সম্রাট আকবরের মনসবদারী প্রথা সম্বন্ধে যা জান লিখ।

ভূমিকা : সম্রাট আকবরের সেনাবাহিনীর বিন্যাস এক ঐতিহাসিক সংযোজন। তাঁর সামরিক সংস্কারের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল মনসবদারী ব্যবস্থার প্রবর্তন। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করে সৈন্যবাহিনীর শোচণীয় অবস্থা লক্ষ করলেন। ঐ আমলে নানা বৃত্তির লোক সেনাবাহিনীতে যোগদান করতো। এর ফলে সেনাবাহিনীতে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, দক্ষতার খুবই অভাব ছিল। ১৫৭১ খ্রিঃ আকবর সামরিক সংস্কার সাধন করার উদ্দেশ্যে শাহবাজ খানকে মীর বকসী পদে নিযুক্ত করে স্বয়ং একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। ইতিহাসে এটাই আকবরের মনসবদারী প্রথা নামে পরিচিত
১. আকবরের মনসবদারী প্রথা : 'মনসব' শব্দের অর্থ পদমর্যাদা বা অফিস এবং যিনি এ পদের অধিকারী ছিলেন, তাকে বলা হতো মনসবদার। ঐতিহাসিক আইভিন এ সম্পর্কে বলেন, 'আকবরের এ সামরিক প্রথার উদ্দেশ্য ছিল মনসবদারদের মধ্যে পদমর্যাদার ধাপ এবং বেতনের ক্রমোন্নতি নির্ধারণ করা।' সৈন্যবাহিনীতে ক্ষমতানুযায়ী পদমর্যাদা দিয়ে সৈন্যবাহিনীকে সুসংহত করা। প্রত্যেক মনসবদার তার পর্যায় অনুযায়ী নির্দিষ্টসংখ্যক সৈন্য, অশ্ব, হস্তী প্রভৃতি প্রস্তুত রাখতে বাধ্য থাকতেন।
২. মনসবদারী প্রথা প্রবর্তনের কারণ : সমস্ত মুঘল সাম্রাজ্য কয়েকটি জায়গিরে বিভক্ত ছিল। এ সকল জায়গিরের অধিপতিগণ বিপদকালে সম্রাটকে নির্দিষ্টসংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্য সরবরাহ করতে বাধ্য ছিল। কিন্তু এসব জায়গিরদাররা সুশিক্ষিত সৈন্য মোতায়েন না করে বেশিরভাগ অনুপযুক্ত সৈন্য রাখত। ফলে তারা সরকারকে ফাঁকি দিত। মীরবকশী তাদের সৈন্যবাহিনী পরীক্ষা করতে চাইলে তারা অনভিজ্ঞ কতকগুলো সৈন্য এনে হাজির করতো। তাই সম্রাট আকবর এ সমস্ত সৈন্যবাহিনীকে সংস্কারের জন্য শাহবাজ খানকে নির্দেশ দেন।
৩. মনসবদারী নীতির গঠন ব্যবস্থা : 'আইন-ই-আকবরী' গ্রন্থে আবুল ফজল ৭৬ টি মনসবের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু বাস্তবে ৩৩ টি মনসবের অস্তিত্ব ছিল। সর্বনিম্ন মনসব ২০ জন সৈনিকের নেতৃত্বের অধিকারী ছিলেন। ৭,০০০ হতে ১০,০০০ সৈন্যের অধিনায়কগণ রাজপরিবারের ছিল। কিন্তু মানসিংহ, টোডরমল, মীর্জা শাহরুখ এবং কুলচি খানের ক্ষেত্রে এ আইনের ব্যতিক্রম ঘটে। মনসবদারগণ রাজকোষ হতে বেতন পেতেন এবং তাদের নিযুক্তি, পদোন্নতি ও পদচ্যুতির ব্যাপারে সম্রাট সর্বেসর্বা ছিলেন।
৪. মনসবদারদের দায়িত্ব ও কর্তব্য : মনসবদারী নীতির দ্বারা প্রত্যেক পদস্থ ব্যক্তি প্রয়োজনানুযায়ী রাষ্ট্রকে সামরিক সাহায্য দান করতেন। সামরিক প্রয়োজনে প্রধানত মনসবদারী প্রথার সৃষ্টি হলেও মনসবদারদেরকে শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারেও সংযুক্ত থাকতে হতো। তাই মনসবদারী প্রথা ছিল সেনাবাহিনী, সামন্তগণ ও প্রজাশাসন একের মধ্যে তিনের সম্মিলিত ব্যবস্থা। প্রত্যেক মনসবদারকে তার পদের গুরুত্ব অনুসারে নির্দিষ্টসংখ্যক হস্তী, গাধা এবং গো-সংকট সংগ্রহ করতে হতো । রাজকীয় শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনে মনসবদারদের এক স্থান হতে অন্য স্থানে বদলি করা হতো ।
ক. ৫. শ্রেণিভেদ ও বৈশিষ্ট্য : সম্রাট আকবরের মনসবদারীদের মধ্যে তিন শ্রেণির মনসবদার দেখা যায়। যথা ঃ
প্রথম শ্রেণির মনসবদার : যে সব মনসবদারের জাত ও সাওয়ারের সংখ্যা সমান ছিল তারা প্রথম শ্রেণির মনসবদার ছিলেন ।
খ. দ্বিতীয় শ্রেণির মনসবদা
র : যে সব মনসবদারের সাওয়ার জাতের অর্ধেক বা অর্ধেকের বেশি ছিল তারা দ্বিতীয় শ্রেণির মনসবদার ছিলেন।
গ. তৃতীয় শ্রেণির মনসবদার : যে সব মনসবদারের সাওয়ার জাতের অর্ধেকেরও কম বা সাওয়ার ছিল না, তারা তৃতীয় শ্রেণির মনসবদার ছিলেন। কোন কোন সময় আবার মনসবদারকে দো-আসপা ও সি-আসপা পদ প্রদান করে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হতো। জাত ও সাওয়ার পদের ব্যাপারে মনসবদারের তিনটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। (১) জাত পদ অবশ্যই সাওয়ার পদের সমান বা সাওয়ার পদ হতে উচ্চতর হতো, (২). জাত পদের ভিত্তিতেই অগ্রাধিকার দেওয়া হতো, সাওয়ার পদের ভিত্তিতে নয়, (৩) সাওয়ার পদ ব্যতীতও জাত পদ হতে পারত কিন্তু জাত পদ ব্যতীত সাওয়ার পদ হতে পারত না।
৬. বেতন ও ভাতা : মুঘল আমলে বিশ অশ্বারোহী সৈন্যের মনসবদারের বার্ষিক বেতন ছিল ৭৫০ টাকা। আর সাত হাজার অশ্বারোহী সৈন্যের মনসবদারের বেতন ছিল তিন লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা। উক্ত বেতন ছিল তাদের ব্যক্তিগত পদের সাথে সংযুক্ত। বেতন ছাড়াও অনেক সময় উপযুক্ত মনসবদারকে বিভিন্ন ধরনের নজরানা, উপাধী ও সম্মানসূচক চিহ্ন প্রদান করা হতো। মনসবদারগণ যে পরিমাণ সৈনিক মীর বকশীর তালিকাভুক্ত করাতে পারতেন সে অনুপাতে তাদেরকে বেতন দেওয়া হতো ।
৭. মনসবদারী প্রথার ইতিবাচক ফল : কেন্দ্রীয় শাসন বিভাগ ও বিশাল সামরিক বিভাগ সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালনের জন্য আকবরের মনসবদারী নীতি বিশেষ ফলদায়ক হয়েছিল। মনসবদারী প্রথার ইতিবাচক ফল ছিল নিম্নরূপ :
ক. এ প্রথার ফলে কেন্দ্রের কোন সামরিক শাসনের ব্যাপকতা ছাড়াই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সৈন্যবাহিনীর ভরণ- পোষণের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি পায় ।
খ. সাম্রাজ্যের কোন অংশে বিদ্রোহ বা গোলযোগ দেখা দিলে কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়াই মনসবদারগণ তা দমন করতে পারতেন। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হতো না ।

