-ই-কাজী (বিচার বিভাগ)।
চ. দিওয়ান-ই-বারীদ (ডাক বিভাগ) ।
৩. খান-ই-সামান : রাজকীয় গৃহস্থালি কাজের তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণ করার জন্য এ আমলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের একটি বড় দপ্তর ছিল। এ বিভাগে একজন গৃহধর্মী এবং বহুসংখ্যক কর্মচারীসহ অসংখ্য খাদেম ও পাচক-পাচিকা নিযুক্ত থাকত। গৃহাধ্যক্ষ, রন্ধনশালা, মেহমানদের আপ্যায়ন, অভ্যর্থনা এবং অবস্থানের বন্দোবস্ত করতেন।
৪. বেসামরিক শাসনব্যবস্থা : শাসনকার্যের সুবিধার জন্য শেরশাহ তাঁর সাম্রাজ্যকে ৪৭টি পরগনায় এবং পরগনাগুলোকে গ্রামে বিভক্ত করেন। কতকগুলো পরগনা নিয়ে একটি বিভাগ বা সরকার গঠিত হতো। এ সরকারের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন ‘শিকদার বা মুনসিফ ই-মুনসিফান'। প্রত্যেক পরগনায় আমীর, সিকদার, মুনসিফ, আমিন, খাজাঞ্চী, একজন দাসী ও দুইজন হিন্দি লেখক থাকতেন। পরগনার কর্মচারীদের পরিচালনার জন্য প্রত্যেক সরকারের জন্য শিকদার-ই-শিকদারান ও একজন মুনসিফ-ই-মুনসিফান থাকতেন। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সমগ্র দেশের শাসনব্যবস্থার শীর্ষে ছিলেন শেরশাহ স্বয়ং। কর্মচারীদের দুর্নীতিমুক্ত রাখার জন্য শেরশাহ কর্মচারীদের বদলী প্রথার ব্যবস্থা করেছিলেন ।
৫. রাজস্ব ব্যবস্থা : কৃষি ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা সম্পর্কে শেরশাহ যে নীতি অনুসরণ করেন তার উৎকর্ষ এমন যে, তা পরবর্তী যুগে অনুকরণ করা হয়েছিল । সরেজমিনে তদন্ত ও নির্ভুল জরিপের পর শেরশাহ জমির উৎপাদিকা শক্তি ও অন্যান্য গুণাগুণ বিচার করে নগদ টাকায় বা উৎপন্ন দ্রব্যের অংশ রাজস্ব নির্ধারণ করেছিলেন। রাজস্ব নির্ধারণ করার সময় যথাসম্ভব উদারতা প্রদর্শন করা হতো, কিন্তু আদায়ের সময় কঠোরতা অবলম্বন করা হতো। তিনি চাষীদের পাট্টা দ্বারা জমিতে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে দিতেন এবং বিনিময়ে তাদের নিকট থেকে কবুলিয়াত গ্রহণ করতেন । 8 ৬. জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা : প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অনাবৃষ্টি ও কুঠি জোতদারদের অত্যাচারে ফসলের ক্ষতি হলে তিনি রাজস্ব মওকুফ এবং কৃষিঋণের ব্যবস্থা করতেন। রাজস্ব শাসনব্যবস্থায় তিনি আলাউদ্দিন খলজীর রাজস্ব নীতি সম্প্রসারিত এবং যুগোপযোগী করেন। ফলে এটা মুঘল ও ব্রিটিশ রাজস্ব নীতিতে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল ।
৭. শুল্ক নীতি : অর্থ ব্যবস্থায় গলদ উপস্থিত হলে যে কত দুর্যোগ ঘটে তার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বরাবরই মিলে থাকে। সেদিকে শেরশাহের প্রখর মনোযোগ ছিল। সরকারি টাকশাল থেকে যে মুদ্রা প্রকাশিত হয় সে ব্যাপারে যে গলদ দেখা দিয়েছিল তা তিনি সংশোধন করেন। ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষতি না হয় সেদিকেও লক্ষ করে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানের পরিবর্তে নির্দিষ্ট কিছু স্থানে শুল্ক প্রদানের নির্দেশ দেন।
৮. যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা : সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা, জনগণের সুবিধা, ব্যবসায়ীদের যাতায়াত ও মালামাল আমদানি ও রপ্তানির সুবিধার জন্য শেরশাহ পুরাতন সড়ক মেরামত ও নতুন সড়ক নির্মাণ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হল গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড । এটি সোনারগাঁ থেকে সিন্ধু পর্যন্ত প্রায় ৩০০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
