সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল সংক্ষেপে পর্যালোচনাপূর্বক তাঁর উপর নূরজাহানের প্রভাব উল্লেখ কর।

ভূমিকা : মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে একজন প্রতিভাবান ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের জনকল্যাণমূলক কাজের দ্বারা তিনি জনসাধারণের প্রিয়ভাজন হয়েছিলেন। 'দাস্তারুল আমল' নামক বারটি মঙ্গলজনক আইন জারি করে রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা স্থাপনে সচেষ্ট হন। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল ছিল রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল। সম্রাজ্ঞী নূরজাহান সম্রাটের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। অন্যদিকে বিদ্রোহ দমন এমনকি নিজ পুত্রের বিদ্রোহ ঘোষণা ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মধ্যেও জাহাঙ্গীর সুশাসন বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। সিংহাসনারোহণ : সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর ১৬০৫ খ্রিঃ তাঁর পুত্র সেলিম 'নূর উদ্দিন মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী' উপাধী ধারণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিংহাসনে আরোহণ করেই তিনি সকলের আস্থা ও সহানুভূতি অর্জনের লক্ষ্যে তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ক্ষমা প্রদর্শন করেন এবং যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তি দান করেন। একই সাথে তিনি রাজ্যের অভিজাত ও আমীর উমরাহদের পদোন্নতি দান করে তাদের সমর্থন লাভ করেন ।
বিদ্রোহ দমন : সম্রাট জাহাঙ্গীরের সিংহাসন নিষ্কণ্টক ছিল না। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছিল । তিনি কঠোর হস্তে এ সকল বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হল :
১. খসরুর বিদ্রোহ : ক্ষমতা লাভের অব্যবহিত পরেই যুবরাজ খসরু বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মথুরার হোসেন বেগ, লাহোরের আব্দুর রহিম এবং শিখ গুরু অর্জুন তাকে সমর্থন করেন। জলন্ধরের নিকট জাহাঙ্গীর তাকে পরাজিত করে বন্দী করেন এবং তার সমর্থকদের কঠোর শাস্তি প্রদান করেন । অর্জুন সিংকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয় ।
২. কান্দাহার পুনরুদ্ধারে ব্যর্থ : সম্রাট আকবর কর্তৃক বিজিত কান্দাহার পুনরুদ্ধারের জন্য পারস্যের শাহ আব্বাস আকবরের রাজত্বকালে বহু চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অতঃপর তিনি কৌশলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে বন্ধুত্বের ছলনা করে ১৬৫২ খ্রিঃ আকস্মিকভাবে কান্দাহার দখল করেন। জাহাঙ্গীর বহু চেষ্টা করেও কান্দাহার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হননি ।
৩. কাংড়া বিজয় : কাংড়া বিজয় জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালের একটি স্মরণীয় ঘটনা। যুবরাজ খুররমের নেতৃত্বে পরিচালিত সৈন্যবাহিনী এ পার্বত্য দুর্গটি দখল করেন।
৪. বঙ্গে আধিপত্য স্থাপন : ১৫৭৫ খ্রিঃ আকবর কর্তৃক বাংলা মুঘল শাসনভুক্ত হয়। কিন্তু আকবর আফগানদের ক্ষমতা সম্পূর্ণ বিইস্ট করতে সমর্থ হননি। জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ঈশা খানের পুত্র উসমান খানের নেতৃত্বে বঙ্গের আফগানরা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সম্রাট জাহাঙ্গীর এ বিদ্রোহ দমন করেন ।
৫. মেবার বিজয় ঃ স্বাধীনতাকামী মেবারের রানা অমর সিংহকে দমন করার জন্য জাহাঙ্গীর উপর্যপরি কয়েকটি ব্যর্থ অভিযান করেছিলেন। অবশেষে ১৬১৫ খ্রিঃ জাহাঙ্গীর শাহজাদা খুররমকে একটি বিরাট সৈন্যবাহিনীসহ প্রেরণ করেন। অমরসিংহ এবার মুঘল আধিপত্য স্বীকার করতে বাধ্য হলেন।
৬. দাক্ষিণাত্য বিজয় ঃ জাহাঙ্গীর সিংহাসন লাভ করে দাক্ষিণাত্যে স্বীয় আধিপত্য বিস্তারে মনোযোগী হন। ১৬৬০ খ্রিঃ মালিক অম্বর মুঘলদেরকে পরাজিত করে আহম্মদ নগর পুনরুদ্ধার করেন। ১৬১৭ খ্রিঃ জাহাঙ্গীর যুবরাজ খুররমকে আহম্মদনগর পুনরুদ্ধারের জন্য প্রেরণ করেন। খুররম আহম্মদ নগর পুনর্দখল করতে সমর্থ হন। মালিক অম্বরের বিরুদ্ধে এ সাফল্যের জন্য খুররম 'শাহজাহান' উপাধী লাভ করলেন।
৭. শাহজাহানের বিদ্রোহ : জাহাঙ্গীর অসুস্থ হয়ে পড়লে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান স্বীয় জামাতা এবং জাহাঙ্গীরের কনিষ্ঠ পুত্র শাহরিয়ারকে সিংহাসনে বসানোর জন্য চক্রান্ত করতে লাগলেন। শাহজাহান নূরজাহানের ষড়যন্ত্রের কথা অবগত হয়ে ১৬২৩ খ্রিঃ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। কিন্তু ১৬২৩ খ্রিঃ হতে ১৬২৫ খ্রিঃ এর মধ্যে তিনি রাজকীয় বাহিনীর নিকট তিনবার পরাজয় বরণ করে যাযাবরের ন্যায় নানাস্থানে ঘুরে বেড়ান। অবশেষে ১৬২৫ খ্রিঃ তিনি পিতার নিকট আত্মসমর্পণ করে স্বীয় কার্যকলাপের জন্য ক্ষমাপ্রার্থী হলে জাহাঙ্গীর তাকে ক্ষমা প্রদর্শন করেন । ·
