সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা কর । অথবা, আকবরের বেসামরিক ও রাজস্ব শাসনব্যবস্থার বর্ণনা দাও।

ভূমিকা : সম্রাট আকবর ভারতবর্ষের সামগ্রিক ইতিহাসে অন্যতম কৃতি পুরুষ। হিমালয় হতে কৃষ্ণনদী এবং হিন্দুকুশ হতে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি আকবর কেবলমাত্র সমরবিজয়ী নেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন না, এ বিশাল সাম্রাজ্যের শুধু শাসনের জন্য তিনি এক অতি উৎকৃষ্ট শাসন প্রণালী প্রবর্তন করেছিলেন। স্যার যদুনাথ সরকারের ভাষায়, “ভারতীয় ছাঁচে ফার্সি আরবিয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।” ঐতিহাসিক স্মীথ বলেন, "He was endowed with a genius for organization rare among eastern potentates and not common in any part of the world." আকবরের শাসনব্যবস্থার মূলনীতি ছিলোঁ ধর্ম সহিষ্ণুতা, উদারতা এবং প্রচলিত রীতিনীতির পূর্ণ স্বীকৃতি জ্ঞাপন করা। প্রজারঞ্জক শাসক আকবর ভারতে বিদ্যমান বিভিন্ন রাষ্ট্র, বিভিন্ন জাতি এবং বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের সমন্বয়ে ও সংমিশ্রণে এবং তাদের সদিচ্ছা, সহযোগিতা ও সমর্থনের উপর একটি শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন। Historian Adward and Garrate 1, "His reign witnessed the final transformation of the Mughals from more military invaders into a permanent Indian dynasty."
আকবরের শাসনব্যবস্থা : নিম্নে আকবরের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হল : কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা
১. সম্রাটের ক্ষমতা : আকবর ছিলেন বেসামরিক ও সামরিক শাসনব্যবস্থার সর্বময়কর্তা। তিনি সীমাহীন ক্ষমতার অধিকারী হলেও স্বৈরাচারী ছিলেন না। উদার নীতির ভিত্তিতে সুশাসন প্রবর্তন এবং শাসক ও শাসিতের মধ্যে অন্তরের যোগ স্থাপনই ছিল আকবরের শাসন প্রণালীর মূল বৈশিষ্ট্য। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তিনি যোগ্য ব্যক্তিকে উচ্চপদে নিয়োগ করতেন। ঈশ্বরী প্রসাদ আকবরকে প্রজাকল্যাণকারী স্বৈরশাসক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আকবর শাসনব্যবস্থার প্রতিটি দিক যত্নসহকারে পর্যবেক্ষণ করতেন। J.N.Sarker বলেন, "The king was the pivot round which the entire governmental mechinary revolved. " তিনি মন্ত্রীদের শিষ্য না হয়ে, শিক্ষকদের ভূমিকা পালন করতেন।
২. উকিল : শাসনব্যবস্থায় সম্রাটের পরে প্রধানমন্ত্রী বা উকিলের স্থান। বৈরামখান যখন উকিল ছিলেন প্রধান মন্ত্রীত্ব ছাড়াও অন্যান্য বিভাগের উপর তিনি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীদের নিয়োগ কিংবা পদচ্যুতির ক্ষমতা তার হাতেই ন্যস্ত ছিল। পরবর্তীকালে উকিল শুধু সম্রাটের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন।
৩. কেন্দ্রীয় শাসনের অন্যান্য কর্মকর্তা :
ক. দিওয়ান : রাজস্ব বিভাগের প্রধান ছিলেন দিওয়ান। দিওয়ান অর্থনৈতিক বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ, রাজকোষ রক্ষণাবেক্ষণ ও হিসাব পরীক্ষা, রাজস্ব নির্ধারণ ও আদায়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতেন। তিনি সুবাদারের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রাদেশিক শাসন বিভাগের সকল কার্য সম্পন্ন করতেন। তিনি কেন্দ্রীয় শাসনকর্তার নিকটেই কেবল দায়ী থাকতেন। বিচার বিভাগের কর্মচারীগণও তার অধীনে ছিলেন। ៖
খ. মীরবকশী ঃ মীরবকশী ছিলেন সামরিক বিভাগের প্রধান। তিনি সেনাবাহিনীতে লোকভর্তি, শৃঙ্খলা, অশ্ব পরিদর্শন, অভিযান পরিচালনা, অস্ত্র সরবরাহ, সেনাবাহিনীর বেতন প্রদান ইত্যাদি যাবতীয় কাজ সম্পাদন করতেন।