৯. পরধর্ম সহিষ্ণু : সম্রাট শেরশাহ শুধু দক্ষ প্রশাসনিক ইউনিট গড়ে তোলেন নি, জনকল্যাণের লক্ষ্যে তিনি ধর্মীয় গোঁড়ামী থেকেও একে রক্ষা করেছিলেন। এককথায় শেরশাহ পরধর্ম মতে সহিষ্ণু ছিলেন এবং হিন্দুদেরকে উচ্চ রাজ পদে নিযুক্ত করেছিলেন।
১০. পুলিশ ও গুপ্তচর বিভাগ ঃ যাতায়াত ও ব্যবসায় বাণিজ্যের নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সম্রাট একটি সুদক্ষ পুলিশ বাহিনী গঠন করেছিলেন। গ্রাম্য মোড়লদের উপর গ্রাম্য শান্তিশৃঙ্খলার ভার অর্পণ করে তিনি পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় এক নবজীবন দান করেন। একটি দক্ষ গোয়েন্দা বিভাগও সম্রাটকে যাবতীয় খবরাখবর সরবরাহ করতো।
১১. ডাক বিভাগ : শেরশাহ ঘোড়ার ডাকের প্রবর্তন করে সাম্রাজ্যের এক স্থান হতে অন্যত্র দ্রুত সংবাদ আদানপ্রদানের সুব্যবস্থা করেছিলেন।
১২. বিচার বিভাগ : শেরশাহের বিচার ব্যবস্থা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সাম্য ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরগনায় দেওয়ানী মোকদ্দমার ভার ছিল আমীর এর উপর এবং ফৌজদারী মোকদ্দমার ভার ছিল কাজী ও মীর আদালতের উপর। কতিপয় পরগনায় মুনসিফ-ই-মুনসিফান এবং রাজধানীতে কাজী উল কুজ্জাত, সুদর-উস
-সুদুর সর্বোপরি সম্রাট নিজে বিচারকার্য পরিচালনা ও অন্যান্য সমস্ত বিষয়ের সমাধান করতেন । ১৩. সামরিক বিভাগ : অস্ত্রবলে রাজ্য বিস্তার করেছিলেন বলে স্বভাবতই সামরিক সংগঠন সম্বন্ধে শেরশাহের আগ্রহ ছিল। সরাসরি সম্রাটের তত্ত্বাবধানে শেরশাহ এককেন্দ্রিক ও এক বিরাট সামরিক বাহিনী গঠন করেন। কেন্দ্রের সাথে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ও সম্পর্কের সমন্বয় সাধন তাঁর সামরিক সংস্কারের এক অভিনব বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি স্বয়ং ১,৫০,০০০ অশ্বারোহী ও ২৫,০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিযুক্ত করেন। অশ্ব চিহ্নিতকরণ এবং সেনাবাহিনীর বিবরণমূলক তালিকা প্রবর্তন করে তিনি দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করেন। জায়গিরদানের পরিবর্তে নগদ টাকায় সৈন্যদেরকে বেতন দেওয়ার ব্যবস্থা তার সামরিক সংস্কারের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল। সেনাবাহিনীতে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার প্রবর্তন করে তিনি একে প্রায় দুর্জয় করে তোলেন।
১৪. কলা ও স্থাপত্য শিল্প : এছাড়া কলা ও স্থাপত্য শিল্পেও তাঁর উদ্যোগ প্রশংসনীয় ছিল। তিনি শিল্পীদের যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন। তাঁর আমলে নির্মিত পাঞ্জাবের রোটাল, দিল্লীর পুরনো কিল্লা, সাসারামে তাঁর সমাধি স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ।
উপসংহার ঃ পরিশেষে বলা যায়, ইউরোপে অষ্টাদশ শতকে যে কয়জন রাজা অবাধ ক্ষমতার অধিকারী হয়েও প্রজাদের কল্যাণ সম্বন্ধে চিন্তা করতেন ও প্রভূত পরিশ্রম করতেন, তাদের সঙ্গে শেরশাহ এর তুলনা করা চলে। তবে শেরশাহের ন্যায় বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য তাদের ছিল না। সুতরাং বলা যায়, দিল্লীর ইতিহাসে শেরশাহ ছিলেন এক স্বনামধন্য ও শক্তিশালী শাসক। তাঁর সংস্কারাবলির দিকে লক্ষ্য রেখে ঐতিহাসিক কীনি বলেন, "No Government not even the British has shown so much wisdom as did this Pathan." (কোন শাসকই এমনকি ব্রিটিশ সরকারও এ পাঠানের ন্যায় শাসনকার্যে এত বিজ্ঞতার পরিচয় দিতে পারেন নি)।

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]