কবুলিয়াত ও পাট্টার বিশেষ উল্লেখপূর্বক শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা আলোচনা কর ।

ভূমিকা : মুঘল রাজত্বের অন্তবর্তীকালীন শাসক হিসেবে এবং শূর বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে শেরশাহ ছিলেন একজন প্রভাবশালী শাসক। উন্নত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটাতে গিয়ে তিনি যে কবুলিয়াত ও পাট্টা ব্যবস্থার সূত্রপাত ঘটান তার ফলে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সফলতার পশ্চাতে তাঁর পূর্বঅভিজ্ঞতা ছিল বিশেষভাবে কার্যকরী। পিতার জায়গিরের ম্যানেজার হিসেবে জীবন আরম্ভ করায় শেরশাহ প্রকৃতপক্ষে কৃষকদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ লাভ করে। এ বিষয়ে W. H. Morland, "Sher Shah one of the out standing administrator of Muslim India and the only sovereign who is known to have gained, practical experience in Managing a small body, of peasents before rising to the throne of peasant kingdom. [The agrian system of Muslim India, P, 74] 1 দিল্লির সিংহাসনে আরোহণের পর যে ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন ঘটান তা তিনি পূর্বে সাসারাম, খাওয়ামপুর ও টান্ডায় প্রবর্তন করে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন।
শেরশাহের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা : রাজস্ব ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস, সুষ্ঠুভাবে রাজস্ব আদায় এবং রাজস্ব ব্যবস্থাকে প্রজাস্বার্থমুখী করার জন্য যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তা নিম্নে আলোচনা করা হল :
১. ভূমি জরিপ : শেরশাহ সিংহাসনে আসীন হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সুবিধার জন্য এবং ভূমি রাজস্বের উন্নয়নের জন্য সমগ্র অঞ্চলের ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য শেরশাহের পূর্বে কেউ পরিপূর্ণভাবে ভূমি জরিপ ও রাজস্ব নির্ধারণ করেন নি। একমাত্র তিনিই সর্বপ্রথম সর্বজনীনভাবে ভূমি জরিপের ব্যবস্থা করেন।
I.S.H. Quraishi বলেছেন, "ভূমি পরিমাপকে Universal Method এ রূপান্তরিত করেন শেরশাহ।” জমি জরিপের ক্ষেত্রে ফসল উৎপাদনের মৌসুমে ভূমির জরিপ করেছেন। তিনি আবাদি ভূমির পরিমাণ স্থির করে এর উৎপাদিকা শক্তি অনুসারে ভূমিকে উত্তম, মধ্যম ও নিম্ন এ তিন শ্রেণীতে ভাগ করেন। তার জমি পরিমাপের একককে 'সিকান্দারী বিঘা' বলা হতো। ২. রাজস্ব নির্ধারণ : শেরশাহের রাজস্বের নির্দিষ্ট হারের তালিকা দেখার জন্য আমাদেরকে আবুল ফজলের আইন-ই- আকবরীর দ্বারস্থ হতে হয়। এখানে শেরশাহের রাজস্ব হারের তালিকা চমৎকারভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এ তালিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, রাজস্বের হার উৎপাদিত গড়পড়তাভিত্তিক করা হয়েছিল। রাজস্ব হার সম্পর্কে বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত ছিল। যেমন- কারও মতে অংশ, বা অংশ আবার কারও মতে অংশও ছিল। যেমন- মুলতান অঞ্চলে এক বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা) এর জন্য শেরশাহ সেখানকার কর এক চতুরাংশ অংশ নির্ধারণ করেছিলেন। তবে সর্বজনীনভাবে দেখা যায় যে, শেরশাহের করের হার ছিল এক তৃতীয়াংশ অংশ। Morland এর উদাহরণে দেখা যায়, শেরশাহ সিকান্দারী বিঘা পরিমাণ জমির জন্য উৎপাদিত শস্যের পরিমাণ ধার্য করেছিলেন,
উত্তম শ্রেণী- ১৮ মণ
মধ্যম শ্রেণী- ১২ মণ
নিম্ন শ্রেণী- ৮ মণ ৩৫ সের ।
সুতরাং, এর গড় আসে (১৮ + ১২ + ৮.৩৫) ÷ ৩ = ১২ মণ ৩৮ সের ৪ ছটাক। এখানে উল্লেখ্য ভূমি কর নির্ধারণে তিনি তিনটি পদ্ধতির প্রচলন ঘটান। এগুলো নিম্নরূপ ঃ ক. গালা বকশী বা বাটাই পদ্ধতি,
খ. নশক বা মুক্তাই পদ্ধতি এবং