৮. মহব্বত খানের বিদ্রোহ ও পলায়ন : জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সেনাপতি মহব্বত খা ক্রমশ প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠেন। শাহজাদা খুররমের বিদ্রোহ দমনে তিনি যথেষ্ট দক্ষতা ও সামরিক নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছিলেন। মহব্বত খাঁ ভবিষ্যতে সাম্রাজ্যের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে মনে করে নূরজাহান তাকে রাজধানী হতে দূরবর্তী অঞ্চল বাংলাদেশ গমনের নির্দেশ দিলে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করে জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানকে বন্দী করেন। কিন্তু বন্দিনী নূরজাহান কৌশলে স্বামী এবং নিজেকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন। মহব্বত খাঁ অবস্থা বেগতিক দেখে প্রাণভয়ে দাক্ষিণাত্যে পলায়ন করেন ।
বেগম নূরজাহানের সরাসরি প্রভাবাধীনে সম্রাট জাহাঙ্গীর রাজ্যশাসন করেন এবং মুঘল সাম্রাজ্যে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এ ভাবেই জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল অতিবাহিত হয় । সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রভাব ঃ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল এবং তাঁর চরিত্র ও কৃতিত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁর উপর সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রভাব আলোচনা না করলে আলোচনাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। অসামান্য রূপলাবণ্যের অধিকারিণী, বিদূষী, বুদ্ধিমতী নূরজাহান মুঘল হেরেমের সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী মহিলা ছিলেন। তিনি নানাগুণে গুণাম্বিত ছিলেন বলে রাজ পরিবারের সর্বত্রই তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল। তিনি তাঁর প্রভাব ও ক্ষমতা রাজদরবারেও বিস্তার করেন। জাহাঙ্গীরের উপর প্রভাব বিস্তার করে তিনি তাঁর আরীয়স্বজন ও দলীয় লোকদের রাজ্যের উচ্চপদে নিযুক্ত করেন। তাঁর পিতা ইতমাদ- উদ-দৌলা এবং ভ্রাতা আসফ খান জাহাঙ্গীরের উজির নিযুক্ত হন। তিনি তাঁর পূর্ব স্বামীর ঔরসজাত কন্যা লাডলী বেগমকে সম্রাটের প্রথমা স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র শাহরিয়ারের সাথে বিবাহ দিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করেন। অবশ্য শাহরিয়ারকে সিংহাসনদানে তাঁর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। জাহাঙ্গীর নূরজাহানকে অপরিসীম রাজকীয় ক্ষমতা দান করেন। ফলে নূরজাহান অনেক সময় নিজেই রাজকীয় আদেশনামা জারি করতেন। কখনও কখনও সরকারি নির্দেশ নামায় সম্রাটের নামের সাথে তাঁর নিজ নামও যুক্ত থাকত। মুদ্রায়ও তাঁর নাম সম্রাটের নামের সাথে অংকিত হতো। তাঁর ক্ষমতা এতটা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছিল যে, জাহাঙ্গীর একজন নামেমাত্র সম্রাটে পরিণত হন। সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের সম্রাটের উপর এরূপ প্রভাব লক্ষ করে ঐতিহাসিক সুতামাদ খান বলেন, “অবশেষে তাঁর (নূরজাহান) ক্ষমতা এরূপ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, রাজা শুধু নামেমাত্রই রাজা রইলেন।” মূলত নূরজাহানের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার কাছে সম্রাট ছিলেন নিষ্ক্রিয়। শক্তিশালী আমীর ওমরাহগণও নূরজাহানের সামনে শির অবনত রাখতে বাধ্য ছিলেন ।
উপসংহার ঃ সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন সুশাসক। তিনি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। যদিও তিনি অধিকাংশ সময়ই সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের প্রভাবাধীন ছিলেন কিন্তু শাহজাদা শাহজাহানের বিদ্রোহ এবং ক্ষমা প্রদর্শন অতঃপর তাকে মুঘল সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরাধিকার নির্বাচন ইত্যাদির ক্ষেত্রে নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিলেন। জাহাঙ্গীর ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য ষাটটি ঘণ্টাযুক্ত একটি সোনার শিকল আগ্রার দুর্গ হতে যমুনা নদীর তীর পর্যন্ত ঝুলিয়েছিলেন। যে কোন ব্যক্তি বিচারের প্রত্যাশায় শিকলে টান দিয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারত। ঐতিহাসিক ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন, “জাহাঙ্গীর ছিলেন মুঘল ইতিহাসে একটি অন্যতম আকর্ষণীয় চরিত্র।”

FOR MORE CLICK HERE
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস মাদার্স পাবলিকেশন্স
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস ১ম পর্ব
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস
আমেরিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস
বাংলাদেশের ইতিহাস মধ্যযুগ
ভারতে মুসলমানদের ইতিহাস
মুঘল রাজবংশের ইতিহাস
সমাজবিজ্ঞান পরিচিতি
ভূগোল ও পরিবেশ পরিচিতি
অনার্স রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষ
পৌরনীতি ও সুশাসন
অর্থনীতি
অনার্স ইসলামিক স্টাডিজ প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত
অনার্স দর্শন পরিচিতি প্রথম বর্ষ থেকে চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত

Copyright © Quality Can Do Soft.
Designed and developed by Sohel Rana, Assistant Professor, Kumudini Government College, Tangail. Email: [email protected]