আকবরের ধর্মনীতির পটভূমি বিবৃত কর এবং দ্বীন-ই-ইলাহীর উপর মন্তব্য কর ।

ভূমিকা : মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতার সম্মানে ভূষিত আকবর তাঁর চরিত্রের মাধুর্য, কৃতিত্ব, জনহিতৈষী কার্যকলাপ প্রভৃতির জন্য ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ষোড়শ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী এক ধর্মীয় রেনেসার যুগে তাঁর নতুন ধর্মনীতি প্রবর্তন ভারতের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ভারতের মুসলিম স্থপতিগণের মধ্যে আকবরই একমাত্র শাসক। যিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল ভারতীয়দের আনুগত্য ও সহযোগিতার ভিত্তিতে ধর্ম নিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি উদার ধর্মনীতি প্রবর্তনের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
আকবরের ধর্মনীতি : ধর্মমতের ব্যাপারে আকবরের জীবনকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে ১৫৬৫- ৭৪ খ্রিঃ এ পর্যায়ে তিনি পূর্ব পুরুষদের ন্যায় সুন্নী মুসলমান ছিলেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৫৭৫-৮২ খ্রিঃ-এ পর্যায়ে তিনি ধর্মীয় ব্যাপারে উদারনীতি গ্রহণ করেন এবং তৃতীয় পর্যায়ে ১৫৮২-১৬০৫ খ্রিঃ তিনি নতুন ধর্মমত প্রচার করেন। শেষ জীবনে তিনি মুসলমান ছিলেন কিনা সে ব্যাপারে ঐতিহাসিকগণ নানা মত পোষণ করেছেন। তাঁর ধর্মনীতি প্রবর্তনের বিভিন্ন কারণ রয়েছে। যেমন-
১. পারিবারিক প্রভাব ঃ আকবরের পিতা ও পিতামহ ছিলেন উদার ও সংস্কারপন্থি। এমনকি শিয়াপন্থি মাতা হামিদা রানুও ছিলেন ধর্মসহিষ্ণু। পিতা-মাতার এরূপ প্রভাবের ফলেই আকবর উদার ও সংস্কারবাদী হয়ে উঠেন।
২. শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব : আকবরের দরবারে শিয়া-সুন্নীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত বিদ্বেষ ও দ্বন্দ্ব-কলহ বিরাজ করতো। এর ফলে তিনি ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন এবং বিকল্প ধর্মের ব্যাপারে চিন্তা করতে থাকেন ।
৩. হিন্দু রমণীদের প্রভাব : পারিবারিক জীবনে হিন্দু রাজপুত রমণীদের সঙ্গে বিবাহের ফলে আকবর আরো উদারপন্থি ও ধর্মসহিষ্ণু হয়ে উঠেন। আকবর নামায় রয়েছে আকবর তাঁর হিন্দু স্ত্রীদের স্ব-স্ব ধর্ম পালনের অধিকার দিয়েছিলেন।
৪. ধর্মীয় আলোচনা : ফতেহপুর সিক্রীর ইবাদত খানায় হিন্দু, জৌন, জয়ন্তী, খ্রিস্টান, শিয়া, সুন্নী প্রভৃতি ধর্মশাস্ত্রবিদদের আলোচনা শ্রবণে আকবর বিভিন্ন ধর্মের সার সম্বন্ধে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। যার ফলে তিনি একটি সার্বজনীন ধর্মীয় নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন। ৫. রাজনৈতিক কারণ : রাজনৈতিক কারণেও আকবর সকল ধর্মমতকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সার্বজনীন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “আকবর ভারতে হিন্দু মুসলিমের মিলনে এক নীতি পরিবর্তন করতে চান। যাতে দুই জাতির মিলনে একটি নতুন জাতির উন্মেষ ঘটে।”
৬. সুফি ধর্মমতের সংস্পর্শ : প্রথম জীবনেই আকবর সুফি ধর্মমতের সংস্পর্শে আসেন। এতে তাঁর আধ্যাত্মিক চিন্ত ধারা ও অনুসন্ধিৎসার পথ সুগম হয়। তাছাড়া পরবর্তীতে গৃহশিক্ষক আব্দুল লতিফের অধীনে শিক্ষা লাভের ফলেও তিনি 'সুলহ-ই-কুল' নীতি অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেন। ৭. ষোড়শ শতাব্দীর প্রভাব : ষোড়শ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী যে ধর্মীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলেও আকবরের মধ্যে ধর্মীয় ভাবান্তর ঘটে। জার্মানিতে মার্টিন লুথার কিং এর পোপের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ভারতের কবির, নানক, চৈতন্য প্রমুখ ধর্মচার্চদের ভক্তিবাদ আন্দোলন ও সাম্যের বাণী তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
৮. অনুসন্ধিৎসু মন : সর্বোপরি আকবরের অনুসন্ধিৎসু মন সত্যের দ্বার উদ্ঘাটনে সর্বদা নিয়োজিত ছিল। তাই একটি নতুন ধর্ম বিবর্তনে তিনি আত্মনিয়োগ করলেন। তিনি মনে করতেন, কোন নতুন ধর্মমত প্রবর্তন করলে বিদ্বেষভাবাপন্ন বিভিন্ন সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে একটা ঐক্য আসবে এবং এ সংঘবদ্ধ ধর্মমতের মাধ্যমে সাম্রাজ্য পরিচালনা সুষ্ঠু হবে।