খান-ই-সামান ঃ তিনি ছিলেন সম্রাটের গৃহবিভাগের কর্মচারী। রাজ পরিবারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, খাদ্য সরবরাহ যুদ্ধভিযানে সঙ্গী হওয়া, রাজ্যের বিভিন্ন দপ্তর ও বিভাগের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ, তার দায়িত্বে ছিলো। রাজপ্রাসাদের আয়-ব্যয় হিসাব ও কর্মচারীদের তত্ত্বাবধায়ক তিনিই ছিলেন । কাজী-উল-কুজ্জাত : বিচার বিভাগের সর্বপ্রধান ছিলেন কাজী-উল-কুজ্জাত। সম্রাটের পরেই তার স্থান ছিল। সমগ্র দেশের বিচারকদের নিয়োগ, বদলী, বেতন ভাতাদি তিনি প্রদান করতেন। কাজীদের সহযোগিতায় সমগ্র দেশে সুষ্ঠু বিচার সম্পন্ন করতেন ।
সদর-ই-সুদুর : ধর্ম, দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি দান বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন সদর-ই-সুদুর। প্রথম দিকে তিনি আইন ও আদালত বিভাগের কর্মচারীগণের প্রধান ছিলেন। ১৫৮১ সালে আকবর সদর-ই-সুদুর পদটি বিলুপ্ত করেন। ফৌজদার : জেলার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা ছাড়াও ফৌজদার তার অধীনস্ত সেনাবাহিনীর সাহায্যে বিদ্রোহ দমন করা, কর আদায়ে সহযোগিতা করা প্রভৃতি সম্পন্ন করতেন।
ছ. মুহতাসিব : গণচরিত্র রক্ষা করার দায়িত্বে তিনি নিয়োজিত থাকতেন। তার কাজ ছিল পুলিশ ও কাজীর মধ্যবর্তী অবস্থানের। কারণ, তিনি অপরাধীদেরকে স্পষ্টেই বিচার করতেন। তিনি ওজন পরিদর্শক হিসেবেও বিবেচিত হতেন।
জ. কোতোয়াল : শহর এলাকার শান্তি রক্ষার ভার কোতোয়ালের উপর ন্যাস্ত ছিল। তিনি আধুনিককালের পুলিশ সুপারের কাজ করতেন। শহরের বাড়িঘরের তালিকা রক্ষা করা, হাট বাজারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা, পাহারা দেওয়া, চুরি-ডাকাতি বন্ধ করা, সতিদাহ নিবারণ করা, বেওয়ারিশ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করা ইত্যাদি ছিল তার কর্তব্য।
ঝ. দারোগা-ই-তোপখানা: অস্ত্র শস্ত্র ও গোলন্দাজ বিভাগের প্রধান ছিলেন দারোগা-ই-তোপখানা। এছাড়াও মুস্তাফী, মীর বাহারী, ওয়াক-ই-নবীশ, মীর-আ
রজ, মীর-মঞ্জিল, মীরতোজার প্রভৃতি রাজকর্মচারীরা রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন । ঞ. আমীল ঃ আমীল ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী। কিন্তু এছাড়া তাকে অন্যান্য কাজও করতে হতো। দস্যুবৃত্তি ও অপরাধ দমন করে শান্তি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা, ভূমির গুণাগুণ বিচার, পতিত জমি উদ্ধার, বাজার দর এবং প্রজাদের আর্থিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা প্রভৃতি কার্য আমীলের তত্ত্বাবধানে ছিল।
এভাবে আকবর তার সুবিন্যস্ত শাসনব্যবস্থায় ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করেন।
৪. প্রাদেশিক শাসন : শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সম্রাট আকবর সমগ্র সাম্রাজ্যকে ১৫টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। এ প্রদেশগুলোকে সুবা বলা হতো। আর এর শাসনকর্তাকে বলা হতো সুবাদার। প্রদেশগুলো হল- (ক) বারলা (খ) বিহার (গ) অযোধ্যা (ঘ) এলাহাবাদ (ঙ) আগ্রা (চ) দিল্লী (ছ) আজমীর (জ) সুলতান (ঝ) লাহোর (ঞ) কাবুল (ট) আহমদাবাদ মানব (ড) খান্দেশ (ঢ) বেরার (ণ) আহমদ নগর ।
প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার আদর্শে গড়ে উঠেছিল। তাই বলা হতো মুঘলদের প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার হুবহু প্রতিচ্ছবি। Mughal Administration গ্রন্থে J.N.Sarkar বলেন, "The administrative agency in the provinces of the Mughal Empire was an exact miniature of that of the central government." সুবাদার সম্রাটের প্রতিনিধি হিসেবে প্রাদেশিক, সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। সুবার অন্যান্য কর্মচারীদের মধ্যে সদর, বকসী, কাজী, কোতোয়াল প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য । ৫. রাজস্ব শাসন : মুঘল সম্রাট আকবরের রাজস্বনীতি সমসাময়িক ও পরবর্তী ঐতিহাসিকদের ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। আকবর ১৫৮২ খ্রিঃ রাজা টোডরমলকে দেওয়ানই আসবের পদে নিযুক্ত করেন। রাজা টোডরমলের রাজস্ব সংস্কারের প্রধান নীতিই ছিল জমির উৎপাদিকা শক্তির উপর রাজস্বের পরিমাণ নির্ধারিত করা। তিনি সমগ্র জমি জরিপ করে উর্বরতার ভিত্তিতে সমগ্র চাষের জমিকে চারভাগে বিভক্ত করেন। যথা-