গ. নাকদি বা যবতি পদ্ধতি ।
কাজেই দেখা যাচ্ছে, শেরশাহের রাজস্ব নির্ধারণের এ পদ্ধতি ছিল অভিনব ও বৈজ্ঞানিক ।
৩. রাজস্ব আদায় : শেরশাহের আমলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোন নিয়ম লক্ষ্য করা যায় না। তবে লোদী আমলে শস্যের মাধ্যমে এবং আকবরের শাসনামলে প্রথম দিকে নগদ অর্থের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করা হতো। এর ফলে আমরা জানতে পারি, তার শাসনামলে শস্য ও নগদ অর্থ উভয়ের মাধ্যমেই রাজস্ব আদায় করা হতো। পচনশীল খাদ্যশস্য যেমন- শাকসবজি নগদ অর্থে এবং যেসব বস্তু পচনশীল নয় তা ফসলের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হতো। তবে রাজস্ব আদায় করা হতো হেমন্ত ও বসন্তকালে ।
৪. রাজস্ব আদায়ে কর্মচারী নিয়োগ : রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য শেরশাহ সমগ্র সাম্রাজ্যকে ছোট ছোট প্রশাসনিক ইউনিটে ভাগ করেন এবং ক্ষুদ্রতম প্রশাসনিক ইউনিট ছিল পরগনা। আমিন, মুকাদ্দাস, চৌধুরী, পাটওয়ারী, শিকদার ও কানুনগো প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কর আদায়ের পথ সুপ্রসন্ন করেন। এ রাজস্ব কখনও রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি আবার কখনও স্থানীয় প্রতিনিধি রাজস্ব আদায় করতেন।
৫. রাজস্ব আদায়ে উদারতা : শেরশাহ ছিলেন ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সহজ, সরল ও উন্নত মনের অধিকারী। যার ফলে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও তার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। এ প্রসঙ্গে Dr. Datta বলেছেন "He wanted to build his greatness on the happiness and contentment of his subjects and not by opprissing them."
তাই দেখা যায়, রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের ব্যাপারে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের শেরশাহের নির্দেশ ছিল সময়মতো যেন রাজস্ব আদায় করা হয় এবং প্রজা সাধারণের প্রতি অহেতুক অত্যাচার ও উৎপীড়ন করা না হয়। জমির রাজস্ব নির্ধারণের ব্যাপারে যথাসম্ভব উদারতা এবং রাজস্ব আদায়ের সময় কঠোরতা প্রদর্শন ছিল শেরশাহের রাজস্ব সংস্কারের মূলনীতি। অবশ্য সৈন্য পরিচালনার সময়ে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- অতিবৃষ্টি, খরা, ঝড় ইত্যাদির জন্য শস্যহানি ঘটলে ক্ষতিপূরণ ও কর মওকুফের ব্যবস্থা করতেন।
৬. জনকল্যাণমূলক ব্যবস্থা : ভূমি শাসনব্যবস্থায় শেরশাহ 'তাকাবী ঋণ' ব্যবস্থা চালু করেন। ইতিহাস পাঠে জানা যায়, তাকারী ঋণ হল প্রয়োজনের সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ঋণ। মূলত এ ব্যবস্থার মাধ্যমে শেরশাহ নিজেকে চরম উদার ও প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন।
এ বিষয়ে মতামত দিতে গিয়ে ঐতিহাসিক Kene বলেছেন, "No Goverment even the British has shown so much wisdome as did this pathan (Sher Shah). " (History of the Turks in India, P. 233)
৭. জরিমানা ও মাহসিলানা : শেরশাহ মোট উৎপাদিত পণ্যের অংশ কর ধার্য করলেও আরও কিছু কর আদায় করত। যেমন- জমি জরিপের ও রাজস্ব আদায়কারীর খরচ বাবদ তার সময় কৃষকদের যথাক্রমে 'জরিমানা ও মাহসিলানা' দিতে হতো। এছাড়াও আপদকালীন সময় মোকাবিলা করার জন্য শেরশাহ বিঘা প্রতি অতিরিক্ত কর বা 'মেস' হিসেবে আদায় করত। উল্লেখ্য এ অতিরিক্ত কর যা শস্যের মাধ্যমে গ্রহণ করত তা সরকারি শস্য ভাণ্ডারে জমা থাকত। এছাড়াও প্রত্যেক কৃষকদের রাজস্বের ২% শস্য রাজকীয় কোষাগারে জমা থাকত। দুর্ভিক্ষের সময় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নামমাত্র মূল্যে জনসাধারণের মাঝে শস্য বিতরণ করা হতো।
