সম্রাট আকবরের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর ।

ভূমিকা : সম্রাট আকবরের শাসনামলের সর্বাপেক্ষা বড় কৃতিত্ব ছিল ভূমি রাজস্ব সংস্কার। অর্থ বিভাগের সুবন্দোবস্ত দ্বারা তিনি সাম্রাজ্যের বুনিয়াদকে সুদৃঢ় করেছিলেন। তাঁর আমলে আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব, বাণিজ্য শুল্ক, টাকশাল, উপঢৌকন প্রভৃতি। এ সকলের মধ্যে ভূমি রাজস্ব ছিল রাষ্ট্রের আয়ের প্রধান উৎস।
আকবরের রাজস্বনীতি ঃ সম্রাট আকবরের রাজস্বনীতি সুফল দান করেছিল। এর দ্বারা রাষ্ট্র ও কৃষককুল উভয়ই লাভবান হয়েছিল। রাষ্ট্রের চাহিদার অংশ নির্দিষ্ট হওয়ায় ভূমি রাজস্বের পরিবর্তন ঘটত। যার দরুন রাজস্ব কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর এ রাজস্বনীতির ফলে রাজকোষের অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং এ সকল অর্থ সম্রাট বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যবহার করেন। সম্রাট আকবর শেরশাহ কর্তৃক প্রবর্তিত ভূমি রাজস্বব্যবস্থা অনুসরণ করেন । নিম্নে তাঁর ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা আলোচনা করা হল-
১. ভূমি জরিপ প্রথা : ভূমি রাজস্বের ক্ষেত্রে শেরশাহের কৃতিত্ব ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি এবং তাকে এ ব্যাপারে আকবরের পূর্বসূরি বলা হয়। শেরশাহ শৃঙ্খলার সাথে কৃষিভূমি জরিপ করেছিলেন এবং তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রীতিকে সিংহাসনে আরোহণ করে আকবর যথাযথ রূপ দান করেছিলেন। আকবর শেরশাহের কার্য পুনরায় শুরু করেন এবং মুজাফর খান তারবাতি ও রাজা টোডরমল ছিলেন একজন যোগ্যতম ব্যক্তি। শেরশাহের আমলে রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি প্রভূত অভিজ্ঞতার সঞ্চয় করেন। তিনি সমগ্র আবাদী জমি জরিপ করার ব্যবস্থা করেন। শেরশাহের আমলে জরিপে ছনের দড়ি ব্যবহার করা হতো। অধিক তাপে বা স্যাতসাত আবহাওয়ায় সেই দড়ি সংকুচিত বা সম্প্রসারিত হতো। টোডরমল এর পরিবর্তে বাঁশ দ্বারা জরিপের ব্যবস্থার প্রচলন করেন। এ বাঁশের দু'দিকে লোহার আংটা দ্বারা বাধা হতো।
২. ভূমির শ্রেণি বিভাগ : প্রতি বিঘার উৎপাদনের গড় নির্ণয় করার জন্য জমি চার ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। আর এ ভাগগুলো হল নিম্নরূপ :
ক. পোলাজ ঃ যে জমি সর্বদা আবাদ হতো এবং কখনও পতিত থাকতো না।
খ. চাচর ঃ যে জমি তিন-চার বৎসর ধরে পতিত থাকত।
গ. পারাউতি ঃ যে সকল জমি ভূমির উৎকর্ষ বৃদ্ধি করার জন্য সময়ে সময়ে পতিত রাখতে হতো।
ঘ. বানজারঃ যে সকল জমিকে ৫ বৎসরের অধিক সময়ের জন্য পতিত রাখা হতো। পোলাজ এবং পারাউতি জমির আবার তিনটি পর্যায় ছিল। যথা-উত্তম, মধ্যম এবং নিকৃষ্ট। প্রতি বিঘার উৎপাদিত শস্যের দ্বারা এ তিন পর্যায়ের ভূমির গড় নির্ণয় করা হতো এবং এক তৃতীয়াংশ খাজনা হিসেবে গ্রহণ করা হতো। এ হিসেবেই জমির খাজনার পরিমাণ নির্ধারণ করা হতো। অন্য দু'শ্রেণির জমি সম্পর্কে স্বতন্ত্র ব্যবস্থা ছিল।
৩. কর ধার্য : আবাদী জমির উপর কর ধার্য করা হতো। কর দাতাগণ ইচ্ছানুযায়ী নগদ অর্থ বা দ্রব্যের বিনিময়ে কর প্রদান করতে পারত। অবশ্য সম্রাট নগদ অর্থ গ্রহণই পছন্দ করতেন। শস্যের বিভিন্নতানুযায়ী করেরও পার্থক্য ছিল। বার্লি এবং গমের কর নীল ও ইক্ষুর করের সমান ছিল না। গুজরাটে এ নীতির প্রথম প্রবর্তন করেন রাজী টোডরমল যা পরবর্তীকালে মুঘল সাম্রাজ্যে আদর্শনীতি হিসেবে গৃহীত হয়। বিহার, মালব, মুলতান, গুজরাট এবং রাজপুতনায় এ ব্যবস্থা প্রবর্তিত ছিল।
৪. গাল্লাবকস : গাল্লা অর্থ শস্য, বকস্ অর্থ বিভক্ত বা বণ্টন। তাই এ ব্যবস্থায় শস্যের একটি নির্দিষ্ট মুদ্রায় অথবা শস্যে রাজস্বরূপে গৃহীত হতো। এ ব্যবস্থা সিন্ধুদেশ, কাশ্মীর ও কাবুলে প্রচলিত ছিল।
৫. নসক : নসক ব্যবস্থা অনেকটা জমিদারি প্রথার ন্যায় ছিল। এ ব্যবস্থায় উৎপাদনের মোটামুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে কর ধার্য করা হতো। এ ব্যবস্থা একমাত্র বাংলায় প্রচলিত ছিল।