ক. পোলাজ ঃ যে সকল জমি প্রতিবছর চাষ করা হতো ।
খ. পরাউতি ঃ যে সকল জমি কিছুকাল চাষের পর উর্বরতা সঞ্চয়ের জন্য কিছুকাল পতিত রাখা হতো।
গ. চাচর ঃ যে সকল জমি তিন বা চার বছর যাবত পতিত আছে । বঞ্জর : যে সকল জমি পাঁচ বছরের অধিককাল পতিত আছে।
ঘ. পোলাজ ও পরাউতি জমিকে টোডরমল উৎপন্ন ফসলের পরিমাণ ভিত্তিতে পুনরায় উত্তম, মধ্যয় ও অধম এ তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করেছিলেন।
উক্ত শ্রেণিতে জমিতে কর ধার্যের পরিমাণ ছিল :
উত্তম প্রতি বিঘা-৪০ মন
মধ্যম প্রতি বিঘা-৩০ মন
অধম প্রতি বিঘা- ২০ মন ।
মোট ৯০ জন
এর গড় হবে ৩০ মন এবং সরকারি প্রাপ্য তিনভাগের এক অংশ বা ১০ মন। এ নীতির ফলে সরকার যথেষ্ট পরিমাণ রাজস্ব আদায় করত। ১৬০৫ সালে আকবরের মৃত্যুর সময় বার্ষিক খাজনার পরিমাণ ছিল ১৭,৪৫,০০,০০০ টাকা। ড. স্মিথ বলেন, "In short, the system was and admirable one, the principles were sound and the practical instructions to the official all that could be desired."
৬. আইন কানুন ঃ মুঘল সাম্রাজ্যে কোন লিখিত আইন ছিল না। বিচারকগণ শরীয়তের আইন অনুসারে বিচারকার্য সমাধা করতেন ।
৭. সামরিক ব্যবস্থা : সম্রাট আকবর সমগ্র ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। এ বিশাল সাম্রাজ্যের রাজকীয় বাহিনী ৪টি ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা- (ক) পদাতিক, (খ) অশ্বারোহী, (গ) গোলন্দাজ ও (ঘ) নৌবাহিনী। এর মধ্যে অশ্বারোহী বাহিনী ছিল সবচেয়ে শক্তিশালী। তবে আকবরের সেনাবাহিনী ছিল বিভিন্ন শ্রেণি ও জাতির লোক দ্বারা গঠিত। তাই একে জাতীয় বাহিনী বলা যায় না। নৌবাহনী ছিল নামে মাত্র।
৮. মনসবদারী প্রথা : সম্রাট আকবরের শাসনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য দিক ছিল মনসবদারী। আকবর সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য সাহাবাজ খানকে মীর বকশী পদে নিয়োগ করেন। তার সঙ্গে পরামর্শ করে বিখ্যাত মনসবদারী প্রথার প্রবর্তন করেন। তেত্রিশ পর্যায়ে মনসবদার ছিল। সর্বোচ্চ মনসবদার দশ হাজার সৈন্য এবং সর্বনিম্ন মনসবদার দশজন সৈন্য প্রস্তুত রাখার দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন।
৯. বিচার বিভাগ ও বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন স্বয়ং সম্রাট। তিনি ছিলেন আইনের উৎস । তবে সম্রাট নিজেও আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন না। তিনি বলতেন, If it were guilty of an unjust act, I would rise in Judgement against myself. তিনি ন্যায় বিচারের জন্য সচেষ্ট ও সচেতন ছিলেন। কাজী উল কুজ্জাত ছিলেন সর্বপ্রধান বিচারক। কাজী, মুফতী ও মীর আদল ছিলেন বিচার বিভাগের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
১০. গ্রাম্য পঞ্চায়েত ঃ গ্রাম্য পঞ্চায়েত ছিল বিচার ব্যবস্থার সর্বনম ধাপ। গ্রামাঞ্চলের বিচারকার্য সম্পাদনের ভার ছিল গ্রাম্য মোড়লদের নিয়ে গঠিত গ্রাম্য পঞ্চায়েতের উপর।
উপসংহার : প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও রাজস্ব বিভাগের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে বলা যায় যে, আকবর প্রজাদের কল্যাণের জন্য সময়োপযোগী শাসননীতি প্রবর্তন করেন। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনামলে সর্বপ্রথম আকবরের প্রশাসনিক দক্ষতা চরম শিখরে পৌঁছেছে। প্রশাসক হিসেবে আকবর নিঃসন্দেহে ভারতের মুসলিম শাসকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন। এ্যাডওয়ার্ড বলেন, "Modern India owes much more than superficially apparent to the administrative genius of the great Mughal."

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]