৮. জমিদারি ব্যবস্থার উৎখাত : শেরশাহের ভূরাজস্ব বা ভূমি প্রশাসনব্যবস্থার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল জমিদারি ব্যবস্থার উৎখাত। তবে এক্ষেত্রে উল্লেখ্য তিনি তাঁর স্বল্পকালীন শাসনব্যবস্থায় জমিদারি ব্যাবস্থাকে পুরোপুরি উৎখাত করতে সক্ষম হন নাই। তিনি জমিদারি ব্যবস্থার বদলে রায়তদারী ব্যবস্থার প্রচলন ঘটান যদিও সাম্রাজ্যের অনেকাংশে জমিদারি ব্যবস্থা বহাল ছিল।
৯. কবুলিয়াত ও পাট্টা ঃ শেরশাহ কর্তৃক ভারতীয় উপমহাদেশের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার ক্ষেত্রে যে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত তা হল কবুলিয়াত ও পাট্টা ব্যবস্থা। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ করার জন্যই তিনি এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বলে অনুমিত হয় । এছাড়াও সরকার ও কৃষকদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধিও কবুলিয়াত ও পাট্টা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ছিল। সহজ ভাষায় বললে কবুলিয়াত ও পাট্টা হল দু'টি দলিল। ভূমিতে কৃষকের দায়দায়িত্ব অর্পণ করে এবং নির্ধারিত ভূমি রাজস্ব উল্লেখ করে ও জমির উপর কৃষকদের স্বত্ব স্বীকার করে সরকার কৃষককে পাট্টা প্রদান করত। অন্যদিকে, কৃষক নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব প্রদানে স্বীকৃত হয়ে সরকারকে কবুলিয়াত বা চুক্তিনামা প্রদান করতেন। পাট্টা দ্বারা ভূমিতে কৃষকদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং কবুলিয়াত দ্বারা সরকারের রাজস্ব আদায়ের অধিকার স্বীকৃত হয়। উভয় দলিলেই প্রজাকে বরাদ্দকৃত ভূমির দাগ ও পরিমাণ উল্লেখ করে দেওয়া হতো ৷
১০. রাজস্বের উৎস : শেরশাহের আমলে রাজস্বের উৎসকে দু'টি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। যথা :
ক. কেন্দ্রীয়ভাবে আদায়কৃত রাজস্ব এবং
খ. স্থানীয়ভাবে আদায়কৃত রাজস্ব ।
ক. কেন্দ্রীয়ভাবে আদায়কৃত রাজস্বের উৎস : ক. ওয়ারিশবিহীন সম্পত্তি, খ. বাণিজ্য শুল্ক, গ. লবণ কর, ঘ. অবগারী, ঙ. উপঢৌকন, চ. জিজিয়া, খারাজ, ছ. ভূমি রাজস্ব, জ. খুমস ইত্যাদি ।
খ. স্থানীয়ভাবে আদায়কৃত রাজস্বের উৎস : স্থানীয়ভাবে আদায়কৃত রাজস্বকে আবওয়াব বলা হতো। আবওয়াব সাধারণত বাণিজ্য দ্রব্যাদির উপর ধার্য করা হতো। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আমদানি ও রপ্তানিকারক ও বিভিন্ন পেশাজীবীদের উপর আবওয়াব ধার্য করা হতো। সমালোচনা ঃ শেরশাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত হিসেবে আদৃত হলেও অনেক ঐতিহাসিক এর সমালোচনা করেছেন। যেমন- Moreland বলেছেন, “এটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ছিল না। কারণ, যারা জরিপ করত তারা খামখেয়ালি করত এবং অনেক ফাঁকফোকর থেকে যেত”। আবার ত্রিপাটির বিবরণে, “পরিমাপের ওজনে গড়মিল ছিল, রাজস্ব আদায়কারীরা দুর্নীতি করত এবং কৃষকদের উপর অবিচার করত”। আবার অনেকে বলেছেন, “শেরশাহের রাজত্বকালে রাজস্ব আদায়ের সময় কৃষকদের কোন সুযোগ সুবিধা প্রদান করা হয় নি।"
কিন্তু এসব সমালোচনার সত্যতা নিয়ে সন্দেহের ঢের অবকাশ রয়েছে। কেননা, শেরশাহের সময়ই প্রথম দুর্যোগকালীন অবস্থা মোকাবিলার পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
উপসংহার : উপরিউক্ত আলোচনার শেষে বলা যায় যে, শেরশাহের রাজস্ব নীতি ছিল আধুনিক ও প্রশংসার দাবিদার। কেননা, এর ফলে সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। Smith এর সাথে আমরাও বলতে পারি, "If Sher Shah had been shoned. He world have established his dynasty and the great Mughals would not have appeared on the slage of history," [ Oxford history. P- 3011

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]