গ. মনসবদারদেরকে নিজ নিজ জাতি বা গোত্র হতে নিযুক্তি করা হতো বলে গোত্রীয় আনুগত্য আদায়ের সুবিধা ছিল এবং নিজ নিজ বাহিনীর মধ্যে একতা ও সংহতি রক্ষা সহজ ছিল। घ. নিজ নিজ দক্ষতার উপর পদোন্নতি নির্ভর করতো বলে প্রত্যেক মনসবদার যুদ্ধক্ষেত্রে জয়লাভের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতেন। এতে সামরিক দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ ছিল।
৮. মনসবদারী প্রথার নেতিবাচক ফল : অপরদিকে এ প্রথার নানা প্রকার দোষ-ত্রুটি দেখা যায়। যেমন : দলীয় ভিত্তিতে এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে ঈর্ষা-বিদ্বেষ দেখা যায়। বিভিন্ন জাতির মধ্যে এ বিরোধের ফলে মুঘল সামরিক বাহিনী ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সাম্রাজ্যের পতনের পথ ত্বরান্বিত করে। এ ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর অধিক মাত্রায় বিকেন্দ্রীকরণ হলে কেন্দ্রীয় সরকার শক্তিশালী হতে পারত না। তবে যুদ্ধকালে মনসবদাররা নিজেদের 'মনসব' (পদ) অনুযায়ী নির্দিষ্টসংখ্যক সৈন্য ও অশ্ব জুটাতে পারতেন না। তাছাড়া কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে শক্তিশালী মনসবদার সিংহাসন প্রতিদ্বন্দ্বীর দাবিদারদের পক্ষাবলম্বন করতেন।
উপসংহার ঃ মনসবদারী প্রথার কিছু দোষ-ত্রুটি থাকলেও মনসবদারী নীতি প্রবর্তন করে এক অসীম শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তার সংগঠন শক্তি ছিল অতুলনীয়। তবুও এ প্রথার সমালোচনা করে ড কালিকিংকর দত্ত মন্তব্য করেন, “মুঘল সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ জাতীয় সেনাবাহিনী বলা চলে না। কারণ, বিভিন্ন দেশ ও জাতির সমন্বয়ে এ বাহিনী গড়ে উঠে। মনসবদারী প্রথায় মুঘল শাসনব্যবস্থায় যে সামরিক রূপ ফুটে উঠেছিল এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই । "

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]