দ্বীন-ই-ইলাহীর প্রবর্তন ঃ ১৫৮২ সালে আকবর সকল ধর্মের সার নিয়ে 'দ্বীন-ই-ইলাহী' নামে তাঁর নতুন ধর্মমত ঘোষণা করেন। আকবরের উদ্দেশ্য ছিল এঁকে একটি জাতীয় ধর্মে পরিণত করে সকল ধর্ম অসহিষ্ণুতা দূরীভূত করা। এতে কোন একটি বিশেষ ধর্মের প্রাধান্য স্বীকৃত হয় নি। | দ্বীন-ই-ইলাহীর মূলনীতিঃ সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত দ্বীন-ই-ইলাহীর মূলনীতিগুলো ছিল নিম্নরূপ ঃ ক. এ ধর্মানুসারীদেরকে সম্রাটের নামে ধন, জীবন মান ও ধর্ম উৎসর্গ করতে হতো। খ. এ ধর্মের কালিমা ছিল 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবর খলিফাতুল্লাহ'। গ. ঘ. চ. ছ. সালামের পরিবর্তে আল্লাহ আকবর এবং উত্তরে জারে জাল্লাহ বলতে হতো।
জন্মদিবস পালন, নিরামিশ ভোজন এবং অগ্নিকে পবিত্র বলে মনে করতে হতো।
এছাড়াও এর অনুসারীগণকে মৃত্যুর পর ভোজ না দিয়ে জীবিতকালেই উক্ত ভোজ দিতে হতো।
উপাসনার সময় খ্রিস্টানদের ন্যায় ঘণ্টাধ্বনি করা।
কসাই, জেলে প্রভৃতি নিম্ন শ্রেণির লোকদের সাথে মেলামেশা না করা ।
জ. জৈন নিয়মে পশুবধ নিষিদ্ধ ও হিন্দুনিয়মে গো-হত্যা নিষিদ্ধ।
ঝ. দীপালী, দশহরা, পূর্ণিমা, রাখী, অষ্টমী ইত্যাদি অনুষ্ঠানগুলো জাকজমক করা ।
ঞ. দরবারে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা।
বাদাউনী এর মতে, দ্বীন-ই-ইলাহী প্রবর্তনের জন্য আকবর অনেকগুলো ইসলাম বিরোধী নীতিও প্রবর্তন করেন। যেমন- ক. নামাজ, রোজা ও হজ্জ পালন নিষিদ্ধ ।
খ. দাড়ি রাখা ও কুরআন হাদিস পাঠ নিষিদ্ধ।
গ. মসজিদকে আস্তাবলে রূপান্তর ।
ঘ. সম্রাটকে সিজদা প্রদান ইত্যাদি ।
দ্বীন-ই-ইলাহীর পরিণতি : দ্বীন-ই-ইলাহী জনগণের মধ্যে তেমন কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে নি। আবুল ফজলের মতে, এর সদস্য ছিল মাত্র ১৮ জন। হিন্দুদের মধ্যে একমাত্র বীরবলই এ ধর্মে দীক্ষিত হন। হিন্দু মুসলিম ঐক্য সাধনই ছিল আকবরের দ্বীন-ই-ইলাহীর মূল উদ্দেশ্য। সে দিক হতে বিচার করলে তাঁর দক্ষতা, দূরদর্শিতাও বিরল। কিন্তু আকবর হিন্দুদের প্রতি উদারতার পরিচয় দিতে গিয়ে ইসলাম বিরোধী মনোভাবের পরিচয় দেন, ফলে ইসলাম সম্বন্ধে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এবং মুসলমানদের মনে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর ফলে এক বিরাট আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। স্মিথ মন্তব্য করেন, “দ্বীন-ই-ইলাহী ছিল আকবরের ভুলের স্তম্ভ, জ্ঞানের নয়। এ ধর্মে বিশ্বাস হাস্যকর, অহংকারের কিংবা অসংযত স্বৈরাচারী পৈশাচিক বিকাশ।” দ্বীন-ই-ইলাহী আকবরের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ছিল বিধায় তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এর সমাপ্তি ঘটে।
সমালোচনা ঃ সম্রাট আকবর কর্তৃক দ্বীন-ই-ইলাহীর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। স্মিথ, উলসে হেগ, মনসেরট, এডওয়ার্ড প্রমুখ ঐতিহাসিক বলেন যে, “আকবর ১৫৮২ সালে ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে দ্বীন-ই-ইলাহী নামক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করেন।” তবে ডুবেরিক ও বটেল হো নামক পর্যটকদ্বয় বলেন, “তর্কবিতর্ক সত্ত্বেও আকবর পূর্বের মতই মুসলমান ছিলেন।” মুসলিম ঐতিহাসিকগণ বলেন, “ নাকবর বিশ্বাসী ছিলেন, কিন্তু ইসলামের অনুসারী ছিলেন না।” বারটুলীর মতে, “এটি ছিল সুফীমত, দর্শন এবং একটি ধর্মীয় মতবাদ।” কারো কারো মতে, এ ব্যবস্থা ভারতবর্ষে জাতীয় ঐক্যবোধের উন্মেষ ঘটিয়েছিল। ঐতিহাসিক শর্মা একে "The Crowing expression of the emperor's national Idealism." বলে অভিহিত করেছেন।
উপসংহার ঃ উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, দ্বীন-ই-ইলাহী প্রচারের মূলে ছিল নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আকবর ধর্মীয় কোন প্রয়োজনের তাগিদে এরূপ নতুন ধর্মমত প্রচার করেন নি। ড. হোসাইনী মন্তব্য করেন, রাজ্যের ভবিষ্যতের দিক দিয়ে আকবরের এ বিভ্রান্তিকর ধর্মনীতি অভ্রান্ত ছিল না। এতদসত্ত্বেও ড. ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, "The success or failure of the Din - I - Ilahi as a cult in not a matter of importanc; Politically it produced wholly beneficial results."

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]