৬. রাজস্ব আদায় : আকবর রাজধানীতে একজন প্রধান দেওয়ান, প্রত্যেক সুবার একজন করে দেওয়ান এবং প্রত্যেক সরকারের একজন আমিন ও আমিনকে সাহার্য করার জন্য বিতিকিচি, পোদ্দার, কানুনগো, মোকাদ্দাম, পাটোয়ারী প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগ করে রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা করেন। কর্মচারীগণ যাতে অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত খাজনা আদায় করতে না পারে এবং বন্যা বা অন্যান্য দুর্যোগের সময় যাতে কৃষকগণ ঋণ পাইতে পারে, তজ্জন্য আকবরের কঠোর নির্দেশ ছিল। ক. উত্তম ঃ প্রতি বিঘা = ৪০ মণ
៖ খ. মধ্যম : প্রতি বিঘা = ৩০ মণ
গ. অধম : প্রতি বিঘা = ২০ মণ ।
ঘ. মোট : ৯০ মণ এর গড় হবে ৩০ মণ এবং সরকারি প্রাপ্য তিনভাগের এক ভাগ অর্থাৎ ১০ মণ ।
৭. অন্যায় করের বিলোপ : সম্রাট আকবরের আমলে কতকগুলো অন্যায় করের বিলোপ সাধন করা হয়। অনেক ব্যাপারে প্রজাদের কর হতে অব্যাহতি দেওয়া হতো। বিশেষকরে যখন বন্যা বা অন্যান্য দুর্যোগের জন্য জমির ক্ষতি হতো তখন কর মওকুফ করা হতো। রায়তদিগের সাথে সদয় ব্যবহার করার জন্য রাজস্ব কর্মচারীদিগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল এবং অভাবের দিনে রাজস্ব আদায় করতে জোর জুলুম না করার জন্য আদেশ দেওয়া হয়েছিল ।
৮. তৎকালীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এর তাৎপর্য : সম্রাট আকবরের রাজস্বনীতির সুফল সম্পর্কে বহু ঐতিহাসিক উচ্চসিত প্রশংসা করেছেন। রাজ কর সুনির্দিষ্ট হওয়ায় একদিকে যেমন রাজস্ব কর্মচারীদের দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, অন্যদিকে তেমনি কৃষির উন্নতির সাথে সাথে দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য দ্রব্যাদির মূল্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হ্রাস হয়েছিল । সম্রাটের আয়ও অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় এবং সম্রাট বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কার্যে অর্থ ব্যয় করতেন। ফলে কৃষককুল সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠে ।
৯. জিজিয়া ও তীর্থযাত্রীদের কর মওকুফ ঃ এছাড়াও সম্রাট আকবর রাজপুতদের সুবিধার্থে ১৫৬৩ সালে তীর্থযাত্রীদের উপর অর্পিত কর এবং ১৫৬৪ সালে জিজিয়া কর রহিত করেন। জিজিয়া ছিল অমুসলিমদের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা কর এবং বিদেশী বণিকদের উপর আরোপিত কর ছিল তীর্থ যাত্রীদের কর। এ দুটি করের বিলোপ সাধন এক বিরাট অর্থনৈতিক ত্যাগের পরিচায়ক। এর জন্য আকবরের, জনপ্রিয়তা অমুসলিম সমাজে ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায়। পর্যালোচনা ঃ দূরদর্শী ও পরাক্রমশালী মুঘল সম্রাট আকবর যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর সাম্রাজ্য ছিল মূলত কৃষিপ্রধান। তখন লোকসংখ্যার তুলনায় জমি ছিল বেশি এবং ভূমিও ছিল উর্বর। তাই তিনি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তারই প্রচেষ্টায় সুলতানী আমলের উন্নত ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্প এ যুগে আরও সমৃদ্ধি লাভ করে।
উপসংহার : উপরের আলোচনা হতে প্রতিয়মান হয় যে, সম্রাট আকবর রাজস্ব বিভাগের সুবন্দোবস্ত দ্বারা অর্থনীতির বুনিয়াদকে সুদৃঢ় করেছিলেন। রাজস্ব বিভাগে টোডরমল ছিলেন একজন যোগ্যতম ব্যক্তি, তাঁর প্রচেষ্টায় সম্রাটের আয়ও অভাবনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় এবং কৃষককুলও সমৃদ্ধিশালী হয়ে উঠে। পরিশেষে ড. স্মিথ এর বক্তব্যকে সমর্থন করে বলা যায় যে, "In short the system was an admirable one. The principles were sound and the practiacal instructions to the official all that could be desired